
পঞ্চম শতকের স্পেন: ভিসিগোথ শাসনে নির্যাতনে পিষ্ট প্রজাকূল
পঞ্চম শতকের কথা।
স্পেন তখন শাসিত ছিল ভিসিগোথদের দ্বারা। ভিসিগোথদের সংক্ষেপে "গোথ" বলা হত, যাদের মূল আবাস স্থল জার্মান। তারা ছিল আরিয়ান ক্রীষ্চান। বেদুইন এই জাতিটি বংশ পরষ্পরায় বিভিন্ন দেশ জয় করে তাতে বসতি স্থাপন করে, যাদের মাঝে স্পেন ছিল একটি। স্পেনে যতদিন আরিয়ান ভিসিগোথদের শাসন ছিল, ততদিন সেখানকার পরিবেশ ছিল ইহুদী অধিবাসীদের প্রতি সহনশীল। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায় যখন ৫৮৯ খ্রীষ্টাব্দে স্পেনের ভিসিগোথ রাজা রেকারেড ক্যাথলিক বিশ্বাস গ্রহন করেন। ক্যাথলিকদের বিশ্বাস আরিয়ানদের থেকে অনেকটাই আলাদা, যদিও দুটো গোত্রই ক্রীশ্চান। ভিসিগথ রাজাদের ক্যাথলিক হবার পর থেকে রাজকার্যে চার্চের প্রভাব বেড়ে যায়। সাথে সাথে ইহুদীদের উপর নেমে আসে অন্ধকার এবং নির্যাতন। কাট ছাট করে দেয়া হয় তাদের ধর্ম পালনের অধিকার। নাগরিক অধিকারও হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। যার ফলে প্রায় ৯০০০০ ইহুদী ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়, তা স্বেচ্ছায়ই হোক, কিংবা জোরপূর্বকই হোক। নির্যাতনের এই ধারাবাহিকতায় ৬৩৩ খ্রীষ্টাব্দে স্পেনের সমস্ত ইহুদীদের ব্যাপটাইজড করার পরিকল্পনা হল [৮][১০]। পরবর্তী ভিসিগোথ শাসনে এসব বিষয়ে কিছুটা শিথিলতা এলেও ইহুদীরা নিষ্পেষনের যাতাকল থেকে আর মুক্ত হয় নি। ফলশ্রুতিতে ইহুদীদের অর্থনীতিতে নেমে আসে ব্যপক ধ্বস, কারন তাদের পক্ষে অন্যদের সাথে বানিজ্য করা ছিল প্রায় অসম্ভব।
এভাবেই চলতে লাগল ৭১১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত।
মুরদের স্পেন বিজয়, ভিসিগোথদের পরাজয়:
৭১১ সাল। স্পেনের ভিসিগোথ রাজা তখন রডারিক।
রডারিক খুব অল্প সময়ের জন্য স্পেন শাসন করতে পেরেছিলেন। তারপরেই পরাজিত হন মুরদের কাছে।
মুরদের হাতে রাজা রডারিকের পতন ঘটে কি করে?
মিশরীয় ইতিহাসবিদ ইবনে আবদুল হাকিম ভিসিগোথদের পতন প্রেক্ষাপটের যে বর্ননা দেন তা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে যুগ যুগ ধরে গান, কবিতা গল্পের মাধ্যমে জনপ্রিয় লোকগাথা কিংবদন্তী হিসেবে প্রচলিত হয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
স্থানীয় স্পেনিশ নেতা জুলিয়ান তার কন্যাকে পাঠান
রডারিকের দরবারে পড়াশোনার জন্যে।
কিন্তু রডারিক তাকে ধর্ষন করে। যার ফলে জুলিয়ান
ক্ষিপ্ত হয়ে মুসলিম নেতাদের অনুরোধ করেন রডারিকের
পতন ঘটানোর জন্য।
উপরোল্লিখিত লোকগাথা মুসলিমদের মাঝে জনপ্রিয় হলেও সার্বিক ভাবে তা ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি। রডারিকের পক্ষে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো অসম্ভব কিছু নয়, কিন্তু শুধু এই একটি ঘটনার কারনে রডারিক তার সমর্থন হারান নি। রডারিক তার আশে পাশের নেতাদের সমর্থন হারিয়েছিলেন অনেকগুলো কারনে। [১]
রডারিকের ক্ষমতা আরোহন ছিল বিতর্কিত। রডারিকের আগে রাজা ছিলেন উইটিজা, যার উত্তরাধিকার ছিল স্পেনের সিংহাসনের দাবীদার। কিন্তু ক্যাথলিক চার্চের বিসপবৃন্দ উইটিজার সন্তানদের পরিবর্তে মনোনীত করে রডারিককে। যা উইটিজার বংশধরদের ক্রুদ্ধ করে তোলে। উইটিজারা পালিয়ে জুলিয়ানের কাছে আশ্রয় নেয়। জুলিয়ান সব রকমের সাহায্যের অংগীকার দিয়ে তৎকালীন উমাইয়া গভর্নর মুসা ইবনে নুসায়েরকে অনুরোধ করেন রডারিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে। তার প্রেক্ষিতে মুসা তার জেনারেল তারিক বিন জিয়াদের উপর এ দায়িত্ব ন্যস্ত করেন।
রডারিক একদিকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার, অন্যদিকে প্রজা বৎসল না হবার জন্যে সাধারনের সমর্থন লাভে ব্যর্থ। যার কারনে তার বিপুল সৈন্যবাহিনী থাকলেও তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ছিল পরিষ্কার। অন্যদিকে মুর জাতি ভিসিগোথদের মতই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা বেদুইন জাতি, তার উপর মুসলিম হবার ফলে আরবদের সহযোগিতা প্রাপ্ত। তাই জেনারেল তারিক বিন জিয়াদ মাত্র ৭০০০ সৈন্য নিয়ে রডারিকের লক্ষাধিক সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়ে মোটামুটি অনায়াসে বিজয়ী হন এবং স্পেন দখল করেন। এভাবেই পতন ঘটে স্পেনের সর্বশেষ ভিসিগোথ রাজা রডারিকের।
জেনারেল তারিক ছিলেন একজন মুর নব্যমুসলিম। তিনি যেহেতু একজন অনারব, তাই ধারনা করা হয় আরবী "তারিক" নামটি তার প্রকৃত নাম নয়। [২] তবে তার প্রকৃত নাম যাই হোক না কেন, ইতিহাসে তিনি তারিক নামে পরিচিত হয়ে আছেন। মাত্র সাত বছর সময়কালের মধ্যে তারিক ও মুসার অন্যান্য জেনারেল বৃন্দ পুরো স্পেনকেই মুরদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসেন। তারিকের পরবর্তী জীবনকাল সম্পর্কে নিশ্চিত করে খুব বেশী কিছু জানা যায় না। কয়েকজন ইতিহাসবিদ তারিক ও তার সেনাদলকে আরব, মুর এবং সুদানীজদের মিশ্রন বলে অভিহিত করেছেন।
স্পেন বিজয়ী তারিকের বিজয়ের সেই ঐতিহাসিক দিন:
৩০শে এপ্রিল, ৭১১ খ্রীষ্টাব্দ।
তারিক তার সৈন্যদের নিয়ে স্পেনে পৌছে প্রথমে একটি পাহাড়ের ধারে অবতরন করেন। যা পরবর্তীতে "জাবাল তারিক" বা "তারিকের পাহাড়" নামে পরিচিত হয়। এই "জাবাল তারিক" থেকেই "জিব্রাল্টার" শব্দটি এসেছে। অবতরনের পর পরই তিনি তার সব নৌকা জাহাজ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। হতবুদ্ধি হয়ে একজন সেনা জানতে চাইল, "এখন আমরা কি করে ফিরব?" তারিক শান্তভাবে জবাব দিলেন, " ফিরে যাবার জন্য তো আমরা আসিনি। হয় বিজয়, নতুবা ধ্বংস।"
সৈন্যদের উদ্দেশ্যে দেয়া তারেকের সেই ঐতিহাসিক বক্তিতার কিছু অংশ ছিল নিম্নরূপ:
"হে আমার যোদ্ধাগন। কোথায় তোমরা পালাবে? তোমাদের পেছনে সাগর, সামনে শত্রু। তোমাদের আছে কেবল সাহস এবং ধী শক্তি। মনে রেখো এদেশে তোমরা সেই এতিমদের চেয়েও হতভাগা যাদের লোভী মালিকদের সাথে টেবিলে বসতে হয়। তোমাদের সামনে শত্রু, যাদের সংখ্যা অগন্য। কিন্তু তোমাদের শুধু তলোয়ার ব্যতিরেকে কিছুই নেই। তোমারা বেচে থাকতে পারবে যদি শত্রুর হাত থেকে নিজেদের জীবনকে ছিনিয়ে আনতে পার। ভেবোনা আমি তোমাদের সাথে থাকবো না। আমিই সবার সামনে থাকব, এবং আমার বাচার সম্ভাবনাই সবচেয়ে ক্ষীন।"
এই বক্তিতায় উজ্জীবিত হয় তারেকের সেনাদল। প্রানপন যুদ্ধের দ্বারা স্পেনের মাটিতে রডারিকের অগনিত সেনাদলকে পরাজিত করে স্পেনের বুকে তারা স্থাপন করে মুরদের রাজ্য। মুরদের কাছে ভিসিগোথ সর্বশেষ রাজা রডারিকের পতন ঘটে। স্পেনের নামকরন হয় "আন্দালুসিয়া"।
এখানে দেখুন আন্দালুসিয়ার ম্যাপ:

(কৃতজ্ঞতা: Click This Link)
মুর জাতি আসলে কারা?
ক্লাসিক্যাল গ্রীক এবং রোমান ইতিহাসবিদগন কৃষ্ণ বর্নের পূর্ব আফ্রিকার যাযাবর জাতিকে "বারবার" নামে অভিহিত করেছেন। "বারবার" থেকে বাংলায় "বর্বর" এবং ইংরেজী "barbaric" শব্দ গুলো এসেছে, যা এই জাতির যুদ্ধপ্রিয়তাকে প্রকাশ করে। বারবারদের একটি অংশকে "মুর" বলেও সম্বোধন করা হয়, যারা মিশর থেকে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এরা উত্তর আফ্রিকাতেও প্রভাবশালী হয়। গ্রীক "মোরস" শব্দের অর্থ কালো, যেখান থেকে "মুর" শব্দটি এসেছে। মুর নামকরনের প্রকৃত কারন তাদের কৃষ্ণকায় গাত্রবর্ন, যা এদেরকে ইউরোপিয়ানদের থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টে্র অধিকারী করেছিল। মুরদের প্রসংগে ক্রীশ্চান সূত্র, বিশেষত