আর মাত্র এক ঘন্টা। অর্থাৎ চারটা বাজতে আর মাত্র এক ঘন্টা বাকি। তারপরই তারা আসাবে। তারা প্রায়ই আসে। তারপর চলে যায়, কিন্তু কিছুই হয় না তাদের। যেভাবে আছে, সেভাবেই থেকে যায় সে। মাঝখান দিয়ে সময়টা এগিয়ে যায়। সে নিজের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে ঘরির দিকে তাকায় সেখানে সেকেন্ডের কাটাটি টিকটিক করে এগিয়ে চলে। সে মনে মনে বলে উঠে, হে সেকেন্ডের কাটা, তোকে কি ভূতে তারা করেছে যে, তুই দৌড়াচ্ছিস। তোর কি একটিবার বিশ্রামের দরকার পড়ে না? একটিবার! অন্তত আজ বিশ্রাম নিয়ে নে। ঘুমিয়ে পড়। ওই ঘন্টার কাটাটিকে কিছুতেই চারের ঘরে আসতে দিস না। লক্ষ্মী ভাইটি আমার! ...কিন্তু সেকেন্ডের যে বড়ই নিষ্ঠুর। সে তার নির্দিষ্ট গতিতে এগিয়ে চলে। টিকটিক ...টিক...টিক।
তার খুব করে ইচ্ছে করে, আজকে তারা না আসতে পারে। পথিমধ্যে তারা যেন কোনো নিকট আত্মীয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পায়। অথবা এক েেত্র আরো নিষ্ঠুর হয়ে সে ভাবে। তাদের যেন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। নয়তো তাদের কেউ যেন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে যাতে তারা এখানে না এসে সরাসরি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়। তাতে হয়তোবা বেশি কিছু হবে না। না হোক, অন্তত আজকের জন্য তো সে বেঁচে যায়! অতন্ত আজকের জন্য তো তাকে আর অপমানিত হতে হয় না! অথচ এ সমাজটা কি না তৈরি হয়েছে তাকে অপমান করার জন্যই। সমাজের ভাগ্য ভাল। তার মতা নেই। মতা থাকলে সে ওই একচোখা সমাজকে ধুমরে-মুচড়ে ফেলতো। কি দরকার এই সমাজের? মানুষ নিজেই কি নিজের জন্য যথেষ্ট নয়? সমাজ তো শুঘু উপদেশ দিতে পারে। এটা করো না, ওটা করো না। এভাবে থেকে, ওভাবে থাকতে নেই। এটা থেকনা। তোমাদের একা থাকতে নেই। ওরা যদি একা থাকতে পারে। সে কেন, বা তারা কেন একা থাকতে পারবে না! হায় ঈশ্বর, তুমি তো সবাইকে সমাজ ভালবাসা। তবে সমাজ কেন ভাসে না! তোমার কাছে তো সব রংই সমান। তবে মানুষের কাছে কেন নয়। আর তুমি রং যতই সৃষ্টি করলেই তবে সবাইকে এক রঙের অধিকারী করলে না কেন? তবে কি তোমার মধ্যেও এ সমাজের ছায়া আছে?
সে আবারও তার নিজের দিকে তাকায়। ভাল করে নিজেরকে পর্যবেণ করে। এভাবে আস্তা খুঁজে পেতে চায়। পায় না। অথচ আজ কি না সে বিউটি পার্লার থেকে নিজেকে সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। সেই ছোট বেলা থেকেই বিউটি পার্লারে যাওয়ার শখ তার। কিন্তু অতটা টাকা খরচ করে বাবাকে মাসের শেষে অর্থকষ্টে ফেলতে চাইনি বলেই তার সে ইচ্ছে এতদিন পূরণ হয়নি। আর আজ কি না বাবা নিজেরই এসে বিউটি পার্লারে যাওয়ার কথা বললেন! কি লজ্জা! কি লজ্জা!!
বাবাও নিশ্চয়ই লজ্জাবোধ করেছিলেন। তিনি কথাটি বলেছিলেন মাটির দিকে তাকিয়ে। সত্যি এরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়ার আগে মৃত্যু হলেই সে বেঁচে যেত! সে তখন বলতে চেয়েছিল, বাবা, তুমি আমাকে জন্মদিলে কেন? কি দরকার ছিল অহেতুক নিজের জ্বালা বাঁড়ানোর? তোমরা দু’জন কি কোনো মতে জীবনটা চালিয়ে নিতে পারতে না? জীবনে বেঁচে থাকার জন্য সন্তান কি খুব প্রয়োজন? সন্তানহীন কেউ কি বেঁচে নেই এ জগতে? আজ জন্ম দিলেই যখন, আমার গায়ের রং দেখার পর আমাকে উঁচু পাহাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে না কেন? এক সময় ঘন্টার কাঁটাটি চারের ঘর অতিক্রম করলো। আরো পরে যখন ঘণ্টার কাঁটাটি পাঁচ ছুঁই ছুঁই করছিল তখন আমাদের গল্পের প্রধান চরিত্র সাদিয়ার মনে হলো, আজ বোধ হয় ঈশ্বর তাকে কৃপা করলেন। আজ বোধ হয় তারা আসবে না। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস পেল।... কিন্তু না। আমাদের ঈশ্বর এতটা দয়ালু নয়। তিনি ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করে তাদের আসার সময়টাকেই কেবল দীর্ঘায়িত করেছিলেন। তাদের কোনো দুর্ঘটনার কবলে ফেলেননি। তাই যখন সাদিয়া তার পরনের যৎসামান্য গয়নাগাটি খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো এবং পূর্বপরিকল্পনা মাফিক, বরাবরের মতো, সে দরজার দিকে ধীর কম্পিত পায়ে এগুতে লাগলো।...
ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।