মেডিটেশান কথাটার সাথে যখন পরিচয় তখন ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়ি। টিনেজ বয়স... বড়ই খারাপ সময়। যা একবার মাথায় ঢোকে তা আর বের হবার নাম করে না। গুরুজী মহাজাতক (এই নামেই তার ভক্তরা তাকে ডেকে থাকেন) সম্পর্কে জানলাম। তার বইও পড়লাম একটা। পড়ে-টড়ে আমি মুগ্ধ! কিন্তু সহজে মুগ্ধতা প্রকাশ করা সাংবাদিকতার নীতি-বিরুদ্ধ আর আমি কিনা সাংবাদিক না, সাংবাদিকের কন্যা। মুগ্ধতা কিছুটা চাপা দিয়ে রাখলাম। খেতে বসে খুক-খাক কাশি দিয়ে শেষ পর্যন্ত 'গুরুজী মহাজাতকের' নামটা করেই ফেললাম। আমার বাবা খুব একটা অবাক না হয়ে বললেন যে মহাজাতক এক সময় উনার সাথে একই পত্রিকায় চাকরি করতেন।
প্রথমে অবাক, তারপর খানিকটা হতাশ হলাম। স্টারদেরকে মাটির কাছাকাছি দেখতে মানুষ পছন্দ করে না- এই ফিলোসফি তখনই আবিষ্কার হল!
পরবর্তী:
যাহোক, আচমকা হতাশায় আমি হতাশ হলাম না (তাছাড়া আমার মা বলেছিলেন, মেডিটেশান কোন নতুন জিনিস না। এটা হল ধ্যান। সব ধর্মেই কম বেশি এটাকেই প্রার্থনা আকারে তুলে ধরা হয়েছে। ) বরং মনে মনে আরেকটু উৎসাহী হলাম। বইয়ে অনেক কথা লিখেছে, '....মানুষের মনই হল সকল ক্ষমতার উৎস। মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারলে সবই সম্ভব....' ইত্যাদি ইত্যাদি। সুতরাং আরো কোয়ান্টাম মেথড বিষয়ক বই পড়লাম।
এরপর একটা ভাব এল মনে- এখনই আমি যা খুশি তাই করে ফেলতে পারি! হয়ত সকালে উঠে হঠাৎ দু'হাত দুদিকে মেলে আকাশেও উড়ে যেতে পারি! এভরিথিং ইজ পসিবল!!
আর চুপি চুপি বলি, পাশাপাশি ছিল কতগুলো ওয়াইল্ড ড্রিম....... মনে মনে জোরসে চাইলে (মানে মেডিটেশান করলে) হয়ত একদিন আমি নিজেকে শোয়েব আখতারের গার্ল ফ্রেন্ড কিংবা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওর আরাধ্য হিসেবে আবিষ্কার করব.......
কিংবা জেনিফার লোপেজ কোন ছাইমাথা.... মানুষ আমার ছবি ডাউনলোড করতে করতে পিসি ভরায় ফেলবে....... আহ আরো কত কী!
পুরোটাই হাতের নাগালে.......
কেবল......... ধৈর্য ধরে মেডিটেশান করতে হবে......
ধৈর্য ধরা আরে এটা তো দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ কাজ!
আহ, বেশি বাকি নাই, হে দুনিয়া ওয়েট কর, এ যুগের নেপোলিয়ান আসতেছে.......
মিশন কোয়াইট পসিবল:
এখন কেবল বিসমিল্লাহ বলে শুরু করে দেয়া। শুরু হল মিশন ভেরি মাচ পসিবল। দিনের বেলা মেডিটেশান করা যাবে না (সবাই হাসবে) সুতরাং রাতে কর। ঘুমানোর আগে।
ঠিক আছে, শুরু হল মিশন।
বড়ই এক্সাইটমেন্ট.... হিস্টরি ইন ইটস মেকিং!...
ফেইলিয়র ইজ দ্যা কিলার অব সাকসেস:
'সোজা হয়ে শুয়ে থাক.... দম নাও... ফেল..... গুড....... দারুণ কাজ দিচ্ছে!'
-ওহ না কথা বলা যাবে না মানে মনে মনেও না ( এ আবার কী কথা! জেগে জেগে কি চিন্তাশূন্য থাকা যায়!).... চুপ... মন থাকবে চিন্তা শূন্য... হাওয়ায় ভাসছি যেন......
