কনকনে শীতের রাত যাকে বলে তা এখনও শুরু হয়নি। সবেমাত্র অগ্রহায়ণের শেষ দিক। তবুও এই পার্বত্য চট্টগ্রামে তা বুঝার উপায় নেই। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ট্রেনিং পাওয়া যোদ্ধাদের হাড়েও কাঁপুনী তুলে দেয়। ঘরের একমাত্র জানালায় কফির মগটা হাতে নিয়ে দাঁড়ালাম। ঠান্ডা হাওয়ার এক স্রোত ভারী কমব্যাট জ্যাকেটের ভেতরেও শিহরণ তুলল। মগের এক তৃতীয়াংশ শেষ হবার আগেই দূরের কুয়াশার মধ্যে অস্পষ্ট এক অবয়ব ফুটে উঠল। সেই ছেলেটাই। কত আর বয়স হবে ছেলেটার? ১৭/২১? এ বয়সের ছেলেদের বয়স চেনা ভারী মুশকিল। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা বাতাসে আবারও কেঁপে উঠলাম আমি। কিন্তু ছেলেটা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে ছেঁড়া মলিন একটা প্যান্ট আর হাফ হাতা গেন্ঞ্জি পড়ে, হাতে একটা লাঠি। কিভাবে এই শীতকে সে হার মানাচ্ছে সেই জানে! বরাবরের মত ছেলেটা আমার জানালার দিকে চেয়ে একটা হাসি উপহার দিল। সাধাসিধে বাঙ্গালী তরুণের মুখের সেই হাসিতে কেমন যেন মাদকতা মিশে আছে। ওরকম পবিত্র হাসি কোন মানুষের হতে পারে বিশ্বাস হয় না। দেখতে দেখতে ছেলেটা আবার হারিয়ে গেল গভীর কুয়াশার অন্তরালে।
খুব চেনা চেনা লাগে ছেলেটাকে। প্রতিদিনই ভাবি নেমে গিয়ে ছেলেটার সাথে দেখা করব। কিন্তু কখনই দেখা করা হয় না। কেন তার কারণ আমিও জানি না।
পিছন থেকে বাজখাই স্বরে হুংকার শোনা গেল,
-স্যার!
দীর্ঘশ্বাসটা আড়াল করে পিছনে ফিরলাম। আব্দুল কুদ্দুস। শহরের স্কুলের দারোয়ান ছিল। মিলিটারিতে যাওয়ার শখ থাকলেও টিকতে পারেনি। তবে এখন সুযোগ পেয়ে মিলিটারি হাবভাব দেখাতে কসুর করে না। হালকা করে মাথা ঝাঁকালাম। আমি যে কথা কম বলি আর কিভাবে কোন ইঙ্গিতে কোন কথা প্রকাশ করি তা এরা প্রায় সবাই বুঝে নিয়েছে। কুদ্দুস মিয়া বলল,
-জেনারেল স্যার আপনারে বোলাইসে, স্যার।
-যাও, আসছি।
স্যালুট ঠুকে বেড়িয়ে গেল কুদ্দুস মিয়া। ভারি উলের টুপিটা মাথায় বসিয়ে রওনা হলাম কন্ট্রোল তাঁবুর দিকে। যেতে যেতে ভাবছিলাম জীবনটা কত তাড়াতাড়ি বদলে গেল। লন্ডনে একটা অ্যাসাইনমেন্টে পাঠানো হয়েছিল আমাকে। কাজ শেষে স্পাই সেলের কন্ট্রোলার হিসেবে সেখানেই কিছুদিন থাকতে বলা হল। দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে উদ্বেগ বাড়ছিল। ছোট ভাইটা আছে, কি জানি কি অবস্থা ওর! চলে আসতে চাচ্ছিলাম। হেড অফিস থেকে জানাল হল এখন না, আরও কিছুদিন অপেক্ষা কর, ব্যবস্থা করে প্রয়োজনে আসতে বলা হবে। তারপরও মনের গভীরে জানতাম পশ্চিম পাকিস্তানি জানোয়ারগুলো এভাবে ক্ষমতা ছাড়বে না। এরপর পচিশে মার্চের কালরাত পার হল। গ্রিন সিগন্যাল পেলাম না। এপ্রিল শেষ হতে চলল, দেশের অবস্থা আরও খারাপ থেকে খারাপ হতে লাগল। ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেল আমার। হাতের কাজ গুছিয়ে রেখেছিলাম আগেই। নিয়ম ভেঙ্গে রওনা হব এমন সময় এল সিকিউর লাইনের ফোন। তুলতেই সেই ভারী, গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরটা ভেসে এল। বুকে কাঁপন তুলে দিয়ে জানান হল বহু প্রতীক্ষিত সেই গ্রিন সাইন,
-রায়ান?
-ইয়েস স্যার।
-চলে আসো।
ফোনটা নামিয়ে রেখেই বেড়িয়ে পড়ি। লন্ডনে আমার কন্ট্রোলে থাকা সবগুলো বাঙ্গালী কমান্ডোকে সাথে নিয়ে নেই। নিজেরই দেশে চোরাই পথে ঢুকলাম। বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধ করে এখন এই পার্বত্য চট্টগ্রামে। এরই মাঝে বেশ কয়েকবার ছোট ভাইটার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম। কেউ বলে ও ২৫শে মার্চ রাতেই শহীদ হয়েছে, কেউ বলে পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে গেছে। কোন সংবাদই আমাকে শান্তি দিতে পারল না। তবে মনে মাঝে আমি জানি ও বেঁচে আছে, বেঁচে থাকতেই হবে শায়খকে।
জেনারেল আমার অপেক্ষাতেই বসেছিলেন। আমি ঢুকতেই ইশারা করলেন সামনে বিছানো লোকাল ম্যাপের দিকে, সেখানে এখন পর্যন্ত আবিস্কার হওয়া পাকিস্তানী ক্যাম্প চিহ্নিত করা। বললেন,
-কিছুতেই কিছু হচ্ছে না কর্নেল। আমরা একটা ক্যাম্প ধ্বংস করলে ওরা আরও তিনটে ক্যাম্প থেকে লোক পাঠিয়ে আবারও দখল নিচ্ছে। আমরা ওদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ ক্যাম্পেরও হদিস জানি না। আমরা এখানে বসে নিজেদের পাহারা দেয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারছি না। কিন্তু আমাদের এই অঞ্চলের কন্ট্রোল নিতে হবে। এখানে ছড়ানো ক্যাম্পগুলো থেকে ওদের রিইনফোর্সমেন্ট যাচ্ছে বন্দরে, শহরে। শহরে, বন্দরে হামলা চালানর জন্য গেরিলা টীম আমাদের গ্রিন সিগনালের জন্য অপেক্ষা করছে দুই সপ্তাহ ধরে। এভাবে চলা যায় না। তুমি ভেবে কিছু বের কর।
আনমনে সিগারেট বের করতে গিয়েও পিছনে সেকেন্ড ইন কমান্ডের কাশির আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে হাত সরিয়ে নিলাম। জানতে চাইলাম,
-স্যার, আমাদের লোকাল কোন ইনটেল আছে?
