১
" মানুষ বা যুক্তিবাদী জীব - কিছুটা অহমিকার সাথে নিজেকে যে নামেই অভিহিত করুক না কেন , সে যেমন মর্তলোকের প্রানীসমূহের মধ্যে গুরত্বপূর্ণ তেমনি আবার বিরক্তিকরও বটে।"
এ লাইনটা পড়েই বইটা বন্ধ করল হাসান। সময় নিয়ে পড়তে হবে। রাসেল দিয়ে গেছে। না পড়ে উপায় নেই। তার চেয়ে বরং ছড়া লেখা যাক। হাসান গোটা গোটা অক্ষরে লিখল -
হায়েনা হাসি
"আবার এসেছে নির্বাচন , আবার এসেছে ভোট।
আবার তারা বলছে হেসে আমরা করেছি জোট।
হায়েনার হাসি শুনেছ তোমরা শুধু গল্পের বই-এ
এবার দেখবে তোমরা তা তোমাদের দ্বারে দ্বারে।"
এখানে থামতে হয়্। অনেকক্ষন ধরে কে যেন কলিং বেল টিপছে। বাসায় কেউ নেই। সবাই বিয়ে খেতে গেছে। এই সব অনুষ্ঠান হাসানের কাছে কেমন যেন লাগে। নিজেকে বোকা বোকা মনে হয়। অনর্থক আলোচনাতে বেশিক্ষন থাকতে পারে না। কথার খেই হারিয়ে ফেলে। অল্পতে মাথা গরম হয়। তাই পারত পক্ষে এড়িয়ে চলে। আজ হাসানের চাচাতো ভাইয়ের শালি'র বিয়ে। অনেক দূরের নিকট আত্বীয়। না গেলেও চলে। রুমি তার মেয়েকে নিয়ে ছুটেছে। অনেক্ষন ধরে কলিং বেল বাজছে। বাজুক। হাসান আবার লিখতে শুরু করল। আগেরটা শেষ করার আগেই নতুন একটা থিম মাথায় এসেছে। গোটা গোটা অক্ষরে আবার লিখল
ভাঙা মিস্ত্রি
"হাত গুলো তার শক্ত বেজায় - হাতুরি পিটিয়ে খাই
রাস্তার ধারে তিন দিন বসে একদিন কাজ পাই।
ভাঙলে দেয়াল ভা্ঙলে পিলার একশ টাকা রোজ
ভাঙবে কে সমাজ টা তার কেউ জানে না খোজঁ ?"
যে এসেছে সে বোধহয় না খুলিয়ে ছাড়বে না। অগত্যা উঠতেই হল। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলেই দেখে আনোয়ার এর মা। কাদোঁ কাদোঁ মুখ করে দাড়িয়ে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। কান্নার ফাকেঁ ফাকেঁ ঘটনার সারমর্ম যা বোঝা গেল আনোয়ারের বাপকে আবার পুলিশে ধরেছে। ৬০০ টাকা না হলে ছাড়ানো যাবে না। আর এখনি যদি না ছাড়াই তবে কোর্টে চালান করে দেবে। তখন মহা ঝামেলা। বেশি কথা না বাড়িয়ে ৬০০ টাকা দিয়ে দরজা বন্ধ করল। মেজাজ খারাপের সময় এক কাপ চা খেতে হয়। কিন্তু এখন চা বানানো যাবে না। রুমি রান্না ঘরে তালা মেরে গেছে। রুমি'র এই এক আজব অভ্যাস। বাইরে বের হলে রান্না ঘরে তালা মারবে। তার ধারনা হাসান কিছু একটা করে গ্যাসের চুলো নিভাতে ভুলে যাবে। আর বিরাটা এক্সিডেন্ট ঘটবে। যদিও এরকম কখনো ঘটেনি। হাসানের ভুলো মন বলতে শুধু সে তার চশমাটা খুলে রেখে আসে যেখানে সেখানে। প্রায়ই হারাতে হয়। আগেরটার সাথে শত চেষ্টা করেও জুতসই লাইন মিলানো গেল না। অগ্যতা আবার নতুন করে লিখল-
রিকশাওয়ালা
"চুলে তার পাক ধরেছে অনেক আগে
মানুষ হয়ে মানুষ টানে দিনে রাতে।
চল্লিশ জমা দিলে চল্লিশ থাকে
সমাজ ভাঙার সপ্ন দেখে প্রতি রাতে।"
এবারো একই সমস্যা। কিছুতেই চার লাইনের বেশি লেখা সম্ভব হচ্ছে না। এরকম তো হবার কথা না। হাসানের মাথায় ছন্দ সবসময় ঘোরে। ছড়া লিখাই তার কাজ। হিসাব করলে তার ছড়ার সংখ্যা হাজার পাচেঁক এর কম হবে না। বাজারে তার ১০৩ টি ছড়ার বই আছে। বেশিরভাগই বাচ্চাদের। তবে এখন বড়রারাও ছড়া গিলছে। গত বই মেলায় হাসানের এস.এম.এস ছড়া নামের একটা বই বেরিয়েছিল। রেকর্ড সংখ্যক বিক্রি। হাসানের মাথায় আবার নতুন প্লট এসেছে। এবার সে লিখবেই। গোটা গোটা অক্ষরে আবার লিখল
পোষাক শিল্পী
"বিয়ে তার হয়েছে নতুন পোষাক শিল্পে কাজ
আঠারো ঘন্টা পরিশ্রমে দুজনের মিলে ষাট।
ক্লান- দেহে হয় না সংগম প্রতি দিনই কাজ
ভাবে শূধু সমাজটাকে ভাঙবে কে আজ?"
আজকে তার কি হয়েছে। চার লাইনের ছড়া তার পিছ ছাড়ছে না। অথচ তাকে আজ রাতেই একটা ছড়া লিখে শেষ করতে হবে। সকালে রাসেল আসবে নিতে। রাসেল'রা নতুন একটা পত্রিকা বের করবে। সমাজ পরিবর্তনের চিন্তাধারার পত্রিকা। এই ধরনের লেখা হাসান প্রথম যৌবনে অনেক লিখেছে। এখন কম লেখে। তার বেশিরভাগ ছড়া ফুল-পাখি-প্রজাপতি-ভালবাসা এসব নিয়ে। যেটা মার্কেট এ চলে। আবার কলম নিয়ে বসল। এবার লিখল-
কুড়োনি
"সাড়ে তিন টাকা এক কেজিতে কাগজ কুড়িয়ে পাই
পাল্লার ফাদেঁ তিন ভাই বোনে ছ’কেজি কুড়ানো যাই।
কুড়িয়ে পাওয়া খাবারের ঝগড়া কুকুরের সাথে রোজ
ভাঙবে কে সমাজ টা রাখে না তার খোজঁ ?"
হাসানের দ্বারা বোধহয় হবে না। এখানেই ইস্তফা দিল। রাসেল আসলে এই ছড়া গুলোই হাতে ধরিয়ে দেবে। তাতে যা ভাবে ভাবুক। দরজা খুলে বাইরে বেড়লো। এক কাপ চা খাওয়া দরকার। লাল্টুর দোকান এর দিকে পা বাড়ায় হাসান।
২
হাসানের বাবা আলকাছ চেয়্যারম্যান। ”এ সমাজে যারা খাটে তারা কিছু অর্জন করে না। আর যারা সব কিছু পাই তাদের খাটতে হয় না” - কথাগুলো আলকাছ চেয়্যারম্যান এর বেলায় একে বারেই সত্যি নয়। আলকাছ চেয়্যারম্যান এর পিতৃ প্রদত্ত নাম ছিল আক্কাস। সে খান থেকে কবে কখন আলকাছ হয়ে গেল তা কেউ জানে না। আজ প্রায় ১২ বছর হল হরিণপাতা ইউনিয়নের চেয়্যারম্যান আলকাছ চেয়্যারম্যান। এ ইউনিয়নের এক রকম রাজা তিনি। না চাইতেই সব পান। কিন্তু এই ৫৮ বছর বয়সে এসেও তার পরিশ্রমের শেষ নেই। অত্যাচারী এবং অত্যাচারীত শ্রেণী সর্বদাই পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে থেকেছে। অবিরাম লড়াই চালিয়েছে ক্খনও প্রকাশ্যে কখনো বা আড়ালে। আমাদের আলকাছ চেয়্যারম্যান এক সময় অত্যাচারীত দের দলেই ছিল। তবে সে মুক্তিযুদ্ধের আগের কথা মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশ কিছু ঘটনা চক্রে তার হাতে প্রচুর সম্পত্তি এসে পড়ে। বুদ্ধিমান লোক সুযোগ হাত ছাড়া করে না। আলকাছ সাহেব ও হঠ্যাৎ করে নিজের সত্তাকে বিকিয়ে দিয়ে ধনীদের কাতারে নাম লিখিয়ে ফেলেন। তার পর সেই ধন আগলে রাখা আর তা বাড়ানোর কলা কৌশল এক সময়ের ভূমিহীন কে আজকের আলকাছ চেয়্যারম্যান এ পরিণত করেছে। আলকাছ সাহেবের এক ছেলে । আজকের সমাজ পরিবার প্রথা থেকে তার ভাবালু ঘোমটা টাকে ছিড়ে ফেলে পারিবারিক সম্বন্ধকে নিছক আর্থিক সর্ম্পকে পরিণত করেছে। আলকাছ সাহেবের বেলায়ও তাই। তার সন্তান তার কাছে থাকে না। তার চার বউ এর তিন জন ইতিমধ্যে গত হয়েছেন। ছোট বউকে নিয়ে তার বর্তমান সংসার। আর কাছের মানুষ বলে তার এক ছোট ফুফাতো ভাই। যে ছায়ার মত আগলে রাখে তাকে। চেয়্যারম্যান সাহেবের সকল সুকীর্তি-কুকীর্তির স্াথী। ইউনিয়নে তার ও তার ছেলেদের দাপটও কম নয়। কোন শ্রেণীর উপর অত্যাচার বজায় রাখতে হলে তার জন্য এমন একটা অবস্থা নিশ্চিত করতে হয় যাতে তার দাসোচিত অসিত্মত্ব টুকু অন্তত চালিয়ে যেতে পারে। হরিণপাতা ইউনিয়নে সে রকম একটা অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছে আলকাছ চেয়্যারম্যান। ইউনিয়নের অর্ধেকের বেশী জমি তার। উনি নিজেও জানেন না ওনার কত জমি। কিন্তু ভিতরের খবর হল তার সবচেয়ে কাছের লোক ফুফাতো ভাই মিজান মিঞা প্রায় সব জমিই নিজের নামে করে ফেলেছে। তবে খুব সাবধানে আর কৌশলে। আলকাছ চেয়্যারম্যান বেচেঁ থাকলে তার পক্ষ এ সমপত্তি কোন দিন ভোগ করার সুযোগ নেই। আজ তার আশা পূরণ হতে চলেছে। আলকাছ চেয়্যারম্যান মৃত্যূ শয্যায়। ছেলে হাসানের সাথে তার সম্ম্পর্ক ভাল না। যদিও গত মাসে একবার এসে দেখে গেছে। বাবা'র নীতির সাথে হাসনের বনিবনা হয় না। তাই পারতপক্ষে দূরে দূরেই থাকে। মিজান মিঞার দেরী সহ্য হচ্ছে না। আলকাছ চেয়্যারম্যানের যেন কই মাছের জান। এই যায় যায় তো আবার ফিরে আসে। ধর্য্যর বাধঁ ভেঙ্গে মানুষ অমানুষ হয়ে যায়। মিজান মিঞা ভেবে চিনেত্ম ঠিক করেছে আজ রাতে সে আলকাছ চেয়্যারম্যান কে মেরে ফেলবে। কি ভাবে মারবে তাও ঠিক করা। তার কাছে মানুষ মারা নতুন কিছু না। আলকাছ চেয়্যারম্যান এর কথায় কম মেয়েকে এ ইউনিয়নে সে বিধবা করেনি। তবে কোথায় যেন একটা সাহসের অভাব। মনের কোন অংশ যেন সায় দিচ্ছে না। একদিন এই আলকাছ চেয়্যারম্যান তাকে প্রায় শূণ্য থেকে তুলে এনে আশ্রয় দিয়েছিল। প্রতিটি মানুষের ভিতর দুটো সত্তা থাকে। একটি মানুষ সত্তা আর একটি অমানুষ সত্তা। শেষ পরযন্ত অমানুষ সত্তার ই জয় হল। এই ঘরে এখন কেউ নেই। বিছানায় আলকাছ চেয়্যারম্যান ঘুমিয়ে আছে। পাশে বসে আছে মিজান মিঞা। স্বিধান্তহীনতায় ভুগছে। হাতের কাছেই বালিশ। মুখে চেপে ধরলেই সব সমস্যা মিটে যায়। মিজান মিঞা বালিশ হাতে নিল। এই প্রথম তার হাত কাপঁছে মানুষ মারতে গিয়ে। অজানা আশঙ্কায়। অমানুষ সত্তাটা যদিও জেগে উঠেছে। ঠিক এ সময় হঠ্যাৎ বিদ্যূৎ চলে গেল। সমস্ত ঘর অন্ধকার। মানুষের মানুষ হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান এই অন্ধকারের। অন্ধকারকে জয় করতে গিয়েই আজকের মানব সভত্যা। আবার এই অন্ধাকারের মানুষ হয়ে যাই অমানুষ।
এদিকে রাত ২টা বাজে। রুমি'রা আজ ফিরবে না। হাসানের চোখে ঘুম নেই। রাসেল এর জন্য ছড়া লেখা শেষ হয়েছে। হাসান বারান্দায় এসে দাড়াল। আকাশে আজ চাদঁ ওঠেনি।
৩
দেশ ভাগের পর ভারত থেকে এসে দাদা বরদাকান্তের রাজবাড়ীটা কিনে ছিলেন। রুমি'র তখন জন্ম হয়নি। ভারতে থাকার স্মৃতিও নেই। ছোটবেলা - বড় বেলা সব এই বরদাকান্তের রাজবাড়ী ঘিরেই। মোটামুটি বিঘে পাঁচেক জমির উপর বাড়ী। বেশ পুরনো। আদি বাড়িটা ধ্বংস হয়ে গেছে। ওরা যেখানে আছে এটা নাকি রাজার কাচাঁরি ঘর ছিল। আগে যারা এখানে ছিল তারা বোধহয় সংস্কার করেছে। বাড়ির পাশে বিশাল পুকুর। বাধাঁনো ঘাট এখনও অক্ষত। আর এমন কোন গাছ নেই যে নেই। সকাল বেলায় উঠে আমড়া গাছে কাছে গিয়ে প্রথম ঢিলটা মারতেই তবারক মিঞা ছুটে আসল -
: আম্মাজান ওরা আসতেছে। পালান।
এই কথা বলে সোজা বাড়ীর ভিতর ধুকে পড়ল। ঘটনার আক্মসিকতায় কিছুটা হতচকিত রুমি। ঘরে ঢুকে দেখে সবার আতংকগ্রস্ত চোখ। মা' দরজা বন্ধ করল। বাবা তবারক মিঞা জিজ্ঞাসা করছে
: কে নিয়ে আসছে।
: সামসু মুন্সি। তারে সাথে দেখছি। আপনি পালান।
খালু ভয় পেয়েছে সবচেয়ে বেশী। ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠল
: কোথায় পালাবে
: জংলার দিকে যান।
: ছেলে দুটোকে যুদ্ধে পাঠানোর দরকার কি ছিল
: আহ! ও প্রসংগ এখন থাক।
: থাকবে কেন। এখন মরার জন্য অপেক্ষা করব।
: রেনু তুমি মেয়ে আর বাচ্চাগুলোকে নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে জংলার দিকে যাও।
: জংলার দিকে সাপ আছে।
: গাধাঁর মত কথা বলছ কেন?
