চরের মেয়ে-৩
চরের মেয়ে-১
চরের মেয়ে-২
চরের মেয়ে-৩
চরের মেয়ে-৪
চরের মেয়ে-৫
খালাম্মা বললেন, সমালোচকদের মতে বাংলা সাহিত্যে 'শেষের কবিতা'র চেয়ে শ্রেষ্ঠতর উপন্যাস অদ্যাবধি লেখা হয়নি। ঠিক এ কারণেই দোকানদার আমার পাগল ফুফাত ভাইকে না ক্ষেপিয়ে সবচাইতে ভালো বইটি দিয়েছিলেন, যাতে এ ব্যাপারে আমার তদানিন্তন ভাইটি অন্য কোথাও কোন চ্যালেঞ্জ না করে বসে।
আমি বললাম, আপনি কি বইটা পড়েছেন?
ও-বয়সে 'শেষের কবিতা' পড়া যায় না। তবে আমি আগ্রহ চেপে রাখতে পারিনি। বই হাতে পাওয়া মাত্র পড়তে শুরু করি, যখন পড়া শেষ হয় ততদিনে আমি সপ্তম শ্রেণী পার হয়ে গেছি। মজার ব্যাপার হলো বইটির আগা-মাথা কিছুই বুঝিনি।
এবার আমার একটা প্রশ্নের উত্তর জানার আগ্রহ হলো। মনে মনে বললাম, এই প্রশ্নটার উত্তর যদি আপনি দিতে পারেন তবে আপনি সত্যিকার অর্থেই সাহিত্যের খোঁজ খবর রাখেন।
তাঁকে বললাম, আচ্ছা, বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কবিতা কোন্টি?
খালাম্মা সময় নিলেন না বলতে। বললেন, 'শেষের কবিতা' উপন্যাসের একদম শেষে একটা কবিতা আছে, অমিতের উদ্দেশ্যে লাবণ্যের লেখা :
'কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও,
তারই রথ নিত্যই উধাও।'
এই কবিতাটিকেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা বলে বিবেচনা করা হয়। খালাম্মা পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনি বলুন তো শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প কোন্টি?
আমার নিজেকে খুব খাট মনে হতে থাকলো। এ ভদ্রমহিলার কাছে আমি প্রত্যেকটা সাধারণ জ্ঞানের বিষয়ে হোঁচট খাচ্ছি। অথচ এ বিষয়ে আমারই আধিপত্য থাকার কথা।
আমাকে চুপচাপ থাকতে দেখে খালাম্মা বললেন, এ ব্যাপারে সমালোচকগণ দু-ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ বলেন, রবীন্দ্রনাথের 'পোষ্টমাস্টার', অন্য ভাগ বলেন তাঁর 'কাবুলিওয়ালা'। তবে আমার মতে আরো একটা গল্প এর সাথে যোগ হতে পারে, সেটি রবীন্দ্রনাথেরই 'ছুটি'।
আমি বললাম, আপনি কি তিনটা গল্পই পড়েছেন?
অবশ্যই। অনেক আগে পড়েছি এবং বহুবার পড়েছি।
রবীন্দ্রনাথের মোট ক-টি গল্প পড়েছেন?
অসংখ্য। তবে কি জানেন, রবীন্দ্রনাথের কোন গল্প একবার পড়ে শেষ করা যায় না। বহুবার পড়তে হয়। বলতে পারেন, এক গল্পই আপনাকে বহুবার টানবে, একেক বয়সে এর মধ্যে একেক রকম স্বাদ পাবেন।
একেকটা গল্প আপনি ক-বার করে পড়েছেন?
এস.এস.সি পরীক্ষার আগেই আমি গল্পগুচ্ছ শেষ করেছিলাম। তবে কখনো সখনো হঠাৎ করেই কোন একটা গল্পের কথা মনে পড়ে যায়, ওটি আবার পড়তে বসি। আপনি কি জানেন আমি 'শেষের কবিতা' মোট কতবার পড়েছি?
