২০০৪ সালের দিকের কথা। একসাথে বেড়ে ওঠা বন্ধুদের প্রায় সবাই উপার্জন করতে শুরু করেছি। নিজেদের অন্যরকম স্বাধীন মনে হতে শুরু করেছে। একশ' টাকার জন্যে বাবার কাছে গিয়ে কান চুলকে বায়না করার দিন শেষ। চাইলেই আমরা হাজার টাকা খরচ করতে পারি।
টাকা খরচ করার অন্যতম সেরা উপায় হলো ভ্রমণে বের হয়ে যাওয়া। সমবয়েসী ডজনখানেক বন্ধুদের নিয়ে হৈ হল্লা করতে করতে ট্রেনে রওনা দিলাম কক্সবাজার। এর মধ্যে মোটের ওপর টিকেট পাওয়া গেছে ১১ টা, মানুষ সবমিলে ১২ জন। পুরো সময়টা কাউকে না কাউকে দাঁড়িয়ে যেতে হলো। যখন যার পালা এলো, সে বেচারী মুখ বেজার করে থাকে, বাকীরা "স্টান্ডিং ভাই" নামে ক্ষেপাতে থাকে। ক্ষেপতে ক্ষেপতে একসময় সে হেসে ফেলে। এর পরে যার পালা তাকে ভয় লাগাতে থাকে। রাতভর গান-বাজনা, ঝাগড়া-খুনসুটি কিছুই বাদ গেল না। এই হৈ-হল্লার মধ্যেই কেউ আবার উদাস হয়ে গান শোনে, কেউ এক পশলা ঘুম দিয়ে দেয়। কেউ ট্রেনের জানলা দিয়ে মাথা বের করে রাতের বাংলাদেশ দেখে।
সকাল বেলা চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে পৌঁছে গায়ে লাগে বন্দর নগরীর হাওয়া। সদ্য জেগে ওঠা শহরটির মানুষদের প্রায় না-ব্যস্ত হাঁটা-চলা, মৃদু হাঁকডাক আর শীতল হাওয়ার স্পর্শ সবই ঘোরের মতো মনে হয়।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ঘন্টা চারেকের বাস ভ্রমণ। রাত জাগার ক্লান্তিতে চোখ ভারী হয়ে আসছে, ঠিক এমন সময় স্বপ্নদৃশ্যের মতো প্রথম সমুদ্র দর্শন করলাম আমরা, বাসের জানলা দিয়ে। বিস্মিত শিহরণের ঝাপটায় চোখ থেকে ঘুম উধাও। বাস থেকে নেমেই সমুদ্রের কাছে ছুটে যাওয়া। সমুদ্রের গর্জন যে এতো অদ্ভুত সুন্দর এ ব্যাপারে কোন ধারণা ছিলনা। আমার কাছে মনে হচ্ছিল সমুদ্র আমাদের ডাকছে! সমুদ্রের পানিতে প্রথম পা ভেজানোর মতো আনন্দ খুব কমই আছে। সাদা ফেনিল স্রোত আছড়ে পড়ছে পায়ে। হাত ছড়িয়ে যে দিকে তাকাই শুধুই সমুদ্র। প্রকৃতির এই বিশালত্বের সাথে পরিচয় হতবাক করে দেয় আমাদের সবাইকে।
বাউন্ডুলে বন্ধু ও সহকর্মীদের খপ্পরে পড়ে বাংলাদেশের বহু জায়গা ঘুরেছি, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, রাঙ্গামাটি, বান্দারবান, সুন্দরবন, যশোরের সাগরদাঁড়ি, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ।
বান্দারবনের নীল গিরির চুড়ায় দাঁড়িয়ে পাহাড়, গাছ-পালা দেখে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। দূরে দেখি একখন্ড মেঘ, সেখান থেকে বৃষ্টি ঝরছে! তার আশ পাশে সাদা তুলোর মতো মেঘ বৃষ্টি ছাড়াই নিরীহ ভাবে ঘুরছে। পায়ের নীচের পাহাড়ের মাথায় আমাদের চমকে দিয়ে উঁকি দিল রংধনু! কিন্তু পরমুহূর্তের চমকের কাছে এ বিস্ময় কিছুই না। কয়েক মিনিটের মধ্যে যাদুর মায়ার মতো শত শত খন্ড মেঘ আমাদের ঘিরে ফেলল। নিঃশ্বাসের সাথে ঢুকে যাচ্ছে মেঘের কণা। আমি পুরোপুরি ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম! এ কী! আমি কোথায়! কোন স্বপ্নদৃশ্য এতো সুন্দর হয়েছে কিনা মনে পড়ছে না। মনে করার ইচ্ছাও হচ্ছিল না।
পৃথিবীর অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। পর্যটক সুযোগ-সুবিধা বাদ দিলে প্রকৃতির যেটুকু থাকে, তা দিয়ে কেন জানি মন ভরে না, তা হোক সিঙ্গাপুরের সীবিচ, শিকাগোর জাঁকজমক নদী কিংবা সিয়াটলের ঝকমকে হ্রদ! বাংলাদেশ যে কত সুন্দর একটা দেশ ঘুরে না দেখলে কারো বিশ্বাস করা কঠিন হবে। বাংলাদেশের সৌন্দর্যকে যে উপভোগ করেছে, প্রকৃতি দিয়ে তাকে মুগ্ধ করা পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলোর একটি!