somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবন, সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ ও বাবার গল্প

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১০ সকাল ১০:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার বাবাকে নিয়ে সম্ভবত এটাই আমার প্রথম লেখা। এর আগে কিছু লিখেছি কিনা মনে পড়ছেনা। ভীষন আত্মপ্রত্যয়ী, বিনয়ী ও সাহসী একজন মানুষ। সারাটা জীবন যার কেটে যাচ্ছে জ্ঞান সাধনা আর বইয়ের পিছনে। বই পোকা এই মানুষটিই আমার বাবা। খুব কাছের একজন বন্ধু। আমার চলার পথে প্রতিটিক্ষন যিনি আমাকে সত্য সাহস আর অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন।

বাবার জন্ম বাংলা ১৩৫২ সনের ২৮ চৈত্র/১১ এপ্রিল ১৯৪৬ ইং। ব্রিটিশ শাসনের চিহ্ন তখনও মুছে যায়নি । হয়ে গেলো বাংলা বিভক্তি। আমার দাদা তখন পুঁথির আসর বসাতেন বাড়ীর উঠোন জুড়ে। সারা গায়ের লোক বাহ্বা দিত । কি সুন্দর ও করুন ছিল সেই পুথির সুর। তাছাড়া সংগৃহীত পুথির মধ্যে ছিল-নূর পরিচয়, শুনাভানের পুঁথি, গাজীকালু, কড়িনামা, সফরমুল্লুক, জঙ্গনামা, হরিণনামা, মহব্বতনামা, হাশর মিছিল, ছয়ফুল বেদাত, সাত কইন্যার বাখান ইত্যাদি। সিলেটি 'ভেদকায়া' পুথির সূচনা পর্বের কিছু অংশ তুলে ধরছি-। নাগরী ভাষায় রচিত 'ভেদকায়া' রচয়িতা ছিলেন শাহ ছুফি আবদুল ওহাব চউধুরী।

পরথমে সরন করি আল্লা নিরনজন
কায়াতে চেতন কইলে ভরিয়া পবন।।
বিন্দু জলে বান্দিলে কেমন পুতলা
মাটির ঘরে রুহ ভরি করিলে উজালা।।
অন্ধকার ভাংগিল চক্খু দান দিয়া
এ ভবের রংগ দেখি চক্খু দান পাইয়া।।
করনও দিল ধনি সব সুনিবার
জবান দান র্ছিজি দিল মজা বুঝিবার।।
আরওত ছিফাত আল্লার জবানের মাঝার
জবানে আর দিলে হয় জিকির আল্লার।।

তখন আইয়ূব শাসন ক্ষমতায়- বাবা তখন বড় হচ্ছেন ধীরে ধীরে। প্রাইমারী স্কুলের সীমানা পেড়িয়ে বাবা ভর্তি হয়েছিলেন বারহাট্রা সি কে পি হাই স্কুলে। পারিবারিক কারনে পরিবর্তন করতে হয়েছিল এই স্কুল। ভর্তি হন ময়মনসিংহ মহকুমার অন্তর্গত নেত্রকোনা আটপাড়ার বানিয়াজান সিটি হাইস্কুলে। বাবার কষ্ট গুলো বাড়তে লাগলো- পুরনো বন্ধুদের ছেড়ে আসার কারনে। বাবার এক ক্লাশ উপরেই পড়তেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। তখনও তিনি পুরোদস্তর কবি হয়ে উঠেননি। ব্রিটিশের ঢামাঢোল শেষ হতে হতে প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খানের “মৌলিক গনতন্ত্রের” মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠছিল বাবার শৈশব ও কৈশোর। মৌলিক গনতন্ত্র মানুষ ভালো ভাবে নেয়নি । পরাধীনতার শিকল থাকলেও ছিল সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার অনেক বড় বড় ক্ষেত্র। ১৯৬৮ সালের দিকে বাবা প্রেসিডেন্টের কাছে থেকে পেয়ে গেলেন পূর্ব পাকিস্তানের সেরা পুরস্কার “উন্নয়ন দশক” রচনাকর্মের জন্য।
তিনি “প্রভূ নয় বন্ধু” নামের একটা স্বরচিত বইও উপহার দিয়েছিলেন বাবাকে।

বাবা তখন পুরোদস্তর লেখক। পুরো শিশুতোষ লেখার পটু বাবার লেখা ছাপা হতে থাকে সেই সময়কার বিভিন পত্র-পত্রিকায়। পরিচয় হতে থাকে নেত্রকোনার বিখ্যাত সাহিত্যিকগনের সাথে। কবি রওশন ইজদানী, খান মোহাম্মদ আব্দুল হেকিম,ওস্তাদ জালাল উদ্দিন খাঁ, কবি খালেকদাদ চৌধুরী, আলী উছমান সিদ্দিকী (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সিদ্দিক প্রেসের মালিক), জনাব মুশফিকুর রহমান এসডিত্ত প্রমূখ। উত্তর আকাশ পত্রিকা ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নেত্রকোনার একমাত্র সাহিত্য সাময়িকীর মূখপাত্র। বাবা এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন কবি খালেকদাদ চৌধুরী ছিলেন তার প্রেরনার বড় উৎস। বাবার লেখা ছাপা হতে থাকে সমকালীন পত্রিকা মাহেনও, সওগাতসহ, নবারুন, কচিকাঁচা, সবুজপাতা, মুকুল পত্রিকার মতো শিশুতোষ বিভাগের পাতায়।
আমি তখন খুব ছোট ; বাবার লেখা একটা শিশুতোষ ছড়া মনে পড়ে-
"ইতলে ভূত, বিতলে ভূত, মামদো ভূত তিনে,
ঝগড়া করবে ঠিক করলো মঙ্গলবারের দিনে।
শক্তি তারা করবে পরখ কাহার কতখানি,
মালকোচাতে সাজলো তাই করতে হানাহানি।
প্রথমেতে ইতলে-বিতলে যুঝলো কতক্ষণ,
জখম হয়ে ভীষণভাবে, ভাঙলো নাকো রণ।

অবশেষে ইতলে-বিতলে ক্লান্ত হয়ে হায়,
কোমর ভেঙ্গে পড়লো তারা ভীষন মুর্ছায়।
মুর্ছা তাদের ভাঙ্গে নাকো কোনকালেই আর,
এসব দেখে মামদো ভূতে কান্না করে সার।

কান্না শুনে ধেয়ে আসে আন্দা ছান্দা ভূত,
লেংটিতে সে বেঁধে আনে লক্ষ ভূতের পুত।
ভূতের দলে এসে সবাই জাগিয়ে তোলে রোল,
পথে-ঘাটে বন-বাদাড়ে ভূতের গণ্ডগোল।

বাবার লেখা অসংখ্য ছড়া কবিতা ছড়িয়ে আছে সেই সব পুরনো পত্রিকায়। সংগৃহীত সাময়ীকি, পত্র-পত্রিকাগুলো এখন বাবার প্রতিষ্ঠিত শুনই প্রগতি পাঠাগারকে সমৃদ্ধ করেছে।

আমাদের গ্রামে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পাঠাগার। আমার গ্রামের নামেই পাঠাগারটির নাম ‘শুনই প্রগতি পাঠাগার’। বর্তমানে সংগৃহীত বইয়ের সংখ্যা দুই হাজারের মতো। সেটার রক্ষণাবেক্ষন করেন আমার বাবা-মা। এই পাঠাগারটি এখন সবার জন্য উন্মুক্ত। আমাদের পরিবারের সদস্যদের বাইরেও অনেক মানুষ সেখান থেকে বই নিয়ে পড়ে।

অজপাড়া গা একটি গ্রাম।
যেখানে বিদ্যুতের আলো এখনো পৌঁছায়নি। গায়ের পথ ধরে হাটলে অনেক সবুজের সমারোহ চোখে পড়বে। কাদা মাটির পথ পেরোলেই সেই আলোর রাজ্য। নেত্রকোনা জেলা থেকে ২০ কিলোমিটার পূবে আটপাড়া থানাধীন ‘শুনই’ গ্রাম। আটপাড়া থানা থেকে আড়াই কিলো পাকা রাস্তা পেরিয়ে আধা কিলো কাচা রাস্তা, তারপর আমাদের গ্রাম। আমাদের গ্রামে যেখানে সৃজনশীল ও মননশীল বিনোদনের অন্যকোন মাধ্যম নেই সেখানে আমার বাবার পাঠাগারটি এখন পাঠকদের কাছে একটি ভালোবাসার জায়গায় পরিণত হয়েছে।

১৯৯৭-২০০৫; এই সময়টা ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালীন একটা গুরুত্বপূর্ন সময়। বাড়ী ছেড়ে আমি অনেক দূরে। বাবা-মা ভাই-বোন সবার জন্য মন খারাপ হতো প্রতিদিন। বিশ্ববিদ্যালয় হলে অনেক বন্ধু পেলাম তবুও একটা শূন্যতা কাজ করতো সারাক্ষন। সেই শূন্যতার মাঝে বাবাই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু।


