উইলিয়াম কেরীও যে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত জননীর সন্তান বলে বিবেচনা করতেন এ বিষযে কোনো সন্দেহ নেই এবং সেই মোতাবেকই তিনি সংস্কৃতকে বাংলা ভাষার ভিত্তি হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে হ্যালহেড ও ফরস্টারের মতো ভাষাতত্ত্বে পাণ্ডিত্য দেখানোর খায়েস নিয়ে কেরী বাংলা লিখতে শুরু করেন নি। তারও ছিল সাম্রাজ্যবাদী বদ মানসিকতা এবং তা প্রথাগত মিশনারীদেরই বেশি মানায়। তিনি চেয়েছিলেন বাইবেলের বাণীকে সাধারণ মানুষের কাছে অধিকতর সহজ করে প্রচার করতে। এই ভদ্রলোকই এক সময় স্বীকার করতেন আরবী-ফারসী শব্দ বাংলাভাষার শুদ্ধতাকে নষ্ট করেনি বরং সমৃদ্ধ করেছে। যদিও পরবর্তীতে তার সেই বক্তব্য থেকে তিনি সরে যান এবং সংস্কৃতের সাথে বাংলার ঘনিষ্টতার প্রমাণের জন্য বাদবাকিদের মতো মাঠে নেমে পড়েন।
আরেকটা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ভুল অনুমানকে ফরহাদ মজহার আরেকটি ভুল অনুমান দিয়ে খারিজ করতে চেয়েছেন। সেটা বোধকরি কলকাতার ভাষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য। রবীন্দ্রনাথ কলকাতা অঞ্চলের উচ্চারণকে বাংলা ভাষার আদর্শ বলে ধরে নিয়ে ভুল করেছিলেন। এ বিষয়ে তার যুক্তি কলকাতা সমস্তবঙ্গভুমির রাজধানী! রবীন্দ্রনাথের এই ভুল অনুমানকে খারিজ করতে যেয়ে ফরহাদ মজহার জানাচ্ছেন সাহেবদের রাজধানী হয়ে উঠার কারণে কলকাতা শিল্প ও সংস্কৃতিরর রাজধানী হয়ে উঠবে এ বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই। এটিকে তিনি একটি ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা হিসেবে দেখতে চান। উপরন্তু তার ধারণা সাহেবরা যদি সিলেট বা চট্টগ্রামকে তাদের রাজধানী বানাত সেেেত্র এসব অঞ্চলের প্রচলিত ভাষাই হয়ে উঠত বাংলা ভাষার সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা! ‘কলকাতা সমস্ত বঙ্গভূমির সংপ্তি সার’- রবীন্দ্রনাথের এমন বক্তব্যকে যদি রগচটা কলকাতাইয়্যা মাস্তানের হুংকার মনে হয় সেেেত্র সাহেবদের বিচরনের কেন্দ্র হওয়ার কারণে কলকাতা শিল্প ও সংস্কৃতির কেন্দ্রভুমি হয়ে উঠবে এমনতর ভুল ধারণা করার ফাঁদে ফরহাদ মজহারও আটকে যান। কলকাতা শুধুমাত্র ইংরেজ সাহেবদের রাজধানী হবার কারণে দনি বাংলার এ ভাষাটি যদি ভদ্র ঘরের ভাষা হয়ে উঠে বলে তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো ধরে নেন সেক্ষেত্রে ঠাকুরের সাথে তার তর্কে খানিকটা স্পেস সংকট তৈরী হয়। নতুন একটা কিছু তার বক্তব্যে যোগ হয়েছে বটে। সাহেবদের রাজধানী হবার কারণেই ঠিক নয়, সেই সাথে যুক্ত ছিল কলকাতার দ্রুত নগরায়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রভূমি হয়ে ওঠাও। এটাও তিনি ধরে নিচ্ছেন যে কলকাতায় জমে উঠা ভাষাটি ঠিক কলকাতার ভাষাও নয়। নানান কাজে জড়ো হওয়া সকল প্রদেশ থেকে আসা নানান রকম মানুষে ভারি হয়ে ওঠা কলকাতার এক অভিন্ন ভাষা। অর্থাৎ কলকাতার ভাষাটি শুধুমাত্র কলকাতার মানুষের ভাষা নয়। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের যৌথ ভাষা। মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক ভাষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও ফরহাদ মজহার দুজনেই ভুল অনুমান করেছেন। আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার উপযোগিতার বিষয়ে ইংরেজ শাসকদের মধ্যে প্রথম দিকে কোনো সংশয় ছিল না এ কথা ঠিক। তবে বাংলা ভাষার প্রতি আলগা কোনো প্রীতি ইংরেজ শাসকদের ছিল না। কোম্পানীর মূল ল্য ছিল ফারসি ভাষার বিকল্প হিসেবে বাংলা ভাষাকে দাঁড় করানো। তাদের ধারণা ছিল প্রশাসনিক কাজকর্ম চালানোর উপযোগী ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে তৈরী করা গেলে মুসলিম শাসকশ্রেণীর ভাষা ফারসির আধিপত্যকে রুখে দেয়া সম্ভব হবে। মুসলিম শাসনামলের রাজভাষা ফারসির প্রতি ইংরেজ শাসকদের খানিকটা বিদ্বেষই ছিল। ক্রমাগত এ ভাষার ব্যবহার সংকোচনের মাধ্যমে ফারসি ভাষাকে অকেজো করে ফেলা ছিল তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। শাসনকার্য চালানোর জন্য যেটুকু ফারসির দরকার তার বাইরে এ ভাষার ব্যবহার রুখে দেয়াই ছিল তাদের গোড়ার কাজ। ইংরেজি পত্রিকায় বাংলা বিজ্ঞাপন প্রকাশের মতো ঘটনা উদাহরণ হয়ে না থেকে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল সে সময়। অনেকসময় দেশীয় ভাষায় বিজ্ঞাপন প্রকাশের রীতি মানতে গিয়ে বাংলা হরফে লেখা ইংরেজি বিজ্ঞাপনও প্রকাশ করা হতো! এটাও সত্য যে সেকালে যারা ইংরেজি পত্রিকা নাড়াচাড়া করতেন তাদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যা ছিল নেহায়েৎ হাতেগোনা কয়েকজন।