-ইস, কে হাঁটে এত ধুপ ধুপ করে পা ফেলে.... পাগল নাকি!
-পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে কি বসল আবার...... মশা? বসুক।
-উফ মশা তো না, ড্রাগনের বাচ্চা এক একটা.... মনে হচ্ছে পা-টা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে!
-এহ আবার বসল..... সেম টাইম, সেম প্লেস.....আঙ্গুলটা নাড়ানো যায় না? না থাক, স্টিল থাকতে হবে...... পুরা পাথর........
-আঙ্গুলটা একটু নাড়াই.... যদি এডিস মশা হয়!?!
-গেছে..... যাক..... কোথায় যেন ছিলাম?...
..........
...........
আবার শুরু করা যাক.....
-ইস হাত পায়ের জয়েন্ট গুলো জং ধরে গেল। একটু নড়া চড়া না করলে মরে যাব.....
-ওকে.... রেডি এইবার.........
-ডাইনিংয়ের লাইট জ্বাললো কে?!? রুমে ঢুকল কে?
চোখ খুলে তাকালাম..... অহ..... আম্মু........
(রাতের বেলা নিজে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হলেও চেক করে যায় আমরা ঘুমিয়েছি কিনা ঠিকমত..... কেউ খাট থেকে পড়ে গিয়ে মরে যাবার আগের মুহুর্তে আছে কিনা...... কারো ঠান্ডা লাগছে কিনা...... সর্বোপরি, আমরা ছোট তিনজন রাত জেগে গল্প করছি কিনা........)
সার্চ শেষ হলে আম্মু চলে যায়।
-ওকে আবার......
দম নাও....... দম ফেল ( এটা আবার বলে দেওয়া লাগে?!?)
আহহ..... বড়াপু পাশ ফিরে অলমোস্ট গায়ের উপর উঠে পড়ছে..... ঠেলা দিয়ে তাকে সরিয়ে......
পিপাসা পেয়েছে...... একটু পানি খেয়ে আসি.....
ইয়া আল্লাহ কয়টা বাজে!?!?
দুইটা/তিনটা...... খাইসে, কালকে স্কুল! কোন পড়া নাই তো মানে পড়া তো করিই মাত্র কয়েকজনের। অংক হোম ওয়ার্কটা ফ্রেন্ডদের কাউকে দিয়ে তাড়াতাড়ি করিয়ে ফেলতে হবে। চিন্তা নাই, মিষ্টি করে দেবে....
-কোথায় ছিলাম........
ওহ শুরুতে....
দম নেওয়া আর ফেলা....... এইটাই তো....... হু.... উউউউ.... হাউউউ... (হাই উঠতেসে..... চিন্তা নাই, হাই উঠলে ঘুম চলে যায়, এটা বিজ্ঞানীদের কথা....)
তা-র-প-র......
-ওহ.....
হ্যা.....
কি যেন.. হোমওয়ার্ক...... না সেটা না......
কি যেন..... কি যেন.....
প্রথম দুই তিন দিন.......
ব্যাপার না... এটা বইয়েও লেখা আছে 'প্রথম প্রথম ঘুমিয়ে পড়বেন- এটাই স্বাভাবিক।' আস্তে আস্তে হয়ে যাবে।
পরের দুই তিন দিন..
আজকে খুব ক্লান্ত..... বাদ......
এরপর.....
পরীক্ষা.....
প্রশ্নই আসে না.... পরীক্ষার পর.....
নানা বাড়ি বেড়াতে যাব....... আহ.... এক্সাইটমেন্ট.........
.....
রোজা....... ঈদ........ ফুপাতো ভাই বোন.... খালারা...... খেলা দেখা...... ক্রিকেট........ রাস্তায় দেখা ছেলেটা.. তার হেয়ার স্টাইল....হাসিটাও ভালো....... হে হে অমুক ফ্রেন্ডের মামা (জোস ) তমুক ফ্রেন্ডের কাজিনটা.... (হেববি)....
দুই-তিন বছর পর:
আমার কোন এক ফ্রেন্ড যে কিনা বিদ্যাভ্যাসে আমার চেয়ে পিছনে (মানে যার রেজাল্ট ভালো কিন্তু হাবিজাবি পড়ে কম বয়সে জ্ঞানগুরু/গুর্বী হয় নাই আমার মতন) এসে বলে, 'জানিস অ্যামেইজিং ব্যাপার... কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের কোর্সে আমি আর অমুক আর তমুক...'