: দুলাভাই, আমরা কোনদিকে যাব।
: তুমিও যাও ওদের সাথে। সবাই যাও।
: আপনি যাবেন না।
: না।
: আপনাকে যাইতে হইব।
: আমার জন্য ওরা আসছে। আমাকে পেলে ওরা আর জংলার দিকে যাবে না। আমার জন্য সবাই বেঘরে প্রান হারানোর দরকার নেই।
এ সময় কান্নার রোল উঠল। মা আর কাশেমের মা এক সাথে কাদঁছে।আমার চোখ বেয়েও পানি পড়তে শুরু করেছে। বাবার হাত চলে যায় মা'র মাথায়।
কিছুক্ষনের মধ্যে রাজাকাররা বাড়িটা ঘিরে ফেলল। দূর থেকে সবই দেখা যাচ্ছে। বাবাকে একজন লাথথি মারতে মারতে পুকুর ঘাটে নিয়ে আসছে। ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে ততক্ষনে। তাই নিয়ে বেশ উত্তেজনা। চোখের সামনে পুড়ছে বাড়ী। যার অনেক স্মৃতি এখন চোখের সামনে আসছে না। ঠিক এসময় দুটো গুলির শব্দ। পুকুর ঘাটের পশ্চিম পাশে তবারক মিঞা আমাদের দোনালা বন্দুক হাতে। একটা লোক সাথে সাথে শুয়ে পড়ল। সবাই মূহর্তে পজিশন নিয়ে ফেলেছে। মিনিট দুই যুদ্ধ চলল। এক সময় বাবা আর তবারক মিঞা পাশাপাশি। কিন্তু ধারণার বাইরে কাজটা ঘটল তখন। বাবা আর তবারক মিঞা কে জবাই করা হচ্ছে। জ্যান্ত জবাই। মা মুর্চ্ছা গেছে অনেক আগেই। কাশেমের মা প্রানপনে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত। কিন্তু দৃশ্যটা মনে সেই থেকে আজ অবধি গেথে গেছে। বাবাকে পুকুর ঘাটে তিন জন ফেলিয়ে জোরে চেপে ধরেছে। সামসু মুন্সি গলায় ছুরি চালাচ্ছে। রক্ত আর রক্ত। চরম ভীতু খালু দৌড় দিয়ে সামসু মুন্সিকে এক লাথি মারল। কে যেন পিছন দিয়ে বন্দুকের বাট দিয়ে খালুর মাথায় মারল। তারপর সেই একই কায়দায় খালুকেও বলি দেওয়া হল। বমি করে ফেলেছে রুমা কখন ঠিক মনে নেই। তবে পুরো দৃশ্যটাই দেখছে। মা'র মত মুর্চ্ছা জায়নি। ঘন্টা দুয়েক পরে ওরা চলে গেল। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে রুমি'রা বসে আছি জংলার ধারে। কুয়াশা আর রাতের ভয়ংকর নিস্তব্দতা ছেকে ধরেছে।
মা'র জ্ঞার ফিরেছে। একটা বাড়িতে আশ্রয় পাওয়া গেল। আশ্চার্য এই বাড়ির কাউকে রুমা বা তার মা... কেউই চিনি না। কাশেমের মা নিয়ে এসেছে। এত অচেনা তবু কি যে আদর করে যে থাকতে দিলেন। কাশেমের মামা হন তিনি। রেলের কুলি। কাশেমের মা'র কাছ থেকে সব শুনে বললেন....
: গরীবের ঘরে কোথায় থাকতে দি'। হাসেম সাহেবরে এমনে মাইরা ফেলছে। হারামজাদার দোজখেও তো জায়গা পাইবো না। আল্লাহগো আর কি দেখাইবা তুমি।
এ সব শোনার ধর্য্য তখন রুমি আর তার মা'র নেই। মা এ নিয়ে তিনবার অজ্ঞান হয়েছে। রুমি শুধু তখনো চোখের পানি ফেলিনি। এত দ্রুত এত কিছু ঘটে গেল ঠিক তাল মেলাতে পারছে না। তবে শত চেষ্টা করেও গা'র কাপনি থামাতে পারছে না।
ভাবছে। আর অবাক হচ্ছে। এত শক্ত করে বিধাতা কিভাবে গড়েছেন ।
এক ঘরেই গাদাগাদি করে ওরা ৯ জন। কেউ ঘুমানোর চেষ্টা করছে না। ঝিঝি পোকার শব্দ ছাপিয়ে মা'র ডুকরে ডুকরে কান্নার শব্দ কেমন জানি বেমানান লাগছে। আশেপাশে বোধহয় কোথাও শিউলী গাছ আছে। গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাবার লাশ তখনও বোধহয় পড়ে আছে পুকুর ঘাটে। যতবারই মনে হচ্ছে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠছে। কেন বাবাঁকে বাচাঁতে ছুটে গেলাম না। ছেলে হলে কি ছুটে যেতাম। ঘুমে দু-চোখ জড়িয়ে আসছে।
রুমি বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। রাত বেশি হয়ে গিয়েছিল। বাসায় যাওয়া হয় নি। কমিউনিটি সেন্টার থেকে সোজা পুষ্পদের বাসায়। বিয়েতে অনেক মজা হয়েছে। তবে হঠ্যাৎ সামসু মুন্সিকে বিয়েতে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে রুমি। এ চেহারা ভোলার না। উনি নাকি কনে'র আত্বীয়। চোখের সামনে সমস্ত স্মৃতি জ্বলজ্বল করে উঠছে। কিন্তু কিছুই করা হয়ে উঠল না। কি সুন্দর রসিয়ে রসিয়ে গল্প করে গেল। কাউকে বলতেও পারল না রুমি। পাছে বিয়ে বাড়ীর আনন্দ ম্লান হয়ে যায়। তবে একবার যখন খোজঁ পাওয়া গেছে শেষ দেখে ছাড়বে রুমি। অনেক দিনের সুপ্ত বাসনা জাগ্রত হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কি আসলেই হবে? হাসানকে নিয়ে চেষ্টা করতে হবে। কিছুতেই ছাড়বে না। কখনোই না।
৪
রুমি ভাবীকে এখানে দেখে প্রচন্ড অবাক রাসেল। পুষ্প হাসান ভাইয়ের চাচতো ভাইয়ের শালি। এই তথ্যটা জানা ছিল না। জানা থাকলে কি ঘটনাটা অন্যরকম ঘটতে পারত। পুষ্প চলে যাচ্ছে জীবন থেকে। বিয়ের দিন শত ব্যস্ততার মধ্যে রাসেল এর দিকে একবার কেবল তাকিয়ে ছিল । সেই চোখের চাহনির মানে বোঝার মত অবস্থা তখন তার নেই। বিয়ে বাড়ীতে কেন এল । খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল পুষ্পকে। বিয়ে সাজে কেমন লাগে ওকে। তাই আগ-পিছ চিন্তা না করেই সোজা কমিউনিটি সেন্টারে। কোন গিফট নেওয়ার কথা মনে ছিল না। সামনের সাড়িতে গিফটের পাহাড় দেখে মনে পড়ল। রিমির ভাই এর রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে সোজা ঢুকে পড়েছে পুষ্প যেখানে বসে আছে। জনা কয়েক সখির সাথে চোখাচোখিও হয়ে গেল। যেন ভয়ঙ্কর দুঃচিন্তায় পড়ে গেছে চোখগুলো। কানিজ হাত ধরে কমিউনিটি সেন্টারের এক পাশে নিয়ে আসল ওকে।
: আপনার এখানে না আসলে কি চলত না?
