'নামাজ' - শব্দটা আমার মত বেশ কিছু মানুষের জন্য বেশ বিব্রতকর। কারন একজন মুসলিম হিসাবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা অনেক সময় আমরা পালন করতে পারি না। নামাজ সকল খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখে, নামাজ আপনাকে মানুষ হিসাবে ভালো এবং নৈতিক কাজে অনুপ্রাণিত করবে এমনটাই আমরা শুনি এবং জানি।
কিন্তু আমরা আশেপাশে কি দেখি? আমরা এমন সব মানুষকে নামাজ পড়তে দেখি যাদের কপালে দাগ পড়ে গেছে সেজদা দিতে দিতে কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত জীবনে তারা এমন সব কাজ করে যার সাথে নীতি নৈতিকতার কোন সম্পর্ক নেই।
আমি এমন অনেক ব্যবসায়ীকে মসজিদে নামাজ পড়তে দেখি যারা খোদ রমজান মাসেও মানুষ ঠকানোর ব্যবসা করে এমন কি তাদের চোখ, মুখ থেকেও আপনি নিরাপদ নন। শুধু তাই নয় আমি আমাদের সমাজে এমন অনেক নারী পুরুষকে দেখেছি যাদের অন্তরে প্রচন্ড হিংসা, বিদ্বেষ, কুচিন্তা এবং কুপরামর্শ টগবগ টগবগ করে। এই মানুষগুলোকে আমরা দেখি আজান দিতেই নামাজে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যায়, নামাজ পড়েন। এই সব মানুষ যে নামাজ পড়ে সে নামাজ আমাকে টানে না। এদের দেখে নামাজে দাঁড়ালে সব কিছু মেকি এবং অর্থহীন মনে হয়।
আমি অনেক হুজুরদের দেখেছি তারা নামাজ পড়ে দ্বীন পালনের জন্য, আল্লাহকে খুশি করার জন্য কিন্তু তারা নিজেরাও জানে না, কেন তারা নামাজ পড়ছে, কেন আল্লাহ নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন?
নামাজের নির্দেশনার পেছনে কারন খুঁজতে হলে আপনাকে হযরত আদম সাঃ এর সৃষ্টির সময় ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ প্রথম মানুষকে সৃষ্টি করে আশরাফুল মাখলুকাত হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন যেন ফেরেশতাদের অহংকার বোধ জাগ্রত না হয় বা আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে কোন সন্দেহ বা দ্বিধা তৈরী না হয়। আল্লাহ ফেরেশতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন তার সৃষ্টি হিসাবে হযরত আদম আঃ কে সেজদা দিতে। আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির ব্যাপারে কসম করে বলেছেন, 'লাক্বাদ খালাকনাল ইনসানা ফি আহসানা তাক্বভীম' - অর্থাৎ অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম গঠনে।
আমরা জানি সকল ফেরেশতা আল্লাহর আদেশকে মেনে তার সৃষ্টিকে সেজদা করেছেন। তাঁর সৃষ্টিদের মধ্যে একজন নতুন সৃষ্টিকে সেরা মেনে সেজদা করতে অস্বীকৃতি জানায়। আমরা সেই সৃষ্টিকে শয়তান হিসাবে চিনি। আপনি আল্লাহর দয়ার উদহারন চান? খোদ শয়তানই হচ্ছে আল্লাহর সবচেয়ে বড় দয়ার একটি দৃষ্টান্ত। আল্লাহ যাকে চাইলে সাথে সাথে ধ্বংস করে দিতে পারতেন, সেই শয়তানকে তারই অনুরোধ ক্রমে কেয়ামত পর্যন্ত মানুষকে বিভ্রান্ত করার অনুমুতি প্রদান করেছেন। কারন সে আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করছে যে সে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ছাড়বেই। এই চ্যালেঞ্জ হয়েছে অহংকারের কারনে, নিজেকে বড় মনে করার কারনে।
আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাতকে প্রচন্ড ভালোবাসেন, নানাভাবে রহমতের ছায়ায় রেখেছেন, তিনি নিজেই শয়তান আর আমাদের মাঝের রক্ষাকবজ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আল্লাহ তাই বলেছেন, মানুষ যতই শয়তানের ধোঁকায় পড়ে অপরাধ করুক, অন্যায় করুক - একবার আমাকে অন্তর থেকে ক্ষমা চাইলে আমি তাকে মাফ করে দিবো। (সোবাহানআল্লাহ!) এটা আল্লাহর রহমত এবং দয়ার এক অনন্য নজীর।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ইবাদত করার জন্যই মানব জাতিকে সৃষ্টি করেন। তাঁর সকল সৃষ্টিতে তাঁকে সেজদা করে। ‘সেজদা’ একটি অনন্য এবং অদ্বিতীয় সম্মাননা, যা শুধু আল্লাহরই প্রাপ্য।
কিন্তু সেজদা বিষয়টি এত সহজ বা হালকা নয়। সেই ক্ষেত্রে তো আল্লাহ বলতে পারতেন, তোমরা শুধু আমাকে দিনে পাঁচ বার সেজদা দিবে - দ্যাটস ইট। সেজদা করতে অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়, নিজেকে পবিত্র করতে হয়, আল্লাহর প্রশংসা করতে হয়, আল্লাহর সামনে ঝুঁকতে হয় এবং তারপর আপনাকে সেজদায় যেতে হয়।
এই যে সেজদা করার এই প্রক্রিয়া, সেজদা করার উদ্যোগ বা প্রস্তুতি - এর নামই নামাজ! নামাজের মুল অংশ একটিই - তা হলো সেজদা! সেজদার মাধ্যমে বান্দা সরাসরি আল্লাহর দরবারে হাজির হয়, একজন মানুষ যখন প্রকৃত সেজদায় যায় তখনই সে শুধুমাত্র আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করে।
আপনি যখন সকল প্রশংসা, দোয়া এবং প্রস্তুতির পর সেজদার মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে মাথা নত করবেন, আপনি একটি অদ্ভুত ইতিবাচক মানসিক প্রশান্তি অনুভব করবেন। আমাদের এত দোয়া, এত আমল সব কিছু একটি সেজদার জন্য, যে সেজদা কবুল হবে। একজন মানুষ হয়ত সারাজীবন নামাজ পড়েও একটি সেজদা কবুল করাতে পারেন নি, একবারও মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকতে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হতে পারে নি - এর তাইতে দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে।
দৈনিক পাঁচ বেলা মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে উপস্থিত হতে পারার সৌভাগ্য অর্জন করার জন্য ইদানিং নামাজ পড়ার ইচ্ছে তৈরী হয়। কারন নামাজের মাধ্যমেই আমি সেজদা দিতে পারি, আল্লাহর কাছে যেতে পারি।
সেজদায় গিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। যত মন চায় দোয়া করুন। আপনি আমি আমল করে আল্লাহর ইবাদতের হক আদায় করতে পারব না, সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারব না, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাদের ভুল ভাল প্রস্তুতি একটা আন্তরিক সেজদার উপরই নির্ভর করতে হবে। সেজদার মাধ্যমে সকল সৃষ্টির ভেতরের অহংকারবোধ নষ্ট হয়।
আমার ভুল না হলে রমজানের শেষ দশ দিন শুরু গেছে এবং সম্ভবত আজকের রাত ছিলো প্রথম বেজোড় রাত। আল্লাহ যেন আমাদেরকে অবনত মাথায় তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা, উচ্চকন্ঠে তাঁর প্রশংসা করার সুযোগ আমাদেরকে প্রদান করেন। তাঁর রহমতের সামান্য কনার কনা পেলেও আমরা মানুষ হিসাবে সফল হবো, ক্ষমা পাবো।
এই রমজানের শেষ দশ দিন আপনি পড়ুন - আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা'ফু আন্নি! - হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাশীল এবং ক্ষমা করতে পছন্দ করেন, অতএব আমাকে ক্ষমা করুন।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১:৪৮