somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

।।--ড্রিমলাইনার--।

১৬ ই এপ্রিল, ২০১২ বিকাল ৫:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এটা আমার রুম।

ফ্লাওয়ার ভেসের পাশে ঘুরঘুর করছে বিড়ালটা। কুচকুচে কালো। কাউকে খুঁজছে হয়তো। ফ্লাওয়ার ভেসে রাখা নীল একটা গোলাপ। আমি ভুরু কুচকে ভাবার চেষ্টা করি। বিড়ালটাকে কি আমি আগে কোথাও দেখেছি? এটা কি এখানে অপ্রাসঙ্গিক এবং অনভিপ্রেত নয়?

দরজা ঠেলে কালো চাদর পড়া, লম্বা মানুষটা ঘরে ঢুকলো। উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো কালো বিড়ালটা। এখন সে ফ্লাওয়ার ভেস ছেড়ে তার পায়ের কাছে ঘুরপাক খাচ্ছে। চুকচুক শব্দ করলো মানুষটা। নুয়ে বসে বিড়ালটাকে কোলে তুলে নিলো। তারপর আলতো করে গলাটা টিপে ধরলো।

মানুষটা এখন বিড়ালটাকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তার পেছন পেছন যাচ্ছি। এখন সে মরা বিড়ালটাকে গাছের সাথে বাঁধবে। প্রতিদিনই বাঁধে।

সে একবার পিছে তাকিয়ে আবার পথ চলতে শুরু করলো। আমি কেন জানি কোনদিনই তার মুখটা ভালো করে দেখতে পারিনা। বড় গাছটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। জ্যোৎস্না রাত। আকাশে একটা ঘুড়ি উড়ছে। সুতোর উৎস খোলা মাঠ। কিন্তু মাঠে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। মাঠটা আমার পরিচিত।

গাছে বিড়াল বাধা শেষ। এবার লোকটা ধীরে ধীরে হেটে মাঠের মধ্যিখানে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে তাকে ধরবার চেষ্টা করছি, কিন্তু আমার পা চলছে না। আমি প্রানপন চেষ্টা করে করতে থাকি, কিন্তু পা চলেনা।

স্বপ্নের ঠিক এ পর্যায়ে আমার প্রতিদিন ঘুম ভেঙে যায়। আজও ভেঙেছে। উঠে ঘড়ি দেখলাম। ৩: ৩৭ বাজে। শার্টটা ঘামে ভিজে গেছে। বদলানো দরকার। টেবিলের উপরে পানির জগটা রাখা আছে। উঠে ঢক ঢক করে দু গ্লাস পানি খেলাম। বুকের হার্টবিট একটু কমেছে। স্বপ্ন ভাঙার সাথে সাথে হার্টবিট এতো বেড়ে যায় কেন?

ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে শান্ত হয়ে বিছানায় বসলাম। খয়েরী মলাটের ডায়রিটা বালিশের পাশে রাখা আছে। অবশ্য এটাকে এখন ঠিক আর ডায়েরী বলা যায়না। গত একমাস ধরে এটি শুধু স্বপ্ন লিখে রাখার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।যাই দেখি, টুক করে ডায়েরীতে তুলে রাখি। আজ যে স্বপ্নটা দেখেছি, এটা প্রায় ৫ দিনের পুরনো। অর্থাৎ ৫ দিন ধরে দেখছি। মোটামুটি সবটাই লেখা আছে, দিন দিন আরও কিছু খুঁটিনাটি যোগ হচ্ছে। এই যেমন আজ "ঘুড়ি" কেটে লিখলাম- "লাল ঘুড়ি।"

ডায়েরীর পাতা দিন দিন ভরে যাচ্ছে। কি সব স্বপ্ন এখানে জায়গা করে নিয়েছে! অদ্ভুত, অদ্ভুত সব স্বপ্ন। নীল সমুদ্রে হেটে বেড়ানোর স্বপ্ন। বিশাল বড় মৌমাছির স্বপ্ন। কথা বলা ছবিটার স্বপ্ন। লিখতে যেয়ে দেখি, স্বপ্নের আগা মাথা নাই। অথচ স্বপ্নের ভেতরে কখনো স্বপ্নকে আগা মাথা ছাড়া মনে হয়না। ভারী অদ্ভুত।

ইদানিং মাথায় আরও একটা অদ্ভুত চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। অদ্ভুত এবং ইন্টারেস্টিং। সমস্যা হলো, আমি কিছুতেই এই চিন্তাটাকে মাথা থেকে সরাতে পারছিনা। যদিও আমি জানি, চিন্তাটা মোটামুটি অসম্ভব এবং অবাস্তব।

তবুও ঠিক এ কারনে আমি আমার প্রিয় বন্ধুটির শরণাপন্ন হলাম। আমি জানতাম, পারলে সে-ই পারবে আমাকে কিছুটা আশার আলো দেখাতে। ও ছাড়া আসলে আমার ঠিক তেমন একটা বন্ধুও নেই। খামখেয়ালী স্বভাবের লোকজনকে কেউ পছন্দ করে না। আমার এই বন্ধুটির বড় একটা গুন হলো, তাকে আমি যা ই কিছু বলি, সে মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করে। সেটা যৌক্তিকই হোক, আর অযৌক্তিকই হোক। যদিও এটা তার পেশার স্বাভাবিক নীতি বিরুদ্ধ। সে পেশায় একজন চিকিৎসক। তার পড়ালেখার মুল ক্ষেত্র- নিওরোলজি।

আমি সাত সকালে আমার বন্ধুটির বাসায় হাজির হলাম। তাকে দেখে অবাক মনে হলো না। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, সে ভালো করেই জানতো আমি এই সময়ে আসবো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি তার সাথে আমার নিজের অদ্ভুত রকম মিল পাই। আমার মতো তারও আবেগের কিছুটা ঘাটতি আছে। আমার মতো সেও সংসারবিমুখ। বিয়ে নিয়ে তার মাঝে তেমন কোন আগ্রহ নেই।

আমাকে বারান্দায় বসতে বলে সে ভেতরে গেলো। ফিরে এলো ৫ মিনিট পরে, দুই মগ ভর্তি চা নিয়ে।

আমি কোন ভনিতা ছাড়া সরাসরি মুল প্রসঙ্গে চলে এলাম। চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম-
" তোমার কাছে আমার কিছু প্রশ্ন ছিল।"
"করো।"
"স্বপ্ন নিয়ে তোমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান কতোটুকু উন্নত?"
"ও আচ্ছা।" সে একটা সুদীর্ঘ বক্তৃতার জন্য প্রস্তুত হলো।" আসলে স্বপ্ন একটি জটিল এবং দুর্বোধ্য প্রক্রিয়া। মানুষ তার আশেপাশে যা কিছু দেখে, চারপাশ নিয়ে যা কিছু ভাবে, তার অবচেতন মন সেটাকেই কিছুটা নিয়ন্ত্রনহীন ভাবে হাজির করে। এটা কেন ঘটে, কারণটা এখনো অজানা। প্রতিটা সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষই স্বপ্ন দেখে। তবে স্বপ্ন নিয়ে প্রচুর রিসার্চ হচ্ছে। কে জানে, হয়তো মানুষ একদিন স্বপ্ন দেখার কারণও আবিস্কার করে ফেলবে।"
"স্বপ্নকে বন্দী করার উপর কোন রিসার্চ চলছে কি?"
"বন্দী বলতে কি বুঝাতে চাইছো?"
"মানে আমি বলতে চাইছি, আমরা যে স্বপ্ন গুলি দেখি, সেগুলোকে কোনভাবে সংরক্ষন করে রাখা সম্ভব কিনা।"

সে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। হয়তো সে আমার প্রশ্নটা বুঝতে সময় নিচ্ছে। অথবা আমার প্রশ্ন তাকে একটু বেশিই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।

" মানে তুমি কি বলতে চাইছো, তুমি যে স্বপ্ন গুলি দেখবে, সেগুলোকে তুমি সংরক্ষন করে রাখতে চাও? ভিডিও টেপের মতো?"
"হ্যা। ঠিক তাই।"
"কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ ধরনের কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই।"
"এটা কোন চিকিৎসা নয়। খামোখা চিকিৎসা বিজ্ঞান এর কথা টেনো না। এটা বিজ্ঞান। বিশুদ্ধ বিজ্ঞান। oneirology। এই প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব নেই ঠিক আছে। তুমি আমাকে বলো, এটা কি কখনো করা সম্ভব কিনা?"

বন্ধুটি দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললো-
" বলা যায়, সম্ভব না।"
"কেন সম্ভব না?"
"কারন একটা স্বপ্নের স্থায়িত্ব কাল খুব অল্প। তাছাড়া আমাদের প্রযুক্তি এখনো এতদুর অগ্রসর হয়নি, যে স্বপ্নে বানানো দৃশ্য কোনভাবে ধরে রাখা সম্ভব। EEG ব্যবহার করে শুধুমাত্র স্বপ্নের ইলেক্ট্রিক্যাল সিগনালিং প্যাটার্ন বা তারতম্য দেখা যায়। তার বেশি তো কিছু করা যায়না।"

"তাহলে এটা নিয়ে রিসার্চার রা কাজ করছে না কেন?"
"কেউ হয়তো তোমার মতো এতো আগ্রহ নিয়ে বিষয়টি ভেবে দেখেনি।"
"তো কি হয়েছে? চলো, আমি আর তুমি মিলে কাজ শুরু করি।"
"আমি দুঃখিত। এটা আমার কাছে অনর্থক এবং অপ্রয়োজনীয়।"
"মানুষ সব কাজ প্রয়োজনেই করে?"
"হ্যা। যেমন তোমার এখন এটা প্রয়োজন। মানুষ তার প্রয়োজনের বাইরে যেতে পারে না। তাছাড়া আরও একটা সমস্যা রয়েছে।"
"কি সমস্যা?"
"তুমি পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র।oneirology সম্পর্কে তোমার বিন্দুমাত্র ধারনাও নেই। তুমি কিভাবে কাজ করবে?"
আমি শান্ত মুখে বললাম- "তোমাকে আমার দরকার নেই। আমি নিজেই এটার জন্য চেষ্টা করবো।"
"সে ক্ষেত্রে তোমার জন্য রইলো শুভকামনা।"
"ধন্যবাদ। আমি তাহলে আসি। বিদায়।"

তার এভাবে আমাকে ফিরিয়ে দেওয়াটা ছিল আমার কাছে অপ্রত্যাশিত। আমি oneirology এর ছাত্র না, তাই আমার পক্ষে সম্ভব না, একথাটা আসলে আমার জন্য কিছুটা অপমানকরও বটে। আমি হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম- আমি এটা নিয়ে নতুন করে পড়াশুনা শুরু করবো। বাকি জীবনটা এই কাজের পিছে চলে গেলেও ক্ষতি নেই। জীবনের মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে- আনন্দে থাকা। আমি যদি সারাজীবন এই কাজে থেকেই আনন্দ পাই, ক্ষতি কি?

আমার বাবার রেখে যাওয়া প্রচুর অর্থ বিত্ত এবার কাজে লাগতে শুরু করলো। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, জগতে আসলে কোন জিনিসই অপ্রয়োজনীয় নয়। কদিন আগেও নোটগুলোকে শুধু কাগজের টুকরো মনে হতো, এখন হঠাৎ করেই কতো দামী হয়ে গেলো। আমি কিছু বিদেশি দুস্প্রাপ্য বইয়ের অর্ডার করলাম। অচিরেই তারা আমার সংগ্রহে চলে আসলো। আমি গোগ্রাসে তাদের পড়া শুরু করলাম। পাতার ফাকে ফাকে জায়গা করে নিলো আনন্দ। জিনিসটা নতুন, আমার আগ্রহ তাই বেড়ে দাঁড়ালো কয়েক গুন। আমি হঠাৎ করেই বিষয়টির প্রতি এক ধরনের একাগ্রতা অনুভব করলাম।

আমি বইগুলো পড়তে যেয়ে লক্ষ্য করলাম, এখানে শুধু রোগতত্ত্ব, প্রক্রিয়া, কারন, প্রভৃতি নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। মানুষ কোন কোন অবস্থায় কি ধরনের স্বপ্ন দেখে, তা নিয়ে বিস্তারিত ভাবে তত্ত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোথাও স্বপ্নকে সংরক্ষণ করার কথা কিছু নেই। তাদের তত্ত্ব এর সাথে প্রযুক্তি এবং তার প্রয়োগও খুবই সামান্য। আমি আবিস্কার করলাম- পদার্থবিদ্যা এবং ইলেক্ট্রনিক্স এর একটা বিশাল অংশ এখানে কাজ করতে পারে।

একে একে আমি পড়া শুরু করলাম সিগম্যান্ড ফ্রয়েড, কার্ল জাং, ফ্রিটস, হবসন সহ আরও অনেকের গবেষণাতত্ত্ব। কিন্তু কোথাও- আমি ঠিক যা খুজছি, সেরকম কিছু পাওয়া গেলো না। আমি আরও খোঁজা শুরু করলাম।The Reinterpretation of Dreams নামের একটা বইয়ে আংশিক কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে সেটার মধ্যে যথেষ্ট অসংগতি দেখতে পেলাম আমি। উপায়ন্তর না দেখে আমি বাইরের কিছু নামকরা ইউনিভার্সিটি এর কয়েকজন প্রফেসরকে মেইল করে বসলাম।

অপ্রত্যাশিতভাবে এবং আমাকে কিছুটা অবাক করে দিয়ে ৯ দিনের মাথাতেই একটা রিপ্লাই চলে আসলো। ফিনল্যান্ড থেকে প্রফেসর রিভনসুয়ো লিখে জানিয়েছেন, এটি অত্যন্ত মৌলিক চিন্তাভাবনা। আমি রাজি থাকলে আমি তার সাথে কাজ করতে পারি। ফিরতি রিপ্লাই দিয়ে দিলাম, কিছুদিনের মাঝেই Cognitive neuroscience university of Finland থেকে ইনভাইটেশন লেটার চলে এলো। আমি ফিনল্যান্ড চলে এলাম।

আগেই বলেছি, আমি একজন পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র। সুতরাং আমাকে যদি কাজ করতে হয়, তাহলে অবশ্যই কাজ করতে হবে টেকনিক্যাল অংশে। আমি টেকনিক্যাল অংশেরই দায়িত্ব নিলাম। চারটা ছোট ছোট টিম তৈরি করা হয়েছিলো কিছু তরুন রিসার্চার নিয়ে, তারা প্রত্যেকেই যথেষ্ট মেধাবী এবং কর্মঠ। কাজেই চিন্তার কিছু নেই। আমার দেওয়া মুল আইডিয়াটাও অবশ্য অতো কঠিন কিছু ছিল না। স্বপ্নের ইলেকট্রিক্যাল সিগনাল গুলি এনকোড এবং ডিকোড করে ছবি রূপে নিয়ে আসা।

কিন্তু কাজ শুরু করার পর দেখা গেলো, জিনিসটা শুধু কঠিন নয়,ভয়ংকর রকম কঠিন। ব্রেনের এই ইলেকট্রিক্যাল সিগনাল গুলি আর বাকি ৮-১০ টা সাধারণ সিগনাল এর মতো নয়, বরং অনেকটাই আলাদা। এতো সহজে এদের এনকোড কিংবা ডিকোড করা যায়না। তাছাড়া স্বপ্ন এর স্থায়িত্বকাল এর উপরেও কাজ করতে হলো। দেখা গেলো অ্যাসিটাইলকোলিন, নরএপিনেফ্রিন এবং সেরোটনিন এর একটা নির্দিষ্ট অনুপাত বাইরে থেকে প্রয়োগ করা হলে সেটা স্বপ্ন এর স্থায়িত্বকালের কিছুটা তারতম্য আনে। সবচেয়ে নিখুত অনুপাত বের করা চাট্টিখানি কথা নয়। তারপরেও প্রচুর কাঠখর পুড়িয়ে, প্রচুর হিসাব নিকাশ করে, ৫ বছরের সুদীর্ঘ এবং জটিল গবেষণা শেষে মোটামুটি ভাবে একটা সিস্টেম দ্বারা করানো হল।

প্রথম টেস্ট এর জন্য সাবজেক্ট হিসেবে যাকে নেওয়া হল, তিনি একজন বুড়ো ভদ্রলোক। দীর্ঘদিন ধরে প্যারালাইজড হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছেন। প্যারালাইসিস এর জন্য সমস্ত শরীর অবশ। কিন্তু ঘুম স্বাভাবিক, চিন্তা স্বাভাবিক। স্বপ্নের ইলেকট্রিক্যাল একটিভিটি অতিমাত্রায় স্বাভাবিক। প্রথম টেস্ট হিসেবে সবাই বেশ উত্তেজিত ছিল, সত্যি কথা বলতে আমিও ভেতরে ভেতরে একটা বেশ চাপা উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। প্রফেসর রিভনসুয়ো আমার চেয়েও অনেক বেশি আশা নিয়ে বসে ছিলেন। তার ধারনা ছিল, এটা যদি কোনভাবে সফল করা যায়, তাহলে সেটা হবে বর্তমান বিজ্ঞানের অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ আবিস্কার।

কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছরের সকল পরিশ্রমকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, সমস্ত আশা প্রত্যাশাকে ভেঙে দিয়ে এক্সপেরিমেন্টটা ব্যর্থ হলো। স্বপ্নকে ধরা কি এতোই সহজ? সব কিছু ঠিক রাখার পরেও মনিটর স্ক্রিনে খালি কয়েকটা বিচ্ছিন্ন লাইন ছাড়া আর কিছুই দেখা গেলো না।

আমি প্রচণ্ড রকম মুষড়ে পড়লাম। আমার মন ভেঙে গেলো। আমি বুঝছিলাম, এটা হবার নয়। তবু প্রোফেসর আমাকে অনেক অনুরোধ করলেন হাল না ছাড়তে। ২ বছর আরও গবেষণা করা হলো। টেকনোলজি আরও উন্নত হলো, সম্ভাব্য ভুল-ত্রুটি গুলোও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হলো। কিন্তু লাভ হলো না। স্বপ্ন ধরা দিলো না। আমার মন আগে থেকেই ভেঙে আছে, নতুন করে ভাঙার কিছু নাই। আমি দেশে ফিরে আসলাম।

দেশে ফিরে আসার পর হতাশা আমাকে তীব্রভাবে আচ্ছন্ন করলো। সারাদিন রুমের মাঝে বসে থাকি, কিছুই করার থাকেনা। আমি নানা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করলাম। প্রানপনে চেষ্টা করলাম ব্যর্থতাটুকু ভুলে থাকার। কিন্তু মনের বিক্ষিপ্ততা এতোটুকু কমলো না।

