একটা মজার ঘটনা শুনবেন?
প্রথমেই বলে রাখি, আমি খুব একটা লেখালেখি করি না। বাংলায় আমি খুব একটা ভালো না, সারাজীবন টেনেটুনে ৫০ পেয়ে এসেছি। সাহিত্যচর্চা করা আমার ধর্তব্যের বাইরে। আর পেশার দিক থেকেও আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার। কাগজ কলমে বর্ণমালার বাহারি ব্যবহার আমার তাই ঠিক আসেনা।
তবে প্রতিটা কাজের একটা কারন থাকে। এই যে, এখন লিখতে বসেছি, তারও একটা কারন আছে। কি কারন, আশা করি পুরোটুকু পড়লেই বুঝবেন।
তবে ঘটনার মুল প্রসঙ্গে আসার আগে কিছু পারিবারিক ইতিহাস টানা দরকার।
আমরা যে বাড়িতে থাকি, সেই বাড়িটি মুলত আমার দাদা বাড়ি। ১৯৩০ সালের দিকে আমার দাদা কোন এক হিন্দু জমিদারের কাছ থেকে দাদীর প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও এই বাড়িটা কেনেন। দাদীর আপত্তি থাকার অবশ্য সুস্পষ্ট কিছু কারন ছিল। বাড়ির পূর্ব ইতিহাস তেমন একটা ভালো ছিল না। শোনা যায়, জমিদারের ১১ জন ছেলে মেয়ের প্রত্যেকেরই মৃত্যু হয় এই বাড়িতে। কেউ মারা যায় দুর্ঘটনায়, কেউ রোগে শোকে। এসব শোনার পরেও দাদাজান বাড়িটা কিনেন। তিনি কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন না।
যাই হোক, বাড়িটা কেনার পর আমার দাদী বাড়িটা বন্ধক দিলেন। বাড়ির চার কোনায় হুজুররা দাড়িয়ে থেকে সুরা,আয়াত পড়ে খুব সম্ভবত বাড়ি বন্ধক দেয়, প্রক্রিয়াটা সম্পর্কে আমি আসলে তেমন কিছু জানিনা। বন্ধক দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিলো, যদি বাড়িতে খারাপ কিছু থেকেও থাকে, তবে তা যেন আর কোন অনিষ্ট না করতে পারে।
তবে বাড়িটা কেনার পরে আমাদের পরিবারের তেমন কোন সমস্যা হয়নি। বরং বেশ সচ্ছল অবস্থায় এবং অত্যন্ত সৌভাগ্যের মধ্য দিয়ে আমার ফুপু এবং বাবা চাচারা তাদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ পার করেছেন। বলা যায়, বাড়িটা আমাদের জীবনে শুধু সৌভাগ্যই এনেছে। ক্রমে ক্রমে ফুপুদের বিয়ে হয়ে গেলো, তারা শ্বশুরবাড়ি চলে গেলেন। কিছুদিন পর দুই চাচাও বিদেশে চলে গেলো। বাড়িতে রয়ে গেলাম শুধু আমরা।
আমি পরিবারের বড় ছেলে। আমার বোন আমার চেয়েও ৮ বছরের ছোট। বিশাল দোতালা বাড়ি। মানুষ বলতে আমরা ৪ জন, আর দুইটা চাকর। ফুপু, চাচারা চলে যাবার পর বাড়িটা অনেক বেশি নির্জন হয়ে গেছে।
আগেই বলেছি, মানুষ হিসেবে আমি খুবই সাধারন। কিন্তু সাধারন মানুষের জীবনেও মাঝে মাঝে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। আমার ক্ষেত্রেও তেমনি একটা ঘটনা ঘটলো।
আমার বয়স তখন তেরো। ক্লাস নাইনে পড়ি। সারা বছর টই টই করে ঘুরে পরীক্ষার সময় দেখি অবস্থা খারাপ। কিছুই পারিনা। পরীক্ষার বাকি ৪ দিন, সিলেবাস না শেষ করতে পারলে কপালে দুঃখ আছে। দোতালার প্রায় পুরোটাই খালি, ওখানে কেউ থাকে না। পড়াশুনার কথা চিন্তা করে মা আমার বই খাতা আর পড়ার টেবিল উপরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। শব্দটব্দ কম, নিরিবিলি পরিবেশ, আমারও পড়তে খুব একটা খারাপ লাগেনা। দুপুরবেলা কোনার ঘরটায় বসে অঙ্ক করি।
এক দুপুরে একসাথে টানা অনেকগুলো অঙ্ক করেছি, কিছুটা ক্লান্ত। চোখ দুটো বুজে এসেছে। টেবিলের উপরেই মাথা রেখেই শুয়ে আছি। হঠাৎ হাতের ধাক্কায় বইটা মেঝেতে পরে গেলো। পরে তুলবো, এই ভেবে তখনো চোখ বুজে শুয়ে আছি। হঠাৎ মনে হলো, কে যেন ঘরে ঢুকলো।
তাকিয়ে দেখি ৮-১০ বছরের একটা মেয়ে। ফ্রক পরা, বেশ ফর্সা। লম্বা লম্বা চুল। আমার চোখে চোখ পড়তেই একটু লজ্জা পেলো বোধহয়। এগিয়ে এসে বইটাকে টেবিলের উপরে তুলে রাখলো। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটু হাসলো। তারপর আবার দরজা ঠেলে চলে গেলো।
আমি একটু হতচকিত হলাম। মেয়েটাকে আমি চিনিনা, আগেও কখনো দেখিনি। ভাবলাম, বাসায় হয়তো কোন মেহমান এসেছে। নিচে নামলাম। নেমে দেখি, মা নাক টেনে ঘুমুচ্ছে। আমি মা কে ঘুম থেকে তুললাম।
মা প্রচণ্ড রকম বিরক্ত হলেন। আমি তার কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়েছি। আমাকে ধমক দিবেন কিনা মনে হয় বুঝতে পারছেন না।
আমি বললাম-" বাসায় কি কেউ আসছিলো?"
মা বললো- "কে আসবে? কেউ আসেনাই।"
"আমি যে মাত্র একটা মেয়েকে দেখলাম?"
"কোথায়?"
"দোতালায়। আমার রুমে।"
"কি বলিস উল্টা পাল্টা? মেইন গেট লাগানো। কে আসবে?"
"ও।"
আমি আর কিছু না বলে উপরে চলে এলাম। চোখে তন্দ্রা মতো এলে অনেক সময় মানুষ ভুল ভাল দেখে। আমারও তাই হয়েছে।
কিন্তু রুমে এসে খটকা লাগলো। বই টেবিলের উপর তোলা হয়েছে, এই ঘটনাকে ঠিক ব্যাখা করা যাচ্ছে না। পরক্ষনে মনে হলো, এমনও তো হতে পারে, যে বই আসলে নিচে পরেই নি। পুরোটাই কল্পনা।
যাই হোক, এই ঘটনাটাকে আমি আসলে তেমন একটা পাত্তা দেইনি। পাত্তা দেওয়ার মতো তেমন কিছু মনে হয়নি।
দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটলো তার থেকে ঠিক ৭ বছর পরে। তখন আমি ভার্সিটির ছাত্র।
