উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী নীলা ২ বছর যাবৎ উল্লাস নামের একটি বখে যাওয়া ছেলের সাথে মানসিক সম্পর্কে জড়িয়ে পরেছে। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে বলে পরিবারের সদস্যদের বাইরে নীলার কোন ছেলে মানুষের সাথে চলাফেরা ছিলনা, তার প্রতি এই ছেলের মুগ্ধতার এবং সম্পর্ক তৈরির কারন তাই তেমন বোধগম্যও ছিলনা। ছেলেটি একাধিক মেয়ের সাথে উদ্দেশ্য প্ররোচিতভাবে তার সম্পর্ক রেখে চলত নীলার সেটা বুঝতে পারার মতো বাস্তবিক জ্ঞানও মোটে ছিলনা। ছেলেটি নীলার জীবনে নতুন নতুন অনুভূতি আবিষ্কারের আনন্দের মধ্য দিয়ে মুগ্ধ করে রাখতো। নীলা ধীরে ধীরে একটা ঘোরের মধ্যে ঢুবে যেতে লাগল। তার মনে হলো উল্লাসকে ছাড়া সে বাঁচবেনা। নীলার বাবা মেয়ের এই অস্থিরতা বুঝতে পারার সাথে সাথে নানা রকম নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিলেন। নীলা ওর মাকে বলল, মা তুমি তো সব কিছু বলার আগে বুঝে যাও। তুমি আব্বুকে বোঝাও উল্লাসকে ছাড়া আমার ভারী কষ্ট হয়, মরে যাচ্ছি মনে হয়। নীলার বাবা মা উল্লাসের সম্পর্কে খোঁজ করে জানলেন, ছেলেটা সঙ্গ দোষে দুষ্ট এবং বাবা মায়ের অবাধ্য একমাত্র ডানপিটে ছেলে। ছাত্র জীবন থেকে বের হতেও অনেক সময় লাগবে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে কোন বাবা-মা ই তার আদরের মেয়েকে এই ছেলের সাথে বিয়ে দিবেনা। কিন্তু নীলা? সে দূরন্ত এবং অন্ধ, প্রথম আলাপন তার সর্ব মন জুড়ে শুধু উল্লাসকে টানছে। নীলা ভাবছে এত নিবির করে সে আর কারো হতে পারবেনা। সব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সে উল্লাসকে বিয়ে করে ফেলল। উল্লাস তার নেশা, ধ্যাণ জ্ঞান। বিয়ের খবর জানতে পেরে নীলার বাবা মা অভিমান করেই নীলাকে তার শ্বশুড় আর শ্বাশুড়ীর হাতে তুলে দিল। উল্লাসের বাবা-মা তেমন আপত্তি না করে বিয়েটা মেনে নিলে নীলার মনে হলো সে পৃথিবীর সব চাইতে সুখী মেয়ে। নীলার বাবার বিত্ত বৈভব নীলা এখানে পেলনা ঠিক কিন্তু উল্লাসকে তো পেল। কিছু পেতে গিয়ে কিছু হারিয়ে ফেলা। উল্লাস কিছু দিন পরেই নীলাকে তুচ্ছ করতে শুরু করল, সময় দেয়া কমিয়ে দিল। উপরন্তু উল্লাসের বাবা-মাও বড়লোকের মেয়েটা বাবার বাড়ী থেকে যতটুকু যা আনবে ভেবেছিল তা আনছে না দেখে মানসিকভাবে নীলাকে নানান রকম গঞ্জণা দিতে লাগলো। কিছু দিনের মাঝেই নীলা বুঝতে পারলো সে ভুল করেছে, উল্লাস তাকে পছন্দ করে শখের একটা পুতুল কেনার মতো কিনে এনে বাড়িতে সাজিয়ে রেখেছে। আর উল্লাস পরিবারের সব থেকে কণিষ্ঠ সদস্য হওয়ায় ওর কোনো ব্যাক্তিত্ব প্রকাশ করতে পারেনা। জ্বী হুজুর জাহাপনা আর তোষামদি ভাব পরিবারে সবার সাথে। শুধু নীলার কাছে এলেই কিছুটা পুরুষের মতো আচরণ করতে থাকে। নীলা অবাক হয়, একটু খানি সময়ও এখন উল্লাসের বুকে ভাবনাহীণ মাথা রাখার সুযোগ মিলেনা তার। আহ! এই উল্লাসের জন্য সে সব ছেড়েছে। উল্লাস তাকে প্রতিক্ষণে ভালবেসে সাথে পাশে থাকার মিথ্যা অঙ্গীকার করে এখন কি করছে তার সাথে। নীলা আর উল্লাসকে খুব কাছাকাছি দেখতে পেলেই শুরু হয়ে যায় নীলার শ্বাশুড়ির তর্জন গর্জন। নীলা ধীরে ধীরে খুব অসহায় হযে পরল, শ্বশুড় বাড়ির সবাই জ্ঞান দিতে থাকে তাকে। ও কেমন করে খাবে, ঘুমাবে, হাসবে, গল্প করবে, কোন কোন জায়গায় যেতে পারবে, কাদের সাথে মিশবে। নীলার মাঝে মাঝে ওর শ্বশুড় বাড়িকে একটা চিড়িয়া খানা মনে হচ্ছিল। মাঝ রাতে উল্লাস বাড়িতে আসতে শুরু করেছে। সবাই ঘুমিয়ে পরে নীলা বালিশে মুখ গুজে কাঁদে, আব্বু! কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট হচ্ছে, কথা না শোনার শাস্তি মিলেছে। তুমি আমার কত ভাল চাইতে, আমি তার কোনওটাই না বুঝে নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনেছি। ননাশের প্রশ্নবিদ্ধ চলাফেরার বিষয়ে উল্লাসের কাছে কৌতুহল দেখিয়ে জীবনে প্রথম নীলা মার খেলো। নীলা এখন আর অবাক হয়না। নীলা জানে আজকে যদি ওর বাবার থেকে অনেক টাকা আনে, সবাইকে দেয় তবে নীলা এ বাড়িতে আর যাই খাক মার খাবেনা। কিন্তু না। নীলা তার বাবাকে কোনও কষ্ট দিবেনা। সারা জীবন যৌতুক বিরোধী নীলা তার নিজের জীবনে এই যৌতুকের অভিশাপ ডেকে আনবেনা। হঠাৎ নীলা বুঝতে পারল সে মা হবে, উল্লাস বলল, নীলা খুশি হবো না লজ্জা পাবো বুঝতে পারছিনা।
নীলার শ্বাশুড়ি এই খবরে খুব ক্ষেপে গিয়ে উলট পালট বকতে লাগলো। আর এই অবস্থায় উল্লাস তার মাকে খুশি করতে নীলাকে বলেই ফেলল, নীলা, তোমাকে আমি এ্যাবোরেশন করাবো। নীলা একা থাকে, ওর একটা বাচ্চা হলে ও তাকে নিয়ে সময় কাটাতে পারবে। নীলা কিছুতেই রাজি হলোনা বলে নীলার পেটে প্রচন্ড আঘাত করে উল্লাস। নীলার এত সাহস যে সে তার মা এবং পরিবারের থেকে বিপরীত চিন্তা করে! নীলা প্রচন্ড মলিন মুখ নিয়ে তার নিজের মা-বাবার কাছে দাঁড়ালো। অস্পষ্ট আর ক্ষীণ কন্ঠে শুধু বলল, মা! আমার বাচ্চাটাকে বাঁচাও। বলে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরল মাটিতে। নীলার বাবা-মা বুঝতে পারলেন, তাদের অভিমান নীলার জীবনে অীভশাপ বয়ে এনেছে। নীলার বাবা মা নীলাকে কলেজে ভর্তি করে দিলেন। উল্লাসকে ডেকে বললেন, নীলাকে সে বিয়ে করে নিয়ে গেলেও স্ত্রীর মর্যাদা কেন দিলনা। উল্লাস নিজেকে সংশোধন না করলে নীলাকে তারা আর দিবেনা। উল্লাস একথা জেনে অস্থির হয়ে পরল, হায়! এত সরল বিশ্বাসী আর ভালো বউ সে হারিয়ে ফেললে বড় অপূরণীয় ক্ষতি হবে। উল্লাস ক্ষমা চাইল, বলল ফের আর ভুল হবেনা। কথা দিল সে নীলার বাবা-মায়ের কাছে। নীলার সাথে আবারও আগের মতো অভিনয় করতে শুরু করল, ভালবাসার অভিনয়। নীলা অজান্তে ক্ষমা করে দিল। ভাবল আসন্ন নবজাতকের মুখ দেখে হয়ত উল্লাস ভাল হয়ে যাবে। নাহ উল্লাস পরেও ভাল হলোনা, উল্লাসের নীলার সাথে অভিনয় গুলি পালাক্রমে নানারকম হতে লাগলো। নীলার সরলতাকে পুঁজি করে সে মিথ্যাচার করল, প্রতিহিংসার এক সম্পর্ক তৈরি করল। নেশায় আসক্ত হলো। নির্যাতনের মাত্রা এবং ধরণ বাড়ল। তবুও নীলা দিন পরিবর্তনের আশায় মেনে নিতে লাগল শত রকমের অত্যাচার। পরিবার, সমাজ কি বলে, বিবাহ বিচ্ছেদ সমাজে কতটা গ্রহনযোগ্য, বাচ্চাদের ভবিষ্যতের জন্য বাবার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু এত বিচার বিশ্লেষনে সে প্রতিবাদের কোন ভাষাই আর খুঁজে পায়না। প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ তাই করাও হয়না। আর এ থেকে সাহস বেড়ে যাচ্ছে উল্লাসের। নরম মনের নীলাকে সে কষ্ট, কটাক্ষ আর নোংরা অপবাদ দিয়ে মানসিক নির্যাতনের মাতম শুরু করে। নীলা লজ্জিত হয় আর অপমানের দিক দিশা খুঁজে পায়না। নেশার ঘোরে সে একদিন নীলাকে হয়তো এসিড দগ্ধ বা প্রাণহীনই করে ফেলবে। নীলার তখন বিশ্বাস হবে প্রতারককে উপযুক্ত শাস্তি না দিয়ে তার স্বভাব বদলানোর প্রচেষ্টাই তার মৃত্যুর কারন। এমন এক বর্বর পাষন্ড পিতা সন্তানের জন্য কিই ভাল বয়ে আনবে তাতো বোঝা যায়। দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার সময় নয় তার আগেই বুঝতে হবে নীলাকে এবং নীলার পরিবারকে সঠিক সময়েই সঠিক মানুষ নির্বাচন করে ভুল মানুষ থেকে দূরে সরে থাকার কতটা প্রয়োজন।
তানিয়া
২৬/১১/২০১৫ইং