somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঈশ্বরের রথের উত্থান এবং পতন

২৪ শে আগস্ট, ২০১২ সকাল ৯:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পাঠক কেউ যদি ঈশ্বরের রথ’কে অলৌকিক কোন কিছু ভেবে পোষ্টে ঢুকেন, তাহলে শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ঈশ্বরের রথ, ইংরেজিতে ‘God’s Chariot’ আর হিব্রু ভাষায় যাকে বলা হয় ‘মারকাভা’। ঈশ্বরের রথ বললে প্রাথমিক ভাবনায় উড়ন্ত কিছু মনে আসলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ইসরায়েলের নিজস্ব উদ্ভাবিত ট্যাঙ্ক এর নাম।

পৃথিবীর সামরিক ইতিহাসে ‘মারকাভা’ গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে উন্নত সংস্করণের জন্যই নয়, এই ট্যাঙ্ক বদলে দিয়েছে বিশ্ব রাজনীতি এবং মধ্য প্রাচ্যের মানচিত্র। কখনো এই ট্যাঙ্কের আগ্রাসনে গুঁড়িয়ে গেছে শত্রুর রক্ষণ বুহ্য আবার কখনো এটি হতে গুলি ছুঁড়ে হত্যা করা হয়েছে নিষ্পাপ শিশুকে। এই ট্যাঙ্ক ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর প্রধান শক্তির উৎস, তাদের অহংকার। তবে সব কিছুরই একটা সমাপ্তি আছে, ইসরায়েলের এই দর্পও একসময় চূর্ণ হয়েছিল। আসুন তাহলে, দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যের রণক্ষেত্রে রাজত্ব করে চলা এই ট্যাঙ্কের বিস্তারিত ইতিহাসটা জেনে নেওয়া যাক।

ইসরায়েল তাদের ‘মারকাভা ট্যাঙ্ক’ প্রজেক্টের কাজ শুরু করে ১৯৭৩ সালে এবং ১৯৭৮ সালে ঈশ্বরের প্রথম রথটি যুক্ত হয় ইসরায়েলের সেনাবাহিনীতে। তবে কেন এই মারকাভা প্রজেক্ট আর কি এর বিশেষত্ব, তা বুঝতে হলে আরও কয়েক বছর পিছিয়ে যেতে হবে।


১৯৬৭ সালে মাত্র ৬দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে মিশর, সিরিয়ার কাছ থেকে গাজা, সিনাই, গোলান মালভূমিসহ জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর দখল করে নেই ইসরায়েল। আকারে বড় হয়েও উন্নত সমর-কৌশল এবং অস্ত্রে সজ্জিত ইসরায়েলের বাহিনীর কাছে ভালো মার খায় সম্মিলিত আরব বাহিনী। প্রথমেই ইসরায়েলের অতর্কিত আক্রমনে মিশর এবং সিরিয়ার বিমানবাহিনীর বড় অংশই ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে সন্মুখ সমরে তাদের মান্ধাতা আমলের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ট্যাঙ্কগুলো দাঁড়াতেই পারেনি ইসরায়েলের আধুনিক এবং রূপান্তরিত ব্রিটিশ ও আমেরিকান ট্যাঙ্কগুলোর সামনে; ফলাফল শোচনীয় পরাজয়।

ইসরায়েলের হাতে নিজ ভূমি ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠে মিশর। ১৯৭৩সালে আবারো সৈন্য পাঠায় সিনাই উপত্যকায়, সুয়েজ খাল অতিক্রম করে তারা হামলা চালায় ইসরায়েলের সেনা ঘাঁটিতে; দিনটি ছিল ইহুদীদের সবচেয়ে পবিত্র ইয়ুম কাপুর উৎসবের দিন। অতর্কিত হামলায় ইসরায়েল প্রস্তুত না থাকলেও ভেঙ্গে পড়েনি, তাদের শক্তিশালী ট্যাঙ্ক বাহিনীকে লেলিয়ে দেয় মিশরীয় বাহিনীর পিছনে। ভেবেছিল ট্যাঙ্ক দেখেই পালিয়ে যাবে মিশরের সেনারা কিন্তু তা না হয়ে উল্টে তারা নিজেরাই শিকার হোল বিভীষিকার। ইসরায়েলি ট্যাঙ্ককে মোকাবেলার জন্য মিশর প্রচুর পরিমাণে এন্টি ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল আমদানি করেছিল সোভিয়েত রাশিয়া হতে এবং ইতিহাসে প্রথম বারের মত যুদ্ধে ব্যবহৃত হোল সেটি।


মাটিতে মিসাইল বসিয়ে ট্যাঙ্কের জন্য অপেক্ষারত মিশরীয় সৈনিক

ফলাফল, শত শত ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। প্রায় শ’চারেক ট্যাঙ্ক আর প্রচুর মৃতদেহ ফেলে রেখে পিছু হটতে বাধ্য হোল তারা। পরবর্তীতে পাল্টা আক্রমণে আরব বাহিনীকে যথেষ্ট ধ্বংস উপহার দিলেও নিজেদের প্রাথমিক ক্ষতিটাই বিশাল হয়ে দাঁড়ায় ইসরায়েলের জন্য। কারণ, তারা জানত সুয়েজ খালে টাকা তুলে আর তেল বেঁচে যেকোনো ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া অতি অল্প সময়ের ব্যাপার আরবদের জন্য। কিন্তু স্বল্প জনগোষ্ঠীর এবং সীমিত সংখ্যার ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর জন্য প্রতিটি সৈন্যের প্রাণ অনেক বেশী মূল্যবান।


এই যুদ্ধের পরই ইসরায়েল সিদ্ধান্ত নেয় তাদের নিজস্ব ট্যাঙ্ক বানানোর, এমন ট্যাঙ্ক যা শুধু মিসাইল আক্রমণের বিরুদ্ধেই কার্যকর হবেনা সাথে সৈনিকদের জীবনের বিশাল নিরাপত্তাও নিশ্চিত করবে। আর নতুন এই ট্যাঙ্ক বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হোল জেনারেল ইসরায়েল তেল’এর উপর, যিনি একজন ট্যাঙ্ক যুদ্ধের বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুখ্যাত ছিলেন। নতুন মডেলের ট্যাঙ্ক বানাতে গিয়ে প্রচলিত ট্যাঙ্কের খোল নলচেই তিনি পাল্টে দিলেন। এতদিন ধরে পিছনে থাকা ইঞ্জিনকে নিয়ে এসে ট্যাঙ্কের সামনে বসিয়ে দিলেন, উদ্দেশ্য সামনে থেকে আসা আঘাত হতে ক্রু’দের রক্ষা করা। বলা হয়ে থাকে, ‘এই ট্যাঙ্কের প্রতিটি খুচরা অংশ এমনভাবে বানানো হয়েছে যেন তা সৈন্যদের কোন না কোনভাবে নিরাপত্তা দিবে’। শত্রুর ছোঁড়া গোলা যেন টার্গেট মিস করে, সেজন্য প্রচলিত ট্যাঙ্ক হতে অনেক নিচু করে বানানো হোল আর ধাতু, প্লাস্টিক এর সমন্বয়ে তৈরি ভারী, পুরু আর্মার ব্যবহারের কারণে ওজন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াল ৬৩টন। ফলে গতি অনেকটা হ্রাস পেল কিন্তু ক্রু এবং সৈন্যদের নিরাপত্তা বেড়ে গেল অনেকাংশে।

আরেকটি বিশেষ সুবিধা আনা হোল, তা হচ্ছে পিছনে বসার স্থান বাড়িয়ে অতিরিক্ত সৈন্য পরিবহণের ব্যবস্থাও করা হোল। প্রতিটি ট্যাঙ্কে ৪জন ক্রু এর সাথে ৬জন সৈন্য বহন করা যেত, এতে সমর কৌশলে একটা নতুন পরিকল্পনার যোগ হোল। সুবিধাজনক স্থানে সৈন্য নামিয়ে দেওয়া যেত, যেন তারা সামনে এগিয়ে শত্রুর এন্টি ট্যাঙ্ক ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। অবশেষে ট্যাঙ্ক জগতের এক নতুন বিপ্লব হিসেবে ১৯৭৮সালে প্রথম অফিশিয়ালভাবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হোল মারকাভা-I । নতুন এই ট্যাঙ্কের আগমনে অত্র অঞ্চলের সামরিক আধিপত্য এবং রণকৌশল পুরোই পাল্টে গেল।


