চরের মেয়ে-৪
চরের মেয়ে-১
চরের মেয়ে-২
চরের মেয়ে-৩
চরের মেয়ে-৪
চরের মেয়ে-৫
মিনিট দুয়েকের মাথায় চপল পায়ে দৌড়ে এসে মিষ্টি হেসে দরজার চৌকাঠে পা রেখে দাঁড়ালেন ভাবী, শাহজাহানের বউ। তার পরনে শাড়ি নয়, সেলোয়ার-কামিজ। আমি বিস্ময়ে হতবাক হই - মা-মেয়ের মধ্যে এত মিল! আমার একটা ভুল হতে পারতো - যদি খালাম্মা চলে যাওয়ার বিশ-পঁচিশ মিনিট পরে ভাবী এখানে আসতেন, কিংবা ভাবী যদি সেলোয়ার কামিজের বদলে খালাম্মার শাড়িটির মত একটি শাড়ি পরে আসতেন, আমি নির্ঘাত একে খালাম্মা ভেবে অসংকোচে আগের ধারাবাহিকতায় আলাপ-চারিতায় উদ্যত হতাম।
এবার অবশ্য সৌজন্য প্রদর্শনে ভুল হলো না। উঠে দাঁড়িয়ে সালাম জানাতেই ভাবী হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি নাহিদ ভাইয়া না? আপনার বন্ধু আপনার সম্পর্কে কত গল্প করে! অথচ আপনি আমাদের বাসায় আসেন না। কখন এসেছেন আপনি?
প্রায় ঘন্টা খানেক। আমি জবাব দিই।
ভাবী মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ইশ, কি কাণ্ড দেখেন তো? এক ঘন্টা হলো আপনি এসেছেন, আর আমি জানলাম এই মাত্র। চলুন, পাশের ঘরে আপনার বন্ধু শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
আমি ইতস্তত করতেই ভাবী বললেন, আসুন না, ঘরের ভিতর দিয়েই চলে আসুন।
অবাক কাণ্ড তো! শাহজাহানের শাশুড়ি বলেছিলেন যে, উনি এখানে বসে পাহারা দিচ্ছিলেন, যাতে দুজনে একত্র হতে না পারে। অথচ শাহজাহান দিব্যি অন্য ঘরে নির্ঝঞ্ঝাট শুয়ে আছে - ওখানে খুনোখুনি হয়ে গেলেও কি এখান থেকে কিছু টের পাওয়া যাবে?
বারান্দা দিয়েই হেঁটে শাহজাহানের ঘরে যাওয়া যায়। কিন্তু ভাবী বলছেন ঘরের ভিতর দিয়ে হেঁটে যেতে। ঘরের ভিতর দিয়ে হেঁটে যেতে আমার সংকোচ বোধ হচ্ছিল বলে ইতস্তত করছিলাম। এটা বুঝতে পেরে ভাবী বললেন, কোন লজ্জা করবেন না - মনে করবেন আপনি এ বাড়ির লোক।
আমি মাথা নিচু করে ঘরের ভিতর দিয়ে হেঁটে অন্দর বাড়ির দুয়ারে পা রাখলাম - সেই দুয়ারের ওপর দিয়ে হেঁটে শাহজাহানের ঘরে ঢুকলাম। শাহজাহান স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে লুঙ্গি পরে এলোমেলো ভাবে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। ওর শিয়রের কাছে গুঁটিকতক বই।
ভাবী বললেন, দেখুন আপনার বন্ধুর অবস্থা।
শাহজাহানের পাশে বসে ওর পিঠে ঠেলা দিলাম, কিন্তু নড়াতে পারলাম না। কারণ ওর হলো হাতির মত শরীর। ওর উরু আমার বুকের চেয়ে বেশি চওড়া। ওর বয়স আমার চেয়ে কমপক্ষে পাঁচ বছর বেশি এবং সেকালে ১৬-১৭ বছরের কোন ছাত্র এস.এস.সি পাশ করেছে শুনলে আমরা ভাবতাম, ছেলেটা বেশ অল্প বয়সে এস.এস.সি পাশ করলো। অর্থ্যাৎ শাহজাহানের বয়স ২১-২২ হয়েছিল নিঃসন্দেহে।
আরো জোরে কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে শরীর নড়াতে পারলাম বটে কিন্তু ঘুম ভাঙ্গাতে পারলাম না। ওর বউ মাথার কাছে গিয়ে শাহজাহানের কানে চুলের সুড়সুড়ি দিতেই সে ধ্যাত ধ্যাত শব্দ করে হড়মড়িয়ে উঠে পড়লো। ঘুম জড়ানো চোখে আমাকে সামনে বসা দেখতে পেয়ে সে গদগদ হয়ে বলে উঠলো, না-হি-দ, তুই তাহলে সত্যিই এসেছিস? কি সৌভাগ্য, কি সৌভাগ্য! ভাবী যোগ করলেন, এক ঘন্টার ওপরে হলো।
কি বলছিস? এত আগে আসলি আর আমাকে ডাকলি কেবল?