আমি ঢাকার বাইরে চলে এলাম। দেশের একজায়গা থেকে আরেকজায়গা ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দর্শনীয় জিনিস খুঁজে বেড়াতে লাগলাম। বগুড়া, নেত্রকোনা, তেতুলিয়া, সিলেট, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, টেকনাফ কোন জায়গাই বাদ গেলো না। ২ মাস টানা পথে পথে ঘুরলাম। মুগ্ধ হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার দেশের এতো সৌন্দর্য, অথচ চোখ মেলে কখনোই দেখা হয়নি। সৌন্দর্যগুলো স্বপ্নের মতো, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত, স্বপ্নের মতো নিয়ন্ত্রনহীন নয়- একই ধরনের কাঠামো, কিন্তু জগত ভিন্ন, দৃশ্য ভিন্ন-

পথে ঘুরতে ঘুরতে আমি একদিন হঠাৎ করেই বুঝে গেলাম আমার কি করতে হবে। আমি বুঝে গেলাম, কেন আমাদের সিস্টেম কাজ করেনি। মুল প্ল্যানিং এ যে জিনিসটার অভাব ছিলো, সেটা হলো ছোট ছোট কিছু কাঠামো। মানুষের কাঠামো, বাড়ি ঘরের কাঠামো, প্রাণীদের কাঠামো, গাছপালার কাঠামো। কাঠামো নেই বলেই স্বপ্নের ঘর, ছবির ঘর হিসেবে জায়গা করে নিতে পারেনি, পারেনি স্বপ্নের মানুষ, মানুষের জায়গা করে নিতে। তাইতো রেখা ছাড়া সে আর কিছু দিয়েই নিজেকে প্রকাশ করতে পারেনি। কোড কখনো বুঝেনি, তার কোথায় যেতে হবে।

আমি দ্রুত ঢাকায় ফিরে এলাম। এখন দরকার কয়েকজন ভালো প্রোগ্রামার, তাদের ঢাকাতে পাওয়াও কোন ব্যাপার না। আমি চাইলেই সমস্ত সিস্টেম এখন বাংলাদেশে বসেই তৈরি করে ফেলতে পারবো। স্বপ্নকে হয়তো এবার ধরে ফেলতে পারবো আমি। তাদের ছোঁয়া কি সত্যিই সম্ভব? হ্যা, হয়তো সম্ভব। এবার আমার মন বলছে, এটা সফল না হয়ে যায়না।

-------------------------------------------------------------

আজ আমার বন্ধুটি আমার বাসায় হাজির হয়েছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে দেখে চলেছে আমার "স্বপ্নঘর" এ রাখা প্রতিটি স্বপ্ন। জীবন্ত এবং প্রানবন্ত স্বপ্ন। বোতাম টিপলেই যে স্বপ্ন দেখা যায় বহুবার। আমার সৃষ্ট স্বপ্ন। মস্তিস্কের অনিয়ন্ত্রিত স্বপ্ন। তবু তো সৃষ্টি। নিজের সৃষ্ট সব জিনিসই আসলে সুন্দর। অন্তত আমার কাছে সুন্দর।

বন্ধুটি শেষ দেয়ালে এসে দাঁড়ালো। তার মুখ হাসি হাসি। মনে হচ্ছে সে আমাকে কিছু বলবে।
"তোমার কোন স্বপ্নটি তোমার দেখা সেরা স্বপ্ন?"
" সেরা স্বপ্ন? এইযে ডানদিকের এই কর্নার এর স্বপ্নটা দেখো। হিপোগ্রিফের পিঠে উড়ার স্বপ্ন। এই স্বপ্নটা অনেক সুন্দর।"
হা হা করে হাসলো আমার বন্ধুটি।
"ভুল"। বললো সে।
"তাহলে কোনটি?"

বন্ধুটি মৃদু হেসে বললো- " অবাধ্য স্বপ্নগুলোকে বন্দী করার যে স্বপ্নটা তুমি দেখেছিলে একদিন, সেটাই তোমার জীবনে দেখা সেরা স্বপ্ন।"


সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১২ বিকাল ৫:১৭
২৪টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×