-জিরো। পাকিস্তানীরা লোকালদের পশুর মতো খুন করেছে। মেয়েছেলে, বাচ্চা, বৃদ্ধ কাউকেই বাদ দেয়নি।
মনের মধ্যে দপ করে আগুনটা জ্বলে উঠল। মনে মনে কয়েকটা কঠিন গালি ঝেড়ে জানতে চাইলাম,
-আমি কি আমার ইউনিটকে নিয়ে রেকি করে দেখতে পারি যতদুর সম্ভব?
-তোমার ইউনিট, তোমার ব্যাপার। তবে আমি ফলাফল দেখতে চাই। সময় পাবে ৩ দিন। এর বেশী না।
-ধন্যবাদ স্যার।
বেড়িয়ে এলাম। কমান্ডো ইউনিটের ১০ জন অবশিষ্ট আছে এখনও। ওরা, সেই সাথে কিছু সিভিলিয়ান যোদ্ধা নিয়েই আমার ইউনিট। আজ রাতটা কোনও রকমে পার করতে হবে। সকালে ইউনিট নিয়ে পুরো এলাকা রেকি করা শুরু করে দেব। ঘরে ফিরে এক কোনায় বিছানো চাদরে শুয়ে পড়লাম। চারপাশে আরও অনেকেই শুয়ে থাকলেও সবাই জেগে আছে। এরা কেউই ঘুমায় না, ঘুমাতে পারে না। এদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে হানাদাররা। কাছেই কোথাও ফুপিয়ে কাঁদছে কোনও যুবতী মেয়ে। তার দেখাদেখি আরও কয়েকজনের বিলাপ শোনা গেল। অস্বস্তিকর পরিবেশ। মাথা পর্যন্ত চাদর টেনে দিলাম। এখন আরও একটা রাত কেটে যাওয়ার অপেক্ষা।
সকালে রেশনের নাস্তা সেরেই ইউনিট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দুটো ভাগে ভাগ করে নিয়েছি টীম। আমি একটার সাথে যাচ্ছি, অপরটার দায়িত্বে থাকছে ক্যাপ্টেন আবীর আল জারিফ, আমার সেকেন্ড ইন কমান্ড। পাহাড়ের ঢাল ধরে সাবধানে চলতে লাগলাম আমরা। সবার আগে কুদ্দুস। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াত সে। ওর কাছে সব পাহাড়ি এলাকাই নিজের ঘরের মতো। যদিও সে নিজেও স্বীকার করেছে যে এখানকার মতো পাহাড়ি জঙ্গল তার কাছেও অনেক দুর্গম। তারপরও আমাদের টিমের টিকে থাকার জন্য কুদ্দুসের ভুমিকা অপরিসীম। কিছুদূর এগুতেই খড় খড় করে উঠল ওয়াকিটকি। ক্যাপ্টেন জারিফ। বাটন চেপে ধরতেই ও বলল,
-স্যার আমরা একটা ক্যাম্প পেয়েছি। আমাদের বেস ক্যাম্পের পেছনের পাহাড়টার পরেই। ওরা সংখ্যায় অনেক বেশী, কমপক্ষে ৩৫। কি করব স্যার? ওভার।
-কিছু না। যতদুর সম্ভব রেকি করে অন্য ক্যাম্পগুলো লোকেট কর। বি কেয়ারফুল। ফক্সট্রট ওভার এন্ড আউট।
সেটটা বেল্টে আটকে নিয়ে আবার রওনা হলাম আমরা। হঠাৎ কুদ্দুস মুঠো করা হাত তুলল। সংকেতের মানে সবাই জানে। সামনে সন্দেহজনক কিছু আছে, আর এইখানে সন্দেহজনক কিছু মানেই বিপদ। আমাকে ইশারায় জন্তু জানোয়ার ব্যাবহার করে এমন একটা পথ দেখাল কুদ্দুস। সেখানে অস্পষ্টভাবে মানুষের পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। সাবধানে পথটা এক পাশে রেখে গাছের আড়াল ব্যবহার করে এগুলাম আমরা। এক ঝর্নার কাছে গিয়ে পথ শেষ হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম এটা জন্তু জানোয়ারের পানি খেতে আসার পথ। কিন্তু মানুষের পায়ের ছাপ যেহেতু আছে তারমানে এই পথ মানুষও ব্যাবহার করে। কিন্তু কোথায় তারা?
ছড়িয়ে পরলাম আমরা। রাস্তায় ছাড়া আর কোথাও কোন মানুষের পায়ের ছাপ পাচ্ছিলাম না। রাস্তার পায়ের ছাপগুলোও অদ্ভুত। হানাদাররা হলে বুটের দাগ দেখা যেত, কিন্তু জন্তু জানোয়ারের পায়ের ছাপ থেকে যতটুকু আলাদা করা যায় তাতে বুটের ছাপ মনে হয় না। লোকগুলোও বেশ চালাক, কোনও ট্রেইল রেখে যায় না। পথের পায়ের ছাপও কেউ সাধারণত আলাদা করতে পারত না, কুদ্দুস ছিল বলেই সম্ভব হয়েছে। অন্যরা বেশ কিছুটা দূরে ছিল আমার। হঠাৎ একটা অস্পষ্ট ট্রেইল চোখে পড়ল। পায়ের সাইজ দেখে বাচ্চাদের পা মনে হয়। মনে মনে হাসলাম। ভাগ্যিস বাচ্চাটা বড়দের মতো অত চালাক না। অন্যদের ডাকতে গিয়েও ডাকলাম না, এটা ফলস ট্র্যাকও হতে পারে। কিছুদূর এগিয়ে গেলাম ঘন জঙ্গল ভেঙ্গে। অদ্ভুত জায়গা! লম্বা লম্বা ঘাসের মতো এসব ঝাড়ের মধ্যে পথ হারানো কঠিন কিছু নয়। হঠাৎ আরেক প্রস্থ ঝাড় সরাতেই বেরিয়ে পড়ল এক পায়েচলা পথ। নিশ্চয়ই এ পথ এখানকার আদিবাসীদের তৈরি করা। ওয়াকিটকি তুলে নিলাম।
-ফক্সট্রট কলিং আলফা ২। ওভার।
কোনও সাড়াশব্দ নেই। আবার বললাম,
-ফক্সট্রট কলিং আলফা ২। ওভার।
এবারও শব্দহীন! দ্রুত আগের জায়গায় ফিরে যেতে পা বাড়ালাম। দুবার পথ হারানর পরেও বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ঝর্ণায় যাবার রাস্তায়। কিন্তু কেউ নেই। আরেকবার অন্যদের ডাকলাম ওয়াকিটকিতে কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ নেই। সবাই ভোজবাজির মতো গায়েব হয়ে গিয়েছে!
ঘুরেফিরে সবচেয়ে খারাপ চিন্তাটাই প্রথমে মাথায় আসতে চাইছে। যদিও জানি তা অসম্ভব। কারণ অনেকগুলো, পাকিস্তানিরা হলে গোলাগুলি হত, সংঘর্ষের চিহ্ন থাকতো। কিন্তু কিছুই নেই। তাহলে কি হয়েছে? জলজ্যান্ত একটা দুর্ধর্ষ কমান্ডো ইউনিট কিভাবে গায়েব হয়! পেছন থেকে মিষ্টি একটা স্বর জানতে চাইল,
-কাউকে খুঁজছেন?
পই করে রাইফেল নিয়ে ঘুরলাম আমি। সেই ছেলেটা! রাতে যে ঘুরে বেরায়, আমার জানালার দিকে তাকিয়ে হাসে। কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। ছেলেটাই আবার বলল,
-আপনার বন্ধুদের খুঁজছেন?
ছেলেটা জানল কিভাবে? তাহলে কি ও আমাদের এতক্ষণ ধরে ফলো করছিল? সেটাই বা কিভাবে সম্ভব! কেউ ফলো করলে কুদ্দুস অবশ্যই বুঝতে পারত! যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই বলল,
-আপনার ঐ দাড়িওয়ালা বন্ধুটা অনেক চালাক। বেশ কয়েকবার চোখে পরে যাচ্ছিলাম ওনার। একেবারে শেষ মুহূর্তে সরে গিয়েছি।
-কে তুমি? নাম কি?
-তুষার। আপনি?
-আমি রায়ান, কর্নেল রায়ান।
ছেলেটার কথাবার্তায় শিক্ষিত-মার্জিত ভাব প্রবল। তাই কিছুটা অবাক হয়েই জানতে চাইলাম,
-এই দুর্গম এলাকায় তুমি কিভাবে এলে? আমাদেরকেই বা কেন অনুসরণ করছ?
-সেসব কথা পরে বলব, আপনার বন্ধুদের খুঁজে বের করতে হবে না?
তুষারের কথায় সম্বিৎ ফিরল আমার। এভাবে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে গল্প করাটা বেশ রিস্কি। ছেলেটা ততক্ষনে চলতে শুরু করেছে, পিছু নিলাম।
কিছুক্ষণ পর সেই আদিবাসীদের রাস্তায় ফিরিয়ে আনল আমাকে। চলতে চলতে স্কুল টিচারদের ভঙ্গিতে বলল,
-এখানকার মানুষ খুব বিচিত্র। একই দেশে আমরা সবাই আছি তারপরও তাদের অনেকেই চায় আলাদা দেশ। সেই ১৯৪৭ এ ভারত-পাকিস্তান আলাদা হওয়ার সময় তারা পাকিস্তান চায়নি, ভারত চেয়েছিল। অথচ এখন তাঁদের অনেকেই পাকিস্তান চায়, বাংলাদেশ চায় না। অদ্ভুত না?
-তুমি কিভাবে জানলে?
-বাবা বলেছিল।
আমি অন্য কিছু জানতে চাওয়ার আগেই আবার বলল,
-এই আদিবাসীদের মধ্যে সিংহভাগ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে, বাকিদের মধ্যে কিছু নিরপেক্ষ, কিছু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর কিছু সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা। যে পথটা দেখে এলেন সেখান দিয়ে এই এলাকার আদিবাসীরা পানি সংগ্রহ করতে যায়। যে পায়ের ছাপ দেখে পিছু নিলেন সেটা আমিই রেখেছিলাম আপনাদের সুবিধের জন্য। কিন্তু শুধু আপনি এগুলেন। অন্যরা যখন ঐ পথে খোঁজাখুঁজি করছিল তখন মাওপাও তার দল নিয়ে আসে। ওরা এই পাহাড়ের মানুষ, আদিবাসী। অপ্রস্তুত অবস্থায় আলাদা আলাদাভাবে আপনার সঙ্গীদের আটক করে ওরা। প্রায় নিরস্ত্র আদিবাসীদের উপর অস্ত্র তোলার সুযোগ পেয়েও তোলেনি আপনার বন্ধুরা, অনেক ভাল মানুষ। মাওপাও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। আপনাদের কেউ আক্রমন করলে হয়ত এতক্ষনে সবাইকে খুন করে রেখে যেত, তবে এখন সম্ভবত বন্দি করে রেখেছে ওদের গাঁয়ে।
-তুমি আমাদের সরাসরি এসে সাহায্য করলেনা কেন?
-আমি কাউকে বিশ্বাস করিনা।
এতোটুকুন ছেলের মুখে এই কথা শুনে বেশ অবাক হলাম। বিব্রতকর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে জানতে চাইলাম,
-আমরা কোথায় যাচ্ছি তাহলে?
-আমরা যাচ্ছি সেন তুং গাঁয়ে। ওখানের আদিবাসীরা এই অঞ্চলে খুবই সম্মানীয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেও। তাদের তরুণেরা মুক্তিযোদ্ধা। ঐ গাঁয়ে গিয়ে ওদের নেতা সেন আতাতুং কে সব খুলে বললে তিনি আপনাকে সাহায্য করতে পারেন।
-তাহলে চল।
মানুষের মনের মাঝে প্রভাব ফেলার ভাল ক্ষমতা আছে ছেলেটার। আমি নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে শুরু করেছি ওর উপর। কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমরা পাহাড়ের পাদদেশের সেই গাঁয়ে। আমাদের দেখে আদিবাসীদের মাঝে চাঞ্চল্য দেখা গেল। বেশ কিছু বলিষ্ঠ জোয়ান এগিয়ে এসে আমাদের ঘিরে ধরল। তুষার আমার অস্ত্রগুলো ওদের কাছে জমা রাখতে বলল। আমি সাবমেশিন, রাইফেল আর পিস্তলটা একজনের হাতে দিলাম। আমাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে আসা হল সেন আতাতুং এর কাছে। আমি ভাঙা ভাঙা উপজাতীয় ভাষায় কিছু বলার আগেই উনি বললেন,
-আমি বাংলা জানি। পাহাড়ের আদিবাসীদের প্রায় সবাই বাংলা জানে। নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় নিজস্ব ভাষা ব্যাবহার করলেও বাহিরের মানুষের সাথে আমরা বাংলাতেই কথা বলি। কি সমস্যা বলুন।
আমি আজকের অভিযানের প্রথম থেকে সবটা খুলে বললাম, তুষারও মাঝেমাঝে আমাকে সাহায্য করল। আমাদের কথা শেষ হতে চুপচাপ ভাবল সেন। পেছনে তাকিয়ে এক অনুচরকে ডেকে বিজাতীয় ভাষায় কিছু বলতেই সে ভিড়ের ভেতরে গায়েব হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এল সে। তাঁর পিছনে এল এগারজন সসস্ত্র আদিবাসী তরুন, সবার পিছনে যে এল তাকে দেখে প্রায় চমকে উঠলাম আমি। আর কেউ নয়, সে আমার আপন ছোট ভাই শায়খ রায়ান।
আমাকে দেখে সেও অবাক হল। এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে। কোন প্রশ্নের প্রয়োজন হল না, ঐ একটা দীর্ঘ মুহূর্তের আলিঙ্গনেই দুজন দুজনকে বুঝে নিলাম। সেনের অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে জানালাম,
-আমার ছোট ভাই।
-আচ্ছা।
সেনের কথা শুনে মনে হল বোধহয় হরহামেশা এরকম দুইভাইয়ের পুনর্মিলন দেখা যায়। আবার বলল সে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে,
-এই বছরে এতো চমক দেখেছি যে এখন আর কিছুতেই চমকাই না।
আমি এবার সত্যিই টেনশনে পরে গেলাম। এই অঞ্চলের সবাই কি মাইন্ড রিডিং জানে নাকি! মোড়ল আমাদের অনুসরণ করতে ইশারা করল। সবাই মিলে রওনা হলাম আমরা মাওপাও এর গাঁয়ে। পথে আমাকে সংক্ষেপে জানাল শায়খ ওর কাহিনী। ওকে পাকআর্মি ধরে নিয়ে গিয়েছিল খাগড়াছড়ি ক্যাম্পে। সেখানে অবর্ণনীয় টর্চার করেছে ওর উপর। তারপর একদিন সেখানে বেশ কিছু আদিবাসী যুবক হামলা করে। যুদ্ধের অনভিজ্ঞতার কারনে ওদের অনেকে মারা পড়লেও জয়ী হয় ওরা। শায়খকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে ওদের গাঁয়ে। এক মাসের মধ্যেই নিজের বল ফিরে পায় শায়খ। এরপর পাহাড়ি যুবকদের ট্রেনিং দিয়ে যোদ্ধা তৈরির কাজে নেমে যায়। আমিও ওকে আমার দেশে ফেরার পর থেকে কাহিনী জানালাম। তুষারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে আবিস্কার করলাম ছেলেটা আবারও গায়েব হয়ে গিয়েছে। অদ্ভুত এক ছেলে!
হঠাৎ গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে কিছু সসস্ত্র আদিবাসী ঘিরে ধরল আমাদের। তবে সেন আতাতুং কে দেখে অস্ত্র নামিয়ে নিল। অবশ্য এসব আদিকালের রাইফেল চলত কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। প্রায় ধরে নিয়ে আসা হল আমাদের মাওপাও এর কাছে। উঠোনের মাঝে আধপোড়া এক সোফা রেখে রাজা রাজা ভাব নিয়ে বসে আছে। আতাতুংকে দেখে সবাই নম্রভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও তার মধ্যে নম্রতার ছিটেফোঁটাও নেই। একজন একটা চেয়ার দিয়ে গেল। বসল সেন। কথার তুবড়ি ছুটল তাঁদের মাঝে। মাঝেমধ্যে কিছু শব্দের অর্থ বুঝে ধারনা করতে পারলাম মাওপাও বন্দিদের ফেরত দিতে চাচ্ছে না। পাকআর্মির কাছে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের আটক করে দিতে পারলে পুরস্কার আছে। তাদের মতে বিদ্রোহকারীদের দমনের পর পাহাড়িদেরকে আলাদা মুক্ত দেশ দেয়া হবে।
কথা শুনে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সেন। আমি একপা এগুলাম। সেনকে বললাম,
-আমি কিছু বলতে চাই।
-বল।
মাওপাওকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
-দেখুন কারও বিনাকারনে ক্ষতি করা আমার কাজ না। আমি অন্যায়ের বিপক্ষে। পাকিস্তানীরা আমাদের মানুষ খুন করবে, অত্যাচার করবে সেটা আমি সহ্য করতে পারব না, তাই আমি যুদ্ধে নেমেছি। দেশটা যেমন আমার, তেমনি আপনারও। যুদ্ধে নামতে না পারুন, আমাদের কাজে বাঁধা সৃষ্টি করবেন না।
মাওপান আমার কথা হাত নেরে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেই আমি গলার স্বর একটু বাড়ালাম যাতে ভিড় করে আসা গাঁয়ের লোকেরাও শুনতে পায়,
-আপনাদের কেমন লাগবে যখন কেউ রাতের আঁধারে আপনাদের গাঁয়ে হামলা করে আপনাদের বৃদ্ধ বাবা-মা, বাচ্চা ছেলে-মেয়ে, দুধের শিশু সবাইকে খুন করলে? কেমন লাগবে চোখের সামনে মা-বোন-বউকে লাঞ্ছিত হতে দেখলে, খুন হতে দেখলে?
আপনারা তখন তাই করতেন যা আমরা এখন করছি। আপনাদের কয়েকটি গাঁয়েও তো পাকহানাদাররা গণহত্যা চালিয়েছে, ভুলে গেছেন আপনারা? এতো তাড়াতাড়ি নিজেদের ভাইয়ের-বোনের খুনের কথা ভুলে গেছেন?
শায়খ বলল,
-আপনারাও জানেন আমরাও জানি বাংলাদেশ হোক বা পাকিস্তান হোক, কেউই আপনাদের আলাদা দেশ দেবে না, দেয়া সম্ভব না। বিশ্বাস না হলে সেন আতাতুং কে জিগ্যেস করুন।
সেন মাথা নেড়ে সায় দিল। আমি আবার বললাম,
-তাহলে আপনারাই বলুন আপনারা কার পক্ষ নেবেন, কিসের জন্য পক্ষ নেবেন। আপনাদের ভাই-বোনদের খুনি পাকিস্তানিদের নাকি আমাদের, মুক্তিবাহিনীর?
সবার চেহারাই বদলে গেছে ততক্ষনে, মাওপান টের পেয়ে গেল যে পরিস্থিতি তার হাতের বাহিরে চলে যাচ্ছে, ধুরন্ধর লোক। দ্রুত নির্দেশ দিল সে,
-বন্দিদের নিয়ে আস।
টিমের বাকি পাঁচজনকে নিয়ে আসা হল। সবাইকে ধন্যবাদ আর বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে ফিরতি পথে রওনা হলাম আমরা। শেষবারের মতো সকলের চেহারার দিকে তাকিয়ে সদ্য ফুটে ওঠা পাকিস্তানীদের প্রতি ঘৃণা টের পেয়ে অভিভুত হলাম আমি। টগবগ করে ফুটছে ওদের আদিম রক্ত।
কিছুদূর যাওয়ার পর হাসির শব্দ শুনে ফিরে তাকালাম। শায়খ কৈফিয়ত দিল,
-পাকআর্মি ঐ গ্রামে এরপর এলে তাদের কি অবস্থা হবে সেটা কল্পনা করছিলাম।
দৃশ্যটা কল্পনা করে হেসে উঠলাম আমিও। তবে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারনা থাকলে তখন ঐ হাসি মুছে যেত মুখ থেকে।
আদিবাসী যোদ্ধাদের আমাদের দায়িত্বে দিয়ে তিনজন যোদ্ধাকে নিয়ে নিজের গাঁয়ে ফিরে গেল সেন আতাতুং। শায়খকেও জোর করে পাঠিয়ে দিলাম আমি, নতুন যোদ্ধাদের ট্রেনিঙে ওর প্রয়োজন আছে। আমাদের সবাইকেই যার যার দায়িত্ব পালন করতে হয়। যতক্ষন ওকে দেখা যায় তাকিয়ে রইলাম আমি। এক সময় মিলিয়ে গেল ও। পাঁচজন কমান্ডো আর আটজন আদিবাসী গেরিলা নিয়ে বেস ক্যাম্পে রওনা হলাম আমি। হঠাৎ খড়খড় করে উঠল ওয়াকিটকি,
-আলফা ওয়ান কলিং ফক্সট্রট। ওভার।
-ফক্সট্রট রিসিভিং। গোলাগুলির আওয়াজ কিসের? ওভার।
-স্যার আমরা একটা অ্যামবুশে পড়েছি। মনে হয় টিকব না, বিদায় নিতে কন্টাক্ট করলাম। ওভার।
-পজিশন বল। ওভার।
-কিন্তু আপনারা অনেক দূরে। তারচেয়ে মড়ার আগে যতগুলো পারি পাকি কুত্তা শেষ করি। ওভার।
-পজিশন বল। ওভার।
হাল ছেড়ে সত্যিটা জানাল জারিফ,
-বেস ক্যাম্পে হামলা করেছে ওরা স্যার। আশেপাশের সব কটা ক্যাম্প থেকে বোধহয় লোক নিয়ে এসেছে ওরা। প্রাণপণ যুদ্ধ করছি আমরা। তবে টিকতে পারব না। আপনি চলে যান স্যার, আরও লোক নিয়ে ফিরে আসবেন সম্ভব হলে, শেষ করে দেবেন ওদের। ওভার।
-টিকে থাক জারিফ, টিকে থাক। আমি আসছি। ওভার এন্ড আউট।
জলদি রওনা হলাম আমরা। কিছুদূর যেয়েই বুঝতে পারলাম সময়ের মধ্যে আলফা টিমের কাছে পৌঁছা অসম্ভব। আদিবাসীদেরকে জিগ্যেস করলাম আমি,
-তোমরা কোনও শর্টকাট চেন ঐ জায়গায় পৌঁছানর?
সবাই মাথা নাড়ল। মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে আমার। অসহায়ের মতো আবার ছুটতে যাচ্ছিলাম এমন সময় উদয় হল তুষার। কোনও কিছু জানতে না চেয়ে বলল আমার পিছনে আসুন। দৌড়োতে শুরু করল ও। আমরা সবাই ওকে অনুসরণ করলাম। বেশ কিছু পাহাড়ের অলিগলি ঘুরে একটা পাহাড়ের দেয়ালের সামনে এসে থেমে গেল ও। বিশাল পাহাড়ের দেয়াল দেখে ওর উপর রাগে ফেটে পড়তে যাব এমন সময় আমাকে অবাক করে দিয়ে দেয়াল ঘেসে ওঠা গাছের আড়ালে হাড়িয়ে গেল ও। গাছটা ঘুরতেই পাহাড়ের গায়ে ফোকরটা চোখে পড়ল আমাদের। একটা গুহামুখ। একে একে ঢুকে পড়লাম আমরা। একটার পর একটা সুড়ঙ্গ পার হয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল তুষার। হঠাৎ অস্পষ্ট গোলাগুলির আওয়াজ পেলাম আমরা। চলার গতি বেড়ে গেল। বেস ক্যাম্পের পেছনে লাগোয়া পাহাড়ের গায়ে সুড়ঙ্গমুখ। বেরিয়েই ক্যাম্প চোখে পড়ল। তুষারকে অপেক্ষা করতে বলে ছুটে গেলাম আমরা। ব্যাটল ফর্মেসন ঠিক রেখে ঢুকলাম ক্যাম্পে। একের পর এক গুলি বের হতে শুরু করল আমাদের অস্ত্র থেকে। ক্যাম্পের যোদ্ধারা প্রায় নিঃসাড় হয়ে পড়েছিল। বেঁচে থাকার আরেকটি সুযোগ দেখতে পেয়ে নতুন শক্তি ভর করল ওদের শরীরে। ওদের প্রতিটা গুলিতে মিশে আছে ঘৃণা, রাগ, ক্রোধ, মুক্তির ইচ্ছা। হঠাৎ ডান দিকে এক পাকিস্তানী বন্দুক তাক করল আমার দিকে। জীবনের শেষ মুহূর্ত এসে হাজির হয়েছে বলে মনে হল কিন্তু কার যেন গুলি খেয়ে পরে গেল সে। একটা গলা শুনতে পেলাম,
-হালার পো হালা রাজাকার! সোজা জাহান্নামে যা!
আব্দুল কুদ্দুসের বাজখাই গলা যেন মধুবর্ষণ করল কানে। আবার পাকিদের দিকে মনোযোগ দিলাম। হঠাৎ আক্রমনে হতচকিত হয়ে পরেছে ওরা। আদিবাসী গেরিলাদের বন্য আক্রমন আর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রোধের কাছে বেশিক্ষন টিকতে পারল না। শেষ সৈন্যটাকেও ফেলে দিলাম আমরা।
কার কি অবস্থা দেখতে বের হলাম। যুদ্ধ করার মতো অবশিষ্ট আছি আমরা ৩০ জন। জেনারেলের সাথে সারাদিনের ঘটনার ব্যাপারে আলাপ করতে করতে এগুলাম আমি, পথে জারিফকে দেখে ওর কাঁধে হালকা চাপড় দিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দ ভেসে এল। আমি, জেনারেল দুজনেই দৌড়ালাম শব্দের উৎসের দিকে,
-কি ব্যাপার কুদ্দুস?
পরে থাকা এক পাকসৈন্যের লাশের দিকে ইংগিত করল আব্দুল কুদ্দুস,
-এইডা ঐ পিঠের ওয়্যারলেস দিয়া আমাগো পজিশন দেছে স্যার, কইতাছিল সাবকো ভেজদো! আমি শুনতে পায়া আইয়া গুলি মাইরা দিলাম! থুঃ
দ্রুত পরিস্থিতি একবার ভেবে দেখলাম। জেনারেলকে বললাম,
-স্যার হামলা ঠেকানর মতো যথেষ্ট লোকবল এখন আমাদের নেই। এখন বুদ্ধিমানের কাজ ফিরে যাওয়া। সেন আতাতুং এর গাঁয়ে আমার ভাই আছে, সে সবার নিরাপত্তার ব্যাবস্থা করতে পারবে।
জেনারেল মাথা নাড়ল,
-নাহ! এভাবে যুদ্ধের ময়দান ফেলে আমি পালাব না। আমি বাঙ্গালী, দেশের জন্য প্রান দিতেই এসেছি। তাছাড়া আমাদের কোথাও না পেলে পাকিরা একে একে সব গাঁয়ে হামলা শুরু করবে। নিজেদের প্রানের জন্য আমরা এত জনের জীবনের ঝুঁকি নিতে পারি না।
আমার রহস্যময় হাসিটা দেখে ফেললেন জেনারেল। বললেন,
-দাঁড়াও দাঁড়াও! তুমি আমাদের পাঠিয়ে দিয়ে নিজের টীম নিয়ে থেকে যেতে চাইছিলে! যাতে পাকিরা মনে করে তোমরাই অবশিষ্ট আছ।
মাথা ঝাঁকালাম আমি। জেনারেল প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বললেন,
-তোমাকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি কর্নেল! তবে আমি যাচ্ছি না। কোনও সুস্থ মুক্তিযোদ্ধা যাবে না এখান থেকে। আশ্রয়ার্থী আর আহতদের পাঠিয়ে দেব আমরা। এরপর দেখে নেব ঐ বেজন্মা কুকুরগুলোকে। আই উইল ফাইট দা লাস্ট ফাইট।
আমি জানি জেনারেলকে এখন থামান যাবে না, উনি যা ভেবেছেন তাই করবেন। ভীষণ একগুঁয়ে মানুষ। আশ্রয়ার্থী আর আহতদের পাঠিয়ে দিলেন তিনি পাঁচজন আদিবাসী যোদ্ধা সহ। এরপর বাকি পঁচিশজনকে নিয়ে প্ল্যান করলাম আমরা। পনেরজন থাকবে ক্যাম্পে আর দশজনকে নিয়ে আমি ক্যাম্প থেকে অনেক সামনে এগিয়ে যাব। পাকিরা যেখানে কোন বাঁধা আশা করবে না সেখানেই অ্যামবুশ পাতব আমরা। আমাদের লক্ষ একটাই, মড়ার আগে যতটা সম্ভব সময় দিয়ে যাব আহতদের, গোপন একটা অন্যরকম প্ল্যানও আছে। প্ল্যানিং শেষে জেনারেলকে বললাম আমি,
-স্যার, মনে আছে তো?
পকেট থেকে ছোট জিনিসটা বের করে আমাকে দেখালেন তিনি। মাথা ঝাকিয়ে টীম নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বেশ কিছুদূর এসে অ্যামবুশ পেতে বসলাম আমরা। এখন শুধু পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অপেক্ষা।
সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছি আমরা, যাতে বেশী এলাকা কাভার করা যায়। হঠাৎ পেছনে অস্পষ্ট খসখস আওয়াজ শোনা গেল। না তাকিয়েও বুজতে পারলাম কে এসেছে। তুষার। পাশে এসে ঝোপের আড়ালে বসতেই বললাম,
-এবার তোমার রহস্য, হিস্ট্রির বাক্স খুলবে?
-আমার তো ধারনা আপনি ইতিমধ্যেই তা বুঝে ফেলেছেন।
মৃদু হেসে বললাম আমি,
-হাসান মাহমুদ তুষার। বিখ্যাত দুই বিজ্ঞানী মাহমুদ হাসান এবং জাহানারা হাসানের একমাত্র ছেলে। তোমার বাবার চেহারার সাথে এই বয়েসেই অনেক মিল আছে তোমার। মায়ের চোখ পেয়েছ তুমি। দেরিতে হলেও তোমার জ্ঞানের বহর দেখে তোমার পরিচয় সম্পর্কে ধারণাটা মনে আসে। চাইল্ড প্রডিজি, তাই না?
-ঠিকই ধরেছেন। আপনিও তো তাই ছিলেন। বাবার কাছে অনেক শুনেছি আপনার পরিবারের কথা, আপনার কথা। এক সময় একই ছাদের নিচে আপনার বাবা আর আমার বাবা সংগ্রাম করে বেঁচেছিলেন, এক সাথে ভাষার দাবিতে লড়েছেন।
-তোমরা এই অঞ্চলে এলে কেন?
-বাবা মা দুজনেই চেয়েছিলেন একটু নিরিবিলিতে কাজ করতে। তাছাড়া তারা বোধহয় আসন্ন বিপদের ধারনা করতে পেরেছিলেন। তবে বিপদের হাত যে কত বড় আর ভয়ংকর তা কল্পনা করতে পারেনি তারা। খুন হলেন দুজনেই।
চুপ করে রইলাম আমি। আবার বলল তুষার,
-আমি এই অঞ্চল খুব পছন্দ করেছিলাম। একটু বড় হবার পর থেকেই বাবামায়ের আদরের পাশাপাশি পাহাড়, জঙ্গলের মতো বন্ধুও পেয়েছিলাম। অল্প সময়েই যে কোনও আদিবাসির চেয়ে বেশী চেনা হয়ে গেল এ অঞ্চল। এরই মাঝে বাবা-মা আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতে লাগলেন। একদিন শুনতে পেলাম দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। একটা সুন্দর মানচিত্রের পতাকা বানিয়ে বাসার ছাদে উড়িয়ে দিলাম। বাবা মাঝেমধ্যেই যুদ্ধে যেতে চাইতেন। মা আমার দোহাই দিয়ে আটকাতেন। পাকিস্তানীরা দেশের সব জায়গায় হামলা শুরু করে দেয়। সবাই অস্থির হয়ে পড়ে। বাবা একদিন আমাকে বন্দুক চালান শেখাতে নিয়ে গেল। একদিনেই আমি চ্যাম্পিয়ন মার্কসম্যান। আমাকে একা প্র্যাকটিস করতে বলে বাবা ফিরে গেলেন বাড়িতে। আমিও কিছুক্ষণ পরে ফিরে চললাম। বাড়ির কাছাকাছি এসে কেমন যেন বিপদের গন্ধ পেলাম। ঘরের কাঁচের দেয়ালের মধ্যে দিয়ে দেখতে পেলাম বাবা-মাকে হানাদারদের খুন করার সেই বর্বর দৃশ্য। নিরবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমি। ছাদ থেকে আমার স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাটা নামিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল ওরা।
ওর চোখের দিকে একবার তাকালাম আমি। সে চোখে আগুন জলছে! জানতে চাইলাম,
-তুমি চাও আমি ওদের খুঁজে বের করি?
-না।
-তুমি প্রতিশোধ নিতে চাও না?
আমার দিকে তাকাল তুষার। ওর চোখে এখন আর আগুন নেই, সেখানে রহস্যময় কুয়াশা,
-আমি নিজের হাতে ওদের সবাইকে খুন করেছি।
চমকে গেলাম আমি! কি বলছে ও বুঝতে পারলাম না প্রথমে। আবার বলল ও,
-নিজের ক্রোধকে সামলেছিলাম তখন। দ্রুত ওদের ফিরে যাওয়ার পথে এই আজকের মতই একটা জায়গায় অ্যামবুশ পেতেছিলাম। সাথে ছিল বাবার রাইফেল। সবকটা পশুকে গুলি করে মারি আমি। তবে আমার প্রতিশোধ, যুদ্ধ ওদের সাথেই শেষ হয়ে যায়নি। আমার যুদ্ধ অন্যায়, নির্যাতনের বিরুদ্ধে আজীবন চলবে।
কিছুদিন এদিক ওদিক ঘুরে খুচরা হানাদার মেরে সময় কাটিয়েছি। তারপর একদিন মুক্তিবাহিনী এল। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ক্যাম্প বসল এখানে। আপনি এলেন। আমি প্রতি রাতে এই ক্যাম্প পাহারা দিতে লাগলাম। আমার চেয়ে এ অঞ্চলে ভাল পাহারাদার আর কে হতে পারে?
হঠাৎ সামনে নজর দিয়ে স্থির হয়ে গেল ও,
-ওরা আসছে।
আমিও নড়াচড়াটা দেখতে পেলাম। পাখির ডাক শোনা গেল, কুদ্দুস! সবাই অ্যালার্ট হয়ে গেল। টানটান উত্তেজনায় ভরা পরিস্থিতি। এক সাথে দশটা বন্দুক গর্জে উঠল। দশটা হানাদারের লাশ পড়ল। গুলির শব্দকে ছাড়িয়ে শোনা গেল এগারোজনের ক্রুদ্ধ গর্জন,“জয় বাংলা!”
গুলির বৃষ্টি শুরু হল। আমার নির্দেশে চলে গেল তুষার। হানাদারররা সংখ্যায় প্রায় ১০০ জনের মতো হবে। এরা আক্ষরিক অর্থেই সবাইকে নিয়ে এসেছে। যুদ্ধটা ওয়ানসাইডেড হয়ে গেল। আমরা হাতির পালের সামনে টিনের বাদ্য বাজাচ্ছি যেন। হঠাৎ কাছাকাছি একটা মাথা দেখেই গুলি চালালাম আমি। পড়ে গেল লোকটা। তবে তার পাশের অন্য বন্দুকটা চোখে পরেনি আমার। গুলিটা কাধের পেশি ফুটো করে গেল। পাত্তা না দিয়ে আবার গুলি করলাম আমি। প্রানপনে লড়ে যাচ্ছি আমরা। আমাদের ঘিরে ফেলছে ওরা। একের পর এক আর্তনাদ ভেসে আসছে। একটা বুলেট কান ছুয়ে বেরিয়ে গেল। বসে গুলি করা শুরু করলাম। কাঁধে বুলেটের প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে ঢাল বেয়ে গড়াতে গড়াতে নেমে গেলাম। পাথরে ঠুকে গেল মাথা। অন্ধকার হয়ে এল পৃথিবী।
মুখে পানির ঝাঁপটায় জ্ঞান ফিরল আমার। চোখ মেলে দেখতে পেলাম তুষারের সেই স্বর্গীয় হাসিটা! আমার কাঁধের ক্ষতে লতাপাতার অসুধ আর শার্ট ছেড়া ব্যান্ডেজ করা। বেঁচে আছি বুঝতে পেরে খুব অবাক হলাম। পর মুহূর্তে চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালাম তুষারের দিকে। চোখ নামিয়ে জবাব দিল ও,
-আপনাকেই শুধু সরিয়ে আনার সুযোগ পেয়েছি আমি, আর একজনকেও ছাড়েনি ওরা।
এতদিনের সঙ্গিরা বীরের মতো শহীদ হয়েছে অথচ আমি তাঁদের সাথে থেকেও বেঁচে আছি ভাবতেই হাহাকার করে উঠছে মন। ভাবাবেগ সামলে ঘড়ির দিকে তাকালাম, এক ঘণ্টা বেহুঁশ ছিলাম আমি। তারমানে বেস ক্যাম্পে যা হওয়ার হয়ে গেছে এতক্ষনে। তুষারকে জিগ্যেস করলাম,
-কোন শকওয়েভ অনুভব করেছ, ভুমিকম্পের মতো?
মাথা নাড়ল তুষার। তারমানে ক্যাম্পের ভিতর ফিট করা বিভিন্ন বোমাগুলোর ট্রিগারটা একটিভেট করতে ব্যর্থ হয়েছে জেনারেল। পরিস্থিতি ভেবে দেখলাম। বোমাগুলো ফাটাতে ব্যর্থ হয়েছে জেনারেল, তারমানে পাকআর্মি এখন মহানন্দে ফুর্তি করছে বেস ক্যাম্পে। কোনমতে যদি ক্যাম্পের কন্ট্রোলরুমে ঢুকতে পারি সেখানে বোমাগুলোর সেকেন্ড কন্ট্রোল ট্রিগার লুকানো আছে। রেঞ্জ খুব কম, তাতে কিছু যায় আসে না। অতগুলো নরপিশাচকে শেষ করতে নিজের প্রান দিতে ভয় করি না আমি!
