লিখতে বসব বসি করে করেই জীবনের অনেক গল্প লেখা হলনা । কিন্তু ভেতর থেকে লেখার একটা ভীষণ তাড়না অনুভব করি । এই তাড়নার পেছনে আমাকে একটা কারন বলতে বলা হলে আমি বলব – আমি যদি লিখে যাই, বলে যাই কোথায় আর কেমন করে হোঁচট খেয়েছিলাম আমি, আমার পেছনে হাঁটতে থাকা কারো একটু হলেও সুবিধে হতে পারে । জানতে পারে কি করে হোঁচট খেয়েও উঠে দাঁড়ানো সম্ভব । যদিও জীবন মানেই আপেক্ষিকতার পথ । কিন্তু আপেক্ষিকতার সীমা পেড়িয়ে পারস্পরিক মেল বন্ধনের একই রকম একটা সেতুর দেখা মেলে । যেখানে সবই এক ।
গল্পটা একজন বয়স হওয়ার আগেই বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া মানুষের । সময় কি তাহলে কারও জন্য দিগুন হয়ে যায় ? যাকে আমরা সঠিক সময় বলে জানি সেই সময়ের মাপকাঠি কার হাতে ? যার নাড়াচাড়ায় বৃদ্ধ হওয়ার আগেই বুড়িয়ে গেল সে । সে ইদানিং কিছু খেতে পারেনা । যাও বা কিছু খায় তা হজম করতে পারেনা । সরকারী একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বাইরেও তার পরিচয় সে একজন যোদ্ধা । চাকরী বা অন্য কিছুর অবসর পেলেও যুদ্ধের অবসর মেলেনি তার । যুদ্ধের কোন শেষ নেই, যুদ্ধ কখনো ফুরায় না । যুদ্ধের শুধু শুরু আছে, আর আছে অবিরাম চলতে থাকা । তখন সবে চাকরীতে যোগ দিয়েছে, কিছুদিনের মধ্যেই নজরে এলো সেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চুড়ায় বসা একজনের জালিয়াতি । আর কি বসে থাকা যায় ? অন্যায় মেনে নেয়ার মানুষই সে নয় । যথারীতি যুদ্ধ ঘোষণা । রূপকথার গল্পের মত শুনালেও সত্য যে সে সেই সরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবস্থায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামাল ঠুকে দিল । পরিণতি হিসেবে চাকুরী থেকে বরখাস্ত । ভয়ঙ্কর কঠিন সময় ঘিরে ধরল । গল্পের ভেতর আরেকটা ছোট্ট গল্পে সময়টাকে বর্ণনা করা যেতে পারে । তখন তার ছোট ছেলের বয়স ৪ কিংবা ৫ । মামলা মোকদ্দমা চলছে তার উপর চাকরী নেই তাই পুরো পরিবার গ্রামের বাড়িতে । তিনি গেলেন তার পরিবারকে শহরে নিয়ে আসতে । তখন তার ছোট ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে বলল- ‘’আমি এখানে থেকে যাবনা, এখানে অনেক ভাত’’ । তারমানে সেই শিশু গ্রামে গামলা ভর্তি যতটা ভাত দেখেছে ততটা ভাত সে শহরে দেখেনি । তার কথা শুনে পুরো বাড়ির মানুষের চোখে জল । যখন সময় গুলো এমন ছিল সেই যোদ্ধা মানুষটি হেসেছিল এক কঠিন পুরুষের হাসি । মাথা নোয়ানোর প্রশ্নই আসেনা তার । ৭ মাস মামলা লড়ে বিজয়ী হয়েই সেই অফিসেই কাজে যোগ দেয় সে । মধ্যবর্তী সময়ে অন্য কোন চাকরীতে যোগ দেয়নি সে । সেই প্রতিষ্ঠানেই সবচেয়ে ছোট পদ থেকে ৬ জেলার ইনচার্জ হিসেবে মানে রীতিমত কোম্পানির চুড়ার দিকের একটি পদ থেকে অবসর নেন তিনি । এই দীর্ঘ চাকরী জীবনে এসেছে অনেক ঝড় ঝাঁপটা আর সে স্বযতনে আগলে রেখেছে সততা । হাসি ফুটিয়েছে অনেক মুখে, তাই তাঁকে খারাপ বলার মুখেরও অভাব ছিলনা । উপকারের প্রতিদান আশা না করেও অনেক আঘাত সহ্য করতে হয়েছে উপহার হিসেবে, অবলীলায় । তবু তার একই রকম ভাবনায় একই রকম পথে চলা ।