মারকাভা-I

নতুন এই ট্যাঙ্কের উপস্থিতি আরবদের মাঝে সৃষ্টি করল ত্রাস আর ইসারায়েলিদের জন্য তা ছিল গর্ব এবং আধিপত্যের প্রতীক। ১৯৮২সালে ট্যাঙ্ক বহর নিয়ে লেবাননে হামলা চালাল ইসরায়েল, লেবাননের বন্ধু সিরিয়া এগিয়ে এল তাদের সাহায্যে। দুই পক্ষের ট্যাঙ্ক বাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াই হোল দক্ষিন লেবাননের বিভিন্ন রণক্ষেত্রে। রাশিয়ার টি-৬৪ ট্যাঙ্ক নিয়ে ভালোই বীরত্ব দেখাল সিরিয়ানরা কিন্তু ‘ঈশ্বরের রথ’ মারকাভাই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হোল এসব লড়াইয়ে।
এরই মাঝে ১৯৭৮ সালে মিশরের সাথে ডেভিড ক্যাম্পের শান্তি চুক্তি এবং ১৯৯১এ উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের পরাজয়ের ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে মারকাভা’র প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই ফুরিয়ে গেল। কিন্তু ইসরায়েলের দাম্ভিকতার প্রতীককে তো আর লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখে দেওয়া যায়না, শুরু হোল মারকাভার নতুন মিশন। প্যালেস্টাইন গেরিলা দমনের নামে ট্যাঙ্ক নিয়ে গাজা আর পশ্চিম তীরের জনবসতিতে হানা দিতে লাগল। এরই মাঝে ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে যখন দ্বিতীয় ইন্তেফাদা’র ডাক দেওয়া হোল, নির্মম হয়ে উঠল ইসরায়েল সরকার। ট্যাঙ্ক থেকে গোলা বর্ষণ করা হোল সাধারণ বাসা বাড়িতে, পাথর হাতে শিশুরা পথে নেমে এলে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হোল তাদের।


পাথর হাতে দানবের মুখোমুখি শিশুরা

প্রায় দু’যুগ ধরে দানব মারকাভার বিরুদ্ধে অসহায় ভাবে মার খেল ফিলিস্তিনিরা, কিন্তু এরই মাঝে তাদের মাঝে সৃষ্টি হোল একদল নতুন প্রজন্মের গেরিলা। পাথর আর হাতে বানানো রকেট লাঞ্চারের পাশাপাশি তারা খুঁজতে লাগল মারকাভা ধ্বংসের কৌশল। মারকাভা সম্পর্কে সব তথ্য পেয়ে গেল হাতের নাগালেই, গর্বের প্রতীক মারকাভার সমস্ত তথ্যাদি ইসরায়েল যত্ন সহকারে দিয়ে রেখেছে ইন্টারনেটে। এগুলো ঘাটতে ঘাটতেই গেরিলা গ্রুপ সালাহদিন ব্রিগেড আবিষ্কার করল ট্যাঙ্কের সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটা হচ্ছে এর পেটের দিকে নীচে, আর্মার খুবই দুর্বল সেখানে। শুরু হোল মারকাভার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ।

অবশেষে ২০০২এর ফেব্রুয়ারিতে মারকাভা শিকারের জন্য ইহুদী বসতির কাছাকাছি এক রাস্তায় মাইন পেতে রাখল। প্রথমে লক্ষ্যবস্তু বানাল একটি সামরিক কনভয়কে, আক্রান্ত হতেই উদ্ধারের জন্য এগিয়ে এল মারকাভা ট্যাঙ্ক। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানো মাত্রই রিমোটের বাটন দাবাল গেরিলারা, ৮০কিলো ওজনের মাইন বিস্ফোরিত হোল মারকাভার পেটের নীচে; টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। ঘরে তৈরি বোমার আঘাতে বহুদিনের দর্পচূর্ণ হয়ে যাওয়ায় হতাশার ছায়া নেমে এল ইসরায়েলিদের মাঝে আর এদিকে ফিলিস্তিনিদের মাঝে সৃষ্টি হোল তীব্র উল্লাস এবং আশার।
সালাহদিন ব্রিগেডের এই সাফল্যে অন্য গ্রুপগুলোর মাঝে একইসাথে ঈর্ষা এবং উদ্দীপনার সৃষ্টি করল। একই বছর সেপ্টেম্বরে আবারো আক্রমণ আসল মারকাভার উপর, এবার কাজটি করল আল-কুদস ব্রিগেড। নেট ঘেঁটে তারা আবিষ্কার করল ট্যাঙ্কের ব্যাক-ডোরটি’র আর্মার অনেক পাতলা। সাধারণ আরপিজি রকেট দিয়ে সেখানে আঘাত করল, রকেটের গোলা ভিতরে গিয়ে বিস্ফোরিত হোল; সাথে ট্যাঙ্কের ভিতরে গোলা বিস্ফোরিত হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। ট্যাঙ্কের টুকরা উড়ে গিয়ে মাইলখানেক দূরে গিয়ে পড়ল। ব্যস শুরু হোল মুক্তিকামী প্যালেস্টাইন গেরিলাদের মারকাভা শিকার। আরও ট্যাঙ্ক ধ্বংস হোল তাদের মাইনের ফাঁদে পড়ে।


