একজন মানুষ ঠিক কতটা নিজের মত হতে পারে?
কিংবা একজন মানুষ ঠিক কতটা নিজের মত হতে পারে না?
এই যে আমরা কথায় কথায় বলি Be yourself, কতটুকু আমাদের সাধ্যে কুলায় নিজের মত হতে পারা বা না পারাটা?
আচ্ছা সহজ করে বলি, মানুষ কিছুটা হয় বাবার মত, কিছুটা মায়ের মত, কিছুটা হয়তো খুব কাছের কোনও আত্মীয়ের মত, কিন্তু বাকিটা?
কত কিছু করতে তার ইচ্ছে করে, কিন্তু ইচ্ছেগুলো বুকে পুষে রেখেই সে একটা জীবন পার করে দেয়।
আবার কত কিছু করতে তার ইচ্ছে করে না, কিন্তু পরিপার্শ্বের চাপে পড়ে তাকে বাধ্য হয়ে সেটাই করতে হয়।...
বয়ঃসন্ধির কোনও একটা পর্যায়ে এসে কি করে যেন, খুব অনিচ্ছাকৃতভাবেই টের পেয়ে গেলাম যে খুব আলাদা হয়ে যাচ্ছি সবার থেকে। কি যেন একটা আমার আছে, ওদের নেই। কিংবা কি যেন একটা ওদের আছে যেটা আমার নেই।
আমি কি অন্যরকমভাবে কথা বলি?
হয়তো।
আমি অন্যরকমভাবে হাঁটি-চলি?
না, আমার তো তা মনে হয় না...
কিন্তু ওরা ওভাবে তাকায় কেন? হাসে কেন? টিটকারী দেয় কেন?
আমার মধ্যে কি কোনও বড় ধরণের ডিজঅর্ডার আছে?
আমার তো যখন যা মনে হয় তাই বলি, তাহলে কেন ওরা বলে যে আমাকে বোঝা যায় না?
কিংবা বোঝা গেলেও বিশ্বাস করা যায় না?
কই, জ্ঞানতঃ কারও বিশ্বাস ভঙ্গ করেছি বলে তো মনে পড়ে না!
মনে হতো সবই আছে তবু কি যেন একটা নেই... নিজেকে নিয়ে কাঁহাতক এমন সংকটের মধ্যে থাকতে পারে মানুষ???
দিনে দিনে বাড়তে বাড়তে সেই সংকট এমন একটা অবস্থায় এসে দাঁড়ালো যে প্রতিমুহূর্তে নিজেকে অভিশাপ দেয়া ছাড়া আর কিচ্ছু করার থাকলো না। নিজে যা অনুভব করতাম চেষ্টা করতাম সেইমত কাজ করার কিন্তু ফলটা হতো খুবই নিদারুণ। চতুর্দিকের চাপে নিষ্পিষ্ট হতে হতে একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে আসলেও নীরবে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারতাম না। কেন যেন আত্মপক্ষ সমর্থনের জোরটাও টের পেতাম না ভেতর থেকে। একা হয়ে যেতে যেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ারও অনেক পরে কোনও এক সময়ে এসে হঠাৎ মনে হতোঃ
কেন আমি আমার মত?
কেন আমি একটু চেষ্টা করে আর দশজনের মত হয়ে যেতে পারি না?
আমি তো কখনও ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করিনি যে আমি আলাদা, কিন্তু আর সবাই এসে যদি ক্রমাগত ঠ্যালা- ধাক্কা- গুঁতো দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে যে আমি আলাদা, সেখানে আমার কি করার থাকতে পারে?
খুব বড় গলায় বলার মত কোনও গুণ ছিলো না কোনওদিনই। খুব সাধারণ পরিবারের সন্তান, নিজেও আগাপাশতলা সাধারণ। কিন্তু কোনও এক বিচিত্র কারণে সব জায়গায়ই বড় বেশি Tagged হয়ে যেতে হয়েছে। যতই দ্রবীভূত হতে চেয়েছি, ততই কোথাও না কোথাও এসে বুঝে গেছি যে আসলে দ্রাবক মাধ্যমটাই আমাকে নিয়ে দ্রবণ তৈরী করতে রাজি নয়। অর্থাৎ মানি আর নাই মানি, চাই আর না-ই চাই, অধঃক্ষেপণের মত আমাকে তলায়ই পড়ে থাকতে হবে, শত চেষ্টা করলেও মিশে যাওয়া সম্ভব হবে না।
হায়, নিজেকে কত গালি দিলাম আর কতই না শাপ-শাপান্ত করলাম এসবের জন্য, কিন্তু লাভের লাভ হলো না কিছুই।...
একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে, যখন আর বেঁচে থাকার মত ইচ্ছেটাও অবশিষ্ট নেই, তখন একজন মানুষ বুঝতে শেখালো যে নিজেকে নিয়ে এত সঙ্কুচিত হয়ে থাকার কিছু নেই, কেউ তোমাকে না বুঝলে না বুঝলো, না মানলে না মানলো, একমত না হলে নাহয় নাইবা হলো---তুমি তোমার মত বলেই সবচেয়ে সুন্দর, অন্য কারও মত হয়ে গেলে তোমাকে আর একটুও ভালো লাগবে না! নিজেকে নিয়ে কক্ষনো কোনও দ্বিধায় থেকো না, Just be yourself!
প্রথম প্রথম কথাটায় গা করার মত মানসিক শক্তিও ছিলো না। তারপর যখন ধীরে ধীরে কথাটা হৃদয়ঙ্গম করা শুরু করলাম তখন মনে হলো- আসলেই তো, কি লাভ আর দশজনের মত হবার চেষ্টা করে?
'হংস মাঝে বক যথা' হয়েই যদি জীবনের এতটা সময় পার করে দিয়ে থাকি তাহলে আর হংস হবার চেষ্টাটা ঠিক কতটা যথোপযুক্ত থাকে?
যেখানে আমাকে মেনে নিতেই হচ্ছে যে আমার হংস হবার যোগ্যতা নেই তাহলে সে সাধনা করবোই বা কেন?
সবচেয়ে বড় কথা হলো 'আমি অমুকের মত হলাম না কেন' বা 'তমুকের মত পারলাম না কেন' জাতীয় কথা চিন্তা করে আর কত দীর্ঘশ্বাস ফেলবো? আর কতদিন? আর কতবার?
একটাই তো জীবন, এবার একটু নিজের মত হই, নিজের মত করে বাঁচি। সামান্য একজন মানুষ যদি himself/ herself হয়ে বাঁচতে চায়, খুব কি ক্ষতি হয়ে যাবে এই পৃথিবীর?
কেউ নাহয় নাই বুঝলো, কেউ নাহয় নাই ভরসা করলো, নাহয় কেউ মুখে তুবড়ি ছুটিয়ে গালিই দিলো... আমি কেন পারবো না নিজের পাশে দাঁড়াতে?
এই যে একজন মানুষ চোখে চোখ কিংবা হাতে হাত রেখে বোঝালো যে আমি আমার মত বলেই আমি সবচেয়ে সুন্দর, অন্য কারো মত হলে আমাকে আর ভালো লাগবে না... কথাটা কি সত্যি নয়? আমি কি একটু চেষ্টা করলে পারি না কথাটা সত্যি করে দিতে?
মানুষের সবচেয়ে বড় দোষগুলোর মধ্যে একটা হলো সে দেখে শেখে না, ঠেকে শেখে--- কাজেই সারা দুনিয়া ঠেকে এসে আমি প্রাণপণে বুঝতে শিখলাম যে Yah, I have to be myself!
... ... ...