আগে প্রