আমাদের অনেকের মাঝেই প্রশ্ন জাগে বাংলা বর্ণমালায় সমগোত্রীয় বর্ণ কেন??
যেমন;-
ই,ঈ;
উ,ঊ
গ,ঘ
জ,ঝ,য
ড,ঢ
দ,ধ
ন,ণ
ব,ভ
শ,ষ,স
র,ড়,ঢ়
এ বর্ণ গুলোকে কী কমিয়ে একটি বর্ণে রূপান্তর করা যায় না। তবে বর্ণ মালা থেকে কমে যেত ১৩টি বর্ণ।এতে করে বর্ণ সংখ্যা কমবে এবং বানান হবে সহজলব্ধ। দারুন এবং বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তরের আগে জেনে নেই ভাষা কি?
অর্থপূর্ণ ধ্বনির সমষ্টি হল ভাষা। প্রত্যেক স্বার্থক ভাষার দুটি রূপ থাকে এক. কথ্য রূপ দুই লিখিত রূপ। এর মধ্যে লিখিত রূপ সর্বদাই কথ্য রূপকে অনুসরণ করেন।
কথ্য রূপে আমরা যে ধ্বনি উচ্চারণ করি তার লিখিত রূপ হলো বর্ণ।আর বাংলা ভাষায় উপরের আলোচিত ধ্বনি গুলো ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে উচ্চারিত হয় বলেই ঐসকল ধ্বনির ভিন্ন ভিন্ন লিখিত রূপ এসেছে। প্রকৃতপক্ষে এরা সমগোত্রীয় এবং সমোচ্চারিত বর্ণ নয়।
তবুও আমরা অল্প সময়ের জন্য মেনে নেই এরা সমগোত্রীয় বর্ণ এবং এদের পরিবর্তে একটা বর্ণ, মানে একাধিক ধ্বনির লিখিত রূপ, একটা বর্ণের মাধ্যমে লিখব। ফলে আমাদের বানানের ভুলটা কমে যাবে।এবার আমরা যদি জ,ঝ ধ্বনির এর পরিবর্তে কেবল জ লেখি তাহলে কি হবে সেটা দেখা যাক।ধরুন আমি বোঝাতে চাইলাম ঝাল(pungent) কিন্তু সেটা হয়ে গেল জাল(net)।
আবার ধরুন আমরা দ ,ধ ধ্বনির লিখিত রূপ হিসেবে কেবল দ লিখলাম। এবার আমি কথ্যে বোঝাতে চাইলাম ধান কিন্তু লিখলাম দান।
অথবা ব ও ভ এর পরিবর্তে কেবল ব তাহলে কি হবে চলুন দেখি। ধরুন আমি বোঝাতে চাইলাম আমার ভালে(কপালে) এটা নেই। কিন্তু লিখলাম আমার বালে এটা নেই। তাহলে আমি কথ্য রূপে যেটা বোঝাতে চাইলাম লেখ্য রূপে সেটি দৃষ্টি কটু হয়েগেল।এরকম অন্যান্য আপাত দৃষ্টিতে দেখা সমগোত্রীয় ধ্বনিকে নিয়েও বলা যায়।
আপনি যদি একাধিক ধ্বনির জন্য কেবল একটি বর্ণ ব্যবহার করেন তাহলে বাংলা ভাষার কথ্য ও লিখিত রূপের সাথে বিশাল ফারাক হয়ে যাবে। আর যদি এই লিখিত রূপটা কথ্যের উপর চাপিয়ে দেন তবে উচ্চারণের বৈচিত্র্য ও স্বাতন্ত্র্যতার সাথে সাথে বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারেও একটা বড় রকমের গোল বেধে যাবে । কেননা ভাষার কথ্য রূপকেই লেখ্য রূপ অনুসরণ করে। সহজ করে বললে ভাষার কথ্য রূপে পরিবর্তন আসলেই কেবল লেখ্য রূপ সে অনুযায়ি পরিবর্তিত হয়। এ সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরি একটা দারুন কখা বলেছেন,
“ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, উল্টোটা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে।”
মৈথিলী( এক প্রকার কবি ভাষা) ও সংস্কৃত(প্রাকৃত যুগের সমসাময়িক সাহিত্যিক ভাষা যা সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষা ছিল না) ভাষার করুণ পরিণতি এই উক্তির সত্যতার উদাহরণ। এই দুটো ভাষার কেবল লিখিত রূপ ছিল। ফলাফল এরা আজ বিলুপ্ত অথবা প্রায় বিলুপ্ত।