এটাকে জেদ বলব নাকি অবুঝ ? অনেক বোঝার পরও বুঝে উঠা যায়না সে কেন অবুঝ । এতোটা অবুঝ হওয়া কি আদৌ সম্ভব ? ভাবছেন কেন তাঁকে অবুঝ বলছি আমি ? অবুঝ ছাড়া আর কি বলব তাঁকে ? যতটা অবুঝ হলে আমার মত কারো জন্য স্বাধীনতা এনে দিতে সাধের জীবন বাজি রাখতে পারে সে ততটা অবুঝ । নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পরতে পারে পিছুটান ভুলে নিশ্চিন্তে । আবারো যুদ্ধ, পুরো দেশ জুড়ে, তার সমস্ত অস্তিত্ব আর পৃথিবী জুড়ে । এবার নয় মাস ধরে চলে যুদ্ধ । হারানোর আর পাওয়ার সকল হিসেব তুলে রেখে এবার শুধু আগলে রাখে একটু মাটি, এক টুকরো কাপড় যার মধ্যে জড়িয়ে থাকে পুরো জাতির সম্মান, যার নাম পতাকা । এবারও হার মানেনি সে । যদিও জানি কোন বিনিময় বা কিছুই চায়নি সে তবুও এখন আসি তার অর্জনের তালিকায় । যুদ্ধের পর কোন সুবিধা গ্রহনের চেষ্টায় না লেগে শুরু করেছে ব্যাক্তিগত জীবন যুদ্ধ । যার গল্পের খুব ক্ষুদ্রাংশ আমরা শুনেছি । ব্যাক্তিগত যুদ্ধের সময়ও থেকে থাকেনি ভালবাসা বা মানুষের ডাক । যুদ্ধের উপর লিখেছেন বই ‘’মুক্তিযুদ্ধে আফসার ব্যাটালিয়ান’’, সেটি স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ সরকার প্রণোদিত ও প্রকাশিত ‘’স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস’’ বইটির ৯ম খণ্ডে । কিন্তু আমার মত অপদার্থের সেটা আজও পরা হয়না । মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য অনুষ্ঠানে বলেছেন যুদ্ধের কথা আমরা কোন হিন্দি সিরিয়াল বা ধুম ধারাক্কা কিছুর টানে স্বযতনে এড়িয়ে গেছি, এখনও এড়িয়ে যাই সেইসব অনুষ্ঠান । কতগুলো সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িয়ে আছেন তিনি, কত গুলো ভাল কাজে তার হিসেব আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয় । সরকারী এমন এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন বিগ শট হওয়া ছিল বাধ্য হওয়ার মত যৌক্তিক কিংবা একটু দুর্বল মুহূর্তের পা পিছলানো । সেটুকুও ঘটতে দেয়নি সে । তাই দেখতে দেখতে তার মফস্বলের ছোট্ট বাড়ির পাশে গড়ে উঠল বিশাল অট্টালিকা । তার ঘর রয়ে গেল ছোট, কারন সে চায়নি তার চেয়ে তার ঘর বড় হয়ে যাক । সারাজীবন হাড় ভাঙা খাটুনীতে অর্জিত সব দিয়ে সে আপন করেছিল এক টুকরো মাটি । তার সন্তান পরিবার আর শেষ জীবনের স্বল্পমাত্র সম্বল । তার স্বাধীন করা স্বাধীন দেশের মাটি । মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি বলে দাবি করা রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ক্ষমতাসীন একজন আমলার সু নজরে পরে বেদখল হয়ে যায় তার মাটিটুকু । সকল যুদ্ধে ক্লান্ত, অবসরপ্রাপ্ত তার ছিল বলতে ওটুকুই । কোন সন্ত্রাসীর পক্ষে যা করা সম্ভব হতনা তা করে দিয়েছে যাদের হাতে মাটি আর মানুষকে দেখে রাখার ভার তেমন একজন, ভয়ঙ্কর এক জালিয়াতির মাধ্যমে । বাহুবলের জোরে চেষ্টা করা হলে তিনি বা তার সন্তান অবশ্যই রুখে দাঁড়াত । সে তার সন্তানদের শিখিয়েছে রক্ত শুধু সব সময় শরীরে প্রবাহিত হওয়ার জন্যই নয়, মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ভালবাসা বাঁচিয়ে রাখতে রক্ত দিয়ে দিতে হয় সেই প্রিয়কে সেই সত্য ভালবাসাকে । যখন তার নিশ্চিন্ত এক জীবন যাপন করার কথা তখন আবারো নামতে হল নিজের শেষটুকু আর অস্তিত্ব বাঁচাতে । কারণ পরাজয় সে গোধূলি লগ্নেও মেনে নেবেনা । নিশ্চিন্ত