আমি হাতের পিঠ দিয়ে মাছি তাড়াই.... সময় আর টাকা নষ্ট! বরং পড়াশুনায় মন দে!
-তুই জানিস মেডিটেশান ব্যাপারটা...
-আরে জানি কি আর না (আমার অজ্ঞাত কি কিছু আছে নাকি!)...
বান্ধবীটা হতাশ হলেও নিরাশ হয় না.......
-আমাদের সমুচা খাওয়ায় বুঝলি...
-আমি ক্যান্টিন থেকেই কিনে খাই......(আমি কুল্ডুড)
আরো এক দুই বছর পর:
জীবনে কাজ কাম ফুরায় আসতেসে (মানে বাড়তেসে কিন্তু করতেসি না)
একটা কঠিন সাধনা করা দরকার। জীবনটা যাতে লাইনে আসে।
হাউ অ্যাবাউট ধ্যান করা, মানে 'সরল' ভাষায় তপস্যা। এতে মনের উপর কন্ট্রোল আসবে.......... কিছুটা শান্তি পাওয়া যাবে।
না না.... টম ক্রুজকে বিয়ে করার শখ আর এখন নাই। ওসব দিন কবে পেরিয়ে এসেছি (বয়স হয়েছে তো!)
মহানবী (সা: ) ধ্যান করতেন হেরা পর্বতে।
তাছাড়াও পুরাণের কাহিনীতে পাওয়া যায়, মুণী-ঋষিরা বহু কিছু করে ফেলতেন ধ্যান করে।
আরো আছেন গৌতম বুদ্ধ..
আমি অবশ্যই তাদের মতন হব না। তবে......... কোন একটা কিছু হতে পারে তপস্যা করে (এনরিকে ইগলেসিয়াস/ইকের ক্যাসিয়াস/নিউজিল্যান্ডের যেকোন 'ভদ্র' ক্রিকেটার...নাহলে আতিফ আসলাম... মেল গিবসন (থাক, বিবাহিত মানুষ)...... না না এসব কী যে সব আজব চিন্তা.... এসব কিছুই আমার চাই না... বেভারলি হিলস এ একটা বাড়ি হলেই হবে...) তাছাড়া এসব তো বিষয় না, ধ্যানে যে 'সিদ্ধি' লাভ হবে সেটাই আসল কথা...........
সিদ্ধি লাভ জিনিসটা নিয়ে আরেকটু ভাবতে হবে....
মেডিটেশান-ফেডিটেশান না (ওসব টিনেজার-সুলভ চিন্তা বাদ, আমি একজন গ্রোউন আপ.... ) বরং একটু ধ্যান করে সিদ্ধি লাভ করা যাক।
'সিদ্ধি' টা যেন কি?
হোয়াটেভার.....
চিন্তা খারাপ না....... ধ্যান করা ভালো আইডিয়া........... তাছাড়া কোন ফ্যান্টাসির জগতে বাস করা যাবে না। উঁহু, শতকরা একশো পার্সেন্ট নিষিদ্ধ!
শুধু শুনেছি মেডিটেশান সরি ধ্যান করলে মনে রাখার ক্ষমতা বাড়ে..... স্টুডেন্টদের জন্য বড়ই কাজের জিনিস...........
দেখি দেখি বিবেচনা করে দেখব....... আমি একজন গ্রোউন আপ মানুষ, আমার তো কোন ফ্যান্টাসি নাই....... নিতান্ত 'ভালো কিছু' পাবার আশা মনে নিয়ে ধ্যান করা ভালোই তো... খারাপ কি?
তাছাড়া সিদ্ধি-লাভ কথাটা কত ভালো শুনাচ্ছে (ঐসব টম হ্যাংকস, রিকি মার্টিনদের চেয়ে তো ভালোই)
হুঁ এটাই চাই....
সিদ্ধি-লাভ সিদ্ধি-লাভ সিদ্ধি-লাভ......... কোন স্বার্থ-চিন্তা না...
নিতান্তই সিদ্ধি-লাভ!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০১৪ বিকাল ৪:২৬