গেল শূণ্য আটের সেপ্টেম্বরের কোন এক দুপুরে বনানীর নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির গার্লস লাউঞ্জে গিয়েছি আমার দু'ক্লাসের মাঝখানের বিরক্তিকর সময়টা যেমন-তেমনভাবে কাটিয়ে দেবার জন্য। বেশ কয়েকটা ডিভানে অনেকে শুয়ে-বসে আড্ডা দিচ্ছে, কেউ কেউ ড্রেসিং টেবিলের সামনে মেক-আপ বক্স নিয়ে নিজের ওপর একটা প্লাস্টিক প্রলেপ দিচ্ছে তো কেউ দুপুরের চরম ঘ্যানঘ্যানে সিরিয়ালের নিয়মিত ইমোশনে জর্জরিত-বিগলিত আর বাকিরা ওয়াশরুমের সামনে... প্রায় ৯-১০ জনের কিউ। পেছনের দিকে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মাথা নিচু করে। ওকে দেখলাম আলাদা করে তার কারণ ওর আচরণ আর ওর একটু অন্যরকমত্ব! মেয়েটার আঙুলগুলো আরেকটা চেয়ারে এঁটে আছে খুব শক্ত হয়ে, হালকা কাঁপছেও দেখি নিজেকে সামলানোর জন্য! হঠাৎ বুঝতে পারলাম মেয়েটা একজন "মা"। বাকিদের মধ্যে কেউ কেউ ফিসফাস করছে, বা কেউ কেউ মেয়েটার অদ্ভুত ফুলে ওঠা পেটটার দিকে দেখে কোন না কোন মুখরোচক ঘটনা বানিয়ে ফেলছে; এছাড়া সবাই নির্বিকার। যে যাই করুক বা না করুক, কেউ মেয়েটাকে তার খুব অসহায় একটা সময়ে কিউয়ের সামনে যেতে দিচ্ছে না। মেয়েটার নাম জানলাম, "অতসী"। নিজের সিনিওরিটি ফলালাম এবার একটু...ওর হাত ধরে কিউয়ের সামনে গিয়ে ওকে বললাম, "তুমি এর পর যাবে। এখানে যারা আছে তারাও তো একসময় না একসময় তোমার সময়টা পার করবে তাই না? তখন তারা তেমন ট্রিট পাবে যেমন তারা তোমাকে এতোক্ষণ তোমার সাথে করেছে।" অতসী ইতস্তত করছে আর আমি দাড়িয়ে আছি ওয়াশরুমের মেয়েটার বের হবার জন্য। ওকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে ফিরে আসলাম নিজের জায়গায়। কিউয়ের মেয়েগুলো চোখ দিয়েই আমাকে সিদ্ধ করে ফেললো প্রায়!
সেই দিনটার পর আজকে হঠাৎ-ই অতসীর সাথে দেখা হয়ে গেল বসুন্ধরার রাস্তায়। সে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে, "আমাকে মনে আছে ? ঐযে বনানীর গার্লস লাউন্জে ? মনে নাই ? তখন আমি প্রেগন্যান্ট ছিলাম!"
- আরে অতসী!
এরপর দুজন রাস্তায় দাঁড়িয়েই কুশল বিনিময়... "তুমি কোন সেমেস্টার? বিবিএ? কেমন ছিলা এতোদিন? আমরা তো চিনি-ই না দু'জনকে ভাল মতো! বলোতো তোমার ডিটেইলস্..." এসব বলতে বলতে বের হলো আমাদের বাসাও বেশ কাছাকাছি। একসাথেই একটা সিএনজিতে উঠলাম । অতসী হঠাৎ-ই বলে উঠলো "আমার মেয়েটাকে দেখবা?" বলে আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই একটা এ্যালবাম বের করে ফেললো সে। ফর্সা, গোলগাল পুতুল-পুতুল একটা বাবু ছবি থেকে আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে...আমি খুব চমকে গিয়ে বললাম, "এতো সুন্দর মেয়েটা তোমার অতসী!!!" এরপর এ্যালবাম উল্টে অবাক হয়ে গেলাম... একটা ছবিতে শুধুই ওর বাবুর পা দু'টা, একটাতে শুধুই খুব ছোট্ট হাতের কোঁকড়ানো আঙুলগুলো, একটাতে সিল্ক নরম গোলগোল চুল তো আরেকটা ছবিতে বাবুর ঘুমিয়ে থাকার সময়ের একটু বেঁকে যাওয়া হাসি! আমার এ্যলবাম উল্টে যাওয়ার সাথে সাথে মুগ্ধতা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে!
অতসী- ঝড়, আজকে কিছু কথা বলি তোমাকে?
- তো বলো না!
- আমার বাবুটাকে দেখেছো, আমি যে এতো কম বয়সে এমন কাজ করেছি সেটা নিয়ে প্রশ্ন কেন করোনি ?
- আমি কারো পার্সোনাল ব্যপার জানতে চাই না, অতসী। তোমাকে একদম-ই চিনি না আমি। আর নর্থ-সাউথে অনেক মেয়ের ব্যপারেই অনেক কিছু শুনেছি। তোমাকে বিব্রত করতে চাই নি। তাছাড়া আমার কাছে একজন মা-কে কেন যেন খুব স্পেশাল লাগে!
- তাহলে আমি আমার কথাগুলো তোমাকে বলবো আজকে, ঝড়!
তারপর অতসী মেয়েটা ওর কাহিনী বলে আমি ওকে একদম না থামিয়ে শুনে যাই...
"ঝড়, আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন এসএসসির আগে আগে। খুব হঠাৎ করে! তিনি আমাদের ফ্যামিলির সবচে' হাসি-খুশি-জীবন্ত একজন ছিলেন। আমি আর বড় ভাই মিলে মাকে কি সান্ত্বনা দিবো, আমরা সবাই মিলে ভেঙে পড়েছিলাম। কারোর-ই কারো পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো শক্তি ছিল না, কারন আমাদের যেকোন দুর্যোগে বাবা পাশে থাকতেন। ঠিক তখন আমার ৬-৭ বছরের বড় সাব্বিরের সান্নিধ্যটা পেয়েছিলাম। ছেলেটা আমার ছোটবেলার খেলাধূলার বন্ধু। আমাকেই না, আমার মা-ভাইকেও ও সাপোর্ট দিয়েছে সেসময়টায়। আমি একটা কালো কুচকুচে পৃথিবী থেকে ওর হাত ধরে বেড়িয়ে এসেছিলাম। হয়তো এসএসসিতে বসতে পেরেছিলাম শুধু ওর জন্যই! ও আমার সাথে প্রতিটা মুহুর্ত ছিল মানসিকভাবে। যখন দরকার তখন ওকে পেয়েছি আমি পাশে। তারপরের ৭-৮ বছর আমি বা ও দু'জন-ই দু'জনকে ছাড়া চলতে পারতাম না। শুনতে খুব ড্রামাটিক লাগছে জানি, কিন্তু এটা ইমোশনালি বলছি না। আমার প্রেশার লো হয়ে যেত ওকে না পেলে বেশিক্ষণ!"
"২০০৭। আমার ভার্সিটির থার্ড ইয়ারে সাব্বিরের মা-বাবা ওকে বিয়ের জন্য বেশ জোড়াজোড়ি করায় আমরা দু'জন কিছু চিন্তা না করেই বিয়ে করে ফেলি। আমার গ্রাজুয়েশনের আগে বিয়ের চিন্তা না থাকলেও, সাব্বিরের জন্য আমি সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করি নি। আর সেজন্য আমার কোন অনুশোচনাও ছিল না। এরপর আমি কনসিভ করলাম। ঠিক তার প্রায় কয়েকমাস কেটে যাওয়ার পর আমি বুঝলাম আমি একটা বিশাল ভুল করে ফেলেছি। আমার ভার্সিটির প্রচন্ড প্রেশার। আর এক বছরের মধ্যই আমার গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে যাবে। এই কঠিন সময়ে প্রেগন্যান্সির এই বিরাট ঝামেলা নেয়া সম্ভব-ই না। আমার পেটটার দিকে তাকালে নিজের কাছেই অস্বস্তি লাগতো খুব। ভার্সিটিতেও সবাই ফিসফাস করতো, কেউ বা উল্টাপাল্টা গুজব রটিয়ে দিতো। আর আমি খুব অসুস্থ-ও হয়ে গিয়েছিলাম। সাব্বিরকে দেখতাম সারাক্ষণ অপরাধীর মতো ঘোরাফেরা করতো আমার চারপাশে। আমি ভেবে ফেললাম এ্যাবোর্ট করবো ওটাকে। সাব্বির আর আমি এক ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার আমাদের সব কথা শুনে কিছু না বলেই উনার স্টেথোস্কোপটা এনে আমার কানে দিলেন। তারপর আলতো করে আমার বেশ ফুলে ওঠা পেটের ওপর রাখলেন সাউন্ড রিসিভারটা। বিশ্বাস করবা না, ঝড়! আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম আমার বাচ্চাটার হার্ট কি ভীষণভাবে ধুকপুক করছে! জানো, আমি মাঝে মাঝে রাতে প্রচন্ড ভয় পেয়ে জেগে উঠি, আমার মনে হয় আমাকে কেউ মেরে ফেলতে আসছে, তখন আমার হার্টটা ঠিক এমন জোড়ে জোড়ে ধুকপুকিয়ে ওঠে! আর আমি-ই আমার মেয়েটার হার্টকে শুনতে পাই নি এতোদিন! মেয়েটা আমার প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল! আমি কিচ্ছু না বলে কাঁপতে কাঁপতে রিসিভারটা নিয়ে সাব্বিরের কানে দিলাম। আমার দেখা প্রচন্ড শক্ত মানুষ সাব্বির আমাকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো, "অতসী! আমরা আমাদের মেয়েটাকে মেরে ফেলবো ?" আমার পৃথিবী এলোমেলো-লন্ডভন্ড হয়ে গেল! আমি শক্ত গলায় বললাম, "সাব্বির, আমার মেয়ের নাম কি রাখবো?" সেদিন সারাদিন সাব্বির আমাকে জড়িয়ে ছিল! আমার জীবনের সবচে' অসাধারণ দিন, ঝড়!"
আমি দেখলাম মেয়েটার চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়ছে! ও মনে হয় বুঝতেই পারে নি! সে ব্যাগ থেকে নীলচে একটা কাপড় বের করে একটু পর পর সেটায় নাক-মুখ ডুবিয়ে রাখে...আমি প্রশ্ন প্রশ্ন চোখে বললাম, "এটা কি?"
- আমার বাবুর জামা! কি যে সুন্দর ওর গন্ধ! শুঁকে দেখো!
আমি হালকা বেবী পাওডারের গন্ধ ছাড়া কিছুই বুঝলাম না! ওকে বললাম, "আসলেই কি অদ্ভুত মিষ্টি একটা গন্ধ!" অতসী ঝলমল করে উঠলো!
"আমার মেয়েটার এখন ছয় মাস। সে-ই সকালে মেয়েটাকে রেখে আসি! জানো ঝড়? ও সবকিছু বুঝে! আমি সকালে আসলে ওর মুখটা একটু বাঁকা হয়ে যায়। আবার সন্ধ্যায় ফিরলে ঝকমক করে জ্বলতে থাকে ওর মুখটা! সাব্বির-ও ওকে ছাড়া থাকতে পারে না! অফিস বাদ দিয়ে বসে থাকে ওর কাছে! জানো? আমার প্রেগন্যান্সির সময়টা সেদিন ঐ ডাক্তার পাল্টে দিয়েছিলেন। তাঁর কাছে আমি অনেক ঋণী! আমি তখন কেমন যেন অহংকারী হয়ে গিয়েছিলাম, ঝড়! আমার মনে হতো আমার আশে-পাশের কেউ আমার মতো অসাধারণ অবস্থায় নেই! আমার ভেতরে আমার মেয়ে আছে! আমি কখনোই একা না। আমি মেয়েটার সাথে কথা বলতাম। ওর নড়া-চড়া টের পেতাম। একটা স্টেথো কিনে ওর হার্টবিট শুনতাম! মেয়েটা আমার আর ভয় পায় নি! আগে যে পেটটা নিয়ে অস্বস্তি লাগতো সেটা দেখলে আমার বরং আনন্দে চারদিক ভেসে যেতো! ভার্সিটির আশে-পাশের মানুষের গুজব বা ফিসফাস কানেই আসতো না! সবকিছু ছাপিয়ে আমার মেয়েটার হার্টবিট শুনতাম আমি!..."
আমি অবাক হয়ে একজন মা-কে দেখছি... ক্রমাগত কাঁদছে মেয়েটা আর ওর দু'হাতে জমিয়ে রাখা এক টুকরো নীলচে আকাশ বোধহয় ওর চোখের পানিতেই নীল থেকে আরো নীল হয়ে যাচ্ছে !!!
------------------------------------------------------------------------------------
ঝড়লিপি I
ঝড়লিপি II
ঝড়লিপি III
ঝড়লিপি IIII
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:৪১