[মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১৪]
অনুবাদ: আ-আল মামুন
ফোকাস
ডেভিড হোলডেন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘাতময় পরিস্থিতি গড়ে ওঠা এবং শেষ পর্যন্ত এর ফলে অশান্ত সংকটে পৌঁছানোর পেছনে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবকের অনুসন্ধান করেছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যদি সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করতে না পারেন এবং রাষ্ট্রের সংহতি দ্রুত ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন তাহলে ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে আরেকবার দেশ বিভাজনের চেতনা প্রবল হয়ে উঠবে।
পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ট্রাজেডি ২৫ বছর আগে বৃটিশ শাসন অবসানের মাধ্যমে যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তারই যৌক্তিক পরিণতি। সে সময় একটি স্বতন্ত্র এবং সুনির্দিষ্টভাবে মুসলমানদের জন্য রাষ্ট্র তৈরী করতে গিয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নহ ও তার সহযোগী মুসলিম লীগ নেতারা উদ্ভট এক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল হাজার মাইল শত্রুভাবাপন্ন ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন দুটি এলাকা জনগণকে নিয়ে, যাদের ভাষা আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা; শুধুই ইসলামী বন্ধনের দ্বারা দুটি এলাকা এক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলো।
যা ঘটেছে তা হলো, সিকি শতাব্দী পর বিশ্ব নাট্যাশালায় ক্রমাবর্ধমান হারে টালমাটালভাবে চলতে চলতে পশ্চাদবর্তী অংশ পূর্ব পাকিস্তান অবশেষে অগ্রবর্তী অংশ পাশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে গেল। একক পাকিস্তান এই সপ্তাহান্ত পার করতে পারলো না! ইয়াহিয়া খানের সহযোগী বাহিনী ও ট্যাংক বহরের তৎপরতা দেখে মনে হচ্ছে না যে তারা দু’টুকরো হয়ে যাওয়া পাকিস্তান আবার সংযোজিত করতে পারবে। এই মুহূর্তে যদি সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্বাস করা যায় তবে বলতে হবে প্রেসিডেন্ট ও তার বাহিনীই প্রভাব বিস্তার করে আছে। পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে জানা গেছে। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী করা হয়েছে এবং শুক্রবারে ঢাকায় জারীকৃত সান্ধ্য আইন গতকাল সকাল থেকে নয় ঘণ্টার জন্য রহিত করা হয়েছে। পাকিস্তানের সরকারি রেডিও কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নির্দেশনামা সম্প্রচার করছে। এবং পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের কোনো এক জায়গা থেকে সম্প্রচার করা গুপ্ত রেডিও কেন্দ্রটি সম্পর্কে সামান্যই জানা গেছে। এই কেন্দ্র থেকেই শুক্রবার ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার’ ঘোষণা দেয় বলে খবর পাওয়া গেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এই পূর্ব-প্রদেশকে ‘বাংলাদেশ’ নামেই আখ্যায়িত করেছে। গতকাল পর্যন্ত ভারত হয়ে আমাদের কাছে যেসব খবর এসে পৌঁছাচ্ছে তাতে দেখা যায় পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ শহরে ব্যাপক যুদ্ধ চলছে এবং চট্টগ্রামে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা ও বাঙালি রেজিমেন্টের সৈন্যরা ঘিরে রেখেছে; পাকিস্তান বাহিনী পরাজিত প্রায়- এসব খবরের সত্যাসত্য সম্পর্কে নিশ্চিত কিছুই জানা যায়নি।