মারকাভা বিস্ফোরিত স্থানে পাশের একটি বাড়ির দৃশ্য

এদিকে মারকাভার এই দুর্দশা দেখে সবচেয়ে বড় দানটি দিল হিজবুল্লাহ গেরিলারা। ২০০৬ এর ১২ই জুলাই সকালে প্রথমে রকেট হামলা চালানো হয় ইসরায়েলের ভিতরে, সৈন্যদের ব্যস্ততার সুযোগে অন্যদিক দিয়ে ইসরায়েলের সীমান্তের ভিতরে ঢুকে পড়ে হিজবুল্লাহ গেরিলারা, লুকিয়ে থেকে হামলা চালায় টহলরত দুটি হামভি যানের উপর। বেশ কিছু সৈন্য আহত এবং নিহত হয় আর দুজনকে বন্দী করে সাথে করে নিয়ে যায় হিজবুল্লাহরা। এদিকে খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হয় একটি মারকাভা ট্যাঙ্ক ও একটি সাঁজোয়া যান। এগুলোও আক্রমণের স্বীকার হয়, মাইনের আঘাতে মারকাভা ধ্বংস হয়ে ৪জন ক্রু মারা যায়।
হিজবুল্লাহদের এই আক্রমণে গোটা ইসরায়েলে বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা, জাতীয় নিরাপত্তা কল করে সারা দুনিয়া হতে ডেকে আনা হোল অস্থায়ী সৈনিকদের। ১৯৮২এর মত এইবারও একই কৌশল অবলম্বন করল ইসরায়েল, দুর্ভেদ্য মারকাভার বিশাল বহর পাঠিয়ে দ্রুত এবং যথাসম্ভব কম ক্ষতির শিকার হয়ে অভিযান সফল করা। ইসরায়েলের চীফ অফ স্টাফ দম্ভোক্তি করল, ‘লেবাননের ঘড়ির কাটা ২০বছর পিছিয়ে দিয়ে আসব আমরা’।

প্রথমেই উপর্যুপরি বোমা-বর্ষণ করে হিজবুল্লাহদের যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল করে দিল ইসরায়েলের বিমান বাহিনী, পরে দুইদিক দিয়ে ফ্রন্ট খুলে লেবাননের ভিতরে প্রবেশ করল মারকাভা বহর। প্রথম রাস্তাটি ছিল আল খ্যাইয়াত গ্রামের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া দুর্গম, সঙ্কীর্ণ উপত্যকা। চারিদিকে উঁচু পাহাড়ে বেষ্টিত এই অঞ্চলটি ছিল অসংখ্য গুহা, বড় বড় পাথর আর গাছ গাছালিতে পরিপূর্ণ; যাকে বলা যায় গেরিলা যুদ্ধের জন্য আদর্শ স্থান। আশেপাশের গ্রাম এবং পাহাড়ের ঢালে লুকিয়ে থেকে আশ্রয় নিল হিজবুল্লাহ গেরিলারা, তাদের হাতে ছিল রাশিয়ার তৈরি মেসেট এবং কর্ণেট নামক এন্টি ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল; যেগুলো বানানো হয়েছিল আমেরিকার আব্রাম এম১ ট্যাঙ্ককে ধ্বংস করার জন্য আর হিজবুল্লাহরা সেগুলো কাজে লাগাল ঈশ্বরের রথের বিরুদ্ধে।


কর্ণেট এন্টি ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল

প্রথম আঘাতটি আসল ট্যাঙ্ক বহর উপত্যকার ভিতরে সাড়ে তিন মাইল অগ্রসর হবার পর। মরণভেদী লক্ষ্য নিয়ে আঘাত করল মিসাইল, ধ্বংস হতে লাগল একের পর এক ট্যাঙ্ক। গুহা, গ্রামের পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর মধ্যে ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল গেরিলারা যতক্ষণ না ট্যাঙ্কের দুর্বলতম স্থানটি মিসাইলের নাগালে না আসছে। ৭৩’এর পরে আবারো সেই বিভীষিকার মুখোমুখি হোল ইসরায়েল, অনেক ট্যাঙ্ক আর ক্রুদের জীবন বিসর্জন দিয়ে সামনে এগুতে হোল তাদের।
প্রথম পথে বিপর্যয়ের পর ইসরায়েলিরা দ্বিতীয় পথে আগানোর সিদ্ধান্ত নিল, কিন্তু এটি ছিল ফুটন্ত কড়াই হতে জ্বলন্ত চুলায় ঝাঁপ দেবার মতই। অত্যন্ত সরু, সাপের মত এঁকেবেঁকে চলে গেছে ওয়াদিল আহজাদ নামের এই গিরিপথ, যদি সামনের বা পিছনের ট্যাঙ্কটি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে আর সেখান হতে বের হবার পথ বন্ধ। এই সুযোগটিই কাজে লাগাল হিজবুল্লাহরা, ফাঁদে পড়া ট্যাঙ্কগুলোর একদম কাছে গিয়ে সরাসরি আঘাত করে ধ্বংস করতে থাকল তারা। অসংখ্য ট্যাঙ্ক হারিয়ে কোনমতে মৃত্যুকূপ হতে পালিয়ে বাঁচল তারা।


