সমস্যাঃ পর্ব-১
আমার খুব পরিচিত একজন মাঝে মাঝে বলে, মানি ইজ এনাদার গড। সেদিন ফেসবুকেও দেখলাম একজন স্ট্যাটাস দিয়েছে, তার মামা তাকে বলেছে, মানি ইজ অলওয়েজ গড। আসলেই কি কথাটি ঠিক! আসুন কিছু ঘটনা জেনে নেই -
১। রূপার নতুন বিয়ে হয়েছে। তার স্বামী সম্পূর্ণরূপে স্বকার না বলে তাকে শ্বশুড় বাড়ির সবার কাছে মাথা নীচু করে চলতে হয়। এমনকি তার শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীও মাথা নীচু করেই চলেন। তারা আসলে কার কাছে মাথা নীচু করে চলেন? হয়েছে কি, এই পরিবারের সব থেকে বড় মেয়ে এবং তার স্বামী অঢেল টাকা পয়সার মালিক কোটিপতি। আর এই কারনে এই দুইজন এই পরিবারের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহনকারী, হোক সে সিদ্ধান্ত কারো জন্য সঠিক বা ভুল সর্বশ্য। তারা সকল বিষয়ে এই পরিবারের সকল সদস্যের ভাগ্য বিধাতা। এই ভাগ্য কার জন্য সুপ্রসন্ন আর কার জন্য দুর্ভাগ্য সেটাতো তাদের মুডের উপরই নির্ভর করে। আর নববধু রূপার চোখের কাজল শুধুই গলে গলে পরে আর আহাজারী করে।
২। এসএস গ্রুপ লিমিটেড এর মালিক অর্ণব চৌধুরী। প্রায় ১০হাজার কর্মী কাজ করছে তার প্রতিষ্ঠানে। সকাল বেলা তার মুড খারাপ হলে সবার খবর আছে কয়েক’শ লোকের ৩-৭ দিনের বেতন কর্তন করা হয়ে থাকে। আর মুড ভাল হলে প্রতিষ্ঠানে ঈদের আনন্দের মতো আনন্দ বইতে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মী রাতুল যার মায়ের অসুখ বলে ৫০হাজার টাকা ধার করে প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকা করে শোধ দিবে এই শর্তে। মালিকের খারাপ মুডের কারনে ১৫দিনের বেতন কর্তন হলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। আর তোফাজ্জেল নামক এক বয়োষ্ক কর্মী চাকুরী হারানোর শোকে জ্ঞানহীণ হয়ে লুটিয়ে হাসপাতালের বেডে নিজেকে আবিষ্কার করে। অবিবাহিত মালিহা একজন নারী কর্মী যার বড় একটি পরিবার একার আয়ে চালাতে হয়, যেকিনা প্রমোশনের জন্য মালিকের কাছে অনুরোধ জানালে মালিক তার কাছে মনোরঞ্জনের জন্য কিছু সময় চাইলে সে তা দিতে বাধ্য হলো। তার হতভাগ্য বাবা মায়ের করুণ মুখ আর স্কুলগামী ভাইবোনের পড়ালেখার খরচ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় তার সামনে ছবির মতোন ভেসে উঠলো। নিজের সততার বিনিময়ে সে পেল বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা বড় অঙ্কের টাকা। এই মালিক অর্ণব চৌধুরী তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য ভাগ্য বিধাতা বৈ আর কি!
৩। ইঞ্জিনিয়ার সবুজ আহমেদ দেশে বিদেশে যার কর্মজীবন প্রসারিত। অঢেল টাকা পয়সার মালিক। কত শ্রমিক তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। বাংলাদেশের সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে সে, বাবা- মা, বউ, ছেলে, মেয়ে নিয়ে সুখী পরিবার থাকা সত্ত্বেও ফেসবুক, টুইটার, ইমো, ভাইবার, স্কাইপি ব্যবহার করে নানা বয়সী মেয়েদেরকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ভার্চুয়ালী বড় বউ সম্পর্ক স্থাপনে যার জুড়ি মেলা ভার। টাকার গরমে অতি শীতেও তার সিক্ততা লক্ষ্যনীয় বিষয়। যা কিনা তার কাছে সময় কাটানোর মতো বিনোদন, তা এক সাধারণ মেয়ে আঁচলের জীবনে ডেকে আনলো অভিশাপ। সত্যি মনে করে মেয়েটা তাকে সবটা দিয়ে আগলে রাখতে চাইলেও যখন