মানুষ বিশ্বাস করতে ভালোবাসে, শুভ এবং অশুভের চিরন্তন লড়াই একদিন সমাপ্ত হবে। একদিন শুভ চুড়ান্ত বিচারে জয়ী হবে এবং অশুভের পতন ঘটবে। সে দিন পৃথিবীতে যুদ্ধ থাকবে না, হানাহানি থাকবে না, পৃথিবী হয়ে উঠবে শান্তিময় এবং শান্তির সপক্ষের মানুষেরা একত্রে বসবাস করবে পৃথিবী জুড়ে।
কিন্তু অশুভ এবং শুভের ক্রমাগত দ্বন্দ্ব সেই চুড়ান্ত যুদ্ধের আগ পর্যন্ত চলতেই থাকবে এবং একটা সময়ে অশুভ শুভকে দমিয়ে রাখবে। ঠিক তখনই একজন ত্রাতার আবির্ভাব ঘটবে। যিনি মানুষকে সত্য এবং সুন্দরের পথ দেখাবেন।
যখনই ধর্মের উপরে অধর্ম জয়ী হবে তখনই আমি পৃথিবীতে ফিরে আসবো। যখন পৃথিবীতে যুদ্ধের সুবাতাস, মানুষের ভেতরে হিংসার শ্বাপদ ক্রমগত গজরাবে আমি ফিরে আসবো।
প্রায় প্রতিটা ইশ্বরবাদী ধর্মগ্রন্থে এই সমাপ্তির বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। নতুন নবীর আগমনের কারণও হবে এটাই। ইহুদিরা বিশ্বাস করছে গত ২০০০ বছর ধরেই একদিন তাদের ত্রাতা আসবে, নতুন নবীর আবির্বাভ হবে। মুসলিমদের দাবি আদতে সেই নবী চলে এসেছে, সেই মুহাম্মদ। যিশু অন্তর্বতীকালীন নবী, তার পরেও আরও ত্রাতার আগমন ঘটবে।
শেষ সময়ের পৃথিবীর বর্ণনার অনেকটুকুই মানুষ নিজের সময়ের সাথে মিলিয়ে ফেলে। ঠিক ১৫০০ বছর আগে যখন মানুষ মানুষকে পণ্য বানিয়ে বিক্রী করতো, তখনও মানুষের গায়ে চিহ্ন অঙ্কিত থাকতো। যার কপালের রেখা দেখে চেনা যেতো এই মানুষটা পালিয়ে যাওয়া দাস আর এই মানুষটা স্বাধীন। দাসত্বের চিহ্ন মুছে রক্তাক্ত হয়েছে অনেক কালো মানুষের শরীর।
দাসত্ব নতুন মোড়কে সামনে আসছে, আমাদের অর্থনৈতিক হীনতাকে পূঁজি করে অনেকেই উদয়াস্ত খাটিয়ে নিচ্ছে আমাদের। আমরা পৃথিবীর আলোর পরিবর্তন দেখছি না, সূর্যালোক আমাদের শরীরে একদিন তীব্র এলার্জি তৈরি করবে, অনেক দিন সূর্যের নীচে দাঁড়ানো হয় না। অনেক মানুষই এখন সকালের ঘুম চোখ থেকে মুছে ফেলে কিউবিকলের চার দেয়ালে- তারা চন্দ্রগ্রস্ত নয় এরপরও তাদের সূর্যালোক সহ্য হয় না, শরীর জ্বলে যায় অনন্ত রৌদ্রে।
আমরা নতুন ধরনের অর্থনৈতিক দাসত্ব শৃঙ্খলে স্বেচ্ছায় বন্দী হতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, নতুন নতুন ডিগ্রীর বোঝায় ভারি করি আমাদের কারিক্যুলাম ভাইটা। প্রতি দিন সকাল বেলা এক ঝাঁক সুসজ্জিত মানুষ পরবর্তী অনুগত দাস হয়ে উঠবার তালিম নিচ্ছে নগরের যত্রতত্র গড়ে উঠা ডিগ্রী বেচা প্রতিষ্ঠানের চার দেয়ালের ভেতরে বন্দী থেকে।
