আকাশের মেঘগুলো অদ্ভুত রঙ বদলের খেলায় মেতেছে। লাল থেকে কমলা, তার থেকে হলুদ আবার ধুসর। আমি মেঘের সাথে সাথে হাঁটছিলাম। আকাশটা যেখানে এসে তার সব রঙগুলো একতুলিতে গুলিয়ে ফেলল, সেখানে এসে থমকে গেলাম। মেঘ গর্জন করে বৃষ্টি নামল। ঝুম বৃষ্টি। জনমানবশূন্য পৃথিবীর বুকে অবাধ বৃষ্টি...............
অবাধ্য বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছি। হাতের কাশফুলটা ভিজে চুপসে গেল। লেকের এক কোণায় এসে বসলাম। একী উদাস নির্বাধ বাতাস! আমি চেয়ে রইলাম আমারই অন্তরে। একটা আশ্চর্য ঝর্ণা কুলকুল শব্দে বয়ে যাচ্ছে! এতদিন কোথায় ছিল সব? এইসব আশ্চর্য উদাস দুপুর, সোনার সকাল, মৃদু বিকেল আর স্বপ্নময় রাতগুলোর পর এই কি সেই কাঙ্খিত সময়? সোনার রঙে রাঙা নয়, রৌদ্রতাপে গাঢ় নয়............. কেবলই উদাস সময়। বাতাসের তালে তালে বৃষ্টির নুপূর-নৃত্য। লেকের পানিতে, গাছের পাতায়, মাঠের ঘাসে... এই কি সেই প্রতীক্ষিত বিকেল? বৃষ্টির কান্নায় ভেজা, মেঘের রঙে রাঙা? আমার ঝর্ণাধারাটা আজ বিনা বেদনায় বয়ে চলেছে। পাহাড়ের বুক চেরার বেদনা নেই, এ কেবল আমারই। এই বিকেলের দান। সৃষ্টির তীব্র বেদনার ভয় নেই, জনপদকে গ্রাস করার বুভুক্ষা নেই, এই তো ছিল আমার নিত্যদিনের প্রার্থনা- ব্যথার বুক চিরে বয়ে চলা বেদনাহীন গতি! হৃদয়ে প্রার্থনার সুর ঝংকার দিচ্ছে,
হে প্রভু, এই ব্যথাকে ক্ষমা কর
বয়ে চলতে দাও প্রভু
যতক্ষণ বয়ে চলে সে নিজে
শ্রান্তি যেন না আসে
যেন তার আগে আসে মৃত্যু।
ক্ষমা কর আমাদের
ক্ষমা করতে দাও আমাদের।
শক্তিকে সৌন্দর্য দাও,
সৌন্দর্যকে দাও শক্তি।
হে প্রভু, আমাদের ভালবাস
আমাদের ভালবাসতে দাও,
ভালবাসতে দাও.....................
বৃষ্টির নেশাটা আরো গাঢ় হয়ে উঠছে..... নুপুর পায়ে বৃষ্টিপরীর মৃদু নৃত্য..... ঝর্ণার শব্দ গাঢ় হয়ে উঠছে....... প্রগাঢ় চুম্বনে শ্বেত কাশফুলের আলতো শরীর.......... ঝর্ণাটা সশব্দে বয়ে চলছে............... পাখির গানে মুখর হয়ে উঠছে নির্জন ঝর্ণাটা.......
........................................
সৃষ্টির আদিতে, যেখানে মানুষের পথচলা শুরু, যেখান থেকে মানুষের আকাশ ছোঁয়ার তৃষ্ণা, যেখান থেকে ইউনিকর্ণের পিঠে চেপে আগুনমুখো ড্রাগনকে জয়ের দুর্দম স্পৃহা, যেদিন থেকে এক আত্মা দু'দেহের ফিনিক্সের বিচ্ছেদ......... সেইসব সময় থেকে এক কঠিন পরীক্ষা। অনন্তকাল তৈরীর পরীক্ষা। ছোট্ট সেই ছেলেটা, যার চোখে বিঁধে গিয়েছিল যাদুর আয়নার ছোট্ট একটা ভাঙা টুকরো। যে ভুলে গিয়েছিল তার সব ভালবাসার স্মৃতি। তুষার রাণী তাকে বলেছিল 'অনন্তকাল' বানাতে। অবশেষে যেদিন শীতল তুষার দিয়ে সে বানাল অনন্তকাল শব্দটি, সেদিন তার আত্মা মুক্তি পেল। ব্যথায় তার ছোট্ট বুক টনটনিয়ে উঠল, চোখে নামল অঝোর অশ্রুর ধারা- সেদিন সে মুক্তি পেল। অশ্রুতে ভেসে গেল জাদুর কাচ।
বর্ষায় বিশ্ব চরাচর ঝাপসা হয়ে আসছে.... আমি কাশফুলটা গালে স্পর্শ করাই, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি- আমার অশ্রু না বৃষ্টির ফোঁটা?
বৃষ্টিপরী আর জলপরীদের নাচ........... মনে হচ্ছে, অনন্তকাল ধরে আমার হৃদয়ে এমনি ঝর্ণা বয়ে চলছে....... সেইসব ইউনিকর্ণ-ফিনিক্স-ড্রাগনের সময় থেকেআজকের বিকাল পেরিয়ে আমার শবযাত্রা পেরিয়ে আরো বহুদূর.......
দিগন্তরেখায় দাঁড়িয়ে, রংধনু ছুঁয়ে আকাশের শেষ সীমানায় আজ দাঁড়িয়ে আমি!
অবশেষে আমি অনন্তকাল তৈরি করেছি!!!
.........................
আদি অন্ত সব একাকার হয়ে যাচ্ছে অবিরাম জলধারায়....... জাদুর আয়নার টুকরো ধুয়ে ভেসে গেছে........ আমার প্রার্থনা ধ্বনিত হচ্ছে,
আমাদের ভালবাসতে দাও....... ভালবাসতে দাও..................
অবশেষে............
আমি অনন্তকাল তৈরী করেছি.........................
আমি অনন্তকাল তৈরি করেছি...........................