প্রিয় পাঠক, এই ভ্রমণ কাহিনীতে খুব বেশি ছবি যুক্ত করতে পারছি না বলে দুঃখিত। মেমরী কার্ড জটিলতার কারনে আমার তোলা অধিকাংশ ছবি হারিয়ে ফেলেছি। মোবাইলে কিছু ব্যক্তিগত ছবির পাশাপাশি অল্প কিছু ভ্রমন সংক্রান্ত ছবি আছে। সেগুলো এখানে যুক্ত করার চেষ্টা করব।
।। নষ্টালজিক যাত্রা পথ।।
বর্ডার থেকে পাঁচ মিনিট দূরত্বেই কুচবিহার - জলপাইগুড়ি - শিলিগুড়ি হাইওয়ে। এখান থেকে শিলিগুড়ি, জলপাইগুঁড়ি যাবার বাসও পাওয়া যায়। গাড়ি বেশ দ্রুত চলছে। দুর দিগন্তে ভুটান বা নেপাল থেকে নেমে আসা ঘন মেঘের সারি দেখে মনটা কেমন যেন হুহু করে উঠলো। বুক ভরে একটা বড় নিঃশ্বাস নিলাম। বাতাসে দূর থেকে ভেসে আসা ভেজা মাটির গন্ধ। পথের দু ধারে ঘর বাড়ি, মানুষজন দেখে বুঝার ঠিক উপায় নেই যে আপনি ভারতে আছেন। মনে হচ্ছে বাংলাদেশের কোন এক মফস্বল শহরের পাশ দিয়ে যাওয়া মহাসড়ক ধরে যাচ্ছি।
বেশ কিছুদূর যেতে ড্রাইভার হঠাৎ ব্রেক কষে বললেন, দাদাবাবু আমি তো টোলের টাকা রিচার্জ করতে ভুলে গেছি। এই পথ দিয়ে গেলে আমার জরিমানা হবে তাই একটু ঘুর পথে যেতে চাই।
বিষয়টি হচ্ছে, ভারতের মহাসড়কে বিভিন্ন টোল আছে। সেই টোল প্রদানের একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আছে, যেখানে টপআপ করে টোলের টাকা রাখতে হয়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে টোল প্রদান না করলে সাধারন রেটের চাইতে কয়েকগুন বেশি টাকা পরিশোধ করতে হয়। এতে সুবিধা হলো, টোল নেয়ার জন্য দীর্ঘ লাইনের প্রয়োজন হয় না, ফলে মহাসড়কে জ্যাম হয় না।
আমি মনে মনে ভাবলাম, ভারতে যদি এই প্রযুক্তি প্রণয়ন করতে পারে, তাহলে আমাদের 'ডিজিটাল' বাংলাদেশে কেন তা সম্ভব নয়
সব শুনে শিক্ষক ভদ্রলোক বললেন, যাও, কিন্তু এর জন্য কি আবার বাড়তি খরচ দিতে হবে নাকি?
ড্রাইভার বলল, আপনারা ধনী মানুষ, আপনাদের দুই একশ রুপি বাড়তি খরচে তেমন কিছু হবে না। কিন্তু আমার জন্য এটা বেশ চাপের হয়ে যায়। আমার দাবি নেই, কিন্তু আপনারা বিবেচনা করে যদি মন চায় তাহলে অল্প কিছু বাড়তি দিয়েন।
এরপর আর কথা থাকে না। আমরা মুল সড়ক থেকে নেমে একটি তুলনামুলক ছোট সড়কে নেমে এলাম। এই পথ দিয়ে জলপাইগুড়িও যাওয়া যায়। জলপাইগুড়ির কথা মনে হতে কেমন যেন নস্টালজিক অনুভুতি হলো। সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসের নায়িকা দীপাবলির কথা মনে পড়ে গেল। বড় আত্মবিশ্বাসী আর সাহসী এক চরিত্র, যার প্রেমে পড়েছিলাম। মানুষের মন কি অদ্ভুত! কল্পিত কাহিনীর চরিত্রের প্রেমেও পড়তে পারে। পথের দুই ধারে কিছুটা জঙ্গলের মত গাছ পালা আর ফাঁকা জায়গায় বিছিন্ন কিছু চা বাগান চোখে পড়ল। সমতলে চা বাগান দেখে কিছুটা অবাক হলাম। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, এই পাশেও চায়ের চাষ করে।
আমরা যে পথে যাচ্ছি, সেই পথের দুপাশে বড় বড় গাছের সারি আর মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জংলা গাছপালায় ভর্তি। ড্রাইভার কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। আমি দু পাশের চা বাগান আর প্রকৃতি উপভোগ করছি। মনে মনে ভাবলাম, ভালোই হলো হাইওয়ে ধরে না গিয়ে এই ছোট রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। দীপাবলির শহরের পাশ দিয়ে যাওয়া হবে। বুকের ভেতর মনে হয় হৃদকম্পন কিছুটা অস্থির হতে শুরু করেছে।
