আগুনে পোড়াকে ছিল আমার আজন্ম ভয়। পুড়তে আমি ভীষন ভয় পেতাম, তাই ম্যাচ জ্বালিয়ে পোড়া কাঠিটা পানিতে ভিজিয়ে নিশ্চিত হতাম যে ওটা নিভে গেছে।
পড়তে বসে কারেন্ট চলে গেলে ছোটবেলায় মোম জ্বালিয়ে দিতেন মা। মোম উলটে আগুন লেগে যাবে ভয়ে বইটা সরিয়ে রাখতাম দূরে। দূর থেকে আবছা আলোয় পড়তে দেখে মা বকা দিতেন- "চোখ দুটো হারাবি"... আমি ভাবতাম, চোখ হারালেও জ্যান্ত পুড়ে মরতে তো আর হবে না!
রান্না করতে গেলে গ্যাসের চুলা জ্বালাই। খুব আস্তে দিয়ে রাখি আঁচটা। বাড়াই না কখনো শিখা। গনগনে ওই কমলা বা নীল রঙের আগুনের শিখা কেমন যেন আতঙ্কিত করে রাখে আমাকে রান্নার কাজের পুরোটা সময়...
কতবার যে রাস্তায় পড়ে থাকা আধা জ্বলন্ত সিগারেটের ফিল্টার পা দিয়ে মাড়িয়ে নিভিয়ে দিয়েছি! অন্যের ফেলে যাওয়া বিড়ির আগুন নেভাতে আমার এই ব্যগ্রতা দেখে বন্ধুরা হেসেছে, ব্যঙ্গ করেছে। আমি কিচ্ছু মনে করিনি। শান্তি পেয়েছি- আগুন লাগার ন্যূনতম একটা সম্ভাবনাকেও খতম করে দিয়েছি বলে।
সেবার শীতের ট্যুরে যখন সবাই মিলে ক্যাম্প ফায়ার করা হল, আগুনে ঝলসানো বনমোরগের বারবিকিউ...কী দারুন উৎসব হচ্ছিল আগুনকে ঘিরে! এই আমি; অগ্নিভীতু রইলাম হোটেলের রুমে বসে। কেউ বুঝলনা আমার এই পাগলামির কারণ কী!
মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়েছি, কোনোদিন জ্বালাইনি মরটিন কিংবা গুডনাইট।
ভয়! কয়েলের ওই এক টুকরো আগুনকেই!
আমার চামড়া আমার মাংস আমার কাছে এতটাই প্রিয় ছিল যে, কখনও রোদেও একটু পুড়তে দেইনি, হতে দেইনি একটু তামাটে/ বিবর্ণ, ম্লান। রোদ চশমা, ছাতা, সানব্লক-ক্রীমের কয়েক পরত আস্তরন ছিল আমার নিত্য সাথী।
হ্যাঁ, আমার এই দেহ আমার কাছে এতই প্রিয়। আর হ্যাঁ, আমি অনেক ভীতু। আগুনে দাউ দাউ করে কিছু জ্বলার দৃশ্য কল্পনা করতেও আমার ভয়। বার্ণ ইউনিট, অগ্নিদগ্ধ মানুষ- এই শব্দগুলো আমায় শিহরিত করে আতঙ্কে।
তাই বলে কি আমি ক্ষমা পেয়েছি? অবিশ্বাস্য আতঙ্কে সেদিন যখন ছুটে আসতে দেখেছি একটা আগুনের গোলা আমার দিকে, চারপাশটা নিমিষেই নরক হয়ে উঠেছিল যখন, অসহনীয় উত্তাপে পুড়তে শুরু করেছিল আমার প্রিয় সাদা ওড়নাটা, আমার চুল, চোখের পাঁপড়ি, আমার কাঁধে ঝোলানো নীল ব্যাগ, ব্যাগের ভেতর জমানো আমার এতদিনের গবেষনার ভীষন জরূরী সব তথ্য, ছাতা, খাতা, টুকিটাকি... আমি ছুটতে চেয়েও পারিনি। আমার পায়ের নিচেও কেবলই আগুন!! সেই আগুন, আমার চিরায়ত ফোবিয়া যাকে ঘিরে, সে এখন আমাকে আলিঙ্গন করতে এসেছে...কই! আমি তো কারো এতটুকু দয়া পাইনি...?
শুধু ফিস ফিসিয়ে আমার প্রিয় মানুষটাকে বলেছি- তোমার ক্যান্ডেল-লাইট ডিনার আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। এই যে দেখো, আমি আজ থেকে মোমের আলোয় মিশে গেলাম...
বলেছি মা, তোমার বানানো কাবাব আমার অসম্ভব প্রিয় ছিল। আমার গায়ে কেন যেন আজ কাবাবের গন্ধ- স্বাদটাও বুঝি এক?
বাবা... তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ ছিল, আর বলা হলনা! ভার্সিটিতে খোঁজ নিও, জানতে পারবে!
আর কিছু ভাবিনি, অপেক্ষা করেছি পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে মিলিয়ে যাবার। ছাই হয়েই যেতে চেয়েছি... চাইনি বার্ণ ইউনিটে আরো কটা দিন অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করতে আর নোংরা রাজনীতির ধারক সেইসব নেতাদের নিঃশ্বাসে দূষিত বাতাসে আর একটা দিনও শ্বাস নিতে!
এই অর্ধ দগ্ধ শরীরে এটাই ছিল আমার শেষ চাওয়া...