শফিক খুব ভুলো মনের, সে সাম্প্রতিক কিছু মনে রাখতে পারেনা, তবে অনেক আগের ঘটনা মনে রাখতে পারে, তার মনে থাকে। কারন সে শুধুমাত্র খুব গুরুত্বপূর্ন ব্যাপারগুলি নিয়ে চিন্তা করে, আর তুলনামুলকভাবে হালকা ঘটনা গুলি নিয়ে চিন্তা করেনা। এইজন্য গুরুত্বপূর্ন ঘটনাগুলি তার অনেকদিন মনে থাকে, কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া অনেক কিছুই মনে থাকেনা।
এই গুরুত্বের ব্যাপারটা অবশ্য আপেক্ষিক। যেমন সে টিউশনি করতে গিয়েছে, পড়ানো শেষে হেটে বাসায় ফেরার পরে তার মনে হয় সে তো সাইকেল চালিয়ে গিয়েছিল, তাহলে হেটে বাড়ি ফিরল কেন!
অথচ তার বয়স যখন সাড়ে তিন কি চার তখন একটি সুন্দরী মেয়ে বাজারে তাকে চুমু দিয়েছিল কোলে নিয়ে তা এখনও মনে আছে। ব্যাপারটা গুরুত্বপুর্ন।
সুন্দরী ব্যাপারটা আসলেই, সফিকের মৌমির কথা মনে আসে। মেয়েটা আসলেই সুন্দর। শুধু চুলটা স্ট্রেইট না। মেয়েটা ভালো মানুষও। সফিক এর সাথে যখন প্রথম কথা হত, খুব কেয়ার করত, একদম মায়ের মত করে, শফিকের মায়ের কথা মনে পড়ে গেল, মাকে একটা ফোন দিতে হবে।
মৌমিই ওর দিকে বেশি এগেয়ে এসেছিল। কেয়ারিং শেয়ারিং করতে করতে সফিক আস্তে আস্তে করে মেয়েটির প্রতি আসক্ত হয়ে গেল। সে সবসময়ই অবাক হয়ে থাকত, মানুষ কিভাবে এত ভালোবাসতে পারে! এত যত্ন নিতে পারে! এত মিশে যেতে পারে! সফিক নিজেকে মুল্য দিতে লাগল, যোগ্য ভাবতে শুরু করল। এবং একটা সময় এসে টের পেল, সে যা ভেবেছিল মৌমি তার চাইতেও বেশি যত্নশীল। সে আরও কয়েকজনকে একই ভাবে কেয়ার করে। সফিকের আত্নবিশ্বাস ভেঙ্গে গেল, নিজেকে যতটুকু মুল্য দিয়েছিল সেটুকু হারানোর ভয়ে শফিক উঠে পড়ে লাগল।
মৌমিকে বোঝানোর চেষ্টা করল, এটা নৈতিক না। অনেক বোঝানো সোঝানো এবং টোঝানোর পরে সফিক বুঝতে পারল মৌমি বুঝতে পেরেছে। কারন রাস্তায় চলতে ফিরতে শফিকের ভুলেও কোন মেয়েদের দিকে চোখ পড়ে গেলে রাস্তার ভেতরেই মৌমির সাথে ঝামেলা বেধে যেত। ফেসবুকেও কোন মেয়ে ফ্রেন্ড থাকতে দিল না। কোন এক পুর্ব জন্ম থেকে কোন এক মেয়ে একবার ফোন দিয়েছিল, মৌমি বুঝতে পেরেছিল এবং সেই দিন অবস্থা হাতাহাতিতে গিয়ে ঠেকেছিল। মৌমি শফিককে একটা চড় মেরেছিল, শফিক আস্তে করে একটা কিল মেরেছিল মৌমিকে, আর প্রতিদানে মৌমি লাথি মেরে শফিককে খাট থেকে ফেলে দিয়েছিল প্রায়।
দুজনেই চিন্তা করল তারা বিয়ে করবে। তারা একসঙ্গে থাকতে শুরু করল, লিভ টুগেদার থিম নিয়ে না, বিয়ে করাটা ছিল উদ্দেশ্য। মৌমি ছিল হীন্দু তাই বিয়েটা সহজ ছিলনা।
শফিক আর থাকতে পারছেনা। গ্রামের বাড়িতে মাকে ফোন দিল, হাউ মাউ করে কাদতে কাদতে বলল, মা, মৌমির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। শফিক এর মা বলল, এটাতো অনেক আগের কথা। শফিক বলল, হ্যা কিন্তু এইবার সবকিছু ফাইনাল। মা বলল, এমন হল কেন।
শফিক বলল, ও এখন আর আসতে চাচ্ছেনা, বলছে বাবা-মাকে কষ্ট দিতে পারবেনা। এখনতো আমার সঙ্গে কথাই বলেনা। এখন আর কিছুতেই কিছু হবেনা। শফিক এর হাউমাউ কান্নায় মায়ের মন মোম হয়ে জলতে লাগল গলতে লাগল।
মৌমির ভালো একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে, এরপর থেকে মৌমি শফিক এর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। শফিক ব্যাপারটা চিন্তাও করতে পারছেনা, যেই মানুষটা শফিক ঘুমালে মাথার কাছে জেগে থাকতো সেই মানুষটা ধারে কাছেও থাকবেনা, অনেক দূরে চলে যাবে, ধরা ছোয়ার বাইরে, প্রায় মৃতের মত।
যেই মানুষটা খুব আবেগী ছিল, কিছু একটা হলেই ওড়না বেধে ঝুলে পড়তে চাইত সে বেচে থাকবে, অন্য কারো জন্য ঝুলে পড়তে চাইবে। শফিক মৌমির ফেসবুক আইডি তে ঢুকেছিল, সেই ছেলের সঙ্গে কথোপকথন দেখেছে। সবকিছুই ঠিক আছে, সেই আবেগ, সেই আহ্লাদ, সেই লুতুপুতু। শুধু ছেলেটি শফিক নয়। মেনে নেওয়াটা আসলে সহজ না, এত স্বৃতি, এত কথা, এত ছোয়াছুয়ি, এত ভেতর এত গভীর!