পশ্চিম-বাংলা বর্ডার দিয়ে ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে আসা পূর্ব পাকিস্তানীদের মাধ্যমে ভারত থেকে পাওয়া আরেক খবরে জানা গেছে ইতোমধ্যে দশ হাজার নিরীহ বাঙালি নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে দেড় হাজার কৃষক যারা যশোর বিমানবন্দর দখল করতে গিয়ে সেনা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে। কিন্তু এই খবরকেও একটু সংযমের সাথে বিবেচনা করতে হবে। কারণ ভারতীয় পার্লামেন্টের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া থেকেই বুঝা গেছে যে তার প্রতিবেশী সম্পর্কে তাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপটাই বিশ্বাস করার প্রবণতা বিরাজ করছে। কিছু ভারতীয় সাংসদ ইতোমধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে শুরু করেছে। পাকিস্তান বিরোধী যুদ্ধের পুরনো সমর্থক কৃষ্ণ মেনন তো অতিসত্ত্বর ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার আহবান জানিয়েছেন।
অন্যাদিকে, পাকিস্তান রেডিও কঠোর নির্দেশনামা জারী করেছে। যেকোনো সামরিক আইন অমান্যকারীর জন্য সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডের ঘোষণা দেয়া হয়েছে; প্রেসের ওপর পূর্ণ সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছে; সকল মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনীর চলাচলের ক্ষেত্রে কোনোরূপ গতিরোধক তৈরি বা বাধাদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এসব নির্দেশনা থেকেই বুঝা যায় পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ কতোটা প্রতিরোধের আশঙ্কা করছে। শেখ মুজিবের পক্ষে প্রায় ১,০০,০০০ সশস্ত্র সামরিক সদস্য সংগঠিত হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে এবং আরও ১২-১৫,০০০ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস্ সদস্য স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে যোগ দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। সুতরাং শুরু থেকেই সশস্ত্র প্রতিরোধ মোকাবিলায় ইয়াহিয়া বাহিনীকে ব্যাপক কষ্ট পোহাতে হবে। এর সাথে আবার নিশ্চিতভাবেই বলা যায় পূর্ব-পাকিস্তানের সমগ্র সাড়ে সাত কোটি জনতাই শেখ মুজিবের পক্ষে রয়েছে। ফলে, প্রেসিডেন্টের নির্দেশ বলবৎ করার জন্য পশ্চিম-পাকিস্তানী ৭০,০০০ সৈন্য রয়েছে বলে যে খবর পাওয়া গেছে তা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যএকেবারেই নস্যি মনে হয়।
গোরিলা অঞ্চল
ইয়াহিয়া বাহিনীর জন্য যেকোনো প্রকার চলাফেরা করাই ঝুঁকিপূর্ণ হবে। অধিকন্তু পূর্ব পাকিস্তানীদের আবাসস্থলের নদ-নদী ও জলাভূমি পরিপূর্ণ এলাকা গেরিলা প্রতিরোধের জন্য খুবই উপযোগী। অন্যদিকে, পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পর্যাপ্ত সৈন্য সমাবেশের জন্য একমাত্র সমুদ্রপথই খোলা আছে। কিন্তু করাচী থেকে ভারতের দক্ষিণ প্রান্ত ঘুরে চট্টগ্রামে জাহাজ পৌঁছাতে ছয়দিন সময় লেগে যায়। একটি ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে পাকিস্তানে অবতরণের পর থেকে গত কয়েক সপ্তাহ ভারতীয় আকাশসীমা দিয়ে পাকিস্তানী বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টির যদিও মনে হয় যে চীনা তিব্বত হয়ে পাকিস্তানী বিমান পূর্ব পাকিস্তানে আসতে পারে। কিন্তু ব্যাপক সৈন্য সমাগম ও যন্ত্রপাতি এই পথে বিমানযোগে পরিবহণ পাকিস্তানের আর্থিক সামর্থ্যে কুলোবে না।
সেহেতু, কেবলমাত্র অতিদ্রুত কিছু লোককে হত্যা করে এবং এর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী যদি জনগণকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলতে না পারে তাহলে সেনাবাহিনীকে অবনতিশীল পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হবে। আর তখন তারা শুধু কৌশলগত অবস্থানগুলোতে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হবে এবং দেশের অধিকাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যাবে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ প্রধান বিমানবন্দরগুলো, সড়কপথ এবং রেডিও কেন্দ্র তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ক্ষেত্রগুলোর বাইরে বিস্তৃত এলাকায় যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে।
