কন্ডাক্টরের হাঁক, ‘মহিলা তুলিস না। বাসে মহিলা সিট নাই।’
এটা ঢাকা শহরে থাকা কর্মজীবী নারী কিংবা শিক্ষার্থীদের জীবনে প্রতিদিনের ঘটনা, যাঁরা নিয়মিত বাসে যাতায়াত করেন। সারা দিন ক্লাস-অফিস শেষে ক্লান্ত শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অসহায়ের মতো। একটা বাসের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা তাদের; যদিও বেশীর ভাগ বাসই তাদের তুলতে চান না। কি লাভ ঝামেলা বাড়িয়ে।
আমাদের বাসগুলোতে ‘মহিলা সিট’ নামে কিছু সিট আছে। বাস গুলোতে সামনের দিকে ড্রাইভারের পিছনে ৯টি সিট “মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের” জন্য সংরক্ষিত। বাসের এই সিট গুলোর উপরের এই লেখাটি পড়ার পর কারোই কখনো ইচ্ছা করবেনা ঐ সিটগুলোতে বসতে। কারণ, শিশু বা প্রতিবন্ধিরা চলাচলে হয়তো কিছুটা অক্ষম বা চলাচলে তাদের কিছু সমস্যা হয়। তাই তাদেরকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। কিন্তু তাদের পাশে ‘মহিলা’ শব্দটি যোগ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মহিলাদের অক্ষম হিসাবে ফুটিয়ে তোলা।
মহিলারা আজ সংসার ও সন্তান মানুষ করার পাশাপাশি অফিস করছে, সংসারের হাল ধরছে, সংসার চালাতে সমান ভূমিকা রাখছে এবং আমার মনে হয় পুরুষদের থেকে তারা অনেক বেশী কাজ করছে, অনেক বেশী পরিশ্রম করছে। কিন্তু তারপরও মহিলারা এই সমাজে অবহেলিত, অপমানিত। তাদেরকে রাখা হচ্ছে ‘শিশু ও প্রতিবন্ধীদের’ পাশে।
বড় বাস গুলোতে ‘মহিলা সিট’ গুলিতে প্রায়ই দেখা যায়, মহিলাদের থেকে পুরুষদের সংখ্যাই বেশি। হেলপাররা তাদেরকে যতই বলুক না কেন ‘মহিলা সিট ছেড়ে বসেন’ তারা তা শুনতেই চায়না নব্বুই শতাংশ ক্ষেত্রে। বরং অনেক সময়ই অহেতুক তর্ক জুড়ে দেয় হেলপার বা সিটে বসা মহিলাদের সঙ্গে। তাদের কথা “খুব তো সম অধিকার সম অধিকার করেন, তাহলে সিট দখলের সময় আবার মহিলাদের জন্য আলাদা সিটের কি দরকার?” এদের সাথে তর্ক করে লাভ হয় না; বাসটি যদি সিটিং সার্ভিস না হয় তাহলে তখন মহিলারা দাঁড়িয়ে থাকেন আর পুরুষেরা ‘মহিলা সিটে’ বসে থাকেন।
এই ঘটনাটা এতোটাই স্বাভাবিক যে এটা প্রতিদিনের অনিবার্য বিষয়। প্রায় প্রত্যেকটা দিন দেখা যায় মহিলা সিটটা নিয়ে পুরুষদের ক্যাচাল। একদিনের ঘটনা বলি; ঘটনার উৎস এক মধ্য বয়স্ক মহিলাকে নিয়ে। না সেদিন বাসের সীট খালিই ছিলো শুধু মহিলা তার পাশের ভদ্রলোক সহযাত্রীকে জানালার পাশের সিটটাতে বসতে বলছিলেন। এই নিয়েই কথা চলছিলো;
হঠাৎ ভদ্রলোক বললেন
"আপনারা না সারাদিন খালি পুরুষ নারী সমান অধিকার বলে লাফালাফি করেন, আবার আলাদা সুযোগ চান কেন?"
আমি বললাম
"ভাই নিজের মায়ের জন্য অধিকার চাইলে সেটাকে লাফালাফি বলবেন?"
"খবরদার!! মা নিয়া একটা বাজে কথা বলবেন না......"
"ও আচ্ছা আপনার মা'ই শুধু মা আর কারো মা তো মা না।"
মায়ের অধিকার আর নারীর অধিকার এই শব্দদুটির মধ্যে ফারাকটা কি ? নারী মানেই তো মা......
নিজের মায়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অসম্মান তো আপনি মেনে নেন না।
আবার রাস্তাঘাটে অন্যের মা কে অপদস্থ করতে ছাড়েন না। তাহলে কিসের মনুষ্যত্ব?
এদের সাথে তর্ক করে লাভ হয় না। ব্যাপারটা নৈতিকতার।
এখন একটা বিষয় হলো মহিলা সিট আসলে কেন প্রয়োজন? কারণটা বলার অপেক্ষা রাখে না কেননা আমরা সবাই কারণটা জানি। মহিলারা যদি প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যেতে চান, তাহলে ‘পুরুষদের বরং সুবিধাই হয়’ কারণ তারা তখন বিভিন্ন কৌশলে মেয়েদের গায়ে ধাক্কা লাগান অথবা আরও বেশি কিছু করার চেষ্টা করেন। তাদের “মধুর” ব্যবহার আর আচার আচরণের কারণেই মহিলা সিটের প্রয়োজন হয়েছে। এই যে মহিলা সিটে মহিলারা বসছেন, তারপরও কি তারা নিরাপদ? এ ব্যপারে আমার দেখা
মহিলা সিট দেবার পরও যদি মান সম্মান রাখা দায় হয়ে যায়, তাহলে কিভাবে মেয়েরা ঘর থেকে বের হবে? বাইরে বের হলেই ইভ টিজিং এর শিকার হতে হয়, বাসে উঠলে অপমানিত বা নির্যাতিত হতে হয়, কোন কোন মহিলাকে তো আবার বাসার ভিতরেও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তাহলে মহিলারা এদেশের কোথায় নিরাপদ? কোথায় আশ্রয় নেবে তারা?
মহিলা সিটের বিষয়টি আত্মসম্মান আর মর্যাদার ব্যাপার; মানুষকে বুঝিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। যদি না নৈতিক শিক্ষার বিকাশ ঘটে।
দুঃখ একটাই আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নৈতিকতার শিক্ষাটা দেয় না।