গোল কাঁচের জারে বন্দী সোনালী শরীর আর রংধনু পাখনাওয়ালা ছোট্ট ছোট্ট প্রাণি। গোল্ডফিস, কমেট, গাপ্পি, ব্ল্যাক এ্যণ্ড হোয়াইট এ্যঞ্জেল, যেব্রা, ফাইটার... কত্ত নাম! বন্দী ওরা -জানেইনা নিজেরা! সারাদিন ফুরফুরে মনে বাবল কাটে। একে অপরের ন্যাজে গুঁতোগুঁতি, ছুটোছুটি, আর এইটুকু অপরিসর জায়গায় গোত্তা খেয়ে সুখী থাকা। একঘেয়েমি কাটাতে কখনো ডুব দিয়ে জারে লাগানো মানি প্ল্যান্টের শিকড়ে মুখটা ঘষে মেজে বেশ ফর্সা হয়ে আসে। এরই মধ্যে চলে হয়ত সঙ্গীকে ইম্প্রেস করার খেলা, কোনো জুটির অভিমান আর কারো নিবিড় প্রেম। দিনের বেলা জানালার কাঁচ চুইয়ে ছুঁয়ে যাওয়া এক দলা কুসুম রোদে গা সেঁকে আড়মোড়া ভাঙ্গে, আর ডিগবাজি খায়। রাত্তিরে ঠিক দশটায় কুড়িয়ে পাওয়া গোল গোল দানা খেয়ে দিব্যি পেট ফুলে ঢোল! তারপর চোখটা মেলেই পাখনা এলিয়ে খানিকটা নিথর হয়ে যাওয়া। খোলা চোখে কোন স্বপ্ন টপ্ন আসেনা... কেবল গোটা কয় বুদবুদ ফাটে গভীর রাতে।
জীবনে দুঃখ-কষ্ট, বিচ্ছেদ-অপমান এত কিছুর বালাই নেই বাবা! ভালই থাকে ওরা বছর ধরে। শুধু মাঝে মাঝে কাঁচের দেয়ালের ওই পাড়ে দেখে এক দৈত্যের ইয়া বড় বড় দুটো চোখ। স্বচ্ছ আর আর্দ্র। পুকুরের মত টুপটুপে জলে ভরে যায় কখনো, বৃষ্টির ফোঁটার মত পড়ে যায় ঝরঝরিয়ে। দেখে তারা খানিক বিরতি নেয়া খেলাধুলা থেকে। জারের দেয়াল ঘেঁষে উম-উম মুখ নাড়িয়ে নিঃশব্দে কিছু গল্প শুনিয়ে যায়। দৈত্যকে ভয় পায়না ওরা। ভালবাসে।
আবার কখনো তুমুল হই হই শুরু হয়, ঝনঝন শব্দে কাঁচ ভাঙে চারপাশে। আর ছোট্ট কাঁচের জারবাসীরা অস্থির হয়ে সাঁতরে বেড়ায়, পানিতে আলোড়ন তুলে দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করে সাধ্যমত। শেষে ভয় পেয়ে জারের নিচে রাখা পাথরের মাঝে মুখ লুকায়। সেদিন আর রাত দশটার ডিনারে ডাক পড়েনা ওদের। সারারাত জেগে শুনে যায় সমুদ্রের গর্জনের মত শোঁ-শোঁ শব্দ। নিকষ কালো অন্ধকার আর দূর্বোধ্য কিছু আর্তনাদ...।
পরদিন স্বচ্ছ আর আর্দ্র চোখ নিয়ে ঠিকই আসে দৈত্যটা। এক মুঠো খাবার দিয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। তখন দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে আসে ওরাও। খাবারের আশায় নয়, কাঁচের গায়ে একটু চুমু এঁকে দেয় ওদের প্রিয় দৈত্যের জন্যে। শব্দহীন-ভাষাবিহীন এক ভালবাসার সেতু গড়ে তুলতে চায়।
বিশাল বড় বড় এই প্রাণিগুলোর দুঃখ-যন্ত্রনা ওরা বোঝেনা। তাদের চেয়ে অনেক বড় ঘরে বাস করে, প্রচুর খাবার পেয়েও এত অসুখী কেন এই দৈত্যের দল তাও ওদের অজানা। তবু সুযোগ পেলে ভালবাসা দিয়ে, দু-চার রকম নতুন কসরত দেখিয়ে মন ভাল করে দিতে চায়। সুখী হতে বলে ঠিক ওদের মত!