শাহজাহানকে সংক্ষেপে ঘটনা বোঝানোর পর হাসতে হাসতে দুজনের পেটে খিল ধরে গেল।
শাহজাহান ওর বউকে বললো, এক কাজ কর্, মুড়ি আর কলা নিয়ে আয়। ভাবী কলা আর মুড়ি আনার জন্য বের হয়ে গেলেন। মিনিট খানেক পর ওর শাশুড়ি ঘরে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। অল্পক্ষণ পরই ভাবী চলে এলেন, তাঁর হাতে এক বউল মুড়ি, তবে কলা নেই, তাতে বড় বড় কয়েক খণ্ড নারকেলী গুঁড়। নারকেলী গুঁড়ের মৌ মৌ গন্ধে আমার প্রাণ ভরে গেল।
শাশুড়িকে দেখে শাহজাহান ব্যঙ্গ করে উঠলো - কি রে, তুই নাকি আমার বন্ধুকে খুব হেস্তনেস্ত করেছিস?
শাহজাহানের 'তুই' সম্বোধন শুনে আমি অবাক ও দ্বিধাম্বিত হই। ওর শাশুড়ির দিকে তাকাই। তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কি, বন্ধুর কাছে এরই মধ্যে নালিশ করে ফেলেছেন?
আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করি। খালাম্মা হাসতে হাসতে বলেন, তোর বন্ধু আমাকে কি ভেবেছিল জানিস? ভেবেছিল আমি তোর বউ। বলার সাথে সাথেই তিন জনে হো হো করে হেসে ওঠেন।
ভাবী তাঁর মাকে বলেন, দোষটা তো তোরই। আগে ভাগে বলে দিবি না?
আমি কি অতখানি বুঝতে পেরেছিলাম? খালাম্মা জবাব দেন।
ভাবী শাহজাহানকে বলে উঠলেন, তোর বন্ধুটা এত লাজুক কেন রে? খালি খালি মাথা নিচু করে বসে থাকে।
আমি ভীষণ ধাঁধায় পড়ে গেলাম। কি অদ্ভূত এক জায়গায় এলাম রে বাবা, সবাই সবাইকে তুই-তুকারি করে কথা বলছে! আমি অবাক হই। ভদ্র পরিবারে স্বামী তার স্ত্রীকে হয়তো তুই-তুকারি করে কথা বললেও বলতে পারে, কিন্তু স্ত্রী কিভাবে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় তার স্বামীর সাথে তুই-তুকারি করে কথা বলতে পারে? ঝগড়া-ঝাঁটির সময়ে অনেকে বলে থাকে, সেটি ভিন্ন পরিস্থিতি। কিন্তু এখন তো তা নয়।
সবচেয়ে অদ্ভূত লাগলো জামাই শাশুড়ির পারস্পরিক সম্বোধনে - আসলে কারো সম্বোধনই এখনো ঠিক মত শুনিনি। কিন্তু দুজনই দুজনকে তুই তুই করে কথা বলছে। এটা কি করে সম্ভব? আমার সন্দেহ হলো, ওরা সত্যিকারের জামাই শাশুড়ি তো? নাকি অন্য কোন সম্পর্ক ওদের - আমাকে বোকা বানাবার জন্য একটা কৌশল। সবাই কি মনে করে আমাকে? আমাকে বোকা বানিয়ে ওদের কি লাভ?
খালাম্মা বউলটা নিজের কাছে নিয়ে মুড়ির বালু ভাংতে লাগলেন।
শাহজাহান বললো, মামানী রে, শুধু মুড়িটুড়ি খাইয়ে আমার বন্ধুকে বিদায় করবি? পোলাও-মাংস রান্না কর্। জীবনে প্রথম বারের মত আমার শ্বশুরালয়ে পদার্পন - ওকে কি শুধু মুড়ি খাওয়ানো যায়?
