হাসিমোটো সন্ধের পর মেডিটেশন এ বসেছিল। প্রতিদিনই বসে। নিয়ম ভেঙ্গে গেল ওর মেয়ে লিয়ার ডাকে।
-বাবা, ফোন বাজছে তোমার।
ধ্যান ভেঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে পড়ল হাসিমোটো। ফোনটা নিয়ে কানে ঠেকাল,
-হ্যালো।
-সাগারা, ফিনিক্স।
-শুনছি।
-তোমার সাহায্যের প্রয়োজন।
-অনেক বছর চলে গেছে রায়ান, আমি এখন রিটায়ারমেন্টে আছি।
-আই নিড ইওর সোর্ড। ইটস সাঈদ।
রিসিভারটা শক্ত করে মুঠোর মধ্যে ধরল হাসিমোটো,
-সে আমাদের শত্রু না।
-না, তবে আমি এখন খুব একটা নিশ্চিত না।
-আমাকে কি করতে হবে?
-আমি তোমাকে এপ্রক্সিমেট লোকেশন পাঠাচ্ছি। সাঈদ এর মিগের ক্র্যাশ লোকেশন। ওকে থামাও সাগারা।
-দেখছি কি করা যায়।
ফোনটা নামিয়ে রাখল হাসিমোটো সাগারা।
ইওচি মাউন্টেইন এর মিলিটারি বেজ এর কমান্ডার লেফট্যানেন্ট কর্নেল সাগারা।
জঙ্গল থেকে বের হয়ে কিয়টো শহরে পৌঁছতে পরদিন রাত হয়ে গেল। সাগারা কে কন্ট্যাক্ট করে খুজে পেতে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল রায়ান। এসএএস এ থাকাকালীন ওদের সেফহাউজ ছিল। এখন কার দায়িত্বে আছে কে জানে!
দরজার কড়া নেড়ে জুতো দিয়ে মাটিতে আঁকিবুঁকি করতে লাগল রায়ান। কিছুক্ষন পর দরজা খুলে এক বৃদ্ধা মুখ বের করলেন। জাপানিজ এ স্বাগত জানিয়ে পরিচয় জানতে চাইলেন।
রায়ান এক পা পিছিয়ে দাঁড়াল। বৃদ্ধার নজর মাটির দিকে পড়ল, এক মুহূর্ত নকশাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বাউ করে সরে দাঁড়ালেন। রায়ান ভেতরে ঢুকল। মূল বাড়ির দিকে না গিয়ে অদূরে টুলশেডের দিকে এগিয়ে গেল। বৃদ্ধা টুলশেডের দরজার তালা খুলে দিয়ে সরে গেল দৃষ্টির বাইরে। রায়ান ভেতরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে নিল। একটা বেলচা তুলে নিয়ে মাটিতে ঘা বসাল। কিছুক্ষণ পর ঘর্মান্ত হয়ে থামল। যা খুঁজছিল বের হয়ে এসেছে। একটা বাক্স। ছয় বাই দুই সাইজের। বেলচা দিয়ে বারি দিয়ে পুরনো তালাটা ভেঙ্গে ফেলল।
ডালা তুলতেই যেন একটা পুরনো অতীত ঝাঁপ দিয়ে চোখের সামনে চলে এল। একটা এআই স্নাইপার রাইফেল, সিগ সাওয়ার, ওয়ালথার, এম১৬, এক্সপ্লোসিভ, নাইফ সেট, বুলেটস, কেভলার, কারেন্সি, পাসপোর্টস। হাত বাড়িয়ে খাপে মোড়া কাতানা তুলে নিল রায়ান। খাপ থেকে খুলে ব্লেডটায় হাত বুলাল। যেন সেই শেষ চিৎকারগুলো, সেই অবাক শেষ দৃষ্টি, কারো উদ্ভ্রান্তের মত বেঁচে থাকার আকুতির সব স্মৃতিগুলো একটা শিহরণ বইয়ে দিল রায়ানের প্রতিটা শিরায়। যেন কাতানাটা ওকে পুরনো কেউ একজন হতে সাইরেনের মতো গান শোনাচ্ছিল। বড় নেশাময় সে গান, ভীতিকর সেই পরিচয়। উন্মত্ত সেইসব দিন... এঞ্জেলস অফ ডেথ... রায়ান আর সাঈদ...
হাতলটা ছেঁড়ে দিতেই খাপে ঢুকে গেল ব্লেড। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেল যেন রায়ান। একটা ব্যাগে যা যা প্রয়োজন ঢুকিয়ে নিল। টুলশেড থেকে বেরিয়ে এল ও। বৃদ্ধা খেতে ডাকল ওকে। রায়ান বেশ অনেক ঘণ্টা পর কিছু পেটে দেয়ার চান্স পেয়ে রাজি হয়ে গেল।
খাওয়া শেষে বৃদ্ধা একটা কাগজ দিল ওর হাতে। সময়টা দু ঘণ্টা পরে। দেখা করতে বলা হয়েছে। ইনিশিয়াল দেয়া এইচএস।
বৃদ্ধাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ব্যাগটা কাধে ফেলে বেরিয়ে এল রায়ান।
রায়ানের কাছ থেকে মেসেজ পাওয়ার পর শায়খ চলে এসেছে রাশিয়ায়। জেসন আগেই অপেক্ষা করছিল। দুজনে মিলে সাঈদের সম্ভাব্য এন্ট্রি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করে নিল। এমআইসিক্স এর ইন্টেল যথাসময়ে পেয়ে যাচ্ছে ওরা। সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে ওয়াচার বসানোও হয়েছে। সাঈদকে দেখা মাত্র ওরা জানতে পারবে। এখন অপেক্ষার পালা। নিজেদের সেফ হাউজে বসে তাই করতে লাগল জেসন। আর শায়খ বের হল গাড়ি নিয়ে। টহল দিতে লাগল এপথ, ওপথ।
পিডিএ তে দেখতে পেল রায়ান সঠিক কোঅরডিনেটে পৌঁছে গেছে প্রায়। জাপানিজ আর্মির স্পেশাল ইউনিটের ইউনিফর্ম পরা কিছু সৈন্যকে গার্ডে থাকতে দেখল। কাঁধের ব্যাগ একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রেখে সৈন্যদের এড়িয়ে কর্ডনের ভেতরে ঢুকে পড়ল। একটা ক্র্যাশ সাইট এটা। দূর থেকে প্লেনটা দেখেই চিনতে পারল রায়ান। এটাতে করেই ওরা পালিয়ে ছিল ইওচি থেকে। ল্যান্ডিং গিয়ার ভেঙ্গে গেছে প্লেনটার। এঞ্জিন থেকে এখনও ধোঁয়া বের হচ্ছে। কন্ট্রোল থেকে থেকে স্পার্ক করে উঠছে। ছ’ফুটের বেশি লম্বা একজন সিভিলিয়ান ড্রেসের লোক পরিক্ষা করছে প্লেনের কাছে ঝুঁকে। সন্তর্পণে তার পেছনে এসে দাঁড়াল রায়ান।
-স্ট্যাটাস?