বাংলাদেশে একটা সময়ে হস্তরেখাবিদদের সুসময় ছিলো। তখন দৈনিক খুললেই স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হস্তরেখাবিদদের বিজ্ঞাপন চোখে পড়তো। অনেক দিন হলো তাদের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে না। তবে পাথরের ব্যবসা থেমে নেই, পাথর ধারণ করলেই অশুভের প্রকোপ করে,বৃ্হঃস্পতির নৌকায় লাগে হাওয়া, শনির অশুভ দৃষ্টিকে প্রতিহত করে হাতের আঙটি। অষ্ট ধাতুর আংটির বিক্রী কমছে না, ঢাকা শহরের চিরচারিত দৃশ্য ছিলো একদা, রাস্তায় অনেকগুলো খাম বিছিয়ে বসে আছে তোতাপাখি নিয়ে, সেও ভবিষ্যতবেত্তা। মানুষের ভবিষ্যত বলে দিতে পারে যারা তারা রাস্তায় খাম বিছিয়ে বসে থাকে ঝোলা নিয়ে, তোতা পাখি ঠোঁট দিয়ে খুঁটে আনে ভবিষ্যত বারতা, মানুষের চোখ আশায় জ্বলজ্বল করে।
এইসব দৃশ্য এখন শহর থেকে মুছে গেছে, বছরান্তে পত্রিকাগুলো বিশেষ রাশিফল সংখ্যা বের করলেও মানুষ এখন হাসি মুখে বলতে ভালোবাসে আমি রাশি কিংবা হাত দেখায় বিশ্বাস করি না , কিন্তু অনেক অবিশ্বাসীই দৈনিক রাশিফল দেখেই রাস্তায় নামে সকালে।
আপনার রাশি কোনটা, আমি কিন্তু বৃষ, বুঝেনই তো রাশির দোষ। একটু গোঁয়ার-
আমি সিংহ, আমি মীন, মীনের মতোই নির্বিবাদী, জেলো আমার চরিত্র।
শুধু জন্ম দিন দেখেই রাশি সম্পর্কে নিশ্চিত হবেন না, আপনার কথিত জন্মদিন এবং আপনার প্রকৃত রাশি একই নাও হতে পারে। শুধু আমিই হাত দেখে বলে দিতে পারি, এজন্য আপনার জন্মতারিখ জানবার প্রয়োজন নেই।
এইসব হিংটিংছট বিশ্বাস না করলেও অনেকেই করে।
এক্সরসিজমের সাফল্য বোধ হয় এখানেই। যাদের এইসব অশুভ আত্মা ভর করে, যারা দুষিত নজরের শাপে অসুস্থ কিংবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে তারাও ভেতরে ভেতরে ইশ্বর বিশ্বাসী, তাই তাদের সামনে ধর্মীয় বানী উচ্চারণ করে ইশ্বরের দোহাই দিলে তার মন থেকে অসুস্থতা চলে যায়।
বিষয়টা অদ্ভুত হলেও সত্য।
যদি মানুষ বিশ্বাস না করতো তাবে ক্রুশ কিংবা কোরানের আয়াত এসবের কোনোটাই কোনো কাজ করতো না। মানসিক অসুস্থতার কারণ হয়তো সামাজিক অনাচার কিংবা ব্যক্তিগত অপ্রাপ্তি, তবে ঝাড়ুর বাড়ি কিংবা ঠান্ডা পানি কিংবা মরিচ পোড়া এইসবে কোনো ভাবেই ভুত তাড়ানো সম্ভব হতো না, যদি না মানুষ এই ক্ষেত্রে যে অসুস্থ সেই এই প্রক্রিয়াটিকে বিশ্বাস না করতো।
মানুষ বিশ্বাস করে দজ্জালের জন্ম হয়েছে, মানুষ বিশ্বাস করে এন্টিখ্রাইস্টের জন্ম হয়েছে, মানুষ বিশ্বাস করে চুড়ান্ত লড়াইয়ের সময় উপস্থিত, এখন আমাদের নিজেদের বিশ্বাসের আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে। আগামি ৫০ বছরের ভেতরেই আদতে চুড়ান্ত যুদ্ধ হয়ে পৃথিবীতা চির শান্তির উপত্যকা হয়ে যাবে কোনো এক অলীক উপায়ে। সুতরাং ধর্মযুদ্ধ আসন্ন এবং অবশ্যসম্ভাবী।
খ্রীষ্ট ধর্ম রোমানদের রাষ্ট্র ধর্ম হয়ে উঠবার আগেই অনেক খ্রীষ্টান নিহত হয়েছে রোমান সৈনিকের হাতে। সে সময়ে খ্রীষ্টানদের সংহার করেছিলো নীরো। যার নামের অদ্যাক্ষরগুলো গুনে যোগ করলে হয় ৬৬৬, অশুভ সংকেত। তবে সেই অভিশপ্ত মানুষের জীবনাবসানের পরেও দুই সহস্রাব্দ গেলেও মানুষ এখনও এই চিহ্নের মোহে বন্দী।
ইমাম মাহাদীর চিহ্ন থাকবে, যিশু জন্মাবে, দজ্জালের পরিচয় কি হবে, শেষ সময় কি উপস্থিত, এইসব পুস্তিকা আর প্রবন্ধের বর্ননার সাথে বিশ্বাসী ইমামদের বক্তব্য মিশিয়ে পাঠ করলে ভয়াবহ একটা সমাপ্তির আশংকা করতেই হয়।
অবশেষে তারা আবিস্কার করেছে, শেষ সময়ে সবারই একটা পরিচয় নির্নায়ক সংখ্যা থাকবে। ইদানিং বাংলাদেশেও ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরি হয়েছে, সেখানে নির্দিষ্ট একটা নম্বরে চিহ্নিত করা হয়েছে ব্যক্তিকে। একই সাথে প্রতিটা উপার্জনক্ষম ব্যক্তিও চিহ্নিত হওয়ার অপেক্ষায়। প্রত্যেকের পিন থাকবে, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রকতৃক প্রদত্ত সংখ্যামান নাগরিকের রাষ্ট্রীয় পরিচয় পত্রে লিপিবদ্ধ থাকে, তদারকি কিংবা সার্ভিলেনসের সুবিধার জন্যই এইসব করা।
বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এই সত্যকেই উপস্থাপিত করে যখন চার্চের যুদ্ধবাজ ফাদার আহ্বান জানায় অবশ্যই ইরাকে যুদ্ধ করা উচিত এবং এই লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের খ্রীষ্টানদের ইহুদিদের সমর্থন করা উচিত তখন এর পেছনেও অন্য একটা ইতিহাস থাকে, ক্রুসেডের ইতিহাস, যেখানে মুহাম্মদকে এন্টিখ্রাইস্ট এবং সভ্যতার খলনায়ক চিহ্নিত করা হয়েছিলো আজ থেকে প্রায় ৬০০ বছর আগে। এইসব ধর্মযোদ্ধাদের কাছে এটাই তাদের জীবনের চুড়ান্ত লড়াই। এই লড়াইয়ে জিতে ফিরতে পারলে তারা যুশীর উম্মত হয়ে শান্তির পৃথিবীতে বসবাস করতে পারবে।
তবে ক্রুসেড শেষ হয়েছে, এরপরে আরও অনেক যুদ্ধ হয়েছে, ধার্মিক মানুষদের ভেতরেও লড়াই হয়েছে, রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের লড়াই হয়েছে। আমরা যাদের খল এবং সভ্যতার শত্রু চিহ্নিত করি তাদেরই আমরা এন্টিখ্রাইস্ট অভিধা দিয়ে দিচ্ছি।
ইতিহাসের এইসময়ে পুনরায় মুসলিমরাই এন্টিখ্রাইস্ট এবং এবার তাদের নেতা বিন লাদেন। ইতিহাসের পুনারাবৃত্তি ঘটে পৃথিবীতে।
মানুষ বিশ্বাস করতে ভালোবাসে তাই বিশ্বাস করে। যদিও কিছুই যায় আসে না কারোই এরপরও মানুষ ঘরের দরজায় তাবিজ, কবচ আর রক্ষাবন্ধনী ঝুলিয়ে রাখে,
অশুভ দুরে সরে যাক, শুভের শুভাগমন ঘটুক পৃথিবীতে। দজ্জালের অনুসারীরা তফাতে যাও, ইমাম মাহাদীর ঘোড়া আসছে কেশর উড়িয়ে, সাথে যিশূ, তার সেনাপতি। এবার সত্যের সাথে অসত্যের চুড়ান্ত লড়াই হবে।
রথাশ্বের লাগাম পড়াচ্ছে কৃষ্ণ।