সেসময় ভার্সিটিতে প্রচুর সেশন জট, হলে সিট পাওয়া মানে অমাবস্যার চাঁদ হাতে পাওয়া। তারপরেও এক বছরের মাথায় হলে সিট পেয়ে গেলাম। রেগুলার ক্লাস করা লাগে ভার্সিটির, তার উপর আবার দুইটা টিউশনি করাই। মোটামুটি ব্যস্ত জীবনযাপন। ছুটি ছাড়া বাসায় আসা হয়না।
পুজোর ছুটিতে বাসায় এসেছি। এক দুপুরের কথা। একা একা বসে আছি। বাসায় কেউ নাই। বাবা গেছে কাজে, মা গেছে বোনকে নিয়ে স্যারের বাসায়। ভালো লাগছে না। কম্পিউটারটা অন করে নেট এ বসবো ভাবছি, এমন সময় টের পেলাম,
আমাদের মধ্যেঘরে কেউ একজন হাঁটছে। আমি চেয়ারে বসেই পিছন ফিরে উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। সবুজ শাড়ির আচল দেখতে পাচ্ছি অল্প একটু।
এই প্রথম আমি একটু ভয় পেলাম। বাসায় তো কেউ নেই। দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে মধ্য ঘরে চলে এলাম। এসে দেখলাম, খাটের উপরে শাড়ি পরা ১৬-১৭ বছর বয়সের এক তরুণী বসে আছে।
আমি তাকে চিনলাম। ৭ বছর আগে যাকে দেখেছিলাম, এই সে। এখন যদিও সে অনেক বড় হয়েছে। আগের থেকে অনেক শুকিয়েছে। আগের মতোই ফর্সা আর লম্বা চুল, খোপা করে আটকানো। কানে লম্বা দুল পরা। লম্বা দুলে তাকে বেশ মানিয়েছে। সে হয়তো জানে, কিভাবে সাজলে তাকে সুন্দর লাগবে। যদিও সে এম্নিতেই সুন্দর। শুধু সুন্দর বললে ভুল হবে, অসম্ভব সুন্দর। এতো সুন্দর মেয়ে আমি আমার জীবনে আগে দেখিনি।
আমি হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছি। সে আমার হতভম্বতা দেখে একটু লজ্জা পেলো বোধহয়। ঠিক সেই ছোট মেয়েটার মতো। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললো-
"ভালো আছেন?"
আমি বললাম-" আপনি কে?"
সে বললো-" এখনো বুঝতে পারছেন না আমি কে? কবে বুঝবেন? বিয়ের পরে?"
মেয়েটি এখন পা দোলাচ্ছে। আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিনা। আমার মাথাটা ফাকা হয়ে গেছে। প্রানপনে বুঝার চেষ্টা করে চলেছি যে এটা কি সত্যি? নাকি আমার কল্পনা?
মেয়েটি পা নাচাতে নাচাতে বললো-" শুনেন, আপনাকে একটা কথা বলার জন্য এসেছি। আপনাকে এই চশমার ফ্রেমে মানায় না। আপনি একটা ছোট দেখে রিমলেস চশমার ফ্রেম কিনবেন, ঠিক আছে?"
হতভম্ব আমি বললাম-" আপনার পরিচয় কি?"
সে বললো-" আমার পরিচয় আপনি জানেন। এতো খাবি খাচ্ছেন কেন? আপনার খাবি খাওয়া দেখে আমার নিজেরই তৃষ্ণা পেয়ে গেছে। আপনি কি আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারবেন? নাকি নিজে যেয়ে খেয়ে আসতে হবে?"