: জানি নি
: আচ্ছা ঠিক আছে। আমি সব সামলে নেব। আপনি চলে যান।
: এখনই
: হ্যা এখনই।
: ওর সাথে একটা কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
: কোন কথা হবে না। আপনি ওকে ভালবাসেন না। আপনি চান আপনার কারনে ও যে জীবন শুরু করতে চাচ্ছে সেখানে কষ্ট পাক।
: বাহ! ভালই তো বললে।তোমার বান্ধবীর জীবনটা জীবন আমারটা কিছু না।
: রাসেল ভাই। আপনার সাথে তর্ক করতে ইচ্ছা করছে না। প্লিজ আপনার পায়ে ধরি। আপনি চলে যান। প্লিজ........
রাসেল আর কথা বাড়াই না। মোবাইলে ওর একটা ছবি তুলতে চেয়েছিল তাও আর হয়ে ওঠে না।
গেটের বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে ওমনি রুমি ভাবী বলে উঠল
: এই রাসেল এদিকে একটু শোন।
: জী ভাবী।
: ওই যে লোকটাকে দেখছ ওকে কি তুমি চেন?
: না ভাবী। তবে খোজঁ নিয়ে জানছি।
: ভাই যাও না একটু।
ভাবী'র কন্ঠটা অদ্ভুত লাগে রাসেল এর কাছে। কোন একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু এখন এত সব ভাবার সময় নেই। রাসেল এখান থেকে পালাতে পারলে বাচেঁ। লোকটা পুষ্পের বড় খালু। ভাবীকে এই তথ্যটা দিয়ে কেটে পড়ে রাসেল। মাথার পিছনে প্রচন্ড ব্যাথ্যা করছে। চা খেতে হবে। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে রহমতের দোকানের দিকে পা বাড়ায়। রহমতের দোকানের স্পেশাল চা (ওর ভাষ্য মতে) খেয়ে আবার হাটা। গন্তব্যবিহীন হাটাঁ। হুমায়ুন আহমেদ এর হিমু যেভাবে হাটেঁ। তবে তার মত খালি পায়েঁ না। সন্ধা হব হব করছে। কোমল একটা বাতাস বইছে। আশেপাশে প্রচন্ড কাকের কোলাহল। হাটতে হাটতে মনে পড়ছে পুষ্পের কথা।
ওর সাথে পরিচয় হয়েছিল মোবাইল এ। এক বন্ধুর কাছ থেকে নম্বরটা পেয়েছিল। ফোন করতেই গালাগালির সম্মুখিন। কিছুটা বিব্রত। তবে জেদ চেপে গেল। এই মেয়েকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। তাই সিম চেন্জ করে আবারও ফোন। এবার আর আগের মত কোন ভুল হল না। কিভাবে কিভাবে যেন আলাপ জমে গেল। আসলে মানুষের মুড একটা বড় ব্যাপার। মানুষযে যে কখন কি করে বসে তা আগে থেকেই বোধহয় স্বয়র্ বিধাতাও ক্লল্পনা করতে পারে না। এক কথা দু কথায় বেশ চলছিল। রাতের পর রাত কেটে যেতে লাগল অর্নথক কথায়। কি বলত আর কি বলত না তা বোধহয় কোনদিনও মনে করতে পারবে না। চলছিল বেশ। একদিন আসল দেখা করার প্রশ্ন। একটা ফাস্টফুডের দোকানে। বিপত্তি বাধঁল দেখা করে। না রাসেল এর পছন্দ হয় ওকে না ওর পছন্দ হয় রাসেলকে। হয়ত সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু ওই যে মানুষের মন। বোঝা সাধ্যি কার? দু-জন দু-জনের প্রেমে। রেস্টুরেন্ট পার্ক রিক্সা মার্কেট। বহতা নদীর মত টোনাটুনির প্রেম কাহীনি। রাসেল আর পুষ্পের বয়স প্রায় কাছাকাছি।
টানা চার বছরের প্রেম কাহিনী শেষ করে যখন মেয়ের বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়ার ভাবনায় আত্বীয় স্বজনের ঘুম নষ্ট তখন রাসেলের মাষ্টার্ষটাও কমপ্লিট হয় নি। দু টো টিউশনি করেই হাত খরচটা উঠে। বাবার হোটেলে খাওয়াটা হজম করতে কষ্ট হয়। এমতাবস্থায় বিয়ের কথা পাগলের প্রলাপ। অপেক্ষা কর বলা ছাড়া সত্যিই নিরুপায়। ভালবাসার ঘাটতি ছিল না মোটেই। কিন্তু ভবিষ্যতের ঠিক যে এখনো করতে পারে নি তাকে মেয়ের দেবে দুঃসাহস! পুষ্পের এক কাকী'র মাধ্যমে অনেক খানি এগুনো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু কোথা থেকে এক খালা এসে সব বিগড়ে গেল। ঘটনা চক্রে রুমি ভাবী আজ সেই খালুরই খোজঁ নিচ্ছে। বিদেশী পাত্র। আবার কম্পিউটার ইন্জিনিয়ার। ঘটনা কত দ্রুত ঘটতে পারে ধারণা ছিল না।গত কয়েকদিন এ কোথা থেকে যে কি হয়ে যাচ্ছে তাও ভেবে কুল কিনারা করতে পারছে না।এবং সব প্রশ্নকেই অমিমাংসিত রেখে সবচেয়ে অপ্রিয় সত্য কথা রাসেলের জীবনে আজ পুষ্পের বিয়ে।