বলুন।
আমি যখন দশম শ্রেণীতে, তখন ওটি দ্বিতীয়বার পড়তে বসি। আমার মনে দারুণ জেদ ধরলো, বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম উপন্যাস, আর আমার মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও আমি তা বুঝবো না? তা হয় না। এবার পড়ে আমি বেশ মজাই পেলাম। বইটার এক জায়গায় গিয়ে আমার খুব খারাপ লাগলো, কান্না চলে এল। অমিত যোগমায়াদের বাড়ি গেছে। কিন্তু যোগমায়ারা আর আগের বাড়িতে নেই। 'ঘর বন্ধ, সবাই চলে গেছে, কোথায় গেছে তার কোন ঠিকানা রেখে যায়নি'। অমিত লাবণ্যের বসবার ঘরে গেল। 'সেই ঘরটার মধ্যে বোবা একটা শূন্যতা। তাকে প্রশ্ন করলে কোন কথাই বলতে পারে না। সে একটা মূর্ছা, যে মূর্ছা কোনদিনই আর ভাঙবে না।' তারপর অমিত নিজের কুটিরে গেল। যোগমায়া যা যেমন রেখে গিয়েছিলেন তেমনি সব আছে। এমন কি, যোগমায়া অমিতকে দেয়া তাঁর কেদারাটিও ফিরিয়ে নিয়ে যাননি। যেন স্নেহ করেই এই কেদারাটি তিনি অমিতকে দিয়ে গেছেন। অমিত যেন শুনতে পেল শান্ত মধুর স্বরে তাঁর সেই আহ্বান - 'বাছা'!
তারপর আর পড়েননি?
এ পর্যন্ত আমি মোট সাতবার পড়েছি। যতবার পড়েছি, আমার মনে হয়েছে এ বুঝি আমি প্রথমবারের মত উপন্যাসটি পড়ছি।
খালাম্মার হাতে একটা বই। আমার ধারণা হলো এখন তিনি 'শেষের কবিতা' পড়ছেন। বইটি একবার নেড়েচেড়ে দেখার সাধ হলো। জিজ্ঞাসা করলাম, হাতের ওটা কি 'শেষের কবিতা'?
আরে না, খালাম্মা বললেন, এটা হলো 'শঙ্ক্ষনীল কারাগার'।
কার লেখা?
হুমায়ূন আহমেদের নাম শুনেছেন?
বিটিভিতে তখন হুমায়ূন আহমেদের একটা ধারাবাহিক নাটক শুরু হয়েছে - 'এইসব দিনরাত্রি'। আমাদের বাসায় তো আর টিভি ছিল না; টিভি ছিল শেরখান, জাহিদ, খায়ের, মাসুদ আরো অনেকের বাসায়। স্কুলে ওরা 'এইসব দিনরাত্রি' নিয়ে কত মজার মজার আলোচনা করতো, এত ভালো নাটক নাকি টিভিতে আর কখনো হয়নি। ওরা বলতো, হুমায়ূন আহমেদ ওদের প্রিয় নাট্যকার। অবশ্য এর অনেক আগে, যখন আমি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি, একবার হুমায়ূন আহমেদের একটা উপন্যাস পড়েছিলাম, নাম ছিল 'নন্দিত নরকে'। এটা নাকি তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস। জাহিদদের বাসায় যখন গিয়েছিলাম, ওর বড় ভাই আমাকে ওটা পড়তে দিয়েছিলেন। আমি পুরো বইটি মাত্র পাঁচ দিনে পড়ে শেষ করেছিলাম (আমার ঐ বয়সে পাঁচ দিনে পড়ে একটা বই শেষ করার মধ্যে অসাধারণ কৃতিত্ব ছিল)। বইটি আমার কাছে খুব ভালো লেগেছিল।
আমি খালাম্মাকে বললাম, আমি হুমায়ূন আহমেদের বই পড়েছি।
খালাম্মা চঞ্চল হয়ে বললেন, তাই? কি কি বই পড়েছেন?
বইয়ের নাম বলতে লজ্জা হলো বইকি। একটা মাত্র বই পড়েছি, এ কথাটি তো আর গর্বের সাথে বলা যায় না। খালাম্মা আমার মনের কথাটি বুঝতে পেরে বললেন, হুমায়ূন আহমেদের কোন বই পড়া আমি মিস করি না। ছোট ছোট একেকটা বই, অথচ কি নির্মল আর প্রাঞ্জল সুখ দেয়! পড়তে পড়তে হেসে কুটি কুটি হই, আবার হঠাৎ করেই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি কথায় এত হাসি আর করুণ বেদনা ফুটিয়ে তোলার দক্ষতা বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া অন্য কারোর নেই। দারুণ মজার একেকটা বই পড়ি আর আমি অবাক হই, এ লোকটা এমন অসাধারণ বইগুলো কিভাবে লিখেন? আপনি হয়তো জানেন না, মানুষ কিন্তু আগে এত বই পড়তো না। হুমায়ূন আহমেদের বই মানুষের মধ্যে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। বই পড়ার মধ্যে যে কি আনন্দ আমার মনে হয় এটা