আমি জানতাম পানি আনতে গেলে এসে আমি আর তাকে দেখবো না। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় আমি এতোটাই অবাক হয়েছিলাম যে আমার আসলে এর বাইরে কিছু করার ও ছিল না। আমি বেকুবের মতো পানি আনতে গিয়েছি। এবং এসে দেখি, কেউ নেই। রুম ফাকা।
আমি মনটাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা দরকার। যত বেশি অবাক হবো, চিন্তাভাবনা ততো বেশি জট খাবে। কয়েকটা সম্ভাব্য ব্যাখা দাড়া করানো যায়।
প্রথম ব্যাখা হচ্ছে- মেয়েটা কোন না কোন সুত্রে আমার আত্মীয়, যাকে আমি আগে দেখিনি, বা চিনিনা। মেয়েটা আমার সাথে ফাজলামি করেছে।
এই ব্যাখার সমস্যা হচ্ছে- হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি এই ব্যাখাকে সমর্থন করে না।
দ্বিতীয় ব্যাখা- মেয়েটি পুরোটুকুই আমার কল্পনা। কোন না কোনসময় এরকম একটা মেয়ে দেখে আমার অবচেতন মন আমার অজান্তে তার একটা ছায়া তৈরি করেছে।
ব্যাখার সমস্যা হচ্ছে- আমি রিমলেস চশমা পছন্দ করি না। কোন কালেই না। আমার অবচেতন মন কখনোই নিজে থেকে চশমার ব্যাপারে এরকম একটা সাজেশান দিতে চাইবে না।
তৃতীয় এবং সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখা হচ্ছে-
এটি একটি অদ্ভুত,অতিপ্রাকৃত,রহস্যময় এবং ব্যাখাতীত ঘটনা।
তবে যেটাই হোক না কেন, এটা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে আমার কপালে দুঃখ আছে। আমি আমার বোধবুদ্ধি সব এই ঘটনায় হারিয়ে বসে আছি। আর তার বদলে মেয়েটা আমার মস্তিস্কে বিশাল একটা জায়গা দখল করে বসে আছে। যেখানেই যাই,যেটাই করি, ঘুরে ফিরে একটু পর পর তার মুখটাই মনে পড়ে।
আমি মহা যন্ত্রণায় পড়লাম। তাকে ভুলেও থাকতে পারছি না, না দেখেও থাকতে পারছি না। বাসায় কিছু বললাম না , কারন বললে কোন সমস্যার সামাধান হবে না। উল্টো ঝামেলা বাড়বে। আমাকে ঝাঁর ফুক দিবে। পানি পরা খাওয়াবে। হুজুর ডাকবে। আরও কতো কি করবে কে জানে।
আমি দিনের পর দিন একা থাকা শুরু করলাম। সারাদিন আমার কাটে দোতালায়। নির্জনে, একা একা। শুধু খাওয়ার সময় নিচে নামি। রাতে ইলেক্ট্রিসিটি গেলে বারান্দায় যেয়ে অন্ধকারে বসে থাকি। কারেন্ট থাকলে লাইট নিভিয়ে শুয়ে থাকি। পাছে তাকে আবার দেখা যায়। তার প্রতি আমার আকর্ষণ দিনকে দিন বাড়তেই থাকলো।
একটা সময় আমি নাওয়া খাওয়াও ছেড়ে দিলাম। যেখানেই যাই, শুধু তাকে আর একবার দেখার চিন্তা। আকাশে চিন্তা, পাতালে চিন্তা। তার প্রতি আমার অনিয়ন্ত্রিত, দুর্বার কৌতূহল এবং দেখার তীব্র ইচ্ছা অচিরেই প্রেমে রূপ নিলো। আমি ভয়ংকর ভাবে এই রহস্যময়ী তরুণীর প্রেমে পড়লাম।
শুরু হল আমার অপেক্ষা। সময় ধীর হয়ে গেলো। ঘড়ির কাটা যেন ঘোরে না। সারাটা দিন জীবন্মৃত হয়ে থাকি। এক একটা দিন এক একটা বছরের সমান মনে হওয়া শুরু করলো। মনে হলো, অনন্তকাল ধরে আমি তার অপেক্ষায় বসে আছি।
সে তবু আর আসেনা।
আমার রুমে সারাটা দিন কাটে আমার একা একা। কেউ আসলে বিরক্ত হই। এমনকি বাবা মা এলেও। ৬ মাস ধরে ভার্সিটিতে যাইনা। বাসা থেকে বের হইনা। অবস্থা দেখে বাপ-মা জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন।
