পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানটায় আমাদের আড্ডা। সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য, রাজনীতি, খেলাধূলা কোনটাই বাদ যায় না আমাদের আলোচনা থেকে। এ যেন মাসকাওয়াথ আহসানের 'অদ্ভুত আধাঁর এক'-এর অ্যারিষ্টটলের পাঠশালা। 'কাশবন' নামে একটা সাহিত্য ক্লাব নিয়েই আমাদের চিন্তা-ভাবনার আবর্তন। রাজনীতি থেকে সবাই একটা নিরাপদ দূরত্বে। কেন জানি রাজনীতিটাকে বড় বেশি অর্থহীন মনে হয়। তারচেয়ে ঢের ভালো জীবনানন্দের কবিতায় লক্ষীপেচাঁর ডাক শোনা, আহমদ ছফার প্রবন্ধ সংকলনের বিশ্লেষনে কালক্ষেপন করা, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের 'বহে জলবতী ধারা' থেকে শৈশবের হারিয়ে যাওয়া নদীটাকে খুঁজে ফেরার চেষ্টা করা কিংবা আবু হাসান শাহরিয়ারের জবানীতে উত্তরাধুনিকের ব্যবচ্ছেদ করা। তবুও আমরা দূরে থাকতে পারিনা। সাহিত্যের অলি-গলি-পাকস্থলি ভ্রমণ শেষে একসময় আমরা যখন সবুজ আঙিনার সম্ভাবনার দিকে দৃষ্টিপাত করি তখন রাজনীতি প্রসঙ্গই উঠে আসে প্রাসঙ্গিকভাবে। আমরা তখন হতাশ হই।
আমাদের সাত জোড়া চোখ গ্রাস করে গাঢ় অন্ধকার। স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দলটি এখন আদর্শচ্যুত, নীতিহীনতার গড্ডালিকা প্রবাহে আকন্ঠ নিমজ্জিত। অন্য বৃহত্তর দলটির নীতিই নেই, যুদ্ধপরাধীদের নিয়ে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করে চলেছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। শহীদ মিলনের আত্মদান আর নুর হোসেন রক্তের দাগ হৃদয় থেকে মুছে ফেলার মতো দু:সাহস নেই বলে স্বৈরাচারী ভাঁড়কে মেনে নেয়ার প্রশ্নই আসে না। বামদলগুলোর প্রতি কিছুটা সহানুভূতি এখনো রয়ে গেছে (কাগজের দাম বাড়লে এখনো যে প্রথম প্রতিবাদটা তাদেরই করতে দেখি) যদিও তাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীনের লেজুড়বৃত্তি করতে করতে নিজেরাই অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। আমাদের সামনে এখন কোন আইকন নেই। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে কোন রাজনীতিবিদই আইকন হতে পারেনি। তাই আমরা দ্বিধাযুক্ত।
তবে একজন মানুষ আছেন যিনি দ্বিধাহীনভাবে আমাদের হৃদয় জুড়ে আছেন। তিনি কালের ক্ষুদ্র কোন অংশ নন, তিনি নিজেই এক মহাকাল। তিনি ইতিহাসের সামান্য এক চরিত্র নন, তিনি নিজেই এক ইতিহাস। তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। যাঁর সাহসিকতা, অবিচল সংগ্রাম, আর সুনিপুণ দিকনির্দেশনায় আজ আমরা লাল সবুজের পতাকার গর্বিত মালিক। আমরা তাঁকে বাবা বলেই জানি, নিজের বাবার মাঝে সতত তাঁর ছায়া খুঁজে বেড়াই।
২.
আমরা যেখানে আড্ডা দেই ঠিক তার বিপরীতে আরেকটা দোকান আছে। সেখানেও আড্ডা চলে নিয়মিত। আমরা তাদের এড়িয়ে চলি আদর্শগত অবস্থানের কারণে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া আর তার ফাঁকে রগ-কাটা বিদ্যায় পারদর্শী হওয়ার মতো মনোবৈকল্য আমাদের ঘটেনি এখনো। তবে দিন কয়েকের মধ্যে যখন অনেকের বেশ-ভূষা পাল্টে যায়, রঙচঙা টি শার্টের বাহার দেখি তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না বায়তুল মালের টাকায় ভালোই দিন কাটছে ওদের। আমাদের সাথে তাদের বিরোধ নেই, সখ্যতা থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। এভাবেই কেটে যেচ্ছে দিন।
তবে নির্বিরোধ থাকা খুব বেশিদিন সম্ভবপর হলো না। ক্ষমতার দাপটেই বোধহয় আমাদের আড্ডার ডানপাশের ওয়ালে, যেখানে আমরা লিখেছিলাম- 'রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল - কাশবন' সেই লেখাটা মুছে ফেলা হলো। আমরা ক্ষুব্ধ হই, পাভেল ভাই আমাদের শান্ত করেন, ধৈর্য্য ধরতে বলেন। আমরা ধৈর্য্য ধরি। তার ঠিক দুই দিন পরে দেখি, সে জায়গায় লেখা হয়েছে, 'শেখ মুজিব জাতির পিতা হলে আমি কার সন্তান?' নীচে রগ-কাটা সংগঠনটির নাম, সেই নাম উচ্চারণ করতেও আমাদের ঘৃণা হয়।
যে পাভেল ভাই আগের দিন আমাদের নিবৃত্ত করেছিলেন তিনিই সেদিন বললেন, প্রতিরোধ শুরু হওয়া উচিত প্রথম স্তরেই। তোরা একটু অপেক্ষা কর, আমি আসছি। বলেই তিনি বাসার দিকে হাঁটা দিলেন। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এলেন। উনার হাতে ব্রাশ আর রঙের কৌটা (কাশবন-এর ব্যানারের, পোস্টারের সব কাজ তিনি নিজেই করতেন)। তিনি বললেন, বাবার অপমান কোন সন্তান সহ্য করতে পারে না, করা উচিতও নয়। তিনি ওদের সামনেই ওই লেখাটির ঠিক নীচে বড় বড় করে লাল অক্ষরে উত্তর লিখলেন- "তুই রাজাকারের সন্তান।" আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রইলাম, সেই সাথে শ্রদ্ধায় অবনত হলাম। তবে জানতাম ওরা সুযোগ খুঁজবে প্রতিশোধ নেয়ার। তাই বার বার পাভেল ভাইকে সাবধান করে দিলাম সবাই।
৩.
আমাদের আশঙ্কা মিথ্যে হয়নি। ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় রাতে বাড়ি ফেরার পথে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন পাভেল ভাই। আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না কে বা কারা করেছে এই কাজ। সবুজ জমিনে নিজ হাতে বিছিয়ে দিলাম পাভেল ভাইয়ের নিস্তব্ধ শরীর। আমাদের নি:শ্বাস ভারী হয়ে আসে। পাভেল ভাইয়ের কথাটা বার বার মনে পড়ে, প্রতিরোধ শুরু হওয়া উচিত প্রথম স্তরেই। মনে পড়ে, চে ইজ ডেড বাট ফাইট গোজ অন। সপ্তমকে বলি, যা পাভেল ভাইয়ের সেই ব্রাশ আর রঙের কৌটাগুলো নিয়ে আয়। সপ্তম নিয়ে আসে। তারপর আমরা পাভেল ভাইয়ের লেখাটির ঠিক নীচে ওদের সামনেই আরো ছয়বার লিখি আনকোড়া হাতে-
"তুই রাজাকারের সন্তান।"
"তুই রাজাকারের সন্তান।"
"তুই রাজাকারের সন্তান।"
"তুই রাজাকারের সন্তান।"
"তুই রাজাকারের সন্তান।"
"তুই রাজাকারের সন্তান।"
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০০৭ রাত ৩:০১