রওনা হতে যেতেই কি ব্যাপার জানতে চাইল তুষার। বললাম ওকে। মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনল ও। ট্রিগারটা দেখতে কেমন, কোথায় আছে জানতে চাইল, বললাম।
ও শান্তভাবে একমিনিট ভেবে বলল ও যেতে চায় আমার বদলে। আমি অবাক! পাগলটা বলে কি! আমি কিছুতেই রাজি হলাম না, নিজের বদলে একটা তরুন প্রান আমি কিছুতেই শেষ হতে দিতে পারি না। ও যুক্তি দেখাল যে ওর পক্ষে ভেতরে যাওয়া সহজ। কিন্তু আমি কিছুতেই ওর প্রানের ঝুঁকি নিতে পারি না। ওকে শায়খের কাছে সেন তুং গাঁয়ে যেতে বলে রওনা হলাম আমি। কিছুদুর যেতেই পেছনে খসখস শব্দ। রেগে গিয়ে কিছু বলতে ঘুরতে গেলাম, কিন্তু তাঁর আগেই আকাশ ভেঙ্গে পড়ল মাথায়! দ্বিতীয়বারের মতো সেদিন জ্ঞান হারালাম আমি।
জ্ঞান ফিরল ভয়ানক ঝাঁকুনিতে। একদিনে এতবার আক্রমণে আমি প্রায় নিঃশেষ তাই শকওয়েভের ধাক্কা খেয়েও প্রথমে কিছু বুঝলাম না! পরমুহূর্তে দ্বিতীয় শকওয়েভের ধাক্কার সাথে সাথে সোজা হয়ে বসলাম। মাথার কাছেই তুষারের সেই লাঠিটা পড়ে থাকতে দেখে কি হয়েছে বুঝতে পারলাম! তুষার আমাকে মাথায় বাড়ি মেরে রেখে ক্যাম্পে চলে গেছে! ট্রিগার একটিভেট করে দিয়েছে ও। নিস্ফল আক্রোশে হুংকার দিয়ে উঠলাম। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে গেল সেই হুংকারের।
ধীরে ধীরে হেঁটে প্রবেশ করলাম বিধ্বস্ত বেস ক্যাম্পে। চারিদিকে লাশ! অবাক হয়ে দেখলাম লাশদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই! না পাকিস্তানী না বাংলাদেশী, বিস্ফোরণে পুড়ে গিয়ে সব হয়ে গেছে একই রকম বীভৎস মানুষের লাশ। জীবিত কেউ নেই এই লাশের মেলায়। কোথাও কেউ নেই!
রাতে প্রায় ভেঙে পড়া, বিধ্বস্ত দালানটার সেই ঘরটাতে গিয়ে দাঁড়ালাম। কফি বানালাম স্টোভে। ঘরের একমাত্র জানালায় কফির মগটা হাতে নিয়ে দাঁড়ালাম। ঠান্ডা হাওয়ার এক স্রোত ভারী কমব্যাট জ্যাকেটের ভিতরেও শিহরণ তুলে দিল। দূরের কুয়াশার জালের দিকে তাকালাম। সব আগের মতই লাগছে। নাহ! আগের মত নেই। আজ কারও বিলাপ নেই, বাজখাই কণ্ঠের মালিকের দেখা নেই, নেই সেই দুঃসাহসী তরুণ। তাঁর সেই মিষ্টি স্বর্গীয় হাসির অনুভূতিটা নেই। অজান্তেই টপ করে চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি পড়ে মিশে গেল কফির মগে।
কফি শেষ করে ফিরে আসতে যেয়েও কি মনে করে যেন ঝাপসা চোখে আবার তাকালাম। ভুল দেখছি? চোখটা মুছে আবার তাকালাম। নাহ! ভুল দেখছি না। ঠোঁটের কোনে হাসিটা ফিরে এল। দূরের কুয়াশার মাঝে অস্পষ্ট এক অবয়ব ফুটে উঠছে। ছেঁড়া মলিন একটা প্যান্ট আর হাফ হাতা গেন্ঞ্জি পড়া, হাতে একটা লাঠি, ঠোঁটে স্বর্গীয় হাসি। সেই ছেলেটাই...

আলোচিত ব্লগ
আমরা যেমন আমেরিকান পণ্য বয়কট করছি, আমেরিকা আমাদের বয়কট করলে কী হবে?
কোক, পেপসি বা অন্যান্য খাবার কিংবা কসমেটিকসের আমেরিকান পণ্য আমরা বয়কটের ডাক দিয়েছি, ইজরায়েলি পণ্য বলে। যদিও এর মধ্যে সবগুলো ইজরায়েলিই তো নয় ই, আমেরিকান পণ্যও নয়।
এসব নিয়ে আমেরিকার... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্পের ট্রারিফ নিয়ে পাগলামী বিশ্ব স্টক মাকের্টে তোড়পাড়। এখন কি বিনিয়োগের ভালো সময়?
যাদের ডোনল্ড ট্রাম্পের মতন প্রসিডেন্ট আছে তাদের পাগল দেখতে অন্য কোথাও যাইতে হয় না্। প্রতিদিন টিভিতেই ট্রাম্পকে দেখে তারা।
২০২৫ সালের এপ্রিলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত... ...বাকিটুকু পড়ুন
হিরো আলমদের ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া রত্নরা
আশিক চৌধুরী সেদিন বলেছিলেন, মার্কিন শুল্কারোপ আমাদের জন্য ভালো সংকেত ।
তিনি আরো বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের বিষয়টিকে আমি সুযোগ হিসেবেই দেখছি। কারণ যে দৃষ্টিভঙ্গী থেকে যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে—... ...বাকিটুকু পড়ুন
রোহিঙ্গা ইস্যুতে সামরিক জান্তার প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবসম্মত ?
বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ফেসবুক পোস্টে সম্প্রতি ব্রেকিং নিউজ— মিয়ানমার নাকি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার জনকে ফেরত নিতে প্রস্তুত! আরও ৭০ হাজার যাচাই-বাছাইয়ে আছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
স্মৃতি নামের পরশপাথর
ফিরে ফিরে আসা
ভালুকা ছেড়েছি আট বছর হলো। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভালুকা ও এর আশেপাশে কয়েক জায়গায় বসবাস করেছি, কোচিং করিয়েছি, স্কুলে পড়িয়েছি। বেকারত্বের সময়ের কত... ...বাকিটুকু পড়ুন