সমাজবিজ্ঞানী বিনয় ঘোষের একটা লাইন উদ্ধৃতি করা যাক:
... কলকাতা শহরকে নতুন রাজধানী করার পরিকল্পনা করে ওয়ারেন হেস্টিংস কোম্পানির ডিরেক্টরদের কাছে যে পত্র লিখেন তাতে বলেন যে কলকাতা রাজধানী হলে অনেক দিক থেকে সূফল ফলার সম্ভাবনা আছে। ... (কলকাতার মন)
বুঝা যায় কলকাতা শহরকে শিল্প ও সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি হিসেবে নিয়ে আসার পরিকল্পনাটা আসে মূলত ওয়ারেন হেস্টিংস এর কাছ থেকে এবং এই বিষয়ে তিনি কোম্পানির ডিরেক্টরদের কাছে পত্রও লিখেছিলেন। তাতে উল্লেখ ছিল কলকাতা যদি রাজধানী হয় সেেেত্র অনেকদিক থেকে সুফল ফলার সম্ভাবনা আছে। কলকাতা রাজনীতির রাজধানী হয়ে ওঠে মূলত হেস্টিংস এর আমল থেকে। এই হেস্টিংস এর পৃষ্ঠপোষকতাতেই কিন্তু উইলিয়াম জোনস- হ্যালহেডরা সে সময় দেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চায় তথা ইংরেজদের প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার হাওয়াটা বইয়ে দিচ্ছিল। সে সময় অফিস-আদালত সবকিছু ধীরে ধীরে কলকাতায় স্থাপিত হতে থাকল এবং বৃটিশ আইন অনুযায়ী বিচার ব্যবস্থাও আরম্ভ হল। আদালতের কাজে ইংরেজী ভাষা ব্যবহার হলেও ইংরেজী ভাষা চর্চার বিষয়ে ইংরেজদের খুব একটা শুচিবায়ু ছিল না। কাজ চলতে পারা ইংরেজী জানা থাকলেই চলত। বরং হেস্টিংস এর সময়ে এদেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতির উপরই জোর ছিল আপাত বেশি। যদিও এর উদ্দেশ্য পরে আর মহৎ থাকে নি।
সে যাই হোক এটা খুব স্পষ্ট যে মুসলমান শাসনামলের রাজভাষা ফারসিকে সরাতেই তারা কলকাতাকে শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। মূলত সে কারণেই সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলা ভাষা সাহেবদের কাছে এতটা কদর পেয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তাদের সে ল্য পূরণ করা সম্ভব হয়নি। তার অন্যতম কারণ কলকাতা ছাড়াও কোম্পানি উত্তর ও দণি ভারতের বিরাট অংশের অধিকার নিজেদের হাতে নিয়ে আসে। ফলে বাংলা ভাষা পুরো অঞ্চলের সার্বজনীন ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা তাদের পে সম্ভব ছিল না। সম্ভবত প্রয়োজনও ছিল না। মূলত এখানেই বাংলা ভাষার উপর তাদের সর্ব প্রকার দরদ ও মায়া উবে যাওয়ার কথা। দেখা যাচ্ছে একটা ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলা ভাষাকে ইংরেজরা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল এবং তার একটা সুদূর প্রসারী ল্য তাদের ছিল। তাদের সে ল্য পুরণ হয়েছিল কিনা ঐতিহাসিকরা ভাল বুঝবেন। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় অমসৃণ বিকাশের পরও শেষপর্যন্ত বাংলা ভাষায় নতুন স্রোত যেটা সাহেবরা দিয়েছিলেন তাতে বাংলা ভাষায় যে গতি সঞ্চার হয়েছিল তার বেগ পূর্বেকার কয়েক শতাব্দীর বাংলা গদ্যের বিকাশের চেয়ে অনেক বেশি বেগবান ছিল। ইংরেজদের কাছ থেকে প্রাপ্ত উপকরণ যা বাংলাভাষা পেয়েছিল তার অবদানও সামান্য নয়। ছাপাখানা স্থাপন সহ বাংলা ব্যাকরণ প্রণয়ন, বিভিন্ন রকম আইনের অনুবাদ এবং স্কুল-কলেজ স্থাপনের মাধ্যমে বাংলা ভাষা চর্চার এক শক্ত ভিত্তি তাদের মাধ্যমে রচিত হয়েছিল। গবেষক গোলাম মুরশিদের ভাষায় ইংরেজ রাজত্ব স্থাপনের এক শতাব্দীর মধ্যে অনুকূল পরিবেশ বাংলা গদ্য যে পরিনতি লাভ করে পূর্ববর্তী কয়েক শতাব্দীতে তার এক শতাংশও ল্য করা যায় না। এই গবেষকের কথায় যদিও কিছু বাড়তি শব্দের যোগ আছে তবু এ থেকে বাংলা ভাষার উপর ইংরেজদের প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতার অবদান কিছুটা বোঝা যায়।