১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে মৌলবাদীদের নামকরণ বিরোধী আন্দোলনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পুরো আট মাসের জন্য বন্ধ হয়ে গেল - খুব হতাশ হলাম। অনেক আন্দোলন, মানববন্ধন করলাম আমরা। লেখক হুমায়ুন আহমেদ ও জাফর ইকবাল স্যারও আমাদের সাথেই ছিলেন প্রতিনিয়ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে আমরা খবরের কাগজ বিছিয়ে সেখানে বসে অনশন করে প্রতীকি প্রতিবাদ করেছি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার জন্য, বিশ্ববিদ্যালয়তো রাজনীতির খেলার মাঠ নয়। বাবার লাঙ্গলের ফলা থেকে উঠে আসা কষ্ঠার্জিত টাকা খরচ করে এখানে পড়তে এসেছি। আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের কষ্ঠটা উপলব্দি করতেন বলেই আমাদের পাশে এসে দাড়িয়েছেন। তাই স্যাররাও আমাদের সাথে ছিলেন প্রতিনিয়ত। কথা বলেছেন, সাহস জুগিয়েছেন এবং অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। আমাদের মাঝে যখন বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদে যোগ দিলেন, আমরা একটু ভরসা পেলাম। স্যারের সাথে অনেক কথা হতো আমাদের সেই খারাপ সময়গুলোতে। আমাদের জীবন থেকে যে মূল্যবান সময় গুলো হারিয়ে যাচ্ছে, তার ক্ষতিপূরন কে দেবে? দিনের পর দিন আমরা সত্যি সত্যি হতাশ হচ্ছিলাম। ক্লাশ নেই, পরীক্ষা নেই। হল ছেড়ে দেয়ার নোটিশ পাঠিয়েছে কতৃপক্ষ। তখন মোবাইল ফোনে বিল বেশী ছিল বলে আমি বাবাকে চিঠি লিখতাম। বাবাও আমাকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন। এক একটা চিঠির মমার্থ আমাকে খুব নাড়া দিত। বাবার চিঠিতে জীবন, দশর্ন, সাহিত্য, বাস্তবতা, উপদেশ সব কিছই লুকিয়ে থাকতো, এই চিঠি গুলো সংকলন করলে একটা চমৎকার পত্র সাহিত্যে রূপ নেবে।

৭১-এ যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো।
বড় চাচা চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে প্রশিক্ষন নিতে। বাবা একা হয়ে পড়লেন। আমার দাদাকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং বেঁধে রেখে নির্যাতন করা হয়েছিল। আমার মা তখন তাঁর গর্ভে ধারন করে বয়ে চলেছেন আমার বড় বোনকে। সেই কষ্টের দিনে শীতের কুয়াশায়- ভোরে আমার গর্ভবতী মাকে নিয়ে বাবার গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল পাক হানাদার বাহিনীদের জন্য। তারা সত্যি সত্যি মেরে ফেলতো সবাইকে। সংবাদ চলে গিয়ে ছিল এই পরিবারের এক জোয়ান মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে প্রশিক্ষন নিতে গিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ্রহণের জন্য। তখন আমন ধানের চাষ হতো ব্যাপক, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আমনচালের ঝাউ রান্না শেষ করে
লম্বা শীষওয়ালা ধানের ক্ষেত পেরিয়ে বাবা-মা পৌঁছে ছিলেন অন্য গায়ে। ধান শীষের আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিলো সেদিন আমার মায়ের পা।

যুদ্ধের ভয়াবহতা বেড়েই চলছিল দিনের পর দিন।
রাজাকাররা আমার দাদাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু আমাদের গ্রামের বাড়ীতে চলেছিল ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটপাট। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিলো ধানের গোলায়, উঠোনে কেটে রাখা ধানের স্তুপে। দাদী সেই গুলির খোলস বাঁশের টুকরীতে জড়ো করে রেখেছিলেন-আর বিলাপ করতেন সময়ে অসময়ে। সেদিন পাশের বাড়ীর লাল মিয়া কাকা গুলিতে আহত হন। মাকে নিয়ে বাবা চলে যান মোহনগঞ্জে আমার বড় খালার বাড়ীতে। সেখানে পনের দিন থাকার পর জানা গেল আটপাড়ার অবস্থা ভালো। অনেক পাক আর্মি ও রাজাকার মারা গেছে। আটপাড়া থানার বেল গাছের নিচে মেরে পুতে রেখেছে এইসব জানোয়ারদের। বাবা ফিরলেন বাড়ীতে। মা আবার গুছাতে শুরু করলেন সংসার.......।

যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে মা মাছ খাওয়া ছেড়ে দিলেন। বিলে-ঝিলে, নদীতে তখন সর্বত্রই মানুষের লাশ। নদীর কিনারে আটকে থাকা ভেসে আসা মানুষের লাশ বাঁশের লগি দিয়ে প্রতিদিন ভাসিয়ে দিতেন আমার দাদা। কার স্বজন ওরা কেউ জানে না- এখনো জানে না


বাবার সাথে চমৎকার একটি ছবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে লেখালেখি নিয়ে কথাবার্তা। সময়কাল ২০১২।

বাবার লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্হ "জীবনবৃত্তে" স্মৃতিচারণ করেছেন যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা, সেখান থেকে কিছু উদ্ধৃত করছি-

------"আরেকটা গল্প বলি। এটা আসলে গল্প নয়, সত্যি কথা।
সময়টা ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের খেলার মাঠের পাশে যেখানে পাক-হানাদার বাহিনী একাত্তুরে চালিয়েছিল নৃশংস হত্যাকান্ড। আর আর সেখানে জন্ম হয়েছিল একটি নতুন কবিতারও। কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখছিলেন একটি অসাধারন কবিতা "জগন্নাথ হল: সাতাশে মার্চ একাত্তর"।

২৪মার্চ ২০১২।
আমার বই প্রকাশনার কাজে আমি তখন নেত্রকোনা থেকে এসেছি ঢাকায়। দেখা হলো গুণের সাথে সেই বধ্যভূমির পাশে।
মনের জানালায় ভেসে উঠতে লাগলো সেই একাত্তুরের দু:সহ স্মৃতি। কত লাশ, কত ঘর হারা মানুষ। মা ও আমার অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে দৌড়াচ্ছি অজানা এক গন্তব্যে। বাবাকে রাজাকাররা বেধে রেখেছে। ছোটভাই শামছুর রহমান তখন যুদ্ধের প্রশিক্ষন ক্যাম্পে। বাবা যখন ছাড়া পেলেন। বাড়ীতে তখন উঠোনের কাটা ধানের মাচায় দেখতে পেলেন অসংখ্য গুলির খোসা। চালের মটকা গুলো খালি। আমার পাশের বাড়ির প্রতিবেশী ভাই লাল মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে কাতরানোর সুর। বাড়ির পূব পাশে লালচান্দের বাজারে পাশ দিয়ে বয়ে চলা "বিষনাই" নদীতে আটকে আছে অসংখ্য নারী-পুরুষের লাশ। আমার বাবা নৌকার লগি দিয়ে ভাসিয়ে দিতেন এই সব লাশ।

অনেকদিন পর বধ্যভূমির পাশেই কবির কন্ঠে রেকর্ডিং হলো সেই সময়ের কথা গুলো। বাংলাদেশী একটি স্যাটেলাইট টিভি এই অনুষ্ঠানটি সম্প্র্চার করে। ভয়াবহ সময়ের কবিতার কিছু ছবির কিঞ্চিত অংশ এখানে তুলে ধরছি।

জগন্নাথ হল: সাতাশে মার্চ একাত্তর
মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য কার্ফ্যু তুলে দেয়া হলো,
দেড় দিন দেড় রাত্রি গৃহবন্দী থেকে আমরা দু'জন
নগরীর রুপ দেখতে বাইরে বেরুলাম।
আজিমপুর মোড়ে বেয়নেটবিদ্ধ এক তরুনের লাশ
স্বাগত জানালো আমাদের। তারপর বৃদ্ধ একজন।
অগ্নিদগ্ধ মর্টার বিদ্ধস্ত এই প্রাচ্য নগরীকে
মনে হলো প্রান স্পন্দনহীন এক মৃত প্রেতপুরী।
অপসৃত অদম্য প্রানের গর্ব, ডানে বাঁয়ে
সর্বএ মৃত্যুর হাতছানি। যুবতী কন্যাকে নিয়ে
পালাচ্ছেন পিতা, মা'র কোলে দুগ্ধপোষ্য শিশু।
প্রিয়জনের খোঁজে উদ্বিগ্ন মানুষ ছুটছে সতর্ক,
যেমন সন্ত্রাসবিদ্ধ বনের হরিন ক্ষিপ্ত নেকড়ের তাড়া খেয়ে ছুটে ।"

আমার বাবা ছেলেবেলা থেকেই বাবা কাপড়ের ব্যবসা করতেন। নেত্রকোনার হরেন্দ্র- ধীরেন্দ্র সাহার কাপড়ের দোকান হতেই বাবা তার দোকানের মালা-মাল আনতেন। প্রতি সপ্তাহেই প্রায় নেত্রকোনা যেতেন। বাবার সাথে আমিও মাঝে মাঝে নেত্রকোনা যেতাম।

একদিনের কথা মনে আছে আমাদেও পাশের বাড়ীর কদর আলী মামা, বাবা ও আমি নেত্রকোনা যাই। তখন শীতকাল। শীতের কাপড় কিনব। শহরে যেয়ে জানতে পারলাম যে অনেক জায়গাতে কলেরা ডায়রীয়ার প্রাদূর্ভাব। বাবার কাপড় কেনা হলে, সুমন্ত বাবু নামে দোকানের এক পরিচালকি কছু কমলা ও ফল-মূল কিনে এনে আমাদের দিয়ে বলেন, শহরে কোন হোটেলে কোনকিছু খাবেননা। আমরা কিছুনা খেয়েই তাড়াতাড়ি শহর থেকে বের হয়ে আসি। বাবার জীবনের অনেক কিছুই আজ ভুলে গেছি। এখন আর মনে করতে পারছিনা।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবাকে দেখেছি সংখ্যালগু হিন্দুদের প্রতি দরদী সহানুভূতিশীল বন্ধুরূপে। অনেক বিপন্ন হিন্দু আপন মালামাল বাবার কাছে গচ্ছিত রেখে তারা সীমান্তের ওপারে চলে যায়। দেশ মুক্ত হলে এসব মাল তাদের ফেরত দিয়ে দেয়া হয়। আমতলার জোগেশ মাষ্টার বাবার কাছে তার এক গাভী রেখে যান। নেত্রকোনার“ সোনালী মেডিকেল হলের মালিক যতীন বাবু লাল রঙের ফিলিপস রেডিও রেখেযান। স্বরমুশিয়া গ্রামের যতীন্দ্র ও আমতলা গ্রামের গোপাল কিছু টাকা হরেন্দ্র - ধীরেন্দ্র সাহার কাছে গচ্ছিত রেখেছিল। যখন নেত্রকোনার সোনালী ব্যাংক লূট হয়ে যায় তখন হরেন্দ্র-ধীরেন্দ্র সাহার কাছে যে টাকা গচ্ছিত ছিল তা” তারা ফেরত দিতে ব্যর্থ হন। তখন তারা যতীন্দ্র ও গোপালকে বলে দেয় ; তোমরা শুনই গ্রামের ইসহাক আলী মিয়ার কাছে যাও তাঁর কাছে আমাদের কিছ টাকা পাওনা আছে। যখন গোপাল ও যতীন্দ্র বাবার কাছে আসে। তখনব বাবা ১৩ টাকা মন দরে ধানবিক্রি করে তাদের টাকা পরিশোধ করে দেন। এই যতীন্দ্র - গোপাল বাবার প্রশংসায় পঞ্চ মুখ ছিলেন।

নেত্রকোনার ছোট বাজারে হাসেমিয়া লাইব্রেরীর কাছেই সুরেশ গোয়ালার চিড়া-মুড়ি, দই দুধের দোকান ছিল।সংগ্রামের সময়ে সে আমাদের শুনই গ্রামের বেপারী বাড়িতে আশ্রয় নেয়। যে বাড়িতে এসে সে আশ্রয় নিয়েছিল, সেই আশ্রয় দাতারাই তার দোকান দখল করে নেয়। অন্যায় ভাবে সম্পদ দখলদারীদের অন্তরালের সেই কথা গ্রামের সবাই এখনো জানে। সীমান্তের ওপার থেকে সুরেশ এসে দেখে যে, আশ্রয়দাতারাই তার দোকান দখল করে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "দুই বিঘা জমি'র" উপেনের মতোই তার কান্নার কোন মূল্য হয়নি।

অনেক বিপন্ন মানুষের মানসম্ভ্রম রক্ষায় তিনি অগ্রনী ভূমিকা পালন করতেন। অনেক শরনার্থী ও বিপন্ন মানুষের খাবার ও টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে দেখেছি তাঁকে। কুনাপাড়া গ্রামে“ বড়আবু” ধান-পাটের ব্যবসা করতেন। সংগ্রামের এক সঙ্গীন মুর্হূতে পাক- হানাদার- বাহিনীর ভয়ে বিপন্ন হয়ে দু’টি সুন্দরী যুবতী মেয়ে ও স্বর্ন টাকা নিয়ে আমাদের গ্রামে আসে। আমাদের গ্রামের হেকিম ও আলাল তার সাথে ব্যবসা করতো, বড় আবু তখন তাদেরকে বলে তোমরা আমাকে সীমান্ত পার করে দিয়ে সাহায্য কর। গ্রামের দুজন লোকের কাছে স্বর্ন গচ্ছিত রেখে দু’টি মেয়েকে নিয়ে বড় আবু সীমান্ত পার হবার আগেই মেয়ে দু’টিকে সন্ত্রাসীরা ছিনিয়ে নেয়। এই শোকেই বড় আবু এখানে মৃত্যুবরন করে। দেশ মুক্ত হবার পর বড় আবুর ছেলে এসে স্বর্ন দাবী করলে, পূবোর্ক্ত ব্যক্তিরা সম্পূর্ন ভাবে অস্বীকার করে, ইত্যকার কত কান্নার গল্পইনা এখানে লুকিয়ে আছে।

আমি “ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে” (ন্যাপ) যুক্ত ছিলাম। অধ্যাপক মোজাফকর আহমদ এর গ্র“পে। বেগম মতিয়া চৌধুরী ও সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে আমরা নির্বাচনী প্রচারনায় আটপাড়া এনেছি। আমার ছোট ভাই শামসুর রহমান মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্পে চলে যায়। পাক-হানাদার বাহিনী এ খবর পেয়ে যায়।