শেষ জীবনের বদলে এবারও এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মামলা যুদ্ধ । ধার দেনা কে বন্ধু করে দৌড়াতে হচ্ছে এর কাছে ওর কাছে । যে দেশ এনেছিল, মাটি এনেছিল স্বাধীন করে তাকেই দেশ মাটি মানুষ পর করে দিল নিমিষে । লড়াই চালাচ্ছে সে, জানা যাচ্ছেনা কতদিন চলবে, এটুকু ধরে নেয়া যায় যতক্ষণ বেঁচে আছে এই অবুঝ, ততক্ষন মাথা নিচু হবেনা, চলে গেলেও মাথা উচু করেই যাবে সে । কারন তার কাছে সে হারেনি এখনও, হারতে দেয়নি তার মূল্যবোধ কিংবা মনুষ্যত্বকে । সব কিছুর মত আদালত আর মামলা চলছে, ফলাফল ? আমি আপনি দুজনেই জানি । মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক কিছু করেছে স্বীকার করে নিচ্ছি । সেই সব সুবিধা তো সে চায়নি । সে সধারনের মতই চেয়েছে স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকতে । সেটাও কেন সম্ভব নয় ? সে মুক্তিযুদ্ধ আবাসনে ঘর চায়নি, নিজের মাটিও নিজের রইলনা । মুক্তির লড়াই তো সে তার একার জন্য করেনি । সকলকে একই ভাবে একটি দেশের মানুষ ভেবে ভাল রাখার, ভাল থাকার ব্যবস্থা কেন হলনা ? যুদ্ধের পর রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানো কি তার অপরাধ ? আরও সুযোগ আছে, আছে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য কিছু শিক্ষা ও সুযোগ । তার ছেলের কাছে এমন একটা শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়ার চেয়ে না পড়াই ভাল মনে হয় । তাই এই সুযোগও তাদের তেমন কোন কাজে লাগেনি । কারন এসবও চায়নি তারা কেউ । সে এখনও চায়না কিছুই । কেউ তার গল্প জেনে তার পাশে দাঁড়াক বা জানতে পারুক তাতেও তার ভীষণ আপত্তি । সে এখনও যা চায় তা দেশের জন্য, মানুষের জন্য । সে চায় দেশের কথা যেমন করে ভাবতে পেরেছে তারা তেমন করে কেউ ভাবুক । সে চায় তার মত আরও কিছু অবুঝ মানুষ হোক ।
এখনও টিভি পর্দায় যুদ্ধের কোন ভিডিও চিত্র ভেসে উঠলে তাঁকে দেখা যায় চোখ মুছতে । এখনও দেশের কোন অর্জনের সংবাদ প্রচারে অসুস্থ শরীরে বিছানা ছেড়ে টিভি পর্দার কাছে চলে আসে । তাঁকে অবুঝ না বলে কাকে বলব ? কি বলব ? এখনও তার সামনে রাগে, ক্ষোভে কিংবা মানসিক দুর্বল হতাশায়, কোন অন্ধ ক্রোধে বলা সম্ভব নয় ‘’এই দেশের কিচ্ছু হবেনা’’ অথবা ‘’বাঙালি জাতটাই এমন’’ কোন কথার কথা । সম্ভব নয় এখনও অনেক কিছু এই সব সম্ভবের দেশে । এই যে লেখার প্রয়োজনে সব সম্ভবের দেশ বলেছি, এটাও সে মেনে নেবেনা আমি জানি । আমি অনেক জানি অনেক বুঝি । এত বোঝার পরও এই অবুঝ মানুষটির সামনে আমি দাঁড়াতে পারিনা, চোখ তুলে চাইতে পারিনা তার চোখের দিকে । পারিনি আমি, পারিনা । সম্ভবই নয় । নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হয়, লজ্জা হয় আমার । কারন তার চোখের দিকে তাকানোর মত কিছুই করতে পারিনি আমি । কেটে গেছে অনেক সময় কিন্তু আজও পারিনি ।
তবে আমি জানি আমি পারব । আমাকে পারতেই হবে এবং আমাকেই পারতে হবে । এরও একটা কারন আছে । কারণ
এই অবুঝ মানুষটির সামনে দাঁড়ালেই ভেতরে ভীষণ ভাবে কিছু একটা গর্জে উঠে । শক্তিরা চিৎকার করে । সাহস মাথা চাড়া দেয় । আমার ছোট্ট বুকেও আগুন জ্বলে ।
যে অবুঝ মানুষটির গল্প করছিলাম সে আবার অবুঝ বাবা...
যাযাবর রাসেল
ধানমণ্ডি
১৪/১১/২০১২