আমাদের দেশে একটা জিনিস কমন। কেউ একজন নতুন একটা ব্যবসা নিয়ে আসলো। ব্যবসা যদি ফেল করে, তাহলে কোন কথা নাই। কিন্তু কোনভাবে সেটা যদি লাভের মুখ দেখে, তাহলেই সর্বনাশ! যে যেভাবে পারবে হুবহু একই আইডিয়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এটা চলতে থাকবে যতদিন পর্যন্ত না সেই ধরণের ব্যবসার বারোটা বাজে।
এধরণের হাজার হাজার উদাহরণের মধ্যে একটি হলো বেসরকারী টিভি চ্যানেল।
সেদিন একটা জায়গায় পড়লাম, দেশের বেশিরভাগ টিভি চ্যানেলগুলো তাদের কর্মীদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারছেনা। উন্নয়নশীল দেশের ছোট আকারের বিজ্ঞাপনের বাজার নিয়ে যদি শতাধিক মিডিয়া (প্রিন্ট, ভিজ্যুয়াল) কাড়াকাড়ি করে তাহলে প্রত্যেকের ভাগে যা জুটবে তা দিয়ে নিজেদের টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে যাওয়ার কথা। তারওপর এই বিজ্ঞাপনের বাজারের একটা অংশে আবার ভাগ বসিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী দেশের টিভি চ্যানেলগুলো, আমাদের দেশের দর্শকদের একটা বড় অংশ তাদের নিয়মিত ভোক্তা কিনা, তাই!
আমি নিজে একাধিকবার দেখার চেষ্টা করেছি ভারতীয় সিরিয়ালগুলোর কিছু অংশ। ধৈর্য্যের ব্যাপারে আমার যৎকিঞ্চিৎ সুনাম থাকলেও এক্ষেত্রে তেমন সুবিধা করতে পারিনি। যারা নিয়মিত দেখেন তাদের জিজ্ঞেস করলে বললেন, ভারতীয় সিরিয়ালগুলো তাদেরও তেমন একটা ভালো লাগে না, কিন্তু এর চাইতেও ভালো কিছু না থাকাতেই এটাই তাদের দিনান্তের বিনোদন।
এমুহূর্তে সবমিলিয়ে কতগুলো দেশী টিভি চ্যানেল আছে, সেটা হাতে গুনে শেষ করা মনে হয় কষ্ট হবে। এর যেকোন একটিতে গেলেই অবধারিতভাবে পড়তে হবে বিজ্ঞাপনের উৎপাতে। অনুষ্ঠান যদি চলে পাঁচমিনিট, বিজ্ঞাপন চলবে পঁচিশ মিনিট। প্রচন্ড ধৈর্য্যশক্তির পরীক্ষা দিয়ে যদি সেই অনুষ্ঠানটি দেখার চেষ্টা করেন দর্শক ভদ্রলোক (বেচারী বলা ভালো), এবং সেই অনুষ্ঠানটি যদি হয় নাটক, তাহলে সহ্য করতে হবে স্থূল ভাড়ামি। যদি হয় টকশো তাহলে শুনতে হবে দেশ ও জাতি উদ্ধার করা গালাগালি।
ভালো অনুষ্ঠানের জন্যে দরকার ভালো বাজেটের। ছোট আকারের বিজ্ঞাপনের বাজারের হাজার ভাগের অংশীদার টিভি চ্যানেলগুলো একেকটি অনুষ্ঠানের জন্যে যে বাজেট থাকবে এটা দিয়ে মানসম্পন্ন কিছু করা আসলেই কঠিন।
আমি ব্যবসা-প্রশাসনের লোক নই, কিন্তু পেশাগত কারণে ব্যবসা-সংক্রান্ত কিছু কিছু বিষয় জানতে হয়। সেই সীমিত ধারণায় বলতে পারি আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর ব্যবসায়িক স্ট্রাটেজিগুলোতে বড় ধরণের সমস্যা আছে।
সে সমস্যাটি হলো আমাদের দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা অবমূল্যায়ন করা। প্রতি বছরই এই ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে আমাদের। বিনোদনের জন্যে, যোগাযোগের ভালো সুবিধা পাওয়ার জন্যে খুব সাধারণ আয়ের একজন মানুষও মাসে শাতাধিক টাকার বাজেট রাখতে পারে। মোবাইল প্রতিষ্ঠানগুলোর হাজার কোটি টাকার মুনাফা করে দিয়েছে আমাদের দেশের মানুষই। তাতে দোষেরও কিছু নেই। কারণ ক্রেতাও খুশী। বিক্রেতাও খুশী!
এছাড়াও সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে প্রায় কোটি বাংলাদেশী, যাদের ক্রয়ক্ষমতা দেশের তুলনায় অনেক বেশী। দিনশেষে নিজ দেশের সংস্কৃতির, ভাষার ভালো মানের অনুষ্ঠানের জন্যে প্রবাসী প্রতি বছরে গড়ে হাজার টাকা বাজেট থাকা তেমন কঠিন হওয়ার কথা নয়। সে হিসেবে শুধু প্রবাসীরাই বছরে হাজার কোটি টাকার ব্যবসার ক্রেতা হতে পারে আমাদের দেশী মিডিয়া ও চ্যানেলগুলোর।
দর্শকদের পরোক্ষ ক্রেতা (অন্য প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে) না ধরে প্রত্যক্ষ ক্রেতা হিসেবে চিন্তা করলে সম্পূর্ণ নতুনভাবে এই শিল্পটি জেগে উঠবে আমার ধারণা। এই কাজটি যারা যতো ভালোভাবে করতে পারবে তারাই দাপট নিয়ে টিকে থাকবে ভালো মানের অনুষ্ঠানসেবা নিয়ে।