পাক বাহিনী যখন আমাদের বাড়ি অগ্নিসংযোগের জন্য আসে তখন পূর্ব দিক হতে মুক্তি বাহিনীর গুলির আওয়াজ পেয়ে পূর্ব দিকে তারা সরে যায়। এই ভাবে আমাদের বাড়ি রক্ষা পেয়ে যায়। এটাও আল্লাহ্র অসিম অনুগ্রহ। আমাদের পাশের বাড়ীর লালমিঞা ও মোর্শেদ মিঞা গুলিবিদ্ধ হয়ে যায় ও মাটিতে তারা লুটিয়ে পড়ে। এর পরের বাড়ীর লুদু মিঞার স্ত্রী তখন গর্ভবতী ছিলেন। উঠানে ধান রোদ দেওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়। গুলির আঘাতে তার গর্ভপাত হয়। সে দিনের সে সন্তান আজও বেঁচে আছে। তার নাম রাখা হয়“গুলিচান”। এরপরে পাক-বাহিনী প্রত্যেক বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই আগুনের তাপে বাতাসের ধোঁয়ায় সব কিছু আচ্ছন্ন হয়ে যায়। দূর থেকে যারা এই অগ্নিকান্ড দর্শন করেছে , সবাই বলছে আমাদের বাড়ীতে আগুন জ্বলছে। আমার এক ছোট বোন শামসুন্নাহার আমার বই গুলির জন্য আক্ষেপ করেছে যে, আমার সংগৃহীত বই গুলি পুড়ে গেছে বলে ধারনা করেছে। অথচ আল্লাহ্ আমার এই বইগুলি রক্ষা করেছেন। আমার বাবা তখন বাড়ীতে ছিলেন। দেখেছি তার মাঝে অসীম মনোবল, পাক-বাহিনী হাতেধরা দেওয়ার দুরন্ত সাহস। কিন্তু,তখন পাক-বাহিনী আমাদের বাড়ীতে আসেনি। আমরা বাড়ী হতে তখন পালিয়ে গেছি, আমার স্ত্রী তখন গর্ভবতী। সব ক্ষেতে তখন ধান, এই ধানি জমি পেরিয়ে আমার স্ত্রী ও অন্যান্য মেয়েরা দূরবর্তী গ্রামে চলে যায়।

প্রায় নয় মাস ধরে পাক-বাহিনীর অত্যাচার চলে। তাদের ভয়ে আমার মা ও অন্যান্য মেয়েরা মোহনগঞ্জ থানার কমলপুর গ্রামে আমার বোনের বাড়ী চলে যান। এর পর দেশ তাড়াতাড়ি মুক্ত হয়ে যায়। আমাদের থানার পাক-বাহিনী সরে যায়। আল্বদর ও রাজাকারদের মেরে থানার পূবপাশে গর্তে পুঁতে রাখা হয়। আমার মা সে দিনের কথা স্নরণ হলেই কাঁদতেন। স্বাধীনতার পর পরেই আমাদের বাড়িতে ডাকাতি হয়। কাপড়ের দোকান ও অন্যান্য মালামাল নিয়ে ডাকাতেরা নৌকা যোগে সরে পরে।

তখন বর্ষাকাল। আমাদের বাড়ীর পশ্চিম পাশে হাওর বর্ষাকালে নৌকা নিয়ে চুরি ডাকাতি করা সহজ। ডাকাতির শেষ পর্যায়ে ডাকাতেরা আমার দেড় বছরের মেয়ে নার্গিসকে নিয়ে চলে যেতে উদ্ধত হয়। আমার মা টাকা-পয়সা ও অলংকার দিয়ে ডাকাতের হাত থেকে মেয়েকে ফিরিয়ে আনে। একথা স্নরণ হলেই মা কাঁদতেন...."

বাবার লেখা স্মৃতিকথা, জীবনবোধ ও আত্মজীবনীমূলক 'জীবনবৃত্তে' বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে অমর একুশে বইমেলায়। সে বইয়ের ফ্ল্যাপে লিখা কথা পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি:

‘জীবনবৃত্তে’ মূলত লেখকের স্মৃতিকথা। স্মৃতির আঁধারেই বিধৃত হয়েছে ইতিহাস। শব্দের শৈলীতে জীবনের যে জলছবি এঁকেছেন তা সময়ের দর্পনে তিনি ধরে রাখতে চেয়েছেন জীবনবোধের মনোগ্রাহী বিশ্লেষণের মাধ্যমে। আর সে অনুপুক্সক্ষ বিশ্লেষণে উঠে এসেছে বিগত কয়েক দশকের সমাজ চিত্র, সোনালী শৈশবের হারানো দিন, বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য-পুথি সাহিত্য, চৈত্র-সংক্রান্তির সংস্কৃতি ও লেখকের বাবার দিনলিপির খেরোখাতা। তাতে উঠে এসেছে মানুষের জীবনবোধ ও মনোলোকের পরিশীলিত ইতিহাস। লেখনীতে তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধ ও নেত্রকোনা জেলার কিছু কিংবদন্তীতুল্য ও আলোকিত মানুষের গল্প গাঁথা। তাদের নিয়ে লেখকের সহজ-সরল, সাবলীল স্মৃতিচারণ বইটিকে আরো তথ্যসমৃদ্ধ করেছে। স্মৃতিকথা, জীবনবোধ ও আত্মজীবনীমূলক উনিশটি স্মৃতিচারণ নিয়ে লেখা ‘জীবনবৃত্তে’ বইটি লেখকের প্রথম প্রকাশনা।


'জীবনবৃত্তে' বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি।

শিশুদের জন্য বাবার লেখা একটি নান্দনিক ছড়াগ্রন্হও প্রকাশিত হয়। দারুন সব মজার ছড়া নিয়ে এ বইটি জয় করে শিশুদের মন।


শিশুতোষ ছড়াগ্রন্হ 'দুষ্ট লীলাবতী' দেখছে এক বছর বয়সী আমার কন্যা 'শেহজাদী ফারহা অর্থি'।


নিভৃত গ্রামে থাকলেও প্রতিনিয়ত লিখে যাচ্ছেন। এবছর প্রকাশিত হয়েছে তার কিশোরদের ছড়াগ্রন্থ 'দুষ্ট লীলাবতী' http://rokomari.com/book/76347। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। লেখা শেষ করেছেন 'অমর মনীষা' নামক ৩০টি প্রবন্ধের পান্ডুলিপি। 'পুথি সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য' শিরোনামের লেখাটি পুথি সাহিত্য নিয়ে ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। এছাড়া লেখা শেষ করেছেন 'বৃহত্তর ময়মনসিংহের কবি-সাহিত্যিক' শিরোনামে একটি বড় কাজ।

হামিদুর রহমান। আমার বাবা। বয়স সত্তোর ছুই ছুই করছে। গ্রামের খেটে খাওয়া একজন মধ্যবিত্ত কৃষক।
২৩টি স্মৃতিকথামূলক লেখা নিয়ে ২০১৩ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল 'জীবনবৃত্তে'। বইটি প্রকাশ করেছিল 'নান্দনিক'। কয়েকদিন আগে বাবার বইয়ের ১০০০ কপির রয়ালিটি বুঝিয়ে দিলেন প্রকাশনা কতৃপক্ষ। http://rokomari.com/book/60789
লেখালেখি এবং বই আমার বাবাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

গত বছরের কথা।

মুক্তিযুদ্ধ আমি দেখিনি। তবে আমার মা-বাবার মুখে শুনেছি যুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা। আমার গ্রামের বাড়িতে এখনো সংবাদপত্র পৌছায় না। সকাল থেকেই আমার বাবা ফোনে জানতে চাইছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের আজকের বিচারের রায় কি হলো। খুব হতাশ করা কথা বাবাকে শুনাতে হলো। বাবা খুব হতাশ হলেন। মন খারাপ করা অনুভূতি আজ সারাদিন।
আমার প্রবীণ বাবা আর একটা কথাও বললেন না।

সাতচল্লিশের দেশভাগের পর বাবার কৈশোরের দুরন্ত দিন, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন আর একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ। সবচেয়ে কষ্টে কেটে যাওয়া দিন। আমার মায়ের পেটে বয়ে বেরাচ্ছেন আমার বড় বোন নিলুপা’কে। রাজাকাররা লুটপাট করছে আমাদের বাড়ি, দাদাকে বেঁধে রেখেছেন বাড়ির পেছেন বাঁশঝাড়ে। আমার মা, দাদী, ফুফুরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আটপাড়া থেকে মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা। বাড়ির উঠোনে কাটা ধানের মাচায় অসংখ্য বুলেটের খোসা..।

আমার টাইমলাইনে
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেয়া স্ট্যাটাসও মুছে যায়-
প্রযুক্তির আশির্বাদে হ্যাকড হয়,
আমার সাজানো রঙ্গীন মুখপুঞ্জির অনুভাষ্য।
আমার প্রতিবাদ ছাপা হবে তাহলে কোথায়!

বিবেকের ট্যাগলাইনে যা দাগ কেটে আছে-
যুদ্ধের বিভিষীকাময় দিন, আমার মা দৌড়াচ্ছে অনবরত,
পিছনে আগুনে ছারখার আমার মায়ের গুছানো সংসার,
চাচা কাটাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে বিভৎস এক একটি দিন।
আমি ভুলি কি করে?

আমার মনের গহীনের যে কাব্যের সরস জমিন
তাতে আমি লিখে দেই-
“রাজাকারের বাচ্চা, তুই আবার বাংলাদেশ জিন্দাবাদ কস! তরে আমি খায়া ফালামু।”
সে ব্যথা যখন মূর্ত হলো অনলাইনে- ব্লগার এক্টিভিস্টদের মন্তব্যে,
আমার প্রোফাইল তখন আবারো ব্যান হলো।
আর-
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় হলো হতাশায় ডুবানো -
আমরা আবারো সেই পুরনো কফিনের চাদরে মোড়ানো লাশে পরিনত হলাম।
Click This Link

