১.
কয়েকদিন আগে সকালে খুব মন খারাপ করা একটা স্বপ্ন দেখলাম।
এর আগের রাতে তীব্র গরমে আর মশার কামড়ে একটুও ঘুমাতে পারিনি, সারা রাত শুধু ছটফট করেছি। সকালে যখন মশা আর গরম দু'টোরই প্রকোপ একটু কমে এলো তখন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ঘুম এসেছিলো... কিন্তু মাথায় এত দুশ্চিন্তা নিয়ে চাইলেও ঘুমানো সম্ভব না। নাশতা বানাতে হবে, বাসায় অনেক মানুষজন আছে তাদের খাওয়াতে হবে, অফিস যেতে হবে, দুপুরে বাইরের কিছু খাওয়া যাবে না কাজেই সেটাও তৈরী করে বক্সে ভরে নিতে হবে... একদিকে চরম অবসন্নতা, আরেকদিকে মাথা জুড়ে অজস্র টেনশন। কি করবো আর কি করবো না ভাবতে গেলেই হতবুদ্ধি হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হচ্ছিলো।
শারীরিক কিছু সমস্যা হেতু আজকাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই অসম্ভব খিদে পেয়ে যায়। এমন কিছু বেলা হয়নি তখনও, বালিশটা বুকে আঁকড়ে রেখে শুয়ে থাকতে খুব ভালো লাগছিলো... কিন্তু এমন তীব্র খিদে পেটে নিয়ে শুয়ে থাকা কি যে দায়! অথচ সবাই তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, এমন একটা মানুষ নেই যে খাবারের থালা সামনে নিয়ে এসে বলতে পারবে "নাও, খেয়ে নাও!" আধো ঘুম, আধো জাগরণ, শারীরিক দূর্বলতা আর অদ্ভুতরকম খিদের জ্বালা নিয়ে একটা ঘোরের জগত তৈরী হয়ে গিয়েছিলো বোধহয়। তখনই দেখলাম স্বপ্নটা।
দেখলাম, মা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কেমন অদ্ভুত একটা জায়গা... সামনে অনেক রকম খাবার, বড় বড় পাত্রে রাখা... ঠিক বুফে খাবারের স্টল যেরকম হয় সেরকম।
যে ভিখিরি দিনের পর দিন খেতে পায় না, সে যেমন ভাবে মানুষের কাছে খাবার ভিক্ষা করে... আমিও তেমন কাতর গলায় বললাম, "মা আমাকে কিছু খেতে দিবা? বড় খিদা..."
মা আমাকে একটা পাত্রে কিছু খাবার দিলো, আমি বুভুক্ষুর মত হাপুস হুপুস করে খেতে লাগলাম... খেতে খেতেই বুঝতে পারলাম যে হচ্ছে না, এই খাবারে আমার কিছুই হচ্ছে না... হবেও না... খিদে যদি বাস্তবেই লেগে থাকে তাহলে স্বপ্নে যতকিছুই মা আমাকে খাওয়াক না কেন, পেট তো ভরবে না তাই না?... স্বপ্নটা একটু একটু করে পাতলা হয়ে আসতে লাগলো, তবু আমার খাওয়া শেষ হলো না... খিদেও কিছুই মিটলো না... মাঝখান থেকে শুধু এটুকুই ভেবে অসম্ভব যন্ত্রণা হতে লাগলো যে শরীরে কুলাক আর নাই কুলাক এই খিদে আমাকেই মেটাতে হবে... আজ মা কাছে থাকলে এই কষ্টটুকু এভাবে পেতে হতো না... কেমন হতভাগা মনে হলো নিজেকে!
.
.
.
২.
এর আগে একবার একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেটার কথা আমার আজীবন মনে থাকবে।
সারারাত কোনও একটা দূরপাল্লার জার্নি করে এসেছি। সকালে বাসায় পৌঁছেই যথারীতি বিছানায় এক ঝাঁপ দিয়ে পড়ে ঘুম!
অনেক আগে একবার একটা বইয়ে পড়েছিলাম, মানুষ স্বপ্নের ভেতরে এমন একেকটা স্তরের মধ্যে দিয়ে যায় যখন সে স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমারেখা হারিয়ে ফেলে। বুঝতে পারে না যে সে যা দেখছে তা কি আসলেই স্বপ্ন, না বাস্তব।
আমি এখন বুঝতে পারি আমার এই স্বপ্নটা ঐরকম কোনও একটা স্তরে দেখা... নইলে কখনও তা এত জীবন্ত, এত জান্তব হতো না। যখন স্বপ্নটা দেখি তখন বুঝতে পারিনি। বোকা হয়ে গিয়েছিলাম।
দেখলাম, আমার ঠিক সামনে একটা কালো অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। কোনও শরীর নয়, কেবল একটা ছায়ার মত আকার। একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে আছে আমার দিকে, যেন কিছু একটা খামচে ধরতে চায়।
কি বিচিত্র ব্যাপার, অবয়বটা দেখেই আমি বুঝলাম, এ আর কেউ নয়... স্বয়ং মৃত্যু। আমাকে নিতে এসেছে।
মৃত্যুকে দেখেই পেছন ফিরে দৌড়ে পালাবো, এরকম কোনও বোধ কেন যেন মাথায় এলো না... মনে হলো- ও আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে কেন, যেতে হলে আমি নিজ উদ্যোগে, স্বেচ্ছায় যাবো!
কাজেই অবয়বটি আমাকে খামচে ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে আমি নিজেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম... আর ঝাঁপিয়ে পড়েই বুঝতে পারলাম যে... I am no more!
যখন বুঝতে পারলাম যে আমি সত্যিই মৃত্যুর ওপারে চলে গেছি, এপারে আর আসা হবে না... তখন কেমন যেন একটা কষ্ট হতে লাগলো। ঠিক কষ্ট নয়... এক ধরণের আফসোস বলা যায়। যেতে তো আপত্তি নেই, ইন ফ্যাক্ট তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করি... কিন্তু সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেতে খুব ইচ্ছে করে। কিভাবে যাবো তাও তো জানি না... অথচ সবাইকে খুব বলে যেতে ইচ্ছে করে যে, "চলে যাচ্ছি... আর আসা হবে না... তোমরা ভালো থেকো... আমি কোনও কষ্ট দিয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিও..." যখন বুঝে গেলাম যে এই কথাটাই আর বলা হবে না, তখন কি যে খারাপ লাগতে লাগলো... কত অজস্র মানুষ আছে আশেপাশে, তাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়া হলো না... আর কারো কথা নাহয় বাদই দিলাম, যে মানুষটার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম তাকেও একবার বলে যেতে পারলাম না... সে যখন ঘুম ভেঙে উঠে দেখবে আমি আর নেই, তখন তার অবস্থাটা কেমন হবে ভেবে এতই মায়া লাগছিলো... কিন্তু কিচ্ছু করার ছিলো না... আমি কত বার সেই কালো অবয়বটির কাছে মাথা কুটলাম এই বলে যে প্লিজ আমাকে একবার ফিরে যেতে দাও... মাত্র একবার... আমি কেবল বিদায় নিয়ে আসতে চাই, আর কিছু নয়... শুধু একবার... তবু তার এতটুকুও দয়া হলো না... কি ভীষণ তীব্র অনুশোচনা অথচ কিছু করার নেই... কিচ্ছু না... খুব জানতে ইচ্ছে করে মানুষ যখন সত্যি সত্যি মরে যায় তখন তার এরকমই অনুভূতি হয় কিনা...
মরে যাওয়ার বোধটা যে আসলে ঠিক কেমন, সেইদিনই আমার সম্যক উপলব্ধি হয়ে গিয়েছিলো।