শফিক ঘুমের ঔষধ খেল, মরে যাওয়ার জন্য না, ঘুমোবার জন্য। ঘুম হয়না, মনে হয় শফিকের সবটুকু নেই, অল্প একটু আছে, এইটুক ঘুমালে বাকিটুক কি করবে!
আধখানা ঘুমের সময় শফিক এর কাছে একটি ফোন আসল, তাদের গ্রামের একজন প্রভাবশালী লোক, ফয়জুল হক তাকে ফোন দিয়েছে। সফিক এর কাছে ব্যাপারটা পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত, এই লোক এর সঙ্গে তার কোনদিনও ফোন এ কথা হয়নি, ওর নাম্বার তার জানার কথা না। শুধু শফিক যখন গ্রামে যায় তখন দুই একবার কুশল বিনিময় হয়। শফিকের পরিবারের কারো সঙ্গেও লোকটি ওমন ঘনিষ্ট না।
সেই লোক ফোন দিল তাও আবার এত রাতে।
লোকটি শফিককে জিজ্ঞেস করল কেমন আছ, শফিক গতানুগতিক উত্তর দিল, ভালো আছি। কিছু কথা বলার পরে লোকটি বলল আমার তো মনে হয়না তুমি ভালো আছ। সফিক জোর দিয়ে বলল, না কোন সমস্যা নেই। লোকটি বলল, শোন, এইগুলা কোন ব্যাপারনা, বিয়ের পরের সম্পর্ক হচ্ছে আসল সম্পর্ক...... আরো অনেক কিছু। সফিক প্রচন্ড বিস্ফোরনে বিষ্মিত হল। ওর কথা ঐ লোকটা জানল কিভাবে!
শফিকের অনেক আগের কথা মনে থাকে, কিছু কথা ভাসা ভাসা মনে পড়ে, ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা, সেগুলি কি ঘটেছিল নাকি স্বপ্ন ছিল। সেই গুলি নিয়ে সে সন্দেহে থাকে। এমন একটা সন্দেহ অনেক আগে থেকেই ওকে তাড়া করে বেড়াতো।
অনেক আগের কথা, স্কুলে ভর্তি হওয়ারও বছর দুয়েক আগের ঘটনা। একবার মায়ের সঙ্গে ঢাকা যাওয়ার সময় শফিক একরাত কোথায় যেন থেকেছিল মায়ের সঙ্গে। অন্ধকার সেই রাতের একটা মুখ মনে পড়ত ওর। ওর মায়ের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ছিল মুখটা, ও চিনতে পেরেছিল, লোকটি ছিল ওদের গ্রামের ফয়জুল হক। স্বৃতি টা অনেক ভাসা ভাসা মনে পড়ত সফিকের। প্রচন্ড সন্দেহে দ্বগ্ধ হত ও, বারবারই মন কে বোঝাতো ওটা আসলে হয়ত দুঃস্বপ্ন ছিল।
কিন্তু আজ দুঃস্বপ্নেরা সাফ জানিয়ে দিল এর মধ্যে ওরা নেই।
কোনটা বেশি গুরুত্বপুর্ন কষ্ট, এটা নিয়ে আজ রাতে শফিক ধাধায় পড়ে গেল।
অনেক গুলি ঘুমের ঔষধ পাশে আছে, সেই ভয়ে শফিক ঘুমোবার চেষ্টা করল খুব।
পেইন্টিং টা আমার করা
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৮