বুঝতে পারল সে মিথ্যে বলে তাকে ব্যবহার করছে। অতি আবেগী মেয়ে তার অপমান গ্লানি ভুলতে না পেরে অতি অল্প বয়সেই নিজের প্রাণ আত্মাহুতি দিয়ে পৃথিবীকে বিদায় জানালো। সবুজ আহমেদের তাতে কোনও বিকার দেখা গেলনা। তার টাকা তাকে আরও সুন্দরী কাউকে উপভোগের ভার্চুয়ালী বা প্র্যাকটিকালী ব্যবস্থা করেই দিবে। এই ক্ষেত্রেও সে টাকার রাজ্যে নিজেকে বিধাতা এবং অন্যের ভাগ্য নির্মাতা হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে।
৪। আশার আলো স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা নিকিতা বন্দোপাধ্যায় তাঁর ধ্বংশ প্রায় স্কুলটিকে বাঁচিয়ে রাখতে তার অধিনস্ত একজন শিক্ষিকার কাছ থেকে টাকা ধার করে সঠিক সময়ে দিতে না পারায় অধিন্স্ত শিক্ষিকার কাছে জিম্মি হয়ে পরে। এই শিক্ষিকা তাঁর অপারগতাকে দূর্বলতা মনে করে, তাকে নানান রকম প্রেসারে রাখার চেষ্টা করে। হুমকি আর আতঙ্কিত করে মানসিক চাপ তৈরি করে রাখে। প্রধান শিক্ষিকার সততা বা বিশ্বস্ততার অভাব না থাকলেও টাকার অভাব তাকে অধিনস্ত শিক্ষিকার কাছে বারবার অপমানিত করল। সে প্রতিক্ষণ শুধু এটাই কামনা করত যে, তার প্রাণের বিনিময়ে হলেও এই ঋণ শোধ হয়ে যাক। লুকিয়ে চোখের পানি ফেলা তার জন্য ছিল নিত্য সঙ্গী। অর্থনৈতিক অক্ষমতা তাকে অতি আপনজনের প্রকৃত আকৃতি সামনে আনা সহ নানা রকম মনোদৈহিক কষ্টে জর্জরিত করছিল। বারবার তার নিজের মৃত্যু তাকে ডাকছিল। তার মনে আসছিল আজকে সে বেঁচে আছে বলে তার পরিবার তার এই বিপদকে গুরুত্বের সাথে নিচ্ছেনা, মরে গেলে এটা শোধ করতে তারা খুব অল্প সময়ই নিবে। সে তাই মৃত্যুর হাতছানিকে না ফেরানোর চেষ্টা করছিল। টাকার প্রয়োজনীয়তাই এখানে তার ভাগ্য নির্ধারন করতে উদ্যত হচ্ছিল।
২৫/১২/২০১৫ইং
সময়: ১:৫২ মি.
সমাধানঃ পর্ব-২
১। রূপা যখন লেখাপড়া শেষ করে চাকুরী করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে এবং তার স্বামী পরিপূর্ণরূপে স্বকার হয়েছে, তাদের মধ্যে স্বনির্ভরতা ও বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। এখন আর তারা কোনও টাকার গরমে সৃষ্টি করা ভাগ্য বিধাতাকে মানে না। প্রকাশ্যে মাথা উঁচু করে চলে। আড়ালে চোখ মুখে আর কষ্ট পায়না। এটাই হওয়ার ছিল। মানুষ সাময়িক কারনে বড় হতে পারে অর্থ এর দিক থেকে বড়ত্বটা খুবই ক্ষণস্থায়ী। কেননা মূলত মানুষ বড় হয় তার সৎকর্মের কারনে, অর্থের কারনে নয়। মানুষ টাকা দিয়ে সময়িকভাবে মানুষকে তার মত করে চালাতে পারলেও সে কখনও তার বিধাতা হতে পারেনা। বরং যত বড় ধনী ব্যক্তি হোক না কেন, যদি মৃত্যু তার সামনে আসে সে টাকা দিয়ে মৃত্যুকে কিনতে পারেনা। অর্থের বিনিময়ে কেউ তার জন্য নির্ধারিত সময়ের থেকে এক সেকেন্ড বেশি সময় এই পৃথিবীতে থাকতে পেরেছে এমন নজির নেই। যে মানুষ টাকা দিয়ে তার নিজের জন্যই কিছু করতে পারেনা, সে কেমন করে অন্যের ভাগ্য বিধাতা হয়ে বসে এটা বুদ্ধিমান বিবেক ঠিক বুঝতে পারে। মানুষের বিধাতা একজনই আল্লাহ সুবহানা তা’য়ালা।
