ছায়া মানুষটা নিঃশব্দে ছেলেটির মাথার কাছে সরে এসে দাঁড়ায়। কিছুই সে টের পাচ্ছে না। মাথাটা একপাশে হেলে রয়েছে। ছায়া মানুষের ইচ্ছে হল মাথাটা ঠিক করে দিতে, বালিশটা জায়গামত দিয়ে দিতে। কিন্তু.. দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ভাবল, ছায়া মানুষেরা বালিশ ঠিক করতে পারে না।
ছায়া মানুষ ছেলেটির মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ.... চুপচাপ.....
হঠাৎ তার মনে হল, ছেলেটাকে একটু ডাকার চেষ্টা করে দেখা যাক।
সে ছেলেটির পাশে এসে বসল। আবছা একটা নীলাভ আলো ঘরময় ছেয়ে আছে। সে আলোতে ছেলেটার মুখ আশ্চর্যরকম নিষ্পাপ দেখাচ্ছে।
আগামীকাল এই ছেলেটা একটা বড় রকমের কষ্ট পেতে যাচ্ছে, ছায়া মানুষটা সেটা তাকে জানিয়ে দিতে চায়। ছেলেটা বুঝতে পারবে কিনা কে জানে, যে কাজটা সে করতে যাচ্ছে, সেটা হবে তার সমস্যার সূচনা। একজন অমানুষকে বিশ্বাস করতে যাচ্ছে সে। এটা যদি তাকে আগেই জানানো যায় তো চমৎকার হয়।
'কিন্তু.......' নিঃশ্বাস ফেলে ছায়া মানুষ আবার ভাবে আমি তো একে ডাকতেই পারব না। ডাকলেও শুনতে পাবে না। অধিকাংশ মানুষই পায় না। এদের বোধ খুব কম। তবু ডেকে দেখা যাক।
ছায়া মানুষ ছেলেটির চুলে হাত রাখল, নরম ঝলমলে চুল, আরো একবার স্পর্শানুভূতি না থাকায় তার আফসোস হল।
-''এই ছেলে,' সে মৃদু স্বরে ডাকল। তার ডাকে শব্দ হল তবে ছেলেটি শুনতে পেল বলে মনে হল না। সে মুখে একটা মৃদু হাসি নিয়ে পাশ ফিরে শুল, হাত দু'টো মাথার নিচে রেখে।
হয়ত সে কোন সুন্দর স্বপ্ন দেখছে। মুখটা হাসি হাসি হয়ে রয়েছে।
ছায়া মানুষ মুগ্ধ হয়ে আবারও তাকিয়ে রইল। দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে রইল সে...........
ভোর হয়ে আসছে। ছেলেটা হয়ত উঠে যাবে। ছায়া মানুষকেও ফিরতে হবে। কিন্তু আসল কাজটাই তো করা হল না, বলাই হল না ছেলেটাকে। অথচ কথাটা খুবই জরুরী।
''অনেক মানুষ আমাদের কথা শুনতে পায়', নিজেকে যেন স্বান্তনা দিল সে।
'একবার একটা বাচ্চা মেয়ে আমার সাথে কথা বলেছিল, শেষ চেষ্টা করা যাক', ভাবল সে।
ছেলেটার মাথায় হাত রেখে ছায়ামানুষ তার মুখটা একদম ছেলেটার কানের কাছে নিয়ে এল।
'এই ছেলে, এই ছেলে, তুমি মোটেও স্বপ্ন দেখছ না। আমি তোমাকে সাবধান করতে এসেছি। তুমি কালকে ফাঁদে পড়তে যাচ্ছ। একটা ফাঁদ। বুঝলে যাকে তুমি বন্ধু ভাবছ এটা তার কাজ। শুনতে পাচ্ছ? এই বোকা ছেলে.... কোর না, ভুলেও ওকে বি'শ্বাস কোর না, তুমি তো চালাক একটা ছেলে....... এ-ই... আমার কথা মাথায় ঢুকছে কিছু?'
ছেলেটা আবার পাশ ফিরে শুল। তবে এবার আর সে হাসছে না। হাসি মিলিয়ে গেছে।
ছায়া মানুষ প্রাণপণে চাইল যেন ছেলেটা তার কথা শুনতে পায়। একে তো ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে সে.... অথচ ছেলেটা কোনদিন জানবেও না..... ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার। কি আর করা!
ছেলেটার চুলে হাত বুলিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল সে............
পাশ ফিরে শুল ছেলেটা, আবার মুখে হাসি, তবে ছায়া মানুষ এই হাসি দেখতে পেল না।
...............................................................
"আজ অনেকদিন পর ডায়রি লিখতে বসলাম। বেশিক্ষণ লিখব না। সময় নেই। কাজ আছে আজ একটা। লিখছি কারণ আজ মনটা খুব ভালো। খু-উ-ব বেশি ভালো। আজ একটা স্বপ্ন দেখেছি, দারুণ স্বপ্ন। অনেকদিন পর। দেখলাম আমার সেই বন্ধু ছায়াকে। বলেইছি তো আগে। আমি ছোটবেলায় খালি ছায়া ছায়া একটা আজব মানুষকে স্বপ্ন দেখতাম। আমার একটা অংক পরীক্ষার আগে আমি দেখেছিলাম সে আমাকে প্রশ্ন বলে দিচ্ছে। তখন টু-তে পড়ি, গুণ পারতাম না একদমই। আশ্চর্য! ওই গুণটাই পরীক্ষায় এসেছিল। ছায়াটা যদি না বলে দিত তাহলে নির্ঘাত ফেল করতাম। হা হা আমি অংকে একটু বেশি খারাপ ছিলাম।যাই, কাজ আছে।"
................................................................
বেরিয়ে এসে দারুণ ফুরফুরে লাগছে। আহ কাজটা ততটা কঠিন না তাহলে! আমি আমার পথেই চেষ্টা করব। হঠাৎ করে কি মনে হল, সব পন্ড করে দিলাম।
ঠিক করলাম কি? ওরা আর আমাকে কখনোই বিশ্বাস করবে না হয়ত, আমার দুর্নামও হবে হয়ত।
হোক, আমি শুধু আমার মনের কথাটা শুনেছি। মন বলছিল- কাজটা ঠিক হচ্ছে না। ভুল হচ্ছে। মনে হচ্ছিল কে যেন আমাকে আগেই বলে দিয়েছে ওদেরকে বিশ্বাস না করতে । কে বলেছে? কেউ বলেছে নাকি!! কেমন যেন মনে হচ্ছে কেউ একজন কানের কাছে ফিস ফিস করছে, 'তুমি ফাঁদে পড়তে যাচ্ছ... ফাঁদে পড়তে যাচ্ছ...'
হাঁটতে হাঁটতে ছোট একটা লাফ দিয়ে পথের গর্তটা ডিঙিয়ে যেতে যেতে ছেলেটা ভাবে, ধারে কাছে কোন হোটেলে বসে এক কাপ চা খাওয়া যাক। যেটা করা উচিৎ বলে মনে হয়, সেটা না করতে পেরে কখনো এত আনন্দ লাগে না তো! সেলিব্রেট করা যাক ব্যাপারটা!
.....................................................
হাতের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে ছেলেটা ছোট ছোট লাফ দিয়ে খানাখন্দগুলো ডিঙিয়ে যেতে লাগল। তার ঝলমলে চুলে সকালের মিষ্টি রোদ খেলছে তখনো.....