আলফানসুর প্রিমেরা ক্রিকা জেনারেল লিখেছে, "তাদের মুখ যেন পিচের মত কালো।" বিভিন্ন সূত্রে এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে, পনের শতকের পূর্বের মুরদের গাত্র বর্ন বাদামী কালো, অথবা কৃষ্ণ কালো। আফ্রিকার এই যাযাবর জাতিটি ভিসিগোথদের মতই বারবার গোত্রীয় এবং বেদুইন যোদ্ধা জাতি। [৪] মুসলিম ইতিহাসবিদগন অবশ্য দাবী করেন, "মুর" নামটি আসলে হেয় অর্থে প্রচলন করা হয়েছে। সে যাই হোক, স্পেন বিজয়ী জাতিটিকে বর্ননার জন্যে "মুর" বর্তমানে প্রচলিত একটি শব্দ। বৃক্ষের পরিচয় যেমন করে থাকে ফলে, তেমনি মুররাও বিজ্ঞান সভ্যতায় তাদের অবদানের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে রেখে গেছে গৌরবময় চিহ্ন। মুরদের শাসনকালে স্পেনের সভ্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে "when the moors ruled europe" নামের ১ ঘন্টার ভিডিওটি নীচের লিংক থেকে দেখতে পারেন। (Click This Link)। [৩]
মুর রাজ্যের বৈশিষ্ট্য:
মুর শাসিত স্পেনের সভ্যতা ও উন্নতি নিয়ে ইতিমধ্যেই সামহোয়ারে বেশ কিছু পোস্ট বিভিন্ন সময়ে এসেছে। নীচের পোস্টটিতে যেসব বর্ননা দেয়া হয়েছে, তার কোন কিছুই অতিরন্জ্ঞিত নয়।
Click This Link
মুর শাসিত আন্দালুসিয়াতে ক্ষমতায় ছিল উমাইয়া রাজবংশ। এ সময়টাতে কর্ডোভা হয়ে উঠে ইউরোপের সবচাইতে মনোরম শহর। প্রায় ৫০০০ মিল ছিল শুধু কর্ডোভাতেই, যেখানে ইউরোপে একটিও ছিল না। ইউরোপের ৯৯ ভাগ লোক যেখানে ছিল অশিক্ষিত, সেখানে কর্ডোভাতে ছিল ৮০০ পাবলিক স্কুল। তৎকালীন ইউরোপে গোসলখানাকে হারাম বলে গন্য করা হত, অথচ কর্ডোভাতে ছিল ৯০০ পাবলিক বাথ। দশম শতকে কর্ডোভাতে ছিল ৭০০ মসজিদ, ৬০০০০ প্রাসাদ, ৭০ টি লাইব্রেরী যার সবচেয়ে বড়টিতে ছিল ৬০০০০০ বই। অন্যদিকে সে সময়কার ক্রীশ্চান ইউরোপে সবচেয়ে বড় লাইব্রেরীতে ৪০০ এর বেশী ম্যানুস্ক্রীপ্ট ছিল না। ১৪০০ শতকের শেষে ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসে ছিল মাত্র ২০০০ টি বই। তৎকালীন আন্দালুসিয়ায় প্রতি বছর ৬০০০০ পুস্তিকা, কবিতা, সংকলন ইত্যাদি প্রকাশিত হত, যেখানে স্পেন এখন প্রতি বছর ৪৬৩৩০ বই প্রকাশ করে থাকে (১৯৯৬ সাল পর্যন্ত)।
(সূত্র: http://en.wikipedia.org/wiki/Al-Andalus)
নীচে আন্দালুসিয়ার উইন্ডমিলের ছবি (উইকিপেডিয়া থেকে নেয়া) যা তৎকালীন মুর শাসিত স্পেন থেকে পরবর্তীতে ইউরোপের অন্যান্য দেশে প্রচলিত হয়:

এখানে উল্লেখ্য মুর জাতি বার্বার গোত্রভুক্ত হলেও তারা অন্যান্য বার্বারদের মত ধর্মীয় স্বাধীনতা দিতে অস্বীকার করে নি। এর মূল কারন ছিল তাদের ধর্ম ইসলাম। অমুসলিমদের প্রতি সহনশীলতার উৎস কোরানের দুটো আয়াত। "লা ইকরাহা ফিদ্বীন" (দ্বীনের বিষয়ে কোন জবরদস্তি নাই: বাকারা ২:২৫৬)। এবং "ওয়ালাও শাআ রাব্বুকা লা আমানা মান ফিল আরদি কুল্লুহুম জামিয়ান আফা আনতা তুকরিহুন্নাসা হাত্তা ইয়াকুনু মুমিনিন।" (আর তোমার পরওয়ারদেগার যদি চাইতেন, তবে পৃথিবীর বুকে যারা রয়েছে, তাদের সবাই ঈমান নিয়ে আসতে সমবেতভাবে। তুমি কি মানুষের উপর জবরদস্তী করবে ঈমান আনার জন্য?: ইউনুস : ৯৯)। যার ফলে পৃথিবীর বুকে সব ধর্মের মানুষের জন্য তৎকালীন স্পেন হয়ে রইল ধর্মীয় সহনশীলতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে।
মুর শাসনকাল ছিল ইহুদীদের স্বর্নযুগ। চিকিৎসক, দার্শনিক, উপদেষ্টা, সেনাবাহিনীসহ নানান পেশায় ছিল তাদের গৌরবময় পদচারন। তার পেছনে ছিল কর্ডোভার আমীর আবদুর রহমানের ইহুদী কাউন্সিলর হাসদাই ইবনে শাপরুতের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা [৫]। হাসদাই ছিলেন চিকিৎসক এবং কুটনীতিক। আন্দালুসিয়ার ইহুদী দার্শনিকদের একজন ছিলেন কর্ডোভার বিখ্যাত মোসেস মাইমুনাইডস, যিনি একাধারে রাবাই, চিকিৎসক, এবং দার্শনিক হিসেবে স্পেন, মরক্কো এবং মিশরে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। অন্যান্য মুসলিম দার্শনিকদের মত তিনিও এরিস্টটল দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন।
(http://en.wikipedia.org/wiki/Maimonides)। মাইমুনাইডস স্পেনের মুরদের শাসন প্রসংগে ছিলেন, "ইহুদীরা মুসলিমদের স্পেন দখলকে ৭১১ খ্রীষ্টাব্দে স্বাগতম জানায়। মুসলিমদের বিজয়ের সাথে সাথেই ইহুদীদের স্বাধীনতা ও স্বর্নযুগের সূচনা হয়। তারা সাফল্যের সাথে প্রশাসনে, চিকিৎসা শাস্ত্রে, সাহিত্যে ও বিজ্ঞানে অনুপ্রবেশ করতে পারে। [৬]" ।
স্পেনের তৎকালীন সভ্যতা, সংস্কৃতির সাথে যে মানুষটির নাম অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে রয়েছে, তিনি হলেন আবু আল ওয়ালিদ মোহাম্মদ ইবনে রুশদ, সংক্ষেপে ইবনে রুশদ। কর্ডোভান দার্শনিক ইবনে রুশদ তার যুক্তিভিত্তিক মতবাদের মাধ্যমে ইউরোপে রেনেসার বীজ বপন করে যান। ধর্ম বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত এবং যুক্তিবাদ দিয়ে প্রভাবিত দুই পক্ষের মধ্যেকার দৃশ্যমান পার্থক্য প্রসংগে তিনি বলেছেন, "ঐশীবানী এবং যুক্তি দর্শন - দুটোই সত্য, যদিও সত্য অনুধাবনের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। দার্শনিকরা যদি ঐশী বানী ব্যাখায় ভুল করে থাকেন, তবে তাদের সে ভুল ক্ষমার যোগ্য।" ইমাম গাজালীর বিখ্যাত বই "তাহাফুত আল ফালাসিফা" ("দার্শনিকদের আত্মঘাত") কে চ্যালেন্জ্ঞ করে তিনি রচনা করেন "তাহাফুত আল তাহাফুত আল ফালাসিফা" ("দার্শনিকদের আত্মঘাতের ধ্বস")। ইমাম গাজালীর প্রতিটি পয়েন্ট ধরে ধরে তিনি ব্যাখা করে যান গাজালীর যুক্তির দুর্বলতা। তিনি বলেন, গাজালী প্রসংগ না তুলে ধরে বিচ্ছিন্নভাবে দর্শনের কিছু অংশ বেছে নিয়ে তাকে অপব্যাখা করতে চেয়েছেন।
নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে রুশদের চিন্তাধারায় নারীবাদের প্রভাব দেখা যায়। ইবনে রুশদ বলেন, "নারীর মেধার বিকাশে আমাদের সমাজ কোন সহায়তা দেয় না। তাদের গন্তব্য যেন শুধু সন্তান জন্ম দেয়া এবং তার প্রতিপালন। দায়িত্ব সীমাবদ্ধ করে দেয়ার ফলে তাদের যোগ্যতার উপরে এসেছে আঘাত। এর ফলে দেখা যায় নারীদের মধ্যে নেই কোন দক্ষতা, তারা গাছপালার মত জীবন যাপন করে এবং তাদের জীবন শুধু স্বামীর জন্যই উৎসর্গীত। এটা সমাজের জন্য অনাকাংখিত, কেননা নারীর সংখ্যা পুরুষের দ্বিগুনেরও বেশী, অথচ তারা নিজস্ব শ্রমের মাধ্যমে জীবনের প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ।" ইবনে রুশদের মত দার্শনিকদের কারনে তৎকালীন আন্দালুসিয়া ছিল নারীর ক্ষমতায়নের কেন্দ্রবিন্দু। (Click This Link)
ইবনে রুশদের দর্শন চিন্তা সামগ্রিকভাবে মুসলিম সমাজে গ্রহন যোগ্য হয় নি। তিনি ঐশী বানীকে কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই সবার উপরে স্থান দিয়েছেন, এটা সত্য। ঐশীবানীর মহাত্ম্যকে সবার উপরে স্থান দিয়ে দার্শনিকদের অনুধাবনে ভুল থাকার বিষয়টিও মেনে নিয়েছেন। তবে ঐশীবানীর আক্ষরিক অর্থ না নেয়া সহ কিছু বিষয়কে তিনি স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েছেন। তিনি "মহাবিশ্ব অসৃষ্ট" বিষয়ক এরিস্টটলের মতবাদকে ইসলামের দ্বারা ব্যাখা করার চেষ্টা করেন, যেখানে মুসলিম, ইহুদী আর ক্রীশ্চানরা বিশ্বাস করে বিশ্ব একটি সৃষ্ট বস্তু। গ্রীক দর্শনকে এভাবে ইসলামের আলোকে ব্যাখা করার প্রয়াস সাধারনের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ফলশ্রুতিতে গ্রানাডার গ্রান্ড মসজিদের সামনে জন সমক্ষে তাকে পাথর মারা হয়। খলিফা রুশদের পৃষ্ঠপোষক হলেও জনতার চাপের মুখে নত হয়ে রুশদের কিছু বই পোড়ানোর নির্দেশ দেন। তখনকার আন্দালুসিয়াতে "মালিকি" মতবাদ ছিল জনপ্রিয়, এবং খলিফার প্রয়োজন ছিল মালিকি জুরিস্টদের সমর্থন। (Click This Link)।
মুরদের পতন এবং ফার্ডিনান্ড/ইসাবেলার গ্রানাডা বিজয়:
১৬ ই জুলাই, ১২১২ সাল।
স্পেনের বুকে এই দিনটি ছিল একটি গুরুত্ব বহ টার্নিং পয়েন্ট। পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো সব একত্রিত হয়ে মুর রাজ্যের সাথে চরম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে মুরের অধিপতি সুলতান নাসিরের পতন ঘটায়। তার আগের বছর, অর্থ্যাৎ ১২১১ সালে মুর অধিপতি সুলতান নাসির পার্শ্ববর্তী ক্রীশ্চান রাজ্যে এক হামলা চালান, যার প্রতিশোধ নিতে প্রতিপক্ষের সবাই ঐক্যবদ্ধ হন। পোপ ডাক দেন ক্রুশেডের। মুর সুলতানের পক্ষে ছিল আফ্রিকান বেশ কিছু অংশ: মরোক্কো, আলজেরিয়া, টিউনিসিয়া, সেনেগাল, মৌরিতানিয়া। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ আলফানসুদের পক্ষে ছিল পর্তুগাল ও স্পেনের উত্তরাংশের সমর্থন। এই বেদনাদায়ক যুদ্ধের ময়দান সিক্ত ছিল মুসলিমদের হাটুসম রক্তের মাধ্যমে। ১২১২ সালে আলফানসু এবং তার সহযোদ্ধাদের কাছে পরাজয়ের পরে আর ঘুরে দাড়াতে পারেনি মুর রাজ্য। এর পরের ইতিহাস পরাজয়ের ইতিহাস। একের পর এক মুর মুসলিম অধ্যুষিত শহরগুলোর পতন ঘটতে থাকে। ১২৩৬ সালে বৃহত্তম রাজধানী শহর কর্ডোভার দখল নেন কাস্টিলের রাজা ফার্ডিনান্ড। ফার্ডিনান্ড সেভিল দখল করেন ১২৪৮ সালে এবং জেইন দখল করেন ১২৪৬ সালে।
২রা জানুয়ারী, ১৪৯২ সাল।
পরাজয়ের ধারায় সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে ১৪৯২ সালের ২রা জানুয়ারী। গ্রানাডার শাসক আবু আবদুল্লাহ, যিনি ববদিল নামে স্পেনে পরিচিত,
ফার্ডনান্ড ও ইসাবেলার কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হন। সেই সাথে আনুষ্ঠানিক ভাবে অবসান ঘটে মুর সাম্রাজ্যের।
আমেরিকা বিজয়ী ক্রিস্টোফার কলম্বাস ছিলেন এই আত্ম সমর্পন অনুষ্ঠানে। তিনি লেখেন, "ইয়োর হাইনেস কর্তৃক মুরদের কাছ থেকে গ্রানাডা দখলের পর আমি শহরের দুর্গ আল হামরার টাওয়ারে রাজকীয় ব্যানার দেখেছি।"
ববদিলের এই আত্ম সমর্পন ছিল শর্তাধীন, বা চুক্তি ভিত্তিক যা "ক্যাপিচুলেশন অব গ্রানাডা" নামে পরিচিত। ১৪৯১ সালের ২৫ শে নভেম্বরের এই চুক্তিতে ৬৭ টি ধারা অন্তর্ভূক্তি হয়, যাতে গ্রানাডার মুসলিম ও অন্যান্য অধিবাসীদের ধর্মীয়, ভাষাগত, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য অধিকার সুরক্ষিত হয়। চুক্তিটি দেখুন। Click This Link ।
কিন্তু হায়!! এর পরবর্তী ইতিহাস ছিল করুন। কুখ্যাত আল হামরা ডিক্রির মাধ্যমে ইহুদীদের চার মাসের মধ্যে স্পেন ত্যাগে বাধ্য করেন ইসাবেলা ও ফার্ডিনান্ড (http://en.wikipedia.org/wiki/Alhambra_Decree)। এই আল হামরা ডিক্রি শেষ পর্যন্ত ১৯৬৮ সালে ভ্যাটিকান কর্তৃক বাতিল হয়। চুক্তি শর্ত বাস্তবায়ন না করে উল্টো ১৫০১ সালের মধ্যে মুসলিমদের দুটো চয়েস দেয়া হয় : ব্যাপটাইজ, অথবা বহিষ্কার। প্রায় সবাই ক্রীশ্চান হল, যারা মরিস্কো নামে পরিচিত(http://en.wikipedia.org/wiki/Moriscos) । কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মরিস্কোদের বিশ্বাসঘাতকতা ধরা পড়ল যে এদের অনেকে উপর দিয়ে ক্রীশ্চান হলেও ভেতরে ভেতরে ইসলাম ধর্মের প্রতি বিশ্বস্ত। পরবর্তীতে মরিস্কোদেরকেও স্পেন থেকে বহিষ্কার করা হয়।
মুরদের পতনের কারন কি?