ডাক্তার আমার সমস্যা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মন দিয়ে শুনলেন, এবং আমাকে কিছু ড্রাগ প্রেসক্রাইব করলেন। তার কাছে মনে হয়েছে, আমি একজন সিজফ্রেনিক প্যাশেন্ট। বলা বাহুল্য, ড্রাগগুলো ছিল অ্যান্টি- ডিপ্রেসেন্ট এবং হ্যালুসিনোজেনিক।
ছোটবেলা থেকেই আমি মানসিক ভাবে অনেক শক্ত একটা ছেলে। কিন্তু দিনের পর দিন তার অনুপস্থিতি আমাকে মানসিক ভাবে অনেক দুর্বল করে ফেললো। আমি নিজের উপর থেকে আত্মবিশ্বাস হারালাম। একদিকে তার উপর আমার প্রচণ্ড অভিমান হলো। সে কেন আর আসেনা? অন্যদিকে আমার মনে হওয়া শুরু করল-অভিমান করে লাভ নেই, কারন এটি পুরোটাই আমার মনের সৃষ্টি। আমি বই পত্র ঘেঁটে জানলাম হ্যালুসিনেশন এর রোগীরা বাস্তবতা এবং কাল্পনিকতা আলাদা করতে পারে না। হয়তো আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমি হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগ খাওয়া শুরু করলাম।সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসতে সময় লাগলো আরও একটি বছর। দীর্ঘ এক বছর পর আবার আমি ভার্সিটিতে ক্লাস করা শুরু করলাম। একটা সময় পড়াশুনার মাঝে ডুবে গেলাম।
৬ বছর পরের কথা।
আমি তখন প্রতিষ্ঠিত একজন ইঞ্জিনিয়ার। নিজ শহরে চলে এসেছি। প্রাইভেট একটা ফার্মে চাকরি করি, বেশ ভালোই বেতন। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হলে যা হয়, বাসায় টুকটাক বিয়ের প্রস্তাব ট্রস্তাব আসে। আমি মাঝে মাঝেই কানাঘুষা শুনি, কিছু বলিনা। একদিন মা ঠাস করে জিজ্ঞাসা করেই বসলেন-
"কি রে, বিয়ের বয়স তো হয়েছে মনে হয়, মেয়ে টেয়ে দেখবো?"
আমি স্পষ্ট ভাষায় বললাম- "না।"
"না মানে কি?"
"না মানে না। আবার কি?"
এভাবে কেটে গেলো আরও দুটি বছর। বিয়ে করতে না চাওয়ার অবশ্য একটা কারন আছে। আমি আসলে কিছু একটা ঘটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যাই হোক, মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সময় হঠাৎ করেই আমার জীবনে আবার তার প্রত্যাবর্তন হলো।
বিয়ের প্রতি আমার ঔদাসিন্য ও অনাগ্রহ, নাকি তার জন্য মস্তিস্কের গভীরে তৈরি হওয়া আকাঙ্খা- ঠিক কোনটার কারনে সে দেখা দিলো, তা জানিনা। এমনিও হতে পারে। তবে এবার আর সে বাস্তবে আসলো না, আসলো স্বপ্নে। প্রথম প্রথম ১৫ দিনে একবার-দুবার, শেষদিকে অনেকটাই নিয়মিত আসা শুরু করলো সে। আসার সময়ও খুবই নির্দিষ্ট, প্রায়ই শেষ রাতের দিকে। আমি আমার স্বপ্ন নিয়ন্ত্রন করতে পারিনা, আর তাকেও ধরে রাখতে পারিনা। সে আসে, দেখা দেয়, আবার চলে যায়।
আগেরবার নষ্ট হয়েছিলো পড়াশুনা, এবার বাড়লো আমার ঘুম। রাত ১২ টা থেকে বেলা ১২ টা পর্যন্ত ঘুমাই। যদিও তাতে তার আসার সময়ের পরিবর্তন হলো না। সে আসে ওই শেষ রাতেই এবং খুব অল্প সময়ের জন্য। মাঝখান থেকে আমার অফিস মিস হওয়া শুরু করলো।
একদিন সে আমাকে বললো-
"আপনার অবস্থা তো সত্যিই ভয়ংকর। আপনি এখন আমাকে নিয়মিত স্বপ্নেও দেখা শুরু করেছেন।"
আমি বললাম- "হু।"
সে বললো- "আপনি কি জানেন আপনি অসুস্থ?"
