আগের পর্বঃ ঘুম মনেস্ট্রি হয়ে রক গার্ডেন (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৬)
রক গার্ডেন থেকে দার্জিলিং এ আমাদের ‘হোটেল মেঘমা’য় ফিরে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে দশটা নাগাদ আবার বের হয়ে এলাম হোটেল থেকে সারা দিনব্যাপী ভ্রমণের উদ্দেশ্যে, কিন্তু ততক্ষণে আবার আকাশের গোমড়া মুখের দেখা মিললো। এরই মাঝে এগিয়ে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য দার্জিলিং এর “পিস প্যাগোডা”র উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি’তে পারমানবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ এবং এতে প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি’র পর বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখে জাপানের বৌদ্ধ ভিক্ষু নিচিদাতসু ফুজি’র নেতৃত্বে নির্মিত হয়েছিল সর্বপ্রথম। ১৯৪৭ সালে সর্বপ্রথম পিস প্যাগোডা নির্মান শুরু হয়ে এবং ১৯৫৪ সালে জামানের কুমোমোটোতে প্রথম পিস প্যাগোডা উদ্বোধন হয়। পরবর্তীতে হিরোশিমা, নাগাসাকি সহ জাপানের অন্যান্য শহরগুলোতেও পিস প্যাগোডা নির্মিত হয় এবং ধারাবাহিকতায় তা পরবর্তীতে এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকা মহাদেশের নানান জায়গায় এর অনুকরণে পিস প্যাগোডা নির্মিত হয়। বর্তমানে সারা বিশ্বে শতাধিক পিস প্যাগোডা রয়েছে। বাংলাদেশে একমাত্র পিস প্যাগোডাটির নাম “ওয়ার্ল্ড পিস প্যাগোডা আনালায়ো” যা কুমিল্লার শালবন বিহার প্রাঙ্গণে অবস্থিত। ভারতের দার্জিলিং এর বাইরে দিল্লী, লাদাখ, উড়িষ্যায় সহ মোট ০৭টি পিস প্যাগোডা রয়েছে। নেপালের পোখারা বেড়াতে যারা গিয়েছেন, প্রায় তাদের সকলেই পাহাড়ের উপরে অবস্থিত পোখারার উজ্জ্বল সাদা পিস প্যাগোডাটি দেখেছেন।
Hanaokayama Peace Pagoda - জাপানের প্রথম পিস প্যাগোডা
কুমিল্লা আনালোয়া পিস প্যাগোডা
উপরের প্রথম ছবিটির পরবর্তী চারটি উইকিমিডিয়া হতে নেয়া
নিচিদাতসু ফুজি ছিলেন একজন জাপানী বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বৌদ্ধ ধর্মের নিপ্পানজান-মায়াজি আদেশের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯১৭ সালে তিনি মনছুরিয়ায় তার মিশনারি কার্যক্রম শুরু করেন এবং ১৯৩৩ সালের গ্রেট ক্যান্টো ভূমিকম্পের সময় তিনি জাপানে ফিরে যান। ১৯৩৩ সালে তিনি ভারতের বরদা (ভারদা হিন্দি উচ্চারণে) এসে মহাত্মা গান্ধীর সাথে দেখা করেন এবং একসাথে অহিংসা আর শান্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে কাজ করতে সিদ্ধান্ত নেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজের বিপদ হতে পারে জেনেও তিনি নিজ দেশে শান্তির পক্ষে সক্রিয়ভাবে সোচ্চার ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ তার মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে এবং তিনি এরই জের ধরে পরবর্তীতে তার শান্তি কার্যক্রম আরো জোরালো করেন এবং এরই ফলস্বরূপ সারা বিশ্বে এই পিস প্যাগোডা নির্মানের কার্যক্রমের সূত্রপাত ঘটে।
আমাদের সেবারের ট্যুরটির টাইটেলই ছিলো “দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন”, তাই হয়তো মেঘ আর বৃষ্টি পুরো ট্যুরেই আমাদের পিছু ছাড়ে নাই। আমরা যখন দার্জিলিং এর পিস প্যাগোডায় পৌঁছলাম, তখন চারিদিক ঘন মেঘ আর কুয়াশায় ঢেকে গেছে। কাছ হতে দাঁড়িয়েও পিস প্যাগোডার পরিস্কার ছবি পাওয়া যায় নাই। সেখানে আমরা নিজেদের মত করে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। অনেকেই পিস প্যাগোডা’কে বৌদ্ধদের তীর্থস্থান মনে করলেও এটি মূলত বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার সন্ধানে সকল জাতি ও ধর্মের লোকদের একত্রিত করতে ডিজাইন করা হয়েছে, যার মূল মন্ত্র “বিশ্ব শান্তি”।
দার্জিলিং এর পিস প্যাগোডাটির ভিত্তিপ্রস্তর ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে হলেও এর নির্মান শুরু হয় আরো অনেক বছর পরে। ১৯৯০ এর শুরুতে এর নির্মান কাজ শুরু হয়ে ৩৬ মাস এ সম্পন্ন হয় এবং ১৯৯২ সালের ০১ নভেম্বর এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় । এই প্যাগোডার উচ্চতা ৯৪ ফুট এবং প্রস্থে প্রায় ৭৫ ফুট। দার্জিলিং শহরের ভেতরেই ‘জালাপাহাড়’এ অবস্থিত এই প্যাগোডা আমাদের হোটেল থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে ছিলো।
মানবতা এবং বিশ্ব শান্তিতে অহিংসার প্রতীক এই প্যাগোডায় প্রবেশের মুখে রয়েছে রাজকীয় সিংহের ভাস্কর্য। এখানে প্যাগোডার পাশেই রয়েছে একটি বৌদ্ধ মন্দির; এখানে বৌদ্ধের মূর্তির ছাড়াও নিচিদাতসু ফুজির ছবি রয়েছে। কাঠের সিঁড়ির পথে চলে গেছে প্রার্থনা হলের দিকে যেখানে ভোর ৪টা থেকে সকাল ৬টা এবং বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যে ৬:৩০টা পর্যন্ত চলে প্রার্থনা। এই মন্দির আর প্যাগোডা পর্যটকদের জন্য সেই ভোর ৪টা থেকে সন্ধ্যে ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে এবং এখানে প্রবেশ করার জন্য টাকা দিয়ে কোন টিকেট কাটতে হয় না।
প্যাগোডার ভেতরে গৌতম বুদ্ধের চার আসনের মূর্তি দেখতে পাবেন, 'উপবিষ্ট, দন্ডায়মান, শায়িত এবং ধ্যানস্থ'। এখানে নানান শিল্পকর্ম রয়েছে যেগুলোতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গৌতম বুদ্ধের জীবন কাহিনী। বৌদ্ধ পূর্ণিমায় এই পিস প্যাগোডা সংলগ্ন মন্দিরে উৎসবমুখর পরিবেশে বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম এই শুভ দিনটি উদযাপন করা হয়। আমরা ঘন মেঘ আর কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা পিস প্যাগোডা তেমন ভালো মত দেখতে না পারলেও মন্দিরের ভেতরে ঢুঁকে গেল আমাদের দলের কয়েকজন। তারা সেখানে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে, ছবি তুলে বের হলে আমরা সবাই রওনা দিলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য দার্জিলিং চিড়িয়াখানা এবং হিমালায়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনিস্টিটিউট এর উদ্দেশ্যে।
ভ্রমণকালঃ জুলাই ২০১৬
এই ভ্রমণ সিরিজের আগের পর্বগুলোঃ
উদ্ভট যাত্রার আগের গল্প (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০১)
যাত্রা হল শুরু; রক্ষে করো গুরু (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০২)
দার্জিলিং মেইল এর যাত্রা শেষে মিরিকের পথে (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৩)
মিরিকের জলে কায়ার ছায়া (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৪)
কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা টাইগার হিল হতে বাতাসিয়া লুপ (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৫)
ঘুম মনেস্ট্রি হয়ে রক গার্ডেন (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৬)
এক পোস্টে ভারত ভ্রমণের সকল পোস্টঃ বোকা মানুষের ভারত ভ্রমণ এর গল্পকথা
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩৫