[মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১১]
অনুবাদ: আ-আল মামুন
সিডনি এইচ. সেহেনবার্গ
পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা থেকে গতকাল সকালে বহিস্কৃত হওয়ার পর নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সিডনি এইচ. সেহেনবার্গ বোম্বে থেকে এই রিপোর্ট পাঠিয়েছেন।
পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানী সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে। সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই প্রদেশের স্বায়ত্বশাসনের দাবি সমূলে ধ্বংস করার জন্য সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ভারী কামান ও শক্তিশালী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করছে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী কোনোরকম ইঙ্গিত ছাড়াই আক্রমণ শুরু করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা, যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সংখ্যাগুরু অংশ, স্বাধীনতা আন্দোলনের সুদৃঢ় ঘাঁটি প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা দখল করার জন্য রাস্তায় নেমে আসে। স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের একটি শক্তিশালী অবস্থান ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রথমদিকে বিক্ষিপ্তভাবে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু রাত একটা নাগাদ ভারী গোলাবর্ষণ শুরু হয় এবং পরবর্তী তিনঘণ্টা অবিরাম গোলাবর্ষণ চলতে থাকে। মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আটক রাখা বিদেশী সাংবাদিকরা ভারী কামান থেকে ব্যাপক গোলাবর্ষণের শব্দ শুনতে পেয়েছে এবং দেখেছে। ঢাকা শহরের উত্তরাংশে অবস্থিত ইন্টারকন্টিনেন্টাল [বর্তমান শেরাটন] হোটেল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পূর্ব পাকিস্তানী বাঙালিদের নিয়ে গঠিত প্যারামিলিটারি বাহিনী ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সদর দপ্তরসহ ঢাকার বিভিন্ন অংশে ব্যাপক অগ্নিকাণ্ড দেখা গেছে।
শনিবার সকালে ৩৫ জন বিদেশী সাংবাদিককে যখন ঢাকা থেকে বহিষ্কার করা হয় তখনও কিছু কিছু জায়গায় আগুন জ্বলছিল এবং বিক্ষিপ্তভাবে গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। সামরিক ভ্যানে প্রহরা দিয়ে বিদেশী সাংবাদিকদের বিমান বন্দরে নিয়ে যাওয়ার সময় সাংবদিকরা দেখতে পায় যে রাস্তার আশেপাশের দরিদ্র বাঙালিদের বস্তিগুলোতে সৈন্যরা আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। এই দরিদ্র বাঙালিরা অনেকেই স্ব-শাসনের কট্টর সমর্থক।
“বাংলাদেশ সাবাড় হয়ে গেছে, অনেক মানুষ নিহত হয়েছে,” বিমানবন্দরে একজন পাকিস্তানী সৈন্য অবলিলায় বলে গেলেন। বাংলাদেশ বলতে বুঝায় ‘বাঙালি জাতি’- পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনকারীরা এই নাম দিয়েছে। ১০০০ মাইল ভারতীয় সীমানা দ্বারা পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন।
আমাদের বিদেশ সংবাদদাতা
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে পূর্ব পাকিস্তানীদের নিয়ে শেখ মুজিবের নতুন রাষ্ট্র গঠন প্রচেষ্টার ভাগ্য গতরাত পর্যন্ত অনিশ্চিত ছিল। বিশ্ববাসীর কাছে পরস্পর-বিরোধী সংবাদ এসে পৌঁছাচ্ছে। গৃহযুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের রেডিও থেকে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছনতাকামী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বৃহস্পতিবার রাত ১.৩০টায় প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাস্থ তার বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু গুপ্ত রেডিও থেকে দাবি করা হয়েছে যে শেখ মুজিব এখনও মুক্ত রয়েছেন এবং চট্টগ্রামে তার সদর দপ্তর স্থাপন করেছেন।
ঢাকা থেকে কোলকাতা ও দিল্লি হয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছানো খবর অনুযায়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম দিনেই ১০,০০০ নিরস্ত্র বাঙালি নিহত হয়েছে। কিন্তু কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকগণ এরূপ অনির্ভরযোগ্য দাবিকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। অন্য একটি অনির্ভরযোগ্য সূত্র বলেছে বর্শা ও ছুরি সজ্জিত ১,৫০০ বাঙালি যশোরে একটি বিমান বন্দরের দখল নিতে গেলে মেশিনগানের গুলিতে নিহত হয়েছে।
দ্যা টাইমস
২৮ মার্চ ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পাকিস্তান: সোচ্চার হবার সময় হয়েছে
সানডে টাইমস-এর গত দুই সংখ্যায়, পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি এবং অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমরা সেখানকার অবস্থা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছি। এসব রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বৃহত্তর স্বায়ত্বশাসনের গণতান্ত্রিক দাবিকে অস্ত্রের মাধ্যমে দমন করার সিদ্ধান্তের ফলে সেখানে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক রক্তক্ষয় শুরু হয়েছে। বিপরীত পাতায় একই সংবাদদাতা পশ্চিম পাকিস্তান সফর করে সেখানে ক্রিয়াশীল প্রভাবক ও ধারণাগুলো বর্ণনা করেছেন। সন্দেহের অবকাশ না রেখে যে সত্যটি প্রকাশিত হয়েছে তা হলো যে একটি নিদারুণ ভুল একটি নিদারুণ ট্রাজেডির জন্ম দিয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ এর পূর্বেও সকরুণ দৃষ্টিতে বিভিন্ন জাতি কর্তৃক গণহত্যা দেখেছে। কিন্তু ভারতীয় উপমাহাদেশ বা অন্য কোথাও সাম্প্রতিক ইতিহাসে গণহত্যার এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই, যেমনটি বর্তমান পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার অসীম গণহত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যত বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সমূলে উৎপাটনের সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা নিয়েছে। নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে বলা যায়, জেনারেল ইয়াহিয়া খান খুবই সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন। পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তার প্রশংসাযোগ্য সদিচ্ছার ফলেই গত ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে শেখ মুজিব ও তার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদের উত্তাল অভিঘাত মোকাবেলায় রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে ইয়াহিয়া খানের স্পষ্টতই দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তানের ঐক্য সমুন্নত রাখা। মুজিবের কট্টর সমর্থকরা তীব্রভাবে স্বাধীনতা চাইলেও আলোচনা চূড়ান্তভাবে ভেস্তে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কখনোই কিন্তু তিনি আলাদা হয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেননি।
এটা কোনোক্রমেই বিশ্বাসযোগ্য নয় যে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের সাম্প্রতিক সাফল্য অর্থাৎ বাঙালিদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও নতুন প্রশাসন ব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষাকে সামরিক শক্তি দমন করতে পেরেছে বা ভবিষ্যতেও দমন করতে পারবে। ব্যাপক রক্তক্ষয় ছাড়াও ইয়াহিয়া খানের বর্তমান চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আরেকটি ফল হলো এই যে পূর্ব পাকিস্তানে মাওবাদী, নক্সালবাদী ও অন্যান্য ঘোলাপানিতে মাছ শিকারীদের বাইরে শেখ মুজিবকে একমাত্র ন্যায়সঙ্গত নেতার প্রতীকে পরিণত হওয়ার পথ করে দিয়েছে।
ইসলামাবাদে এখন ন্যাক্কারজনক পরিতৃপ্তির পরিবেশ বিরাজ করছে। বৃটিশ সরকারসহ অন্যান্য সরকারের এখন উচিত হবে এই পরিতৃপ্তির পরিবেশকে আঘাত করা। স্যার এলেক ডগলাস হোমের মতো করে পূর্ব পাকিস্তান নাটকীয়তা ‘আভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ বলে দায়িত্ব শেষ করলেই চলবে না। পূর্ব পাকিস্তানে এখন যা ঘটছে তেমন আভ্যন্তরীণ ঘটনা অনেক সময় ন্যায় ও মানবিকতার বিরুদ্ধে অপরাধের সামিল। ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ভারত, চীন ও রাশিয়া ছাড়া অন্যান্য দেশগুলো কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান ঘটনাকে ক্ষুদ্র আঞ্চলিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করাটা হাস্যকর ভনিতা।
পূর্ব পাকিস্তান ঘটনাক্রমের প্রতি পূর্বের চেয়ে অনেক দৃঢ় কণ্ঠে বৃটিশ সরকারের অসোন্তষ প্রকাশ করার সময় হয়েছে। অবশ্য, অনেক আগেই বৃটিশ সরকারের সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল। প্রথাগত প্রাইভেট ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানকে এখনই জানতে দেয়া উচিত যে তিনি কতো ভয়ঙ্কর ভুল নীতি গ্রহণ করেছেন (যদি এখনও কোনো পদক্ষেপ না নেয়া হয়ে থাকে)। যদিও পাকিস্তানের শাসকবর্গ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি নন- এই হিসেবে বৈদেশিক সাহায্য বন্ধ করা সাধারণ জনগণের প্রতি অবিচারেরই সামিল। তবু প্রয়োজন হলে পাকিস্তানের বৈদেশিক সাহায্যদাতা দেশগুলোকে সাথে নিয়ে বৃহত্তর পদক্ষেপ নিতে হবে। চূড়ান্তভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যেকোনো ভাবে আলোচনার আয়োজন করতে হবে। আর যথাদ্রুত ইয়াহিয়া এই সত্য উপলব্ধি করে শেখ মুজিবকে ঢাকায় ফেরত পাঠালে পাকিস্তানের অধিকতর মঙ্গলের জন্য আলোচনাযোগ্য একজন প্রতিনিধি পাওয়া যাবে।
দ্যা টাইমস
২৮ মার্চ ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ২
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৩
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৪
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৫
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৬
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৭
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৮
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৯
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১০