somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহাকালের মহাপথিক : জীবনানন্দ

২২ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

''সবিতা, মানুষজন্ম আমরা পেয়েছি
মনে হয় কোন এক বসন্তের রাতেঃ
ভূমধ্যসাগর ঘিরে সেই সব জাতি,
তাহাদের সাথে
সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুন্জ্ঞন;'' ( সবিতা, বনলতা সেন )

এ যেন ইতিহাসের পথে ছুটে চলা এক মহাপথিক স্মৃতিচারণ করছেন তার প্রিয় মানুষীর কাছে। মহাকালের পথে ক্লান্ত প্রাণ নিয়ে ছুটে চলা কবি তাঁর অন্য একটি কবিতায় বলেছন,

''যে নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার-হাজার বছর আগে ম'রে গিয়েছে
তারাও কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে করে এনেছে
যে রূপসীদের আমি এশিয়ায়, মিশরে, বিদিশায় ম'রে যেতে দেখেছি
কাল তারা অতিদুরে আকাশের সীমানায় কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা
হাতে ক'রে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন ...
মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য ?
জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য ?
প্রেমের ভয়াভহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য ?'' (হাওয়ার রাত, বনলতা সেন )

যেন মহাবিশ্বের পটভুমিতে দাঁড় করিয়ে মানুষকে জীবন সম্পর্কে গভীরতর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন মহাকালের মহাপথিক : জীবনানন্দ। তিনি আসলে এমন এক মহাজাগতিক বীক্ষা অর্জন করেছিলেন যার ফলে যে বিষয়টিকে দেখেছেন তাই অত্যন্ত ব্যাপক হয়ে উঠেছে। ইতিহাসকে তিনি ধারণ করেছেন অপরিমেয় সময়ের মোড়কে, আবার মুহূর্তকালের ব্যাপ্তিতে। তিনি বলেছেন, ''কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।''

স্বভাবোক্তি অলংকার ও বাক্‌প্রয়োগের দেশজ রীতির মিলনে সৃষ্ট তাঁর আপাত- দূর্বোধ্যতার অন্তরালে এক দুজ্ঞেয় রহস্য বিরাজিত। জীবনানন্দ বোধ হ্য় খুবই অল্পকিছু লোকের একজন, যিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে মানুষের জন্ম, মৃত্যু আর কর্মকান্ডকে ইতিহাস ও মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সে সাথে ভাষায় সে-রকম দঢ়তা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি দু'জন কবিতায় লিখেছেন,

''আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;-এক নক্ষত্রের নিচে তবু- একই আলো পৃথিবীর পারে
আমরা দু'জনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়.....?''

বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থ বিজ্ঞানী সাগান এরকমই একটি কথা অন্যভাবে বলেছিলেন, প্রজাপতির দৃষ্টিতে যেমন মানুষের জীবন হলো অবিচল, বিরক্তিকর, প্রায় সামগ্রিকভাবে স্হবির তেমনি নক্ষত্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাকালে মানব জীবন হলো আলোক ঝলকের মতো, অস্হিরতায় পূর্ণ ক্ষীন শতকোটি সংক্ষিপ্ত জীবনের একটি। যে জীবের আয়ুষ্কাল সাতকোটি বছরের এক নিযুতাংশ মাত্র, তার কাছে এই সুদীর্ঘ সময়টি কীভাবে প্রতিভাত হয় ? আমরা হলাম প্রজাপতির মতো যেটি একটি দিনকে মহাকাল ভেবে বসে আছে।

----------------------------------------------------------------------------------
জীবনানন্দ দাশের জন্ম ১৮৯৯ সালে বরিশাল জেলায়, মৃত্যু ১৯৫৪ সালে। জীবনানন্দের বাবার নাম সত্যানন্দ দাশ, মাতা কুসুম কুমারী দাশ। পিতা একজন স্কুল শিক্ষক, প্রবন্ধকার, ব্রক্ষবাদী নামে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। মা হাসির গান ও কবিতা লিখতেন। জীবনানন্দ মারা যান বালিগন্জ্ঞ ট্রাম দূর্ঘটনায়, ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর, রাত্রি ১১.৩৫ মিনিটে শম্ভুনাথ হাসপাতালে।

জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্হ বের হয় ১৯২৭ সালে ''ঝরা পালক''; এরপর একে একে ধূসর পান্ডুলিপি, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, তাঁর মৃত্যুর পর বের হয় রূপসী বাংলা, বেলা অবেলা কালবেলা ।
----------------------------------------------------------------------------------

অনেকেই জীবনানন্দকে রূপসী বাংলার কবি বলে আখ্যায়িত করেন, কেউবা বলেন অচরিতার্থ প্রেমের কবি। এটা ঠিক যে জীবনানন্দ শুরু থেকেই রবীন্দ্র বলয় থেকে দুরে থাকার চেষ্টা করেছন।স্বতন্ত্র কিছু সৃষ্টি করার প্রয়াসে তিনি যে পুরোপুরি সার্থক হয়েছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। রূপসী বাংলা কাব্য গ্রন্হে নিজেকে সম্পুর্ণ আলাদা এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে দাঁড় করালেন, যেখানে সময় থেমে গেছে আবহমান বাংলার রূপ নিয়ে। আর এই কাব্য গ্রন্হের মধ্য দিয়ে স্হান ও কালের সীমানা পেরিয়ে নিজেকে পরিব্যাপ্ত করলেন নক্ষত্র পর্যন্ত ও সম্পর্কযুক্ত করলেন বিশ্ব ইতিহাসের সাথে।

''চারদিকে শান্ত বাতিভিজে গন্ধ...মৃদু কলরব;
খেয়া নৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;
পৃথিবীর এইসব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;.......
এশিরিয়া ধুলো আজ ব্যাবিলন ছাই হয়ে আছে।''
( সেইদিন এই মাঠ, রূপসী বাংলা )


বিরহ বিচ্ছেদ জীবনানন্দের কবিতায় কখনই রোমান্টক হয়ে উঠেনি।বিরহ, বিচ্ছেদ, মৃত্যু তাঁর কবিতায় এসেছে অনন্ত শূন্যতা নিয়ে ভোরের শিশিরের মতন। গভীর শূন্যতাবোধের অনুচ্ছ্বসিত সংযত প্রকাশ তাঁর প্রেমের কবিতাকে এক অনন্য রূপ দান করেছে। আর তারই এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে আছে বনলতা সেন কাব্য গ্রন্হটি। বনলতা সেন, সুদর্শনা, শ্যামলী, সুরন্জ্ঞনা, সবিতা, সুচেতনা এমনই কয়েকটি নারী চরিত্র আমরা এই কাব্য গ্রন্হে পেয়ে যাই। যারা শুধুমাত্র প্রেমিকা হিসেবেই নয়, কখনো কখনো অতীত ইতিহাসের ঘটনার সাক্ষ্য হিসেবেও আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়....

''সুরন্জ্ঞনা,আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছো;
পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন;
কালো চোখ মেলে ঐ নীলিমা দেখেছ;
গ্রীক হিন্দু ফিনিশীয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন
শুনেছ ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা-নগরীর গায়ে
কী চেয়েছ ? কী পেয়েছ ? - গিয়েছে হারায়ে।''
( সুরন্জ্ঞনা, বনলতা সেন)

ব্যক্তি জীবনেও জীবনানন্দ ছিলেন নিঃসঙ্গ, লাজুক, স্বল্পবাক, আত্মমগ্ন একজন মানুষ। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ''জীবনানন্দের স্বভাবে দুরতিক্রম্য দুরত্ব ছিল ... যে অতিলৌকিক আবহাওয়া তার কবিতায়, তাই যেন মানুষটিকে ঘিরে থাকত সব সময়। নিচের কবিতার মাধ্যমে নিঃসঙ্গ ও আত্মমগ্ন জীবনানন্দের মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায়.....


''কি এক ইশারা যেন মনে রেখে একা-একা শহরের পথ থেকে পথে
অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম বাস সব ঠিক চলে;
তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হয়ে চলে যায় তাহাদের ঘুমের জগতেঃ

সারারাত গ্যাসলাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো করে জ্বলে।
কেউ ভুল করে নাকো- ইটঁ বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাদ সব
চুপ হয়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে।

একা-একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব;
তখন অনেক রাত- তখন অনেক তারা মনুমেন্ট মিনারের মাথা
নির্জনে ঘিরেছে এসে; - মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব

আর কিছু দেখেছি কিঃ একরাশ তারা আর মনুমেন্ট ভরা কোলকাতা?
চোখ নিচে নেমে যায়- চুরুট নিরবে জ্বলে বাতাসে অনেক ধুলোখড়;
চোখ বুঝে একপাশে সরে যাই........''


হয়তো এমনই এক নির্জন বিষন্ন রাত্রিতে একাকী আত্মমগ্ন কবি অজান্তেই দূর্ঘটনার কবলে পড়েন। আজ ২২ অক্টোবর, কবির মৃত্যু দিবস। কবির প্রতি শ্রদ্ধা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১২:২৪
২৬টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×