এ ক'দিন বেশ গোপনীয়তায় কাজ সারা হয়েছে। ওর বিয়ে হচ্ছে এ খবর যখন এল রাসেল তখনও ব্যস্ত আজিজ সুপার মার্কেটে ওদের নতুন পত্রিকা নিয়ে। সমাজ পরির্বতনের তীব্র আকাঙ্খা সব সময়। কিন্তু নিজের জীবনেই যে এত বড় পরিবর্তন হয়ে যাবে ভাবেনি কখোনো।
হাটতে হাটতে সিনেমা হলটার সামনে এসে সিনেমার নাম দেখে দৃষ্টি আটকে গেছে।" ভালবাসার দাম"। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। একটা মেয়ে হঠ্যাৎ জিজ্ঞাসা করল :
: আমারে নিয়ে সিনেমা দেখবেন।
বেশ অবাক হয়ে রাসেল জিজ্ঞাসা করল -
: আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন।
মেয়েটার হাসি ভাবনার জগৎ থেকে বাস্কবে নিয়ে আসে। বুঝতে পারল সবটা। মেয়েটাকে পাশ কাটিয়ে সিনেমা হলটা ছেড়ে স্টেশনের দিকে হাটাঁ ।প্রচন্ড খিদে লেগেছে। স্টেশন এলাকায় একটা হোটেল আছে পরিচিত এক বন্ধুর বাবার। সেখানে খাবো। মোবাইলে বাবুকে বলল "আসছি"। অন্ধকার নেমে এসেছে। একটা বাচ্চা ছেলে আর তার বাবা ভিক্ষা করছে। বাবাটা একটা অদ্ভুত গাড়িতে চেপে বসেছে। ছেলেটা ঠেলছে। রাসেল কিছু না ভেবেই বিশটাকার একটা নোট ছেলেটার হাতে দিয়ে দিল। যদিও জানে সারা রাতের সিগারেট খরচ আর থাকছে না। কিন্তু মানুষতো। কখন কি করি নিজেই বুঝতে পারে না। নোটটা দেখে ছেলেটার চোখ চকচক করছে। অবাক। কি করবে বুঝতে পারছে না।বাবাটা বোধহয় অন্ধ। ঘটনার কিছুই সে এখনো জানে না। লক্ষ করলাম বাচ্চাটার চোখের আর্কষনি ক্ষমতা প্রবল। মায়ায় জড়িয়ে যাওয়ার মত।
পুষ্পের চোখের মায়ায় আটকে ছিল যেমন ও চার বছর। বলার মত কোন চেহার পুষ্পের ছিল না। তারও নেই। তবে "দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ" রবি কি দেখে লিখেছিল জানি না তবে রাসেল সত্যিই ওর চোখের প্রেমে পড়েছিলাম। ছেলেটার মায়াবি ঐ চোখকে পিছনে ফেলে রাসেল এগিয়ে যায় সামনে।
৫
হৃদয় বড় কঠিন গন্তব্য। এতদিন সংসার করেও হাসান রুমি'র হৃদয়ে ঢুকতে পারে নি। রুমি কি পেরেছে? অন্ধকার ঘরে বালিশে বুক চেপে লোনা জলে চোখ ভরে ভাবছে রুমি। কিছুক্ষন আগেই হাসানের সাথে কথা হল। বিয়ে বাড়ী থেকে ফিরেছে দুই দিন হল। হাসান বাসায় ছিল না। বাবা'র মৃত্যূ সংবাদ পরদিন পেয়েই ছুটেছে। রুমি'র জন্য অপেক্ষা করে নি। ঘন্টাখানেক হল এসেছে। বাবা'র মৃত্যূ শোক কাটিয়ে উঠতে পারে নি এখনো। এসেই শুরু করল ঝগড়া। কেন রুমি বিয়ে বাড়ীতে রাত থাকল। কত কিছু বলা'র ছিল রুমি'র। শ্বশুর মশাই সমন্ধে। বিয়ে বাড়ীতে দেখা হওয়া ঐ রাজাকার টা'র সম্মন্ধে। কিন্তু কিছুই বলা হয়ে উঠল না। এক কথা'য় দুই কথা'য় রুমি ছোটবেলা থেকেই এতিম। বাবা হারানো'র শোক ও কি বুঝবে এমনও কথা শুনতে হল। বাবা হারনো'র শোক রুমি বুঝবে না - রাগে দুঃখে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করেছে রুমি।
হাসানে'র সাথে রুমি'র পরিচয় পর্বটা বেশ অদ্ভুত। একদিন ঝিগাতলা'র টিউশনি শেষ করে বাইরে এসে বুঝতে পারল রুমি লক্ষন খারাপ। ঝুম বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা। বাসে উঠার চিন্তা বাদ দিতে হল। মোহিত একটা সি.এন.জি ধরে দিল। কথা না বাড়িয়ে ২০ টাকা বাড়তি ভাড়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে চেপে বসেছিল। সাথে সাথেই প্রকৃতি তার সব দুঃখ উজাড় করে ঝাপিয়ে পড়ল। মহাখালি রেল ক্রসিং এর কাছে এসে জ্যাম এর দৈর্ঘ দেখেই বুঝতে পারলাম কপালে খারাবি আছে। পরের এক ঘন্টার মধ্যে দফারফা সাড়া। আশেপাশ দিয়ে প্রবল বেগে ধাবিত হওয়া সদ্য আমদানী করা গাড়ীর কারনে ময়লা পানিতে শাড়ি ভিজে একাকার। ষোল কলা পূর্ণ হল কাকলীর কাছে এসে। জমে থাকা পানিতে সি.এন.জি গেল বন্ধ হয়ে। শত চেষ্টা বিফলে যাওয়ায় বত্রিশ পাটি দাতঁ বের করে ড্রাইভার জানাল অতিরিক্ত ২০ টাকা দিতে হবে না। যা ভাড়া তা দিয়ে নেমে কেটে পড়লেই সে বাচেঁ।
রাত তখন প্রায় দশটা। সে দাড়িয়ে আছে রাস্তার ঠিক মাঝের ফুটপাতে। অল্প অল্প বৃষ্টি তখনো হচ্ছে। দুই পাশেই পানি তাই কোন দিকেই যেতে পারছিল না। নিকষ কালো অন্ধাকার জেঁকে ধরেছে তখন। কিন্চিত ভয়ও লাগছে। না ভুতকে না। মানুষকে।
কি করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যখন ঠিক এ সময় একটা ট্যাক্সি ক্যাব পাশে এসে ব্রেক করল। জানালা নামিয়ে এক চ্যাঙরা ছোকড়া জিজ্ঞাসা করছে -
: কোন সাহায্য করতে পারি।
দেখেও না দেখার ভান করে থাকতে পারল না। মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল
: সি.এন.জি নষ্ট হয়ে গেছে। আরেকটার অপেক্ষায় আছি।
: কিছু মনে না করলে আপনাকে উত্তরা অবধি লিফট দিতে পারি।
: না ঠিক আছে। পেয়ে যাব। আর আমাকে টঙ্গী যেতে হবে।
: মনে হয় পাবেন না। যে পানি জমেছে।
এ দেখি নাছোড় বান্দা। কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সেই আবার কথা বলে উঠল-
: কিছু মনে করবেন না। আমি হাসান। একজন ছোটখাট কবি। আপনি অযথা ভিজবেন না। উত্তরা পর্যন্ত গেলে একটা রিকশা নিয়ে টঙ্গি চলে যেতে পারবেন।
হাসানে'র গলা'র স্বরটা ছিল অদ্ভুত সম্মোহনি জাগানো। কেমন যেন ভরসা যোগায়। পরে অবশ্য জেনেছে ও ভাল কবিতা আবৃত্তি করে তাই গলা'র স্বর এরকম। "ছোটখাট কবি" - শুনেই হেসে ফেলেছিল রুমা। কি যেন কি ভেবে উঠে বসেছিল। হয়ত আর কোন উপায় ছিল না। মানুষ কত অসহায় এদেশে আরেকবার আবিষ্কার করল। ছেলেটা সারা পথ একটিও কথা বলা হল না। উত্তরা আসার পর ছেলেটা মুখ খুলল -
: টঙ্গীতে কোথায় যাবেন?
: স্টেষন রোড।
: আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি।
: না অনেক কষ্ট করেছেন। আমাকে এখানে ছেড়ে দিলেই হবে।
: না! এ আর এমন কি?
: আপনার বাসা কি উত্তরাতে।
: না মিরপুর। উত্তরায় এক বন্ধু'র বাসায় যাচ্ছি।
কিছুক্ষনের মধ্যে বাসায় পৌছে গিয়েছিল। ছেলেটাকে কিছু ধন্যবাদ মাখানো কথাবার্তায় বিদায় করা হল।
কিন্তু এর মাস ছয়েক এর মাথা'য় সেই ছেলে মানে হাসানে'র সাথে বিয়ে হয়ে গেল।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসব স্মৃতি হাতরাচ্ছে রুমি। হঠ্যাৎ মনটা ভাল হয়ে গেল। একটু আগে হাসানে'র সাথে যে কথাকাটি হয়েছিল তা বেমালুম ভুলে রান্না ঘরে চা বানাতে বসল। দু একটা ব্যাতিক্রম বাদ দিলে সৃষ্টি শুরু থেকে আজ অবধি শুধু পুরুষে'র জয় জয়কার। নারী'রা শুধু গর্ভধারণকারী, এর বেশি কিছু নয়। এভাবে চিন্তা করলে নারী হয়ে জন্মানো টা অস্বস্তিকর মনে হয় না। আর শেষ পর্যন্ত নারী'রা এই সত্য উপলদ্ধি করেই রণে ভঙ্গ দেই। সবারই যখন একই অবস্থা তখন আর আমি কেন আলাদা হব।
রুমি'র নিজেই প্রবোধ দেই নিজেকে হাসানে'র বাবা মারা গেছে তাই ওর মাথা ঠিক নেই। উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। এক কাপ গরম চা নিয়ে সে উপস্থিত হল হাসানে'র সামনে।
৬
হাসান বাবা'র লাশ দেখে যত না আঘাত পেয়েছে হয়েছে গ্রামবাসী'র কথায় তার থেকেও বেশি বিস্মিত। এই মানুষটি'র ছেলে ছিল সে। হাসানে'র বাবা'র মৃত্যূতে গ্রামের সহজ সরল চির ভুখা মানুষেরা মিষ্টি বিলি করেছে খুশি'তে। যেন এক রাক্ষসে'র মৃত্যূ হয়েছে। হাসান নিজেও বাবাকে পছন্দ করত না। শোষকে'র প্রতি শোষিতে'র অপছন্দের মাত্রা যে এত বেশি - এই ধ্রুবো সত্য'র সাথে পরিচয় ছিল না হাসানে'র। অনেকটা পালিয়ে এসেছে সে জন্মভূমি থেকে। বিক্ষিপ্ত মন তাই রুমা'র সাথে করে ফেলেছে অকারন একটা ঝগড়া। রুমা'র হাতে'র চা হাসানকে স্বর্গীয় আনন্দ এনে দিয়েছে। এত কটু কথা বলা'র পরও কিভাবে পারে ও এভাবে আপন করে নিতে পারে। ভুলিয়ে দিতে পারে সীমাহীন মন কষ্ট। যুগে যুগে এভাবেই পুরুষের পাশে স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নারী'রা এগিয়ে না এসে শুধু গর্ভধারিনি হলে কি যে হত এই মানব সভ্যতা'র? আগুনটাও জ্বালানো শেখা হত না বোধহয়।
৭