অবহেলিত প্রান্ত
পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার পুনঃকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আশু বাস্তব ফলাফল যাই হোক না কেন, মানসিকভাবে পাকিস্তানীরা আলাদা হয়ে গেছে। এই বিচ্ছিন্নতার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হতে এতোদিন সময় লাগলো সেটাই বিস্ময়ের। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুর বছরগুলো থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা নিজেদেরকে পাশ্চিম-পাকিস্তানী শাসকবর্গের কাছে অবহেলিত হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। আইয়ুব খানের উচ্চাভিলাষী সামরিক একনায়কতন্ত্রের এক দশকে বাঙালিদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ না করে বরং তীব্রভাবে দমন করা হয়। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান যখন অপসারিত হলো বাঙালিদের এসব আশা-আকাঙ্ক্ষা আকস্মাৎ বিক্ষোভরূপে প্রকটিত হয়ে উঠলো। প্রতি বর্গমাইলে ১৩০০ বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তান পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং এটি পৃথিবীর নিম্নতম জীবনমান সম্পন্ন এলাকাগুলোর অন্যতম। এক হাজার মাইল দূরবর্তী রাওয়ালপিন্ডী ও করাচীর কেন্দ্রীয় শাসনের সাথে তারা খুব সামান্যই একাত্মতা বোধ করে। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারতের সাথে চলা পাকিস্তানের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধও তাদের আবেগকে খুব কমই স্পর্শ করে। যদিও এই যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানের যে সামরিক ব্যায় হয় তার সিংহভাগ বহন করে পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র পাট রপ্তানী থেকেই পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক মূদ্রার অর্ধেক অর্জিত হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট বরাদ্দের তিন ভাগের এক ভাগেরও কম পায় পূর্ব পাকিস্তান। বাঙালিরা দেখলো কোনোরূপ আর্থিক ব্যায়ের হিসাব ছাড়াই পশ্চিম পাকিস্তানে নতুন রাজধানী রাওয়ালপিন্ডীকে ঐশ্বর্যমণ্ডিতভাবে গড়ে তোলা হলো, অন্যদিকে তাদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও সরকারি ব্যায় বৃদ্ধির কারণে।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে বাঙালি কেরানী ও ব্যবস্থাপক শ্রেণীর সাথে পাঞ্জাবী যুদ্ধবাজ শ্রেণীর মধ্যে বিদ্যমান পুরনো বিদ্বেষ প্রবল হয়ে ওঠে। এই বাঙালি কেরানী-ব্যবস্থাপক শ্রেণীটি বৃটিশ আমলে প্রশাসনের প্রধান অবলম্বন ছিল। অন্যদিকে পাঞ্জাবী যুদ্ধবাজ শ্রেণীটিও বৃটিশ ভারতে যেমন সেনাবাহিনীতে প্রতাপশালী ছিল তেমনই পাকিস্তান আমলেও প্রতাপশালী হয়ে ওঠে। ১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে কাশ্মির নিয়ে অমিমাংশিত যুদ্ধ শেষে বাংলার দুর্দশা আরও বৃদ্ধি পায় কারণ কেন্দ্রীয়ভাবে ভারতের সাথে সকল বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা হয়। এর ফলে নিকটস্থ কোলকাতা বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানী বাণিজ্য পরিচালনা এবং শিল্প-কারখানার জন্য ভারতীয় সুলভ কয়লা আমদানী করা থেকে তারা বঞ্চিত হয়।
মুজিবের প্রচারণা
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান গণতন্ত্র প্রত্যার্পণের ওয়াদা করেছিলেন, তার পতনের পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই পথই সুগম হলো। পূর্ব পাকিস্তনের আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে কাশ্মীর যুদ্ধের পরপরই ১৯৬৬ সালে গ্রেপ্তার করা হয় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের জন্য ছয়-দফা দাবীনামা পেশ করার দায়ে। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনে এটা চতুর্থবারের মতো কারাবরণ। তার এই গ্রেপ্তার বাঙালিদের কাছে তাকে দেশমাতৃকার জন্য আত্মোৎসর্গকারী নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল এবং তার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে পালিত ধর্মঘট ও আন্দোলন ছিল আইয়ুব খানের পতনের প্রধান কারণ। জেল থেকে শেখ মুজিব যখন মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন এবং ইয়াহিয়া খান যখন ডিসেম্বরে দেশব্যাপী সংসদ নির্বাচন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন বিচ্ছিন্নতাবাদী ধারা, তার ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাকে স্ব-শাসনের পক্ষে নির্বাচনে প্রচারণা চালাতে বাধ্য করল যার ফলাফল ছিল তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
শেখ মুজিব কোনো অর্থেই বিপ্লবী নন। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা তাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল এবং শক্তি অর্জন করছিল। আর এই জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রভাব দেশের পশ্চিমাংশেও পড়েছিল। বিভাজন রোধকল্পে এবং পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম-পাকিস্তানের সকল প্রদেশকে আইন, প্রশাসন ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্বায়ত্বশাসন দেয়ার ওয়াদা করেছিলেন। কিন্তু এই ওয়াদার সাথে সাথেই সঙ্গোপনে বিশেষত সেনাবাহিনীর মধ্যে এই আতংক জেগে উঠেছিল যে, যদি এই ওয়াদা পূরণ করা হয় তাহলে সামরিক বাহিনীতে পাঞ্জাবীদের প্রধান্যশীল ভূমিকা হ্রাস পাবে এবং গোপনে এই হুমকিও বিরাজ করছিল যে প্রেসিডেন্ট এই ওয়াদা পালন করতে গেলে সামরিক বাহিনী আবার ক্ষমতা দখল করে নেবে।
সাধারণ নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত প্রথম তারিখ অর্থাৎ গত অক্টোবরে নির্বাচন হলে হয়তো কোনো প্রকার সমঝোতায় পৌঁছান যেত যদিও তখনও বাঙালি বিচ্ছিনতাবাদী আন্দোলোন প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু সমঝোতায় যে সম্ভাবনাই থাক না কেন তা হেমন্তের প্রলয়ঙ্করী প্রাকৃতিক বন্যায় ভেসে যায়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন স্থগিত করেন। কিন্তু বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন নিয়ে সমস্যা ঘনিভূত হয়। বিধ্বংসী বন্যার ব্যাপকতা সামাল দেয়া পাকিস্তানের প্রশাসনিক ও আর্থিক সামর্থ্যর বাইরে চলে যায়। গাঙ্গা উপত্যকার বাংলায় অসংখ্য মৃত্যু ও ধ্বংস ঘটে এই বন্যায় এবং প্রতিদিনই এই বন্যা মোকাবিলায় সরকারের দুর্নীতি ও অদক্ষতা প্রকটিত হয়ে ওঠে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, বন্যাকবলিত বাঙালিদের দুর্দশায় পাশ্চিম-পাকিস্তানী প্রশাসন একেবারে নির্মোহ ভাব প্রদর্শন করে যা বাঙালিদের পাকিস্তানবিরোধী আবেগকে দুর্বার করে তোলে।
অবশেষে গত ডিসেম্বরে পুনরায় যখন সাধারণ নির্বাচন হলো তখন শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ স্বশাসনের পক্ষে প্রচারণা চালালো যেখানে পরিপূর্ণ বিচ্ছিন্নতার একটু নিচের অবস্থানে থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে শুধু প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতি রাখর কথা বলা হলো। আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল অভাবনীয়। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ১৫৩টি আসনের মধ্যে ১৫২টি লাভ করে আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিব অদ্ভুত এক অবস্থায় পড়লেন। তিনি একদিকে আপাতদৃষ্টিতে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনীতিবিদ ও সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হলেন, কিন্তু এমন একটি দেশে যেখানে তার কর্মসূচি ও দল দেশটি ভাঙ্গার চেষ্টা করছে বলে প্রতীয়মান। একইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভূট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৩৮ আসনের মধ্যে ৮১টি আসন লাভ করল, যা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে কম গুরুত্ববহ। এই প্রথমবারের মতো দেশের দুই শাখার বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবধারা পরস্পরের মুখোমুখী হলো। ইসলামী ভাতৃত্বের পুরনো বন্ধন স্পষ্টতই অন্য এক আবেগ দ্বারা বিচ্ছিন্ন হলো এবং দুই অংশের সমন্বয় বা বিচ্ছিন্নতার জন্য সামরিক ভয়ভীতি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না।
চরমপন্থীদের প্রতীক্ষা
সমঝোতার সকল পথ রুদ্ধ হয়েছে এবং বলপ্রয়োগ ছাড়া এখন আর কোনো পথ খোলা নেই। সব প্রচেষ্টাই যেখানে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে বলপ্রয়োগ সফলতা আনবে এটা আশা করা বাতুলতা। কয়েক হাজার মৃত্যুর বিনিময়ে বাঙালিদের এখনকার মতো দমিত করা গেলেও যে চেতনা দেশটিকে বর্তমান ট্রাজেডির দিকে ধাবিত করেছে সেই চেতনা আরও গভীরতর হবে। অনিশ্চিত সরবরাহ লাইনের ওপর নির্ভর করে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে দমিয়ে রাখার আর্থিক ও আবেগগত মূল্য দেয়া পাকিস্তানের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে না। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বিক্ষোভ মেটানোর জন্য শেষ পর্যন্ত কোনো পথ খোলা আছে এমন বলা যায় না।
সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, এই গৃহযুদ্ধ পরিপূর্ণ স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা তিরোহিত করবে যদি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সামরিক অধিগ্রহণের মাধ্যমে দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখেন। কারণ শেখ মুজিব জেলে থাকুন বা বাইরে থাকুন তার পিছনে রয়েছে আরও কট্টরপন্থী ব্যক্তিবর্গ। এই কট্টরপন্থীদের কেউ কেউ তার নিজের দল আওয়ামী লীগের সদস্য, যারা সম্ভবত শেখ মুজিবের ইচ্ছার তোয়াক্কা না করে তাকে গত কয়েকমাসে বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে অগ্রসর করিয়েছে। আর, আওয়ামী লীগের বাইরের অন্যরা কট্টর বিপ্লববাদী দলগুলোর সদস্য।
বয়োবদ্ধ কিন্তু এখনও সকলের শ্রদ্ধার পাত্র মওলানা ভাষানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গত ডিসেম্বরের নির্বাচন বয়কট করেছিল এবং তার দল এখন কিছু উপদলে বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু এখনও হাজার না হলেও কয়েকশত দক্ষ নেতা রয়েছেন যারা ইতোমধ্যে পশ্চিম বাংলার নকশাল আন্দোলনের নির্দেশনা অনুসরণ করে কৃষক বিপ্লব ঘটানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছে এবং সম্ভবত তারা মাওবাদী চীনের সহায়তা নেবে। পূর্ব পাকিস্তানে দীর্ঘদিন সামরিক দখলদারিত্ব অব্যাহত থাকলে তা বিপ্লবীদের শক্তি বাড়াতেই সহায়তা করবে। আর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সংক্ষিপ্ত অভিযান শেষে বিকল্প স্থানীয় নেতৃত্ব বের করে পুনঃসংহতিবিধানের যে আশা করেছিলেন তা এখন চন্দ্রের চেয়েও দূরবর্তী বলে মনে হচ্ছে।
যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে কী?