-ক্র্যাশ করেছে ছয় ঘণ্টার মত হবে। আমরা ঘণ্টা দুয়েক আগে পৌঁছেছি।
-বম্ব?
-একদিকে কাত হয়ে ক্র্যাশ করেছে। দুটো মিসাইল ওদিকেই চাপা পরেছে। ওর লোকবল ছিলনা ট্র্যাক দেখে বুঝলাম। স্বাভাবিক। এখানে ক্র্যাশ করতে হবে এটা ওর মাথায় ছিল না। একটা ওয়ারহেড খুলে নিয়ে নিউক্লিয়ার কোর আলাদা করে নিয়ে গেছে।
-একটাও ওর হাতে বিপদজনক।
-এখন কি করতে বলো?
-তুমি অফিশিয়ালি চার্জ নাও ব্রিটিশদের সাথে কন্টাক্ট করে।
-আর সাঈদ?
-ওকে আমিই সামলাবো। ধন্যবাদ সাগারা। সায়োনারা।
ঘুরে জঙ্গলে মিশে যাচ্ছিল রায়ান। পেছন থেকে বলল সাগারা,
-উই আর হু উই আর রায়ান এন্ড রিমেম্বার, আকু সকু যান।
অন্ধকারে মিশে গেল রায়ানের অবয়ব।
রেল স্টেশনে ঢুকল সাঈদ। হাতে বেঢপ সাইজের একটা ব্রিফকেস। প্ল্যান হচ্ছে রেলে করে যতটা সম্ভব সীমানার দিকে এগিয়ে যাওয়া। সেখান থেকে রাশিয়া যাওয়ার পথ খুঁজে নেবে। সুটকেসটা জ্বালাচ্ছে। পিওর নিউক্লিয়ার কোর নিয়ে এভাবে চলাফেরা করা খুবই রিস্কি। ওদিকে আর কোন পথও নেই। বম্বটা নির্দিষ্ট একটা লক্ষে পৌঁছুতেই হবে। গাড়িতে উঠে বসল সাঈদ। প্ল্যাটফর্মে সতর্ক দৃষ্টি হানছে ওর চোখদুটো। না, সেরকম কোন বিপদ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। রেগুলার রেল গার্ডস আছে কিছু। সম্ভবত এখনও রায়ান কিছু করতে পারেনি। ভালই হয়েছে ওর জন্যে। সাঈদ প্লেন ক্র্যাশের পর তেমন হতাশ হয়নি। জাপানে এটা ওর প্রথম যাত্রা না। এটা ওর জন্য যুদ্ধক্ষেত্র। ওর এবং রায়ান দুজনের জন্যেই। সেটার জন্যেই সমস্যা। বম্বটা সাথে না থাকলে ও নির্দ্বিধায় রায়ানের সাথে লড়তে পারতো। কিন্তু এখন একটা লায়াবিলিটি নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। মাথা ধরেছে সাঈদের খুব। বেশ কিছুদিন এই সমস্যা হচ্ছে ওর। প্রথমে হাল্কা মাথাব্যাথা, এরপর ভয়ানক থেকে ভয়ানক। যেন কোন নামী আর্টিস্টের মিউজিক পারফরম্যান্স। ধিরলয়ে শুরু হয়ে সর্বস্ব কাঁপিয়ে দিয়ে তারপর থামা। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। বগিতে শেষ একবার কড়া দৃষ্টি বুলিয়ে সাইট হেলান দিয়ে চোখ মুদল সাঈদ। এক হাত পাশে রাখা ব্রিফকেসের হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে রেখেছে। আরেক হাত কোটের পকেটে পিস্তলের গ্রিপে। মাথা ব্যাথাটা বারছে...বেড়েই চলেছে।
প্রায় ঘণ্টা তিনেক পার হয়েছে বুঝতে পারল সাঈদ মনের ঘড়ির মাধ্যমে। ট্রেনটা একটা স্টেশনে থামছে। ঘুম ভাঙ্গা চোখে প্ল্যাটফর্মে নজর বুলাল সাঈদ।‘ চমকে উঠল কিছু রেগুলার আর্মি ইউনিফর্ম দেখে। ওর রুট কি রায়ান বুঝে ফেলেছে? না, সেটা সম্ভব না। রায়ান সম্ভবত সব জায়গাতেই পাহারার ব্যবস্থা করেছে। ট্রেনে সৈন্যদের ঢোকার কোন ইচ্ছে দেখল না। ওরা কে নামসে আর কে উঠছে সেদিকে লক্ষ্য রাখছে। সাঈদ ট্রেন আবার ছাড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। ট্রেন ছেড়ে স্টেশন পেড়িয়ে বের হতেই লাফ দিল দরজা থেকে। কুয়াশায় ভেজা মাঠে পড়ল ওর শরীর। দুটো পাক খেয়েই উঠে স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে শুরু করল ও। পসারণকারী ট্রেনের ছেড়ে আসা বগি থেকে কেবল কয়েকজন যাত্রী বিস্ময়ে চোখ বড় করে ওকে শেষবারের মত দেখে নিল।
সাঈদ কিয়টো থেকে সহজেই বের হতে পারল। তবে জাপান থেকে বের হতে বেশ বেগ পেতে হল ওকে। পাঁচবার বেশ পাল্টাতে হয়েছে ওর। জাপানিজ আর্মি ওর বেরোবার সব পথ বন্ধ করে রেখেছে। ওর লোকদের মাধ্যমে খবর পেয়েছে রাশিয়ায় ঢোকার পথগুলোতেও পাহারা দিচ্ছে জেসন আর শায়খ। ছদ্মবেশে ছদ্মবেশে ও কেবল তাদের হাত থেকেই বেঁচে থাকল। কিন্তু জাপান থেকে বম্ব ও বের করতে পারছে না, নিজেও বম্ব রেখে বের হতে পারছে না। এর মধ্যে কয়েকবার রায়ানের চোখে ধরা পরতে পরতে বেঁচে গেছে। একটা বারে বসে ও ভাবছিল এখন কি করা যায়... এতদিন পর্যন্ত প্রতিটা জিনিস প্ল্যানড ছিল ওর। সব ছিল নিখুঁতভাবে সাজানো। জেলে রায়ান দেখা করার পর এলোমেলো করে দিয়েছে যেন সব... ওর ভেতরের আদিম খুনে আগুন যেন দাউদাউ করে জ্বলছে...
আরেক রাউন্ড স্থানীয় সাকি শেষ করে দরাম করে কাপটা রাখল ও টেবিলে। বিল রেখে উঠে পরল। একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। আর অপেক্ষা, লুকোচুরি ও করবে না। অনেক হয়েছে।
ওর এজেন্সির লোকাল অফিস ইউজ করছে রায়ান। সেফ হাউজের ধার ধারেনি। এখান থেকে নিজেই সাগারা, জাপানিজ মিলিটারি, নেভি সবার সাথে লিয়াজো হিসেবে কাজ করছে। সাঈদের দেখা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে কিছুক্ষন বেশ কিছু জায়গা নিজে টহল দিয়ে এসেছে রায়ান। কিন্তু সাঈদের দেখা ও নিজেও পায়নি। তাই আবার অফিসে ফিরে এসে কি করবে তাই ভাবছিল। এখানকার এজেন্সি চিফ জামান একবার উঁকি দিয়ে দেখতে এসেছিল স্যার কি করছে। থমথমে মুখ আর হাতে সিগারেট দেখে কেটে পরেছে। ওর দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দিনেই শায়খ রায়ান ওকে বলেছিল,
-শুন জামান, আমরা জানি সাধা ধোঁয়া সন্ধির প্রতীক। তবে আমাদের বসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো।
-কেমন?
আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল জামান। শায়খ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
-যখনই দেখবে ওর হাতে সিগারেট, বুঝবে অশনি সংকেত দেখছ, মনের ভিতর যুদ্ধ চালাচ্ছে সে... সো, মানে মানে কেটে পরবে। ইউ গট দ্যাট?
-ইয়েস স্যার।
সটান হয়ে বলেছিল জামান। সে কথাই মনে রেখেছে সে। রায়ানের হাতে সিগারেট, তাই সে জাস্ট কেটে পড়তে পেরেই বাঁচল।
দুবার রিং হতেই স্যাটফোনটা নিয়ে কানে লাগাল রায়ান,
-সাঈদ বলছি।
-বল।
-আর না। অনেক হয়েছে।
-আমিও তাই বলি। ধরা দে।
-ধরা আমি দেব না। বরং তুই আমার বের হবার ব্যবস্থা করবি।
-রক্তের নেশার সাথে কি লিকয়ারটাও গিলেছিস নাকি?
-রান রান রান ওয়ে,
ডোন্ট প্লে নিয়ার হিয়ার
হিয়ার লাইস দ্যা ওয়ান
হু আই কলড ডিয়ার...
চকিতে একটা কবরফলক, নিজের লেখা এপিটাফ চোখের সামনে ভেসে উঠল রায়ানের। ফোনে হাতের আঙ্গুলগুলো যেন ডেবে যাচ্ছে ওর। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-কি বলতে চাইছিস তুই?
-আই হ্যাভ হার। তুই আমাকে যে মুহূর্তে রাশিয়া পর্যন্ত সেফ প্যাসেজ দিবি, আমি তোকে ঠিকানাটা জানাবো। এন্ড পিএসঃ সি ইজ ভেরি মাচ অ্যালাইভ। রেস্ট ইজ আপ টু ইউ।
মুঠোর ভিতর টাস করে ফোনটা ভাঙল রায়ানের। কল কেটে দিয়েছে সাঈদ। আরেকটা ফোন নিয়ে জেসনকে কল করল ও।
-স্যার?
-একটা প্যাসেজ বানাও জেসন, সাঈদ ওর বোমা নিয়ে রাশিয়ায় ঢুকবে।
-স্যার, আর ইউ শিওর?
-ডু এজ আই অর্ডারড।
-ইয়েস স্যার।
সামনে বসা শায়খের দিকে তাকিয়ে শ্রাগ করল জেসন। শায়খ বলল,
-কি ব্যাপার?
-কোন এক্সপ্লেনেশন না দিয়ে বললেন প্যাসেজ ওপেন করতে।
-মাথাটা গেছে নাকি?
-কেয়ারফুল শায়খ।
ভ্রুকুটি করল জেসন। বসের নামে উল্টোপাল্টা কোন কথা ওর সামনে বলতে কেউ সাহস করেনা। বলল,
-আমার ধারণা সাঈদ কোন কিছু একটা খুঁজে বের করেছে স্যারকে ব্ল্যাকমেইল করার।
-তাহলে আর চিন্তা নেই। ওকে ব্ল্যাকমেইল করলে খেলার শেষ সাঈদ নিজেই টেনে আনছে। হি ডাজন্ট লাইক টু বি ব্ল্যাকমেইল্ড অ্যাট অল।
হাসল শায়খ। ওর ফোন বেজে উঠল এ সময়।
কলটা কেটে সোজা একটা পে-ফোনে ঢুকল রায়ান।
-আমি রায়ান বলছি।
-আপনি? কি ব্যাপার?
-ব্যাপার অনেক কিছুই। কিছু তো আপনি জানেনই। এখন আমাকে কিছুটা জানান।
-কি জানতে চান, বলুন।
-হোয়াট হ্যাপেন্ড টু হার এক্সাক্টলি দ্যাট ডে?