বলছিলাম বাবার কথা ।
আমার মায়ের সাথে বাবার মান-অভিমান হতো শুধুমাত্র বই নিয়ে। সারা বাড়ী জুড়ে বই। আলমিরা, টেবিল, বুক সেলফ যখন ভর্তি হয়ে যেত-সবশেষে শোবার বিছানা দখল করতো বইয়ে। এই নিয়ে মায়ের কতশত কথা । তবুও বাবা নিরবধি বই নিয়ে ছিলেন-আছেন-বই বিতরণ করে বই পড়েই বাবার আত্মিক শান্তি এটাই বাবার আপন জগত।
বাবার সংগৃহীত প্রতিটি বইয়েই গোটা হাতের অক্ষরে লেখা আছে-
“আমার জীবন উৎসর্গ করেছি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ- জ্ঞান অর্জনের জন্য।”
প্রচন্ড নজরুল ভক্ত বাবা। নজরুলের প্রতিটি বইয়ের প্রথম সংস্করণ বাবার কাছে আছে। প্রতিটি বই যেন বাবার এক একটা আত্মা।

বাবা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ-এর ন্যাপ ছেড়ে আসলেন কম্যুনিস্ট পার্টিতে। চলল অনেক দিন। কবি গোলাম মোস্তফার “ইসলাম ও কমিউনিজম” পড়ে বাবা প্রভাবিত হয়েছিলেন। প্রগতি প্রকাশন মস্কোর এক আলমিরা বই বাবা পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। খুব আফসোস হয়েছিল বাবার কাছে এই গল্প শুনে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সময় সেসব বই আমাকে নতুন করে টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করে আমি তখন পূর্ণাঙ্গ পোষ্ট গ্রাজুয়েট। নিজেকে একজন ক্ষুদে সমাজবিজ্ঞানী মনে করছি আর গর্বে বুক ফুলাচ্ছি। হঠাৎ একদিন বাবার সাথে সমাজ সাহিত্য ও রাজনীতি নিয়ে অনেক যুক্তি-তর্ক-গল্প। আমার দীর্ঘ ছাত্র জীবনের সব জ্ঞান কেমন যেন মিছেমিছি মনে হলো। হেরে গেলাম বাবার কাছে। মনে হলো আমার বাবাই শ্রেষ্ঠ সমাজবিজ্ঞানী, আমার বাবাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা, আমার মা-ই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা।

এই লেখাটা ঢাকায় বসে লিখছি। খুব মনে পড়ছে আমার মা’কে, বাবা’কে আর আমার প্রিয় ছোট বোন 'টুনি' কে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:৩০
৩৭টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মহান আল্লাহতালা কতজন নবী- রাসুলের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন এবং কোন ভাষায় কথা বলেছেন?

লিখেছেন রাজীব নুর, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৮



হ্যা আল্লাহপাক নবী রাসূলের সাথে কথা বলেছেন।
কারো সাথে কথা হয়েছে সরাসরি। কারো সাথে ফেরেশতাদের মাধ্যমে, কারো সাথে ওহির মাধ্যমে। আমরা যেভাবে কথা বলি একজন আরেকজনের সাথে আল্লাহ... ...বাকিটুকু পড়ুন

জিব্রাইল (আ: ) বললেন, "আপনি পড়ুন"

লিখেছেন জেনারেশন৭১, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০২



এখন ব্লগে এমন কেহ আছেন নাকি, যিনি স্কুলে গিয়ে ১মবার বর্ণমালা পড়েছেন শিক্ষকের কাছে? আজকাল, শহরে জন্মনেয়া বাচ্চাদের ( যেসব পরিবারে ২/১ জন শিক্ষিত আছে ) ৮০ ভাগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটা সময় পর

লিখেছেন সামিয়া, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৪

ছবিঃ আমার তোলা

একটা সময় পর
মানুষ মাথা পেতে নতজানু হয়ে
সহজেই ভুল স্বীকার করে;
বিনা দোষে নির্দ্বিধায়।

অতিরিক্ত শীতে
বেমালুম ভুলে যায়
গায়ে জড়ানো চাদরের রং।
চুল আঁচড়ে চিরুনি রেখে;
খুব আগ্রহে আবারো খোঁজে ;
হারিয়ে যাওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিবেশী দেশ ভারত নিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ-জনগণের মতভেদ কেন?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৪০


ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে শোচনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এর দায় বাংলাদেশের মানুষের তুলনায় ভারতের মিডিয়া এবং মুষ্টিমেয় কতিপয় ভারতীয় বেকুবদের বেশি। শেখ... ...বাকিটুকু পড়ুন

রোগিণীর মা হওয়ার বাসনা পূরণ করতে ডাক্তার কর্তৃক নিজ বীর্য দান

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০১


পৃথিবীর যে কোন সমাজেই অনেক দম্পতির জন্য সন্তানহীন থাকা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমাদের দেশের মত ধর্মীয় গোঁড়ামির দেশে অনেক সময় সহজ সরল নিঃসন্তান নারীরা সন্তান লাভের আশায় ভণ্ড পীরের কাছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×