বাঙালি কৃষকদের যুদ্ধ করার মতো বুকের পাটা নেই- ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর যুদ্ধবাজরা এরূপ মনে করলেও তা যথার্থ নয়। ভারতে ইতোমধ্যে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে গণঅভ্যুত্থান গড়ে তোলার মতো শক্তি কৃষকদের রয়েছে। যাহোক, যতোই হতবুদ্ধিকর বা বিভ্রান্তিকর মনে হোক না কেন, পাকিস্তান বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে তাদের অবস্থান যতো দীর্ঘায়িত করবে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম বাংলার বিপ্লবীরদের একই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ততো বেশী সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। এই আশঙ্কার ব্যাপারে রাওয়ালপিন্ডী ও নয়াদিল্লী উভয়পক্ষেরই সতর্ক হওয়া দরকার। দুই দেশের বাঙালি ঘনবসতিপূর্ণ এই প্রান্তে যে বিপ্লবী তৎপরতা শুরু হয়েছে তা এখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের দাবীর ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানে জনমতের ভিতরেও বিভাজন পরিলক্ষিত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানকে বলপূর্বক একীভূত রাখতে গিয়ে যদি দেশটি ক্ষমতার অপচয় করে তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানে এই বিভাজন আরও বেড়ে যাবে। বিশেষত পাঞ্জাবী সামরিক নেতাদের নির্দেশে যদি দেশের শক্তিক্ষয়ের নীতি গৃহীত হয় তবে জনমতের বিভাজন বেড়ে যাবে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা অসঙ্গত যুদ্ধনীতি গ্রহণ করবে না কারণ পাঞ্জাবী কর্তৃত্ব সেখানেও জনপ্রিয় নয়।
এটা অবশ্য সত্য যে পশ্চিম পাকিস্তানে ইসলামী রক্ষণশীল ধারা এখনও শক্তিশালী। নবীর প্রতি গভীর আস্থা ও মহম্মদ আলী জিন্নাহর পবিত্র স্মৃতির প্রতি আস্থাশীল পশ্চিম পাকিস্তানীরা একক পাকিস্তান রক্ষা করাকে পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করে। কিন্তু প্রাদেশিক বিক্ষোভ মেটাতে এটাই যথেষ্ট নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে বাংলার মনস্তাত্বিক বিচ্ছিন্নতা যদি বাড়তেই থাকে তাহলে আইনানুগভাবে দুই অংশের পৃথক হয়ে যাওয়ার পক্ষেও পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিকের সংখ্যা বাড়তে পারে। পূর্ব পাকিস্তানের পাট অত্যান্ত মূল্যবান কিন্তু সেখানকার সীমাহীন দরিদ্রকেও অস্বীকার করবার উপায় নেই। আর এ কারণেই তারা হয়তো পূর্ব পাকিস্তানকে তার ‘নিজের ভাগ্যমতো ধ্বংস হতে দাও’ এই মতের পক্ষে রায় দিতে পারে।
বাংলাকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছেন, অনুরূপ সঙ্কটে সাম্প্রতিক নির্বাচনী জয়ের পরে ভারতের ইন্দিরা গান্ধীও পড়তে পারেন। যখন দেখা যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিম-পাকিস্তানের সাথে একত্রে থাকার সম্ভাবনা একেবারেই নেই তখন ভারতের স্বার্থেই, যত দ্রুত সম্ভব শেখ মুজিবের কর্তৃত্ব থাকতে থাকতেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি অর্জন করাতে হবে। কারণ শেখ মুজিব যদি দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ থাকেন তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের গণজোয়ারের প্রভাবে ভারতীয় অংশের বাংলায়ও শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা হ্রাস পাবে। তদুপরি, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে গেলেও ভারত নিশ্চিন্ত হতে পারবে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শুধু বাংলায় নয়, অন্যান্য প্রদেশেও যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছে তা নির্বাচন বিজয়ী মিসেস গান্ধী দীর্ঘদিন হয়ত গোপন রাখতে পারবেন না। সর্বোপরি, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যদি বাধাগুলো অতিক্রম করতে না পারেন তাহলে এই সপ্তাহান্তে অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে থাকবে। বৃটিশ শাসনের অবসানের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেভাবে যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছানো গিয়েছিল, সেরকম কোনো সমাধানে না গিয়ে বরং ভারতীয় উপমহাদেশ আঞ্চলিক বিভাজনের দীর্ঘ পথে যাত্রা শুরু করবে।
দ্যা সানডে টাইমস
২৮ মার্চ, ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ২
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৩
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৪
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৫
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৬
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৭
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৮
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৯
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১০
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১২
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১৩