একমাত্র হুমায়ূন আহমেদই আমাদেরকে শিখিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদ মানুষকে চুম্বকের মত বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করে রেখেছেন। জরিপ করলে হয়তো দেখা যাবে, যে লোক জীবনে মাত্র একটা বই পড়েছে, সে নিঃসন্দেহে হুমায়ূন আহমেদেরই একটা বই পড়েছে। আমার মনে হয় কি জানেন, আমার মনে হয় এমন একদিন আসবে যখন সাহিত্যের ছাত্ররা হুমায়ূন আহমেদের প্রতিভা নিয়ে গবেষণা করবে। এমন প্রতিভা খুব বিরল। এঁরা ক্ষণজন্মা।
এ মহিলাকে দেখি আর ক্রমশ অবাক হতে থাকি। একটি গণ্ডগ্রামের মেয়ে, চরের মেয়ে, সেই বিচারে তিনিও একটা অসাধারণ প্রতিভাময়ী নারী নন কি? তাঁকে মনে মনে ক্ষণজন্মা বলতে আমার কোন দ্বিধা রইল না। আমি হার মানলাম। আসলে নিজের সম্বন্ধে কোন বড়াই করতে নেই। কাউকে বাইরে থেকে দেখেও তার ভিতরটা তুচ্ছ ভাবা ঠিক না। আমি যতই বড়াই করি না কেন, আসলে এটা আমার অহমিকা। বই মুখস্ত করে ক্লাসে সর্বোচ্চ নম্বর পাই বটে, কিন্তু আমার সত্যিকার ঞ্চানার্জন হয় না। আমার কি ঞ্চানার্জনের সদিচ্ছা আছে? অধ্যবসায় আছে? আমার নিজের সম্পর্কে তাহলে এত বড় ধারণা কেন আমার? আমি মনে মনে সামনে উপবিষ্ট বিজ্ঞ মহিলার প্রতি সশ্রদ্ধ হলাম।
খালাম্মা বললেন, আপনার সাথে আমি এত কথা বললাম কেন, জানেন?
জ্বি না।
আমি একজন শিক্ষিকা। সবাইকে ছাত্র মনে হয়, সবাই আমাকে শিক্ষিকা ভাবে না যদিও, ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে আমি খোলামেলা আলোচনা পছন্দ করি। কিন্তু আপনার ওপর প্রথমে ক্ষুব্ধ হয়ে কঠিন আচরণ করেছিলাম। এর দ্বারা নিশ্চয়ই মনে কষ্ট পেয়েছিলেন। সারা জীবন আমার সম্বন্ধে আপনার মনে একটা খারাপ ধারণা থাকবে। তাছাড়া আপনি একটা অসম্ভব লাজুক ধরণের ছেলে। আমি লাজুক ছেলেদের পছন্দ করি, এরা সচরাচর ভদ্র ও নম্র হয়। কিন্তু আপনার মত এতখানি লাজুক থাকা ভালো না। মেয়েদের সাথে কথা বলতে গিয়ে মুখ আড়ষ্ট হওয়া কিন্তু ভীরুতার লক্ষণ। আপনার লাজুক আচরণ দেখে আমার মনে হলো যে আপনার মধ্যে একটা পরিবর্তনের দরকার। আমার সাথে প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে আপনি কথা বলেছেন। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন যে আপনি আগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি স্মার্টলি কথা বলতে পারছেন? মুখে কোন জড়তা নেই, সেই লাজুকতাও নেই।
আমি এবার সত্যি সত্যিই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলাম। খালাম্মা বললেন, এখন আপনাকে 'তুমি' করে বলা যায়। প্রথমেই বলতে পারতাম। আপনি কি না কি ভেবে বসেন, এজন্য বলিনি। আমার ধারণা তাতে আপনার জড়তাও কাটতো না।
জ্বি।
আর সব সময় 'জ্বি' 'জ্বি' করেও কথা বলবেন না। একবার 'জ্বি', আরেকবার 'হ্যাঁ', আরেকবার 'আচ্ছা', ইত্যাদি মিলিয়ে কথা বলবেন। বুঝতে পেরেছেন?
জ্বি। ----- স্যরি, হ্যাঁ।
খালাম্মা হাসলেন। বললেন, দেখো, তোমার সাথে পাক্কা এক ঘন্টা কথা বললাম। এই দেখো, সত্যিই 'তুমি' বলে ফেললাম। মাইন্ড করবেন না যেন! একটু তুমি বস দেখি। ওদের দুজনকেই ডেকে দিচ্ছি। মনে রেখ, তোমার আসা উপলক্ষে এই অসময়ে ওদের সাক্ষাৎ হচ্ছে। কথাটি কিন্তু মনে রেখ। এই বলে খালাম্মা মুচ্কি হেসে ভিতরে চলে গেলেন।
অন্তরবাসিনী, উপন্যাস, প্রকাশকাল একুশে বইমেলা ২০০৪
পর্ব-১
পর্ব-২
পর্ব-৩
পর্ব-৪
পর্ব-৫
পর্ব-৬
পর্ব-৭
পর্ব-৮
পর্ব-৯
পর্ব-১০
পর্ব-১১
পর্ব-১২
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৪৬