আমি বললাম-"জানি।"
"আপনি চান না আপনার অসুস্থতা ভালো হোক?"
আমি বললাম-"চাই।"
মেয়েটি বললো- "আপনি বিয়ে করেন। আপনার এই অসুস্থতা ভালো হবে।"
আমি বললাম-"না।"
সে বললো- "কেন না?"
আমি কোন উত্তর দিলাম না।
সে কিছু সময় চুপ করে থেকে বললো-" আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন?"
আমি বললাম-"করি।"
"তাহলে আপনি বিয়ে করেন।"
এর পরবর্তী কাহিনী সংক্ষিপ্ত। মা ঘটা করে আমার জন্য পাত্রী দেখা শুরু করলেন। তার কিছুদিন পরেই নওগাঁর এক পরিবারে পাত্রী দেখতে যেয়ে দেখলাম, সেই পাত্রীকে আমি চিনি। ইনিই সেই রমণী, যাকে আমি এতোকাল ধরে দেখে আসছি। ইনিই সেই, যে আমাকে সারাজীবন পাগল বানিয়ে রেখেছেন। তার নাম নিহা।
তার দু মাসের মাথায় মহা ধুমধাম করে আমাদের বিয়েটাও হয়ে গেলো।
আমি এখন আমার স্ত্রীকে নিয়ে অসম্ভব সুখে আছি। এরকম সুখ সবার কপালে জোটে না। তার মতো গুণবতী রমণী পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই বলে আমার ধারনা। তাকে ভালবাসতে বাসতে আমার এমন অবস্থা হয়ে গেছে, যে যতই ভালোবাসি, কেমন যেন খালি খালি লাগে। মনে হয়, আরেকটু যদি ভালবাসতে পারতাম!
সন্ধ্যা নামলে আমরা দোতালার বারান্দায় এসে দাড়াই। সে আমার হাতে হাতে রেখে জ্যোৎস্না দেখে। পূর্ণিমার আলোয় তার খোলা চুল আর সেই লজ্জামাখা হাসি আমার বুকের ভেতরের ভালোবাসার সমুদ্রে কেমন অদ্ভুত একটা তোলপাড় শুরু করে। সেই তোলপাড় বুকের ভেতরে শুধু আলোড়ন তুলেই চলে, তাকে থামানোর উপায় আমার জানা নেই।
আমি মাঝে মাঝে তার হাতে হাত রেখে বলি-
"নিহা।"
"হম।"
"আমাকে একটা সত্যি কথা বলবে?"
নিহা আমার তাকিয়ে মৃদু হাসে।
"আচ্ছা, বলতো, তুমি কি কোনভাবে জানতে তোমার সাথে আমার বিয়ে হবে?"
নিহা মুখ চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে বলে-" তোমার কি মনে হয়?"
আমি বলি- "আমার কিছু মনে হয়না। তুমি বলো। জানতে?"
নিহা বলে-"আমি জানি বা না জানি, অন্য কেউ হয়তো জানতো।"
"কে জানতো?"
নিহা বলে- "আজকের আকাশটা দেখো। সুন্দর না?"
আমার কৌতূহল কাটে না। আমি আবারো জিজ্ঞাসা করি-" আচ্ছা নিহা, তুমি কি আমাকে আগে থেকেই চিনতে?"
নিহা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে-" আমি তো তোমাকে জনম জনম ধরে চিনি।"
"কিভাবে?"
নিহা উত্তর দেয়না। সে শুধু হাসে।
তার সেই ভুবনভোলানো হাসির মাঝেই ভেসে যায় আমার সমস্ত পৃথিবী।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১২ বিকাল ৩:৫০