হঠাৎ ড্রাইভার বলল, বেশি ঘুরে যেতে হবে না দাদা। ফোনে জেনে নিলাম, এই পথ দিয়ে বের হলে আবার রানারহাটের পাশ দিয়ে উঠে যেতে পারব। মনে মনে কিছুটা ব্যথিত হলেও আমার মেয়ের খিদা পেয়েছে শুনে ভাবলাম, ভালোই হয়েছে। হাইওয়ে দিয়ে গেলে দ্রুত পৌঁছে যেতে পারব। বলতে না বলতে আমরা শিলিগুড়ি হাইওয়েতে উঠে পড়লাম। রাস্তায় বিলবোর্ডে একটু পর পর ভারতীয় নায়ক নায়িকা, ক্রিকেটারদের ছবি আর পথের মোড়ে মোড়ে লটারি কেনার দোকান দেখে এই প্রথম বুঝলাম, আমি ভারতে আছি।
।।শিলিগুড়ি শহর।।
দুপুর দেড়টা নাগাদ আমরা শিলিগুড়ি শহরে পৌঁছে গেলাম। হোলির কারনে পুরো শিলিগুড়ি শহর প্রায় ফাঁকা। মাঝে মাঝে কিছু গাড়ি, বাস আর উদ্দাম গতির কিছু বাইকে প্রেমিক প্রেমিকারা রঙ মেখে ছুটে যাচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে - হোলি হ্যায়!
ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের এখানে কি বাংলা প্রধান ভাষা না?
ড্রাইভার বললো, দাদাবাবু, এখানে বাংলা, হিন্দি, নেপালী সব ভাষাই চলে। তবে বাংলার পাশাপাশি, নেপালী ভাষার প্রভাব কিছুটা বেশি।
এটার প্রমান আমরা পরবর্তীতে বেশ কয়েকবারই পেয়েছি। শিলিগুড়ির একদম প্রাণকেন্দ্রের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা মহানন্দা নদী শিলিগুড়ি শহরকে দুইভাগে ভাগ করেছে। অবশ্য নদীর উপর দিয়ে মহানন্দা ব্রিজ এই দুইভাগকে আবার মিলিয়েও দিয়েছে। এই ব্রিজে উঠার একদম আগে হিলকার্ট রোডে শিক্ষক দম্পত্তিকে তাদের পছন্দের একটি হোটেলে নামিয়ে আমরা বিদায় নিলাম। বিদায় বেলায় তাঁরা আমার কন্যাকে আবারও আদর করলেন এবং রংপুরের বাসায় বেড়াতে যাবার দাওয়াত দিলেন। আমরাও আমাদের ঠিকানা আর ফোন নাম্বার বিনিময় করলাম এবং ঢাকায় বেড়াতে গেলে আমাদের বাসায় যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম।
হোলি উপলক্ষ্যে এই দিন পশ্চিমবঙ্গে ছুটি থাকায় তেমন বেশি গাড়ি দেখা যাচ্ছিলো না। আমাদের ড্রাইভারকে দার্জিলিং পর্যন্ত যেতে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি নানা ধরনের কারন দেখিয়ে যেতে রাজি হলেন না। আবার আমাদের উল্টো ভয়ও দেখালেন। বললেন, আজকে আপনারা গাড়ি পাবেন না আর পেলেও গাড়ি ভাড়া অনেক হবে। তারচেয়ে শিলিগুড়িতে কোন হোটেলে থেকে যান, তারপর দিন সকালে চলে যাবেন।
আমি কিছু বলছি না দেখে তিনি নিজের পরিচিত কিছু ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে কথাবার্তার বলে বললেন, নাহ! আজকে গাড়ী হবে না। আর যারা যেতে চাইছে, তারা অনেক বেশি ভাড়া চাচ্ছে। এত ভাড়া দিয়ে কি যাওয়া ঠিক হবে?
আমি জিজ্ঞেস করলাম কত ভাড়া চাচ্ছে?
ড্রাইভার বলল, ৪০০০/৪২০০ রুপি।
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। সত্যি বলতে আমি রাস্তাঘাটে তেমন কোন গাড়ি দেখতে পাচ্ছিলাম না। পথে যে একটা স্ট্যান্ড ফেলে এলাম, সেখানেও খুব বেশি একটা গাড়ি দেখিনি। তাই সত্যি বলতে কিছুটা চিন্তা হচ্ছিলো। তারপর ড্রাইভার আবার বলল, আপনারা যদি আজকেই যেতে চান, তাহলে আমি আমার এক বন্ধুকে রিকোয়েস্ট করে ৩৬০০/৩৭০০ রুপির মধ্যে আপনাদের জন্য একটা গাড়ি ম্যানেজ করে দেয়ার চেষ্টা করতে পারি।
আমি এবারও কিছু না বলে চুপচাপ হয়ে বসে রইলাম। মহানন্দা ব্রিজ পার হয়ে সামনে কিছুটা এগিয়ে যেতেই গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লাম। ড্রাইভার বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, এখানে নেমে যাচ্ছেন যে?
বললাম, দেখি, আজকে মনে হয় না আর যাবো। তারচেয়ে একটু শহর ঘুরে মার্কেটে যাবো। পরে কোন একটা হোটেলে উঠব। আপনি বরং চলে যান, নাম্বার তো রইলোই।
ড্রাইভার আমার দিকে বেশ কিছুক্ষন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তারপর চলে গেলো। আমি সামনে হাটা দিলাম। সত্যি বলতে আমার কখনই এটা বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে, আজকে গাড়ি পাওয়া যাবে না কিংবা পেলেও তার ভাড়া এত বেশি হবে। আমি যেখানে নেমে গেলাম, সেখান থেকে এসএনটি (সিকিম যাবার পারমিশন নেয়ার জায়গা), জংশন আর শিলিগুড়ি সরকারী বাস স্টেশন ২ মিনিটের পথ। এই জংশনে গ্যাংটক, সিকিম, দার্জিলিং সহ বিভিন্ন জায়গায় যাবার রিজার্ভ ট্যাক্সি, শেয়ার্ড ট্যাক্সি এবং বাস পাওয়া যায়। তবে এখানে প্রচুর দালাল থাকে। এদের হাতে পড়লে আপনার আর্থিক ক্ষতি সহ সকল ঘোরাঘুরি প্ল্যান নষ্ট হতে পারে। তাই আমি ঢাকা থেকে রওনা হবার সময় পরিকল্পনা করেছিলাম যে জংশনের আগেই নেমে যাবো। ড্রাইভারের কথাবার্তা শুনে আমার সন্দেহ হবার কারনে আমি আরো আগেই নেমে পড়েছিলাম।
শিলিগুড়ির শুধু যে জংশনেই আপনি দার্জিলিং, সিকিম বা গ্যাংটক যাবার ট্যাক্সি বা জীপ পাবেন তা কিন্তু নয় বরং এই এই রাস্তার আশেপাশে আরো ট্যাক্সি স্ট্যান্ড আছে সেখান থেকেও আপনি জীপ রিজার্ভ করতে পারবেন। বাংলাদেশ থেকে যারা শ্যামলী পরিবহনের ডাইরেক্ট গাড়িতে শিলিগুড়িতে যান, তারা সবাই হোটেল সেন্ট্রাল প্লাজার সামনে নামেন। এটা থ্রি স্টার মানের একটি হোটেল। আসার সময় এই হোটেলে আমি এক রাত ছিলাম। এই হোটেলের সামনে থেকেও চাইলে আপনি দার্জিলিং বা গ্যাংটক কিংবা সিকিমের জন্য গাড়ি ভাড়া করতে পারবেন।
শেষমেষ কোন সমস্যা ছাড়াই আমি জংশনের প্রায় ২০০ গজ আগের আরেকটা স্ট্যান্ড থেকে দার্জিলিং এর জন্য গাড়ি ভাড়া করি। ২২০০ রুপিতে আমি দার্জিলিং এ যে হোটেল ঠিক করেছি, আমাকে সেখানে নামিয়ে দিবে এবং পথে আমাদের চাহিদা অনুসারে যে কোন ভিউ পয়েন্ট বা লাঞ্চের জন্য থামাবে।
আমার মেয়ের তো খিদে আগেই পেয়েছিলো, তাই তার জন্য কিছু স্ন্যাক্স আইটেম কিনতে গিয়ে আমাদের জন্যও কিছু স্ন্যাক্স কিনে আনলাম। মোট ১২০ রুপিতে যে স্ন্যাক্সগুলো কিনলাম তা বাংলাদেশে কিনতে গেলে আমার প্রায় সাড়ে তিনশ টাকার বেশি খরচ হতো।
রোশান নামের এক নেপালি বংশোদ্ভূত ড্রাইভার যখন অমায়িক এক হাসির মাধ্যমে আমাদের নিয়ে দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল, ততক্ষনে ঘড়িতে প্রায় বেলা আড়াইটা বেজে গেছে। আর আমি অনাগত পথের সৌন্দর্য দেখার উত্তেজনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি।
চলবে...।
।। ভ্রমণ কাহিনী।। জঙ্গল, নদী, চা বাগানের দেশ হয়ে পাহাড়ের রানীর দেশে। পর্ব- ১।।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০২৩ রাত ১০:২৫