হৃদয় এ বোধহয় কোন নারী পুরুষ বিভাজন নেই। রাসেল নিজেকে সামলাতে না পেরে যান্ত্রীক নগর থেকে ক'দিনের ছুটি নিয়ে গ্রামে চলে গেছে। পুস্পে'র কথা ভোলা'র চেষ্টা করে রাজনীতি'র বই পড়ার দিকে মনোনিবেশ করেছে। বারবার স্মৃতি আঘাত দিয়ে যাই পুষ্প কিন্তু টলাতে পারে না রাসেল কে। একদিকে আত্বপ্রেম আর এক দিকে বিশ্বাসঘাতকতা শেষ করেছে শোষিত মানুষের রাজনীতিকে। তবে এগিয়ে যেতেই হবে শোষিত মানুষকে। রাজনৈতিক ভাবেই যেতে হবে। র্খব করে আত্বপ্রেম। সব ঝেড়ে উঠে একটা ধ্রুব সত্য আবিষ্কার করেছে রাসেল। পথ দুটোই। পুজিবাদ আছে, রয়েছেই কিন্তু সেতো আশ্রয়, নিরাপত্তা দিতে পারছে না মানুষকে। এমন কি পুজিঁপতিদেরও নয়। তাহলে পথ ছেড়ে দিতে হবে অবশ্যই সমাজতন্ত্রকে। শেষ পর্যন্ত লড়াই একটাই প্রশ্ন আমরা কোন পথ নেব? রাসেল এর পথ বাছতে ভুল হয়নি।
৮
পুস্প মহা আনন্দে আছে। নতুন বর নিয়ে এখন কক্সবাজারে হানিমুনে। হোটেল সি-গাল এ ঢুকেই যে কান্ড টা সবুজ করল। লজ্জা'য় লাল হয়ে গেছে সে। কেউ দেখেছে কিনা কে জানে। মানুষ এত অসভ্য হয়। মানুষ বড় অদ্ভুত প্রানী। পদে পদে বিচিত্রতা । বাস্তবতা বড্ড কঠিন জিনিষ। এ দু'দিনে একবারও রাসেল এর কথা মনে হয় নি পুষ্পে'র। সে আছে এক নতুন ঘোরে। তার সব কিছু ঘিরে এখন সবুজ।
৯
প্রায়শ্চিত করতে হবে। অনেক পাপ সে করেছে। আলকাছ চেয়্যারম্যানকে খুণ করার পর তার এ উপলদ্ধি এসেছে। এবার হজ্জ্বে যাবে মিজান মিঞা। খাশ দিলে তওবা করবে। স্রষ্টা ক্ষমাশীল। নিশ্চয় ক্ষমা করবেন। দরকার হলে এই গ্রামে একটা মাদ্রাসা আর একটা এতিমখানা বানাবে সে। সব সম্পত্তি গ্রামের মানুষে মাঝে বিলিয়ে দেবার একটা চিন্তা উকিঝুকি দিয়ে দিলেও কোন সিস্টেমে কিভাবে দেয়া যায়, দিলে মূর্খ গ্রামবাসী তার সব সম্পত্তি নষ্ট করে ফেলবে কিনা এ ভেবে আপাতত সে চিন্তা বাদ দিয়েছে।
১০
মানুষ প্রতিযোগী প্রানী। সব কিছুতেই তার প্রতিযোগীতা। তবে প্রতিযোগীতা করতে গিয়ে কোন এক সময় মানুষ পশু হয়ে যায়। সামসুদ্দিন সাহেব ওরফে একাত্তুরো সামসু মুন্সি সেই প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়েছিল। হয়ে গিয়েছিল পশু। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সমাজের একটা অবস্থানে পৌছেছে আজকে। সর্বচ্চো রাষ্ট্র ক্ষমতা'র খুব কাছাকাছি এসে পড়েছিল। তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। ভাগ্যে'র সন্ধানে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ৭১ সালে তার শেষ কোথায় সে নিজেও জানে না। ওই যে কথা'য় আছে - "আই হ্যাভ মেড ফরচুন বাট আই আ্যাম নট এ ফরচুনেট ম্যান। " তেমনি ক্ষমতা'র অনেক উপরে উঠে অনেকে'র ভাগ্য নিয়ন্ত্রন করেও বর্তমানে চরম অনিশ্চয়তা'য় দিন কাটাচ্ছে স্বাধিনতা সংগ্রামে যারা জীবন উৎসর্গ করেছে তাদের সন্তানদের একাত্মতা, একাগ্রতা, বিচার পাবার আকুলতা দেখে।
পাদটীকা
নিষ্ঠুর, সবল, ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরাই সর্বত্র জয়ী হয় - এ কথা আপাত বিচারে ঠিক মনে হলেও সময় ধারাবাহিক। সময়ে'র কখনো মৃত্যু হয় না। সময় এগিয়ে চলে। হাসান, রুমি, রাসেল, পুস্প, সবুজ, সামসু মুন্সি, মিজান মিঞা এগিয়ে চলে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। যেখানেই হয়ত সব প্রশ্নের মিমাংসা। আশা আকাঙ্খা'র পরিসমাপ্তি। 'কঙ্কাবতী' বর্তামানে'র সময়ে বন্দী। তবে ইতিহাস বলে রাজকুমারি কঙ্কাবতী রাক্ষসে'র প্রাসাদে চিরদিন বন্দী থাকে না।
১. ১২ ই নভেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:৫৬ ০
জীবন বহমান নদীর মতোই পানি বদল করে... দূষিত পানির সাথে বিশুদ্ধ পানির সংমিশ্রণ ঘটে...আবার প্রাকৃতিক ভাবেই বয়ে চলে সুদূরে... একই আসমানের নিচে (ছাদের নিচে) হাত-পা ছুঁড়তে থাকা মনুষের মধ্যে কতো বৈচিত্রতা... স্বার্থপরতা... খুব ভালো লাগলো।
তবে, রুমীর একজনকে প্রতিশোধের নেয়ার ব্যাপারটা থাকলে আরও ভালো লাগতো, কেন জানি সামসু মুন্সি নাম্নী বাস্টার্ডদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি (মৃত্যু) কামনা করতে খুব ভালো লাগে।
শুভকামনা রইলো।