২। এই অহংকারী অর্ণব চৌধুরী নিজের অহং বোধ এবং খামখেয়ালী করে যত মানুষের ক্ষতি করেছে সেটা তার নিজের ভাগ্যের জন্য পুঁজিই তৈরি হয়েছে। এই পৃথিবীর সব থেকে বড় সত্য হলো মানুষের মাঝে আল্লাহ সুবহানা তায়ালা রহমতসহ বিরাজমান থাকেন। যে প্রতিদিন তাঁকে সত্যিকার ভাবে স্মরণ করেন তিনি তাঁর জন্য যথেষ্ট থাকেন। মানুষের সাথে যেহেতু তিনি আল্লাহ আছেন। এই পৃথিবীতে অর্ণব চৌধুরীর মতো কিছু গুটি কয়েক মানুষ যারা নিজেকে ভাগ্য বিধাতা মনে করেন তারা শুধু মানুষের সাথেই নয় আল্লাহ তায়ালার সাথে অন্যায় করেন। আল্লাহর ক্রোধের শিকার হন। অনেকে বলেন আল্লাহ এত ধীরে বিচার করেন কেন? আল্লাহ তার বান্দাকে নানা ভাবে সুযোগ দেন ক্ষমা চাওয়ার এবং অনুতপ্ত হয়ে নিজের ভুল সংশোধন করার। যখন অহংকারী অর্ণব চৌধুরী অন্য নারীকে ভোগের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছে, ঠিক একই সময়ে তার নিজের একান্ত আপন কেউ ঠিক এমনই পরিস্থিতির শিকার হয়েছে, যা সে বুঝতেও পারেনি এবং কোনও সাহায্যও তাকে করার ক্ষমতা সে রাখেনি। যখন সে অন্য নারীর সম্ভ্রম কাড়তে পরিকল্পনা করছিল, সেই সাথেই সে নিজের জন্য কোনও ভয়ঙ্কর অনিষ্ট ডেকে আনছিল। যে ব্যক্তি নিজের জীবনের সকল প্রকার অনিষ্ট থেকে নিজেকেই বাঁচাতে পারেনা সে কেমন করে অন্যের ভাগ্য বিধাতা হতে পারে। আল্লাহ বলেন-অহংকার আল্লাহর চাঁদর, তোমরা এটা নিয়ে টানাটানি করোনা।
৩। ইঞ্জিনিয়ার সবুজ আহমেদও অবশ্যই অর্থের অহংকারে নিজেকে খুব বড় মানুষ মনে করে আল্লাহর সাথে নাফরমানি করার মতো ঐদ্ধত্য প্রদর্শন করছে। অর্থ সম্পদ আল্লাহর দান। সেই দানকে আল্লাহ নিজের মুঠোয় ভরে নিজের ভোগ বিলাশিতায় অপচয় করতে বলেননি। যার নিজের দেশে এখনও এমন মানুষ রয়েছে যারা একবেলা খেয়ে তিনবেলার ক্ষুধা নিবারণ করে বা কোনও কোনও দিন তাও জোটাতে পারেনা তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে, তাদের সেবায় কোনও সময় বা অর্থ ব্যয় না করে, এসব ব্যয় করছে নিজের মনোদৈহিক মনোরঞ্জনের জন্য নিজের স্ত্রী ব্যতীত অন্য নারীর সাথে সেটাও আবার মিথ্যা পরিচয়ে, বিয়ের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এই ঘৃণার কাজটি করার সময় সে কল্পনাতেও আনতে পারছেনা যে, এর থেকেও বড়ও কোনও পাওনা তাকে আল্লাহ তায়ালা বুঝিয়ে দিতে পারেন। সে মূলত তার নিজের জন্যই একটি ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতই রচিত করল। তার সন্তানেরা কিছু দিন পরে যেদিন কিডন্যাপ হলো তার সম্পদের অর্ধেকটা ব্যয় হলো উদ্ধার কাজে। ছেলেটাকে পাওয়া গেল অক্ষত অবস্থায়, মেয়েটাকে পাওয়া গেল আশংকাজনকভাবে পতিত অবস্থায় যেকিনা গণধর্ষনের শিকার হয়েছে। মানুষ যখন অন্যের কোনও ক্ষতি করে তার মানসিকভাবে তৈরি থাকাটা জরুরী যে সে নিজেও এমন ক্ষতির শিকার হবে। নিজের ভাগ্যই মানুষ ঠিকমত নির্মাণ করতে পারেনা, সে আবার কেমন করে গড়ে অন্যের ভাগ্য!!
৪। আশার আলো স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা যেকোনও বিপদে তাঁর প্রভূর উপর ভরসা করে এই লোন গ্রহন করেছিলেন, সে জানত তার প্রভূ তাকে কোনও না কোনও পথ ঠিকই সামনে এনে দিবেন। ব্যক্তি অনেকের কথা বিশ্বাস করতে চেয়েও সে পারেনি, কারন মানুষ বিশ্বাস রক্ষার বদলে নাফরমানী বেশি করে। উপকারের থেকে ক্ষতিটাই বেশি করে। জীবনের এমন সংকটে নিকিতা বন্দোপাধ্যায় একমাত্র তার সৃষ্টিকর্তাকেই কাছে পেয়েছে। প্রভূর প্রতি অগাধ বিশ্বাস তাকে লোন পরিশোধে সাহায্য করেছে। সৃষ্টিকর্তা ঠিকই একটি সমস্যা সমাধানের পথ সামনে এনে দিয়েছেন। নিকিতা সব সময়ই জানতেন এবং বিশ্বাস করতেন, মানি ইজ নট এনাদার গড!!
তানিয়া
২৭/১২/২০১৫ইং
সময়: ৩:১৮ মি.