মামানী (মামী) বললেন, মোরগ জবাই হচ্ছে। রান্না করতে সময় লাগবে না? ততক্ষণ মুড়ি খা।
আমি বললাম, খালাম্মা প্লিজ, এত ব্যস্ত হবেন না। আমি মুড়িই সবচাইতে বেশি পছন্দ করি। অন্য কিছু করবেন না, প্লিজ।
আপনার সাথে আমার কত মিল দেখেছেন? আমি কি করি জানেন? ভাতের সাথেও মুড়ি মিশিয়ে খাই। দারুণ মজা!
মুড়ির বালু ভাঙ্গা শেষ হলে খালাম্মা মুড়ি আর গুঁড় সামনে এগিয়ে দিলেন।
নারকেলী গুঁড়ের ঘ্রাণে আমার প্রাণটা ভরে গেল। মুড়ির চেয়ে আমি গুঁড়ই বেশি খেতে থাকলাম।
অর্ধেক খাওয়া না হতেই শাহজাহান বললো, চঙ্গটা (মই) আন তো।
চঙ্গ দিয়ে কি করবি? ভাবী জিঞ্চাসা করলেন।
শাহজাহান ভাবীকে বললো, আরে চঙ্গটা লাগা না। তারপর আমাকে সঙ্গে নিয়ে সে বারান্দায় এল। বারান্দার এক পাশে চঙ্গটি পড়েছিল। শাহজাহান নিজেই ওটা উঠিয়ে বললো, আমার সাথে আয়।
আমি শাহজাহানের সাথে বাড়ির পশ্চিম দিকে গেলাম। অগুনতি কলাগাছ দাঁড়িয়ে আছে, তেমনি অসংখ্য কলার ছড়া গাছে গাছে ঝুলে আছে। পাতার পতপত শব্দে এক ধরণের ছন্দময়তাও সৃষ্টি হচ্ছে। শাহজাহান নিচ থেকে ওপরে তাকিয়ে কলার কাঁদিগুলো পরখ করতে লাগলো। তারপর একটা কলাগাছে চঙ্গ ফেলে তরতর করে ওপরে উঠে গেল। মাঝ পথে উঠে বললো, ধূর শালা, কাঁচিই তো আনিনি। কাটবো কি দিয়ে? জয়নব --- জয়নব --- কাঁচিটা নিয়ে আয় তো।
ভাবী কাঁচি নিয়ে দৌড়ে এসে নিজেই মইয়ের কয়েক ধাপ উপরে উঠে শাহজাহানের হাতে পৌঁছে দিলেন। কলাগাছের মাথায় পৌঁছে শাহজাহান একেকটা কাঁদি টিপে টিপে দেখতে লাগলো। কারণ রোদে জ্বলে অনেক কলার গায়ের রং পাকাটে দেখালেও আসলে পাকা নয়।
শেষ পর্যন্ত শাহজাহান দু-কাঁদি কলা কেটে হাতে করে নিচে নেমে এল। এমন বিশালাকৃতির গাছপাকা কলা এর আগে কোথাও দেখিনি।
গাছ থেকে নেমেই শাহজাহান বললো, চিনিস, এর নাম আঁটি-কলা? বিচি-কলাও বলা হয়। এগুলোর পেট-ভরা আঁটি থাকে তো তাই নাম হলো আঁটি-কলা।
ঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে শাহজাহান বললো, জানিস তো, এটা জয়পাড়া হলেও চর এলাকা। সব বৈশিষ্ট্য চর এলাকার মতই। দেখছিস না খালি কলাগাছ আর কলাগাছ? আমরা কলা দিয়ে তিন বেলা ভাত খেতে পারি, আবার তিন বেলা শুধু কলা খেয়েও বাঁচতে পারি।
ঘরে গিয়ে বসতে বসতে শাহজাহান বলে, আঁটি-কলার সাথে একমাত্র মুড়ি হলো উত্তম। এক সাথে মাখালে বিচির কোন অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মুড়ির সাথে যখন কলা মাখিয়ে খাওয়া শুরু করলাম, বুঝলাম শাহজাহান একটা অতি খাঁটি কথা বলেছে। জীবনে অনেক রকম উপাদানে তৈরী করা মুড়ি খেয়েছি। কিন্তু আঁটি-কলা মাখানো মুড়ি আমার কাছে অমৃত মনে হলো। আমি ভেবে পেলাম না আঁটি-কলার সাথে মুড়ির এই অমৃত যোগের কথা ওরা জানলো কিভাবে।
মুড়ি খেতে খেতে আরো অনেক গল্প-গুজব হলো শাহজাহানের সাথে। আমি খাওয়া শেষে চলে আসতে উদ্যত হলেও আসতে দিল না। বললো, আমাকে পোলাও মাংস খেতে হবেই হবে।
গল্পে গল্পে ওদের তুই-তুকারির সম্পর্কটা খোলশা হলো। আসলে আমি যতটা অবাক হয়েছি ভিতরে ততটা রহস্য নেই।
আমরা হর-হামেশা মাকে তুই বলে সম্বোধন করি। নানীর সংসারে শাহজাহান অতি আদরের নাতি ছিল। মাকে, নানীকে তুই-তুকারি করে বলার সাথে সাথে মামীকেও বাল্যকাল থেকে তুই-তুই বলে সম্বোধন করে এসেছে। জয়নবের সাথে বিয়ে হবার পর সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটেছে, তবে সম্বোধনে কোন পরিবর্তন আসেনি।
জয়নবের ব্যাপারটা আরো সহজ। মামাত বোন আর ফুফাত ভাই। বয়সের ব্যবধান ৪-৫ বছর হলেও 'জয়নব এক গ্লাস পানি দে তো', আবার 'ভাইয়া, আমার জন্য মালা আনিস' - সর্বদা সম্বোধন এরূপই ছিল। 'তুই'-এর অদ্যাবধি 'তুমি'-তে উত্তরণ হতে পারেনি।
তবে শাহজাহানের শাশুড়ি একটা ব্যাপারে ভীষণ কড়া। যদ্দিন পরীক্ষা চলবে তদ্দিন জামাই-বউ একত্র হতে পারবে না। দুজনকে তিনি সর্বদা চোখে চোখে রাখেন। কিন্তু ও-দুটো যে কি রকম চালাকের হাড্ডি, তা তো আর খালাম্মা জানেন না। তিনি তো আর ২৪ ঘন্টা পাহারা দিয়েও রাখতে পারেন না। আগুন আর পানি বলে কথা, যা ঘটবার তা প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘটে থাকে।
আমরা ঘর থেকে বের হয়ে উত্তরের বারান্দায় গিয়ে বসলাম। আমার বাম পাশে শাহজাহান আমার বাহু চেপে বসলো, ওর বাম পাশে ওর বউ ওর ওপর শরীর এলিয়ে কাত হয়ে ঘেঁষে থাকলো। খালাম্মা একটা থামের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগলেন।
হঠাৎ আমি মুখ ফস্কে একটা বোকার মত প্রশ্ন করে বসলাম। খালাম্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার বয়স কত?
খালাম্মা ততক্ষণাৎ জবাব দিলেন, ত্রিশ বছর।
কিন্তু পরক্ষণেই তিনজনে খিলখিল করে হেসে উঠলেন। শাহজাহান আমার বাহুতে একটা চাপ দিতে দিতে বলে বসলো, খুব বিপদে আছি রে! কোন্দিন আবার দেখি বাড়িতে আমার শাশুড়ির জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ঘটক এসে হাজির।
মুখের কথা শেষ না হতেই খালাম্মা শাহজাহানের দিকে তেড়ে এসে ওর চুলগাছি ধরে দাড়ুম-দুড়ুম করে পিঠের ওপর কিল ঝাড়তে লাগলেন আর বকতে লাগলেন--- বদমাশের হাড্ডি, বদমাশ--- বদমাশ---
কিল-ঘুষি মেরে তৃপ্ত হয়ে ক্লান্ত অবস্থায় খালাম্মা আগের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ান। বলেন, একদম শুয়োরের শরীর। হাতুড়ি-পিটা করলেও গায়ে লাগে না।
শাহজাহান বেহায়ার মত বলতে থাকে, তোকে দেখে তো মানুষ মনে করে তোর বয়স এখনো পনরই হয়নি। পনর বছর বয়সী মেয়ের জন্য ঘটক আসলে কি তাকে দোষ দেয়া যাবে?
অন্তরবাসিনী, উপন্যাস, প্রকাশকাল একুশে বইমেলা ২০০৪
পর্ব-১
পর্ব-২
পর্ব-৩
পর্ব-৪
পর্ব-৫
পর্ব-৬
পর্ব-৭
পর্ব-৮
পর্ব-৯
পর্ব-১০
পর্ব-১১
পর্ব-১২
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৪৬