হিজবুল্লাহদের মিসাইলের আঘাতে বিধ্বস্ত মারকাভা

সুপ্রশিক্ষিত এবং আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হিজবুল্লাহ বাহিনীর গেরিলা আক্রমণে পুরোই নাস্তানাবুদ হোল ইসরায়েলি বাহিনী। সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গায় আড়ালে উত পেতে থাকা শত্রুর মোকাবেলা করতে করতে মাসখানেকের মধ্যেই সম্পূর্ণ মনোবল হারিয়ে ফেলল তারা, এদিকে ইসরায়েলি শহরগুলোতে গুপ্ত রকেট হামলায় প্রতিদিনই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকল যোদ্ধাসহ অসংখ্য সাধারণ নাগরিক। অবস্থা বেগতিক দেখে জাতিসংঘের যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাবে সায় দিল ইসরায়েল। তাদের অবস্থা তখন ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’, ইতিমধ্যেই তাদের গর্বের প্রতীক মারকাভার ৩৭০টির মধ্যে ৬০টিই হিজবুল্লাহদের হামলায় হারাতে হয়েছে। হতাশা আর মৃত্যুভয়ে ভীত সৈনিকদের ঘরে ফিরিয়ে এনে যুদ্ধের সমাপ্তি টানল ইসরায়েল আর হিজবুল্লাহরা মেতে উঠল বিজয় উল্লাসে।

এই বিজয়ের ফলে হিজবুল্লাহরা জনগণের চোখে পরিণত হোল জাতীয় বীরে এবং ২০০৮সালে তারা মন্ত্রিত্বসহ রাষ্ট্রীয় সদস্যপদ লাভ করে। অপরদিকে এই পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধানে ইসরায়েলে শুরু হোল ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক, বিশেষ করে গর্বের প্রতীক মারকাভার পতনের কারণ নিয়ে শুরু হোল অনুসন্ধান। কারও মতে মধ্যপ্রাচ্যের গেরিলা যুদ্ধের মোকাবেলায় মারকাভা অকার্যকর, তাই একে বাতিল করা হোক; আবার কারও মতে মারকাভা হচ্ছে ইসরায়েলের ভূমিষ্ঠ সন্তানস্বরূপ, কোন মতেই একে পরিত্যাগ বা হত্যা করা যাবেনা। যাই হোক, ইসরায়েলের মারকাভা প্রজেক্ট এখনো চলছে; মারকাভা I, II, III এবং IV পেরিয়ে এখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ট্যাঙ্ক বানাচ্ছে তারা। কিন্তু কথা হোল, সকল শক্তিরই পতন হবে একদিন; যেভাবে নিরীহ মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে, তার পরিণাম কখনো ভালো হতে পারে না। আমাদের সকলেরই আশা রক্তস্নাত অশান্ত মধ্য-প্রাচ্যের বুকে একদিন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

মারকাভা সম্পর্কিত কিছু সাধারণ তথ্যঃ
বডি বা আর্মারঃ ক্লাসিফায়েড/ অজ্ঞাত। তবে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালস (ধাতু, প্লাস্টিক সমন্বয়ে)
ওজনঃ ৬৫ টন
উচ্চতাঃ ২.৬৬ মিটার
প্রধান কামানঃ ১২০মিমি
ইঞ্জিনঃ ১৫০০ হর্স পাওয়ার
অপারেশনাল রেঞ্জঃ ৫০০ কিমি
গতিঃ ৫৫-৬৪ কিমি/ঘণ্টা

[উৎসর্গ, প্রিয় লেখক ইমন জুবায়ের। আমরা পাঠক হিসেবে ক্লান্ত হয়ে গেলেও, লিখতে গিয়ে যার কখনো ক্লান্তি আসেনি]

তথ্যসূত্র
ইউটিউব ভিডিও ১
ইউটিউব ভিডিও ২
View this link
View this link
View this link
View this link

সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১২:০৪
৩১টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×