এবার উপরের বর্ণগুলো কেন সমগোত্রীয় এবং সমোচ্চারিত বর্ণ নয় সে সম্পর্কে আলোকপাত করাযাক:-
প্রথমেই দেখব কেন ই ও ঈ দুটি বর্ণ। এ ধ্বনি দুটির উচ্চারণে সময়ের তারতম্য রয়েছে। উচ্চারণের দীর্ঘতা ও হ্রস্বতা বোঝাতে এই ধ্বনি দুটিকে ভিন্ন ভিন্ন রূপদান করা হয়েছে যাতে দুটি ধ্বনির লিখিত রূপ এক না হয়ে যায়( এ কারনেই ই, ঈ , ি, ী )। উ,ঊ এর ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য।
এবার দেখা যাক গ,ঘ কেন দুটো বর্ণ
গ ধ্বনি উচ্চারনের সময় ফুসফুস তাড়িত বাতাসের স্বল্পতা থাকে। এজন্য একে বলা হয় অল্পপ্রাণ ধ্বণি।ঘ ধ্বনি উচ্চারণের সময় ফুসফুস তাড়িত বাতাসের আধিক্যতা থাকে এজন্য একে বলা হয় মহাপ্রাণ ধ্বনি।( লক্ষ্য করে দেখবেন আন্তর্জাতিক ধ্বনি লিপিতেও গ হলো ga ঘ হলো gha) যার বিভিন্নতা ও স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য বোঝাতে গ,ঘ হয়েছে।
এভাবে
জ,ঝ
ঢ,ড
দ,ধ
প,ফ
ব,ভ
প্রভৃতির ক্ষেত্রেও এই একই নিয়ম খাটে।
এবার আসি ন,ণ। এ দুটো বর্ণও উচ্চারণের স্থান অনুযায়ী স্বতন্ত্র্ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কারন দন্তমূল থেকে উচ্চারিত হয় ন আর মূর্ধা থেকে উচ্চারিত হয় ণ। তাই এই দুটির পরিবর্তে কেবল একটা ন ব্যবহার করলে এই স্বাতন্ত্র্যতা ও বৈচিত্র্য থাকবে না। আর উচ্চারণ লাগবে শ্রুতিকটু।
শ,ষ,স- এই তিনটি ধ্বনির উচ্চারনেও রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। শব্দের আদি, মধ্য, অন্ত্যে এ গুলোর ব্যবহারে রয়েছে স্বাতন্ত্র্যতা
র,ড়,ঢ়
র কম্পনজাত ধ্বনি
ড়,ঢ় তাড়নজাত ধ্বনি
ভিন্ন ভিন্ন শব্দে এদের উচ্চারণ কখনই এক নয় ও এক হবারও নয়।এদের কে যদি এক করে ফেলি তবে রেফ এর স্থলে কোন ‘র’ হবে? তাহলে রেফ এর স্থলে কেবল ‘র’ লিখলেইতো চলত! তাহলে যুক্ত বর্ণ লিখতে গেলে সমস্যায় পড়তে হত।
তবে একথা বলতেও আমার কোন আপত্তি নেই যে কিছু ধ্বনির ব্যবহার বাংলা ভাষা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে(যারা দু একটির বেশি নয়)। তাই তাদের লিখিত রূপ (মানে বর্ণমালা থেকে) বাদ দেয়ার সময় হয়তো এসে গেছে।ভাষা বিজ্ঞানীরা এ বিষয়টা নিয়ে ভাবতে পারেন।
আর একটা কথা বাংলা ভাষা নিয়ে শুধু বাংলা একাডেমিই গবেষণা করে না, আন্তর্জাতিক ভাষা বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত গবেষণা করছেন প্রত্যেকটি ভাষা নিয়ে। যেখানে বাংলাধ্বনির জন্য রয়েছে আন্তর্জাতিক ধ্বনি লিপি। যা কেবল ইংরেজির ছাব্বিশটি বর্ণে সীমাবদ্ধ নয়।
আশা করি আপনাদের ধারনাটা পরিষ্কার হয়েছে।
নিবন্ধটি লেখার জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ডঃ এম এ আলীর প্রতি।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১০:২৪