-আপনি এ লাইনটার কাছে থাকুন। আমি এক ঘণ্টা পর আপনাকে জানাচ্ছি।
নিজের ফোন থেকে শায়খকে ফোন করল রায়ান,
-যা করছিস বন্ধ কর। মস্কোর কোথায় সাঈদ কাউকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বন্দি করে রাখতে পারে সম্ভাব্য সকল জায়গা বের করে আমাকে জানা।
-ভাইয়া, জেসনের সাথে কথা হয়েছে আমার। এসবের মানে কি?
-সাঈদ হ্যাজ হার। আমি এখন পুরো বিস্তারিত বলতে পারব না। সাঈদের পেছনে যেন কোন ফেউ না লাগে। ও বুঝে ফেলবে। তুই যা করতে বললাম কর।
-ওকে।
ফোন রাখতেই ঘড়ি দেখল রায়ান। মাত্র পনের মিনিট পেরিয়েছে। আর পাঁচ মিনিট না যেতেই পে-ফোনটা বেজে উঠল।
-রায়ান বলছি।
-উনি সিআইএ এর হয়ে ফ্রিলান্স কিছু কাজ করেছিলেন। এমন একটাতেই তার ডাবল ব্যবহার করা হয়। শেষে ওদের বিট্রে করায় খেপেছিল সিআইএ। প্রতিশোধ নিতে চাইছিল। আপনার অ্যাকসিডেন্টের সময় ওর সেই ডাবলের বডি ফেলে রেখে আসা হয় সাইটে। আর সে এরপর সিআইএ এর হেফাজতে থাকে। ওরা ভেবেছিল ব্রেইনওয়াশ করে ওকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু আসলে ঘটনা ঘটেছে অন্য। তিনি সবাইকে ঘোল খাইয়ে অনেক ক্লাসিফায়েড ফাইল নিয়ে কেটে পড়েছেন এক মাস আগে। সেই থেকে তিনি লাপাত্তা।
এক মুহূর্ত লাগল রায়ানের সবটা অন্তঃস্থ করতে। বলল,
-এক ঘণ্টার জায়গায় বিশ মিনিটে কাজটা কিভাবে করলেন?
-আই হ্যাভ মাই ওয়েজ। ওদেরকে সে বেঁচে আছে আমি সেটা জানি বলে চাপ দিতেই বেরিয়ে এসেছে সব।
-ধন্যবাদ।
-ইউ আর ওয়েলকাম।
জেসনকে কল করল আবার রায়ান,
-কি অবস্থা?
-দস্তয়ভস্কি পোর্ট ক্লিয়ার।
-শায়খ আছে তোমার কাছে?
-ইয়েস স্যার।
-ফোনটা স্পিকারে দাও, জেসন। খুব মনোযোগ দিয়ে শোন যা বলি...
সাগারাকে বলে জাপানের থেকে বের হওয়ার জন্যেও একটা পোর্ট খালি করল রায়ান। সাঈদকে জানানোর জন্যে কল করল। রুট ডিটেইলস জানানোর পর ঠিকানা দিল সাঈদ। বলল,
-ইউ বেটার ফ্লাই রায়ান... আমার পৌছতে পৌছতে যতটুকু সময় লাগে পাবি। এরপর আর তাকে বাঁচিয়ে রাখা হবেনা। গুড লাক। আই বেটার নট সি এনিওয়ান আফটার মি।
জাপানিজ এয়ারফোর্স থেকে ধার করা একটা বিমান নিয়ে রওনা হয়ে গেল রায়ান রাশিয়ার পথে। হাতে সময় খুব কম।
সাঈদ রায়ানের খুলে দেয়া পথে জাপান থেকে বের হলেও। রায়ানের দেয়া পথে রাশিয়ার ধারেকাছেও গেল না। মাঝপথে বোট থামাল ও। অপেক্ষা করতে লাগল রাডারে চোখ রেখে। এটা একটা জাহাজ রুট। কাঙ্ক্ষিত বিপটা রাডার থেকে আসতেই ব্রিফকেসটা বের করে নিল সাঈদ। বোটটা স্টার্ট দিয়ে পানিতে নেমে পড়ল। সাঁতরে চলে এল বিশাল মালবাহী জাহাজটার এক পাশে। ওর জন্যে ফেলা দড়ি বেয়ে ব্রিফকেস নিয়ে উঠে এল। জাহাজের ক্যাপ্টেন নিজে উপরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় ছিল ওর। উঠে আসতেই হাত মিলিয়ে বললেন,
-আমি ক্যাপ্টেন মাহমুদ।
-আহসান। ঠিক সময়ে পৌঁছানর জন্যে ধন্যবাদ।
-আপনি কি এখন পজেশন এক্সচেঞ্জ করবেন?
ব্রিফকেসটা বাড়িয়ে দিল সাঈদ।
-সি ইট গেট টু দ্যা রাইট প্লেস। ওর ইউ উইল হ্যাভ মি টু ওরি অ্যাবাউট।
-ইয়েস স্যার। প্লিজ, গো টু ইওর কেবিন।
-পথ দেখান।
এখন আবার প্ল্যানমত আগাচ্ছে সাঈদ। তবে প্ল্যানটা নতুন। রায়ানের সমস্ত মনোযোগ রাশিয়ার দিকে সরিয়ে নেয়াই ওর প্ল্যান। ও বলেছে নিজে বম্ব নিয়ে যাচ্ছে রাশিয়ায়। বন্দির ঠিকানাও রাশিয়ায়। আসলে সাঈদ ওর শিপ থেকে মাঝপথেই ফ্রেইটারে উঠে গেছে। সেখান থেকে এ পথ ও পথ দিয়ে ঘুরে পৌঁছে যাবে ইংল্যান্ডে... ওর মূল টার্গেটে।
রায়ান আগেই পৌঁছে গেছে রাশিয়ায়। দূর থেকে নজর রেখেছে দস্তয়ভস্কি পোর্টে। নির্দিষ্ট সময় পেড়িয়ে এক ঘণ্টা পার হতে অস্থির হয়ে উঠল ও। এমন তো হওয়ার কথা না। কিছু একটা গোলমাল আছেই। ফিনিক্সের হেডকোয়ার্টারে কল করল ও। সাঈদের রুট স্যাটেলাইট দিয়ে কাভার করা হচ্ছিল। তার রিপোর্ট ই জানতে চাইল। সাঈদের বোট মাঝপথে থেমেছে এবং তারপর সেটা বেসামাল সাগরে ঘুরে বেড়াচ্ছে জানাল হল ওকে। রায়ান জানতে চাইল,
-বোট থামার সময় কাছাকাছি কোন জাহাজ ছিল?
-না স্যার। তবে ট্রেডশিপ রুট তো। কিছুক্ষন বাদেই একটা জাহাজ ক্রস করেছে। স্বাভাবিক ঘটনা ভেবে আমরা আপনাকে জানাইনি।
-শিট! ইউ ইডিয়েট! গেট দ্যাট শিপস ডেসটিনেশন... নাউ।
ফোনের ওপাশের অপারেটর কেঁপে উঠলো ঝাড়ি খেয়ে। দ্রুত শিপের ডিটেইল খুঁজতে লাগল। নামটা বের করতে পেরে আর সমস্যা হল না ডেসটিনেশন জানতে। হড়বড় করে ফোনে বলল,
-পাওয়া গেছে স্যার। ইংল্যান্ড...
আর কিছু শোনার প্রয়োজন বোধ করল না রায়ান। কল কেটে এয়ারপোর্টের জন্যে গাড়ি ছোটাল। সাঈদের প্ল্যান যাই হোক না কেন, সেটা কোথায় ঘটবে তা ও আন্দাজ করতে পারছে ভালভাবেই।
এসএএস এর পুরনো এক আউটসোর্সের ট্রেইনিং ফ্যাসিলিটি, ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের সীমানার কাছাকাছি... একদম শুরুর দিকের। এসব ফ্যাসিলিটির কথা এখন কারো গলা কাটলেও স্বীকার করবে না। যদিও এখনও প্রায় এরকম ফ্যাসিলিটি আরও বানানো হয়েছে। তবে হয়ত ওদের মত আর কাউকে তৈরি করতে পারেনা... কেন তা এক রহস্য। ভাবল সাঈদ। তবে আর যাই হোক, এখান থেকে কেউ আর বেঁচে ফিরতে পারবে না আজ। একের পর এক ওদের সবগুলো ক্লাস এক্স ফ্যাসিলিটি বের করে শেষ করবে ও। ধ্বংসের খেলায় মাতবে।
সতর্ক হয়ে ভেতরে প্রবেশ করল সাঈদ। কতটা দুর্ধর্ষ আর অমানবিক এখানকার বাসিন্দারা, ওর চেয়ে ভাল আর কে আছে জীবিত? হ্যা, আরেকজন আছে রায়ান... কিন্তু সে কি আসলেই আছে, কিভাবে ভুলতে পারল ও এদের? এতদিন এত কিছু করার পরেও ও এদের কিছু করেনি?
শুন্য গার্ডরুম পার হয়ে এডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিঙে ঢুকল সাঈদ। সেখানেও শুন্য। প্রতিটা অফিস কামরা, মেস... সব খালি... কিচ্ছু নেই, কেউ নেই...
একের পর এক কামরা, বিল্ডিং পেড়িয়ে যেতে লাগল সাঈদ। পাগল হয়ে যাচ্ছে যেন ও। অস্রের ব্যাগটা ছুড়ে ফেলল ও নিষ্ফল আক্রোশে। কোথাও কেউ নেই... জীবিত কোন প্রাণীর চিহ্ন পেল না ও। বিশাল দোতলা সমান উঁচু জিমনেশিয়াম এর মত বিল্ডিঙটার ভেতর ঢুকে দাঁড়াল ও। কিছু অশুভ, কি যেন একটা স্মৃতি মনে পড়ার চেষ্টা করছে ওর সচেতন মন, কিন্তু অবচেতন মন গোঁয়ারের মত ব্যর্থ করছে। ওর মনে হচ্ছে কেউ একজন আছে এখানে। ও নিশ্চিত কেউ আছে।
আলো না জ্বালিয়ে নিঃশব্দে প্রবেশ করল ও। অন্ধকারের বাসিন্দার দিকে ওয়ালথার থেকে দু’রাউন্ড গুলি ছুড়েই ডাইভ দিয়ে আশ্রয় নিল থামের আড়ালে। অপর পক্ষ থেকে কোন আহত চিৎকার কানে মধু বর্ষণ করল না। বরং ফিরতি গুলি এসে বিঁধল ওর কাভার নেয়া থামটার গায়ে। এতক্ষনে যেন লড়াইয়ের উত্তেজনা খুঁজে পেল সাঈদ। শিকারে এসে যদি পাল্টা আক্রমণ আর ঝুঁকিই না পেল তাহলে কিসের শিকার? শিকার তখনই শ্রেষ্ঠ হয় যখন সমান, কিংবা শিকারির চেয়েও শক্তিশালি শিকার হয়। প্রতিপক্ষের নিশানা, আন্দাজ, নিঃশব্দটা, ট্রেইনড নিঃশ্বাস, বিরতি সবই যেন তাই চিৎকার করে বলে যাচ্ছে। এত কিছুর পরও একজন আরেকজনকে এখন পর্যন্ত কোন গুলি লাগাতে পারেনি তা দুজনেই জানে। লাস্ট ম্যাগাজিনটা লোড করল সাঈদ। এবার ব্যর্থ হলে আর গুলি নয়... মুখোমুখি... আদিম শক্তির লড়াই হবে। সেখানে থাকবে উন্মাদনা, ঘাম, রক্ত আর প্রতিপক্ষের বিচ্ছিন্ন অঙ্গ... অথবা, প্রতিপক্ষের গুলিতে নিজের মৃত্যু।
শেষ গুলিটাও ব্যর্থ হল সাঈদের। বড় করে দম নিল ও। এবারেই বুঝা যাবে... মৃত্যু নাকি... লড়াই... হাতটা কোমরে গোঁজা ডাবল কোদাচি ব্লেডের দিকে এগিয়ে গেল। হাতল স্পর্শ করার আগেই সমস্ত আলো জ্বলে উঠল জিমনেশিয়ামের। যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী... স্বীকার করল সাঈদ।
আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতেও কোন গুলি হল না। এ যেন সম্মুখ যুদ্ধের আহ্বান। মৃদু একটা ভয়ঙ্কর হাসি খেলে গেল সাঈদের মুখে। ঘরের অপর প্রান্ত থেকে এগিয়ে আসতে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে সেও আগাল। চেহারাটা নজরে পরতেই থমকে গেল ও। একি! রায়ান!
ওর দিকে তাকিয়ে হাসল রায়ানও। সাঈদ বলল,
-তাহলে, শেষমেশ নিজের মনকেও স্ক্যাক্রিফাইস করলি?
কথা না বলে একটা রিমোট বের করে চাপল রায়ান। প্রজেক্টর চালু হয়ে গেল। টাইম-স্ট্যাম্পে বিগত রাতের সময় দেখা যাচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ড সাঈদের খুবই পরিচিত। কারও শোল্ডার ক্যামেরায় করা ভিডিও। তিন জনের একটা টিম ঢুকল বাড়িটায়। আটজন প্রহরীকে শেষ করল ওরা। দুজন একটা ঘরের দরজার সামনে অস্র উঁচিয়ে হুমকি দিল, সারেন্ডার না করলে বন্দিকে খুন করবে ওদের লোক ভিতরে। জবাবে কেবল গুলি করল অনুপ্রবেশকারী দুজন। সেই সঙ্গে ছুট লাগাল বন্ধ দরজার দিকে। সাউন্ডে দরজার ওপাশে হুটোপুটির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। দরজায় ধাক্কা মেরে ভাঙল ক্যামেরাধারি। ক্যামেরা মাটির দিকে ঝুঁকে গেলেও দুটো গুলির আওয়াজ পেল ওরা। সাঈদের চেহারায় কিসের যেন একটা ছাপ পরতে পরতেও পড়ল না।
ক্যামেরাধারি উঠে দাঁড়িয়েছে। মাটিতে পরে থাকতে দেখল ওর একজন লোককে, আরেকজনকেও দেখা গেল, এরপর আরেকজন মুন্ডুহিন... সব মৃৎ! আর সেখান থেকে ক্যামেরা গিয়ে পড়ল বন্দির উপর। চেহারা আর শরীরের দিকে যেন তাকানোই যায় না... ক্ষতে ভরা সারা শরীর... মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। অসংখ্য ক্ষতের চিহ্ন যতটা উন্মুক্ত শরীর দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও প্রহরীদের একজনের বিশাল হান্টিং নাইফ হাতে রিনিসকে চিনতে ওদের কারই সমস্যা হল না।
থেমে গেল ভিডিও। রায়ান সাঈদের দিকে এমন ভঙ্গিতে তাকাল যেন জানতে চাইছে,
-এইবার?
সাঈদ কোন কথা না বলে নিজের কোমরের কাছে হাত নিয়ে গেল। কোদাচি দুটো টেনে বের করে আনল খাপ থেকে। অবিশ্বাস্য গতিতে ছুটে গেল রায়ানের দিকে। রায়ানের ডান হাতের শিথে পোরা কাটানা ওর প্রথম আঘাত থামিয়ে দিল। আর বাম হাতের প্রচন্ড ঘুসিতে ছিটকে কয়েক পা পিছিয়ে গেল সাঈদ। রায়ান শিথ থেকে কাতানাটা টেনে বের করতে করতে বলল,
-কিছু জিনিস নিয়ে কখনও খেলতে নেই সাঈদ। বন্ধুর প্রিয় কাউকে নিয়ে কক্ষনই না।
ওর কথা শুনে যেন একটু থমকে গেল সাঈদ। রায়ান আবার বলল,
-তবে তোকে এবারের মত মাফ করব আমি। কারণ আমার ধারণা তুই মানসিকভাবে সুস্থ না। ধারণা নয়, আমি জানি। নাহলে এই মরীচিকার পিছনে ছুটে তুই আজ এদিকে আসতি না।
-কি বলতে চাস তুই?
-আমি মুখে আর কিছু বলব না। তুই যুদ্ধের জন্য এসেছিস তো, রক্তের জন্যে এসেছিস উন্মাদের মত আবারো... আয় তোকে সেই নেশাতেই বোঝাচ্ছি।
ট্র্যাডিশনাল লম্বা কাতানাটা বাড়িয়ে ধরে দাঁড়াল রায়ান। সাঈদ ছুটে এল আবারো। কিন্তু ডাবল কোদাচি দিয়েও যেন ও ছুতেই পারছে না রায়ানকে। অথচ ওদের দুজনের স্কিলই সমান এক্ষেত্রে... লড়াইয়ের উন্মত্ততায় আশেপাশের দুনিয়ায় কি হচ্ছে কিছুই যেন ওদের খেয়াল নেই। কেবল দুজন দুজনের দিকে আর অস্রের দিকেই সমস্ত শরীর এবং মনের দৃষ্টি, কান, আর সকল ইন্দ্রিয় দিয়ে রেখেছে। ওদিকে রায়ান সাঈদের বেপরোয়া আঘাত কেবল ঠেকিয়েই গিয়েছে এখনও। হঠাৎ এক পা আগে বাড়ল ও। সাঈদের বিভক্ততার ছাপে ভরা মুখটার দিকে চেয়ে বলল,
-মনের মাঝে দেয়াল তুলেছিস পাগলামির নেশায়... আয় আজ সে দেয়াল ভাঙবো।
এক পা এগিয়ে পাশ থেকে কাতানা চালাল রায়ান। একটা কোদাচি দিয়ে সেটা সাঈদ ঠেকিয়ে দিতেই অন্য কোদাচি দিয়ে রায়ানের অরক্ষিত শরীর পেয়ে গেল বাগে। প্রচণ্ড উন্মক্ততায় তলোয়ারটা সেধিয়ে দিল সাঈদ রায়ানের হার্ট টার্গেট করে। শেষ মুহূর্তে রায়ান একটু ঝুঁকে পরতেই বেঁচে গেল। সাঈদের কোদাচি রায়ানের কাধ ছেদ করে বেরিয়ে গেল। কোদাচি টান দিয়ে বের করে নিতেই ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ভিজিয়ে দিল সাঈদের মুখ। সাথে সাথে যেন সাঈদের চোখের সামনে থেকে লাল একটা পর্দা সরে গেল। এক মুহূর্তের মাঝেই ওর মনে পরে গেল এরকম আরেকটা উন্মত্ত রাতের কথা।
এরকম আরেকটা রাতের ওরা ঠিক করেছিল আর না। যাদের কারণে ওদের এই ভয়ানক অবস্থা। নিজেদের মানুষ বলে ভাবতেই ঘৃণা হয়... তাদের আজই শেষ রাত। ওরা রায়ান, সাঈদ সহ আর যারা এই পরীক্ষামূলক ফ্যাসিলিটিতে হিউম্যান গিনিপিগ ছিল, যাদেরকে পশুতে রূপান্তর করা হয়েছে দিনের পর দিন পাশবিকভাবে... তাদের এই শেষ দিনে দেখানো উচিত কি ধরণের পশু তারা তৈরি করেছে। এই শেষবারের মত... নিজেদের মত আর কোন পশু এঞ্জেলস অফ ডেথ এই দুনিয়ায় আসার পথ রাখবে না। সকল রেকর্ডস ধ্বংস করল ওরা। সব একপেরিমেন্টস রিপোর্ট, ডিটেইল। শিকারি হয়ে ভয়াবহ সব শিকারদের এই জিমে জড়ো করেছিল ওরা দুজন তাড়িয়ে এনে। রায়ান বেছে নিয়েছিল এই কাতানা আর সাঈদ কোদাচি... পার্সোনাল টাচ বলে পৈশাচিক হেসেছিল ওরা... সেদিন এই ঘরের রঙ পাল্টে লাল হয়... সেই শেষবার রক্তের নেশায় উম্মত্ত হয় রায়ান... আর সাঈদ... কি থেকে কি হয়ে গেল... মিরা... বন্দিত্ব... ডিভাইডেড মাইন্ডস...ডিলিউশনাল।
রায়ান কি যেন বলতে চাচ্ছিল। সম্বিত ফিরল সাঈদের। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে দুর্বল হয়ে ঢলে পড়ল রায়ান সাঈদের গায়ে। কোদাচি ফেলে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বসে পড়ল সাঈদ। অস্ফুস্টে বলল,
-আমি সরি রে...
হাসল যেন রায়ান, বুঝা গেল না। ও কি বলছে শুনতে মুখের কাছে কান এগিয়ে নিল সাঈদ। শুনতে পেল রায়ানের ক্ষীণ কিন্তু কড়া বন্ধুত্ব মেশানো কণ্ঠে,
-উই আর হোয়াট উই আর।
দুজনের মুখেই হাসি দেখা গেল। সাঈদ রায়ানের ব্লিডিং বন্ধের জন্য ব্যবস্থা করতে যাচ্ছিল।
হঠাৎ বাহির থেকে জিমের ভেতর গ্যাস সেল এসে পড়ল। ওরা কিছু করার আগেই হেভি মেশিনগান দিয়ে ঝাঁঝরা করা শুরু হয়ে গেল জিমের প্রতিটা ইঞ্চি। রায়ানের অচেতনপ্রায় দেহটা কাঁধে ফেলে ছুটল সাঈদ। নিজে বাঁচার চেয়েও বেশি, প্রানের চেয়েও প্রিয় বন্ধুকে বাঁচানোর আকুতি নিয়ে ছুটল।
ছয় মাস পরের কথা।
এমআইবি হেডকোয়ার্টার। আওয়ার বিল্ডিং, রোড ৩, নিকুঞ্জ, ঢাকা।
গাড়ি নিয়ে পারকিং লটে ঢুকে পড়ল সাঈদ। গাড়িটা পার্ক করে রেখে লিফটে উঠে পড়ল। ২৪ তলার বাটনে পুশ করে আইরিশ স্ক্যান কনফার্ম করতেই লিফট চলতে শুরু করল। মৃদু বেল বাজিয়ে ২৪ তলায় পৌঁছানর সংকেত জানাল। দরজা দিয়ে ঢুকে টাইয়ের নট ঠিক করে সিঁড়ি বেয়ে ২৫তলায় চলে এল সাঈদ।
বিল্ডিং এর কয়েক তলা কাভার এর জন্য ছেড়ে দিয়ে বাকি সব ফ্লোরে চলে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স, বাংলাদেশ এর কাজকর্ম। ২৪ এবং পঁচিশ তলা ডুপ্লেক্স সিস্টেমে তৈরি করা। হাইয়েস্ট লেভেল ক্লিয়ারেন্স ছাড়া এখানে প্রবেশ নিষেধ। আর অ্যান্ড ডি এর একটা স্পেশাল মিনিয়েচার সেকশন, মেজর জেনারেল এর অফিস আর স্পেশাল সেকশন জেড প্রস্তাবিত অফিস এর বাস এই ফ্লোরে। সেকশন জেড মেজর জেনারেল কোডনেম প্রাইম এর আন্ডারে কাজ করে এবং শুরু তার কাছেই রিপোর্ট করে, এমন একটা সেকশনের প্ল্যান করা প্রাইম এর মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স এর শুরু থেকেই। ইন্টেলিজেন্স এর কারও কাছে এই সেকশনের রিউমার ই হয়ত পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সত্যিটা দেশের সবচেয়ে সংরক্ষিত গোপনীয় বিষয়গুলোর একটি, এমন হবে। সেকশন জেড তিনজন এজেন্ট নিয়ে গঠন হবে। একজন আরেকজনের মিশন সম্পর্কে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কিছুই জানবে না। ২৪ তলার ওপরের অংশে তাদের অফিস স্পেসের জায়গা। এই প্ল্যান কবে বাস্তবায়িত হবে তা হয়ত মেজর জেনারেল নিজেও জানেন না। এতদিন কেবল রায়ান ছিল এর একজন। আর কাউকে পাচ্ছিলেন না তিনি যোগ্য। তাই সেকশন হিসেবে ঘোষণা না করে রায়ানকে দিয়ে ছুটো কাজই যেন করিয়ে নিতেন। এখন আরও একজন বেড়েছে।
পাশাপাশি তিনটে অফিসরুমের মাঝখানেরটা রায়ানের। বামপাশেরটা সাঈদের। কম্বাইন্ড আউটার অফিসে ডেস্কের পেছনে বসা ফারহানা লাফিয়ে উঠল রায়ানকে দেখে। ফারহানা সেকশন জেড এর এজেন্টদের পার্সোনাল সেক্রেটারি। ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল রায়ান,
-কি ব্যাপার ফারহানা, কেমন চলছে?
-চলছে ভালই।
-রায়ান নেই নাকি অফিসে?
-না। মাস ছয়েকের মত হল গায়েব।
-হুম, লুকস লাইক এজেন্ট রায়ান হ্যাজ এন্ডেড ট্রুলি দিজ টাইম।
চোখ কুচকাল ফারহানা। সাঈদ এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
-তাহলে অফিসে কেবল তুমি আর আমি একা।
দুষ্টুমির ছাপ পরল সাঈদের চেহারায়। চোখ রাঙ্গিয়ে জবাব দিল ফারহানা,
-এতদিন পরে এসেছ, আবার এসেই শুরু করে দিয়েছ বাঁদরামি?
-কি করব বল, ভল্ডেমোর্ট আমাকে অফিসের ধারেকাছে ঘেঁসতে নিষেধ করে দিয়েছে।
-ভাল করেছে। দুয়েকটা বাদর কম থাকলে সবাই শান্তিতে থাকে।
ডেস্কের ফোন বেজে উঠল ফারহানার। সাঈদ নড করে এগিয়ে গেল ওর অফিসের দরজার দিকে। ফারহানা রিসিভার তুলে নিতে নিঃশব্দে কফির কথা বলে অফিসে ঢুকে পরল সাঈদ।
ইন্টারকমে বলল ফারহানা,
-ভল্ডেমোর্ট যেতে বলেছে অফিসে।
মৃদু শ্বাস ফেলে একটা ফাইল হাতে বেরিয়ে এল সাঈদ।
মেজর জেনারেলের দরজায় মৃদু নক করল। তারপর ঢুকে পড়ল। অনেকদিন পর দেখছে মানুষটাকে। এর আগে শেষবার নিজের সলিটারি সেলের বাহিরে দেখেছিল। ইশারায় সাম্নের চেয়ারে বসতে বললেন। সাঈদ বসলে বললেন,
-যেভাবে জেনারেলকে ব্যবহার করে ব্রিটিশদের সাবমেরিন অকেজো করেছ, প্রশংসনীয়।
-আশা করি, ব্রিটিশরা আর সহজে বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে আমাদের হুমকি দিতে আসবে না সহসা।
-তা আসবে না। বেশ আলোচ্য হয়ে উঠেছে ওদের নিউক্লিয়ার সাবমেরিনটার কথা। কোথা থেকে ওটা হাইজ্যাক হল, কিভাবে হাইজ্যাক হল, বাকি নিউক্লিয়ার বম্ব এর কি হল এসবের জবাব দিতে দিতেই ওদের দিন কেটে যাচ্ছে। তবে এর নেপথ্যে কি, কেন কিছুটা হলেও ওরা বুঝবে এবং সাবধান হবে। সেটাই আমাদের আপাতত চাওয়া।
-ইয়েস স্যার।
-তবে শেষ ভাল হলেও, তুমি প্রচুর গুবলেট করেছ। তোমার এই মানসিক সমস্যার কথা আমি জানলাম না কেন?
-ঘটনাটা কেবল আমি আর রায়ান জানতাম স্যার। আমরা দুজনেই ব্যাপারটা ভুলে যেতে চেয়েছিলাম।
কাগজপত্র থেকে চোখ তুললেন প্রাইম,
-তোমাকে চার মাসের মেডিক্যাল এর উপর দিয়ে যেতে হয়েছে, তার ক্লিয়ারেন্স পাওয়া গিয়েছে। এখন থেকে তুমি ডিউটিতে জয়েন করতে পারো।
-থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।
সাঈদের সামনে রাখা ফাইলের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন,
-ওটা কি?
ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে বলল সাঈদ,
-আমার মতে ইনি স্যার, আমাদের সেকশন জেড এর লাস্ট পিস হতে পারে।
ভ্রু কুঁচকে তাকাল মেজর জেনারেল প্রাইম,
-তাই নাকি?
-ইয়েস স্যার।
-নাম?
-রায়হান স্যার, রিনিস রায়হান।
-হুম।
-যদি সিলেক্ট করেন স্যার। তাহলে আর সেকশন জেড কমপ্লিটলি একটিভ হতে পারে।
-ওকে রিকমেন্ডের কারণ কি তোমার?
-স্যার ওকে জেনারেল ভ্লাদিমভিচ সিআইএ থেকে পালানোর পর আটক করে। ওর ওখানের কীর্তি তো রীতিমত প্রশংসনীয় ছিল। আর জেনারেলের এত টর্চারের পরও সে সিআইএ থেকে সরানো ফাইলগুলোর কোন হদিশ দেয়নি। আই নো আবাউট দ্যা মেথডস অব টর্চার অব হিম স্যার। আই থিঙ্ক শি হ্যাজ গট দ্যা পটেনশিয়াল অ্যান্ড ডিটারমিনেশন।
ফাইলটা টেনে নিলেন প্রাইম। ইঙ্গিত পেয়ে দরজার দিকে রওনা হল সাঈদ। পেছন থেকে ডেকে বলল প্রাইম,
-সাঈদ।
-স্যার?
ফাইল থেকে চোখ উঠিয়ে বললেন তিনি,
-নেক্সট টাইম ইউ মেস আপ সামথিং লাইক ইউ ডিড ইন দিজ এসাইন্মেন্ট, ইউ ওয়ন্ট ফেইস এ ফ্রেন্ড’স সোর্ড অব প্রটেকশন বাট আ ফায়ারিং স্কোয়াড।
-সাউন্ডস গুড টু মি। স্যার, ইয়েস স্যার।
বেরিয়ে গেল সাঈদ ভল্ডেমোর্ট এর অফিস থেকে। বলা যায় পালিয়ে বাঁচল।
অকথ্য একটা গালি বিড়বিড় করে দিয়ে ওদের সুন্দরি সেক্রেটারি ফারহানার দিকে এগিয়ে গেল। যেন মন ভাল করতে ফুলের বাগানে যাচ্ছে ভাব নিয়ে...
পুনশ্চঃ আসমিনা তাহেরিনকে দুঃসময়ে সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ।

গল্পের নামকরণ এবং মডিফিকেশন সাজেশন্স এর জন্যে ভাইজানকে ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৩৯