একজন রক্ষনশীল হয়ত বলবেন, "ইসলাম থেকে দূরে চলে যাওয়াই এর আসল কারন। তারিক তো স্পেনে ইসলামী মূল্য বোধ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এরপর সেখানকার রাজা বাদশারা যেভাবে বিলাসিতা, পাপাচারে মত্ত হয়ে যান, পর্দা উঠিয়ে দেন, তাতে পতনের কি বাকী থাকে?" আপনি যদি প্রগতিশীল হন তাহলে এই টিপিক্যাল কথা শুনে বিরক্ত লাগাই স্বাভাবিক। কিন্তু রক্ষনশীলদের এরকম মনোভাব একেবারে অযৌক্তিক নয়। মুরদের পতনের মূল কারন ছিল জাতীয়তাবাদের বিলুপ্তি। একটি ভূখন্ডের অখন্ডতা রক্ষার জন্য জাতীয়তাবাদের আঠার কোন বিকল্প নেই। আন্দালুসিয়ার পরিবেশটি ছিল কিছুটা ভিন্নতর। এখানে ছিল আরব, অনারব মুর সহ বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মিশ্রন। যার ফলে জাতীয়তাবাদের মূল উপাদান ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল দুর্বল গাথুনিতে গাথা। এদের ধর্ম ছিল এক, কিন্তু সে মূল্যবোধ ছিল উপেক্ষিত। যদিও আল্লাহর রাসুল (সা), অনারবের উপর আরবের কিংবা কালোর উপর সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই বলে ঘোষনা দিয়েছেন, বাস্তবক্ষেত্রে এই অধিবাসীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল। এছাড়া কেন্দ্রে ছিল আব্বাসীয় শাসন, যেখানে আন্দালুসিয়ায় চলছিল উমাইয়া শাসন। কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বারোয়ারী সংস্কৃতির আন্দালুসিয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী যারা পাশের ক্রীশ্চান শক্তিকে মোকাবেলা করতে সক্ষম। কিন্তু উমাইয়া শাসক আবদের রহমান শিল্প সংস্কৃতি, বিজ্ঞানের উন্নতির দিকে খেয়াল রাখলেও সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি মনোযোগী ছিলেন না। সব মিলিয়ে মুরদের পতন হয়ে উঠে অবশ্যম্ভাবী।
স্পেনের ক্ষমা প্রার্থনা:
স্পেনের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া বহিষ্কারের জন্য রাজা জুয়ান কার্লোস ইতিমধ্যে ইহুদীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। একবার ১৯৯২ সালে ইসরাইলের সংসদে এবং দ্বিতীয়টি টলেডোর সিনাগগে। কিন্তু মুসলিমদের দাবী সত্ত্বেও তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন নি। যদিও তিন মিলিয়ন মুসলিমকে বহিষ্কার করা হয়, যারা পার্শ্ববর্তী মরক্কোতে আশ্রয় নেয়। ইবনে হাকিম নামে একজন মরোক্কান বলেন, "আমার পরিবারে ১৪টি স্পানিশ নাম রয়েছে এবং আমরা স্প্যানিশ বলি। হারানো সে হোমল্যান্ডের জন্য আমরা এখনও ভালবাসা ধরে রেখেছি। আমি আশা করি না এত বছর পরে সে বাড়ী ও জমি ফেরত পাব। তবে আমাদের নৈতিক শক্তির বিজয় দেখতে চাই।" ইতিহাসবিদ গিবসন এ প্রসংগে লিখেছেন, "মুসলিমদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে সাড়া দেয়া প্রয়োজন। নাকি গ্রানাডার মুসলিমরা সেখানকার ইহুদীদের চেয়ে হীনতর?" (Click This Link)
===========================================
কিছু রেফারেন্স:
১। Click This Link
২। http://en.wikipedia.org/wiki/Tariq_ibn_Ziyad
৩। http://en.wikipedia.org/wiki/Moors
৪। গোল্ডেন এজ অব দ্য মুর: Click This Link ibn ziyad black&f=false
৫। Click This Link
৬। Click This Link
৭। ভিসিগোথ শাসনে ইহুদীদের ভয়ানক অবস্থার পুরো বর্ননা রয়েছে এখানে (সূত্র: http://libro.uca.edu/vcode/visigoths.htm) ।
৮। http://en.wikipedia.org/wiki/Visigoths
৯। http://en.wikipedia.org/wiki/Reccared
১০। Click This Link
১১। Click This Link
১২। Click This Link
১৩। Click This Link
১৪। Click This Link
১৫। Click This Link ibn ziyad black&f=false
১৬। Click This Link
১৭। Click This Link
১৮। Click This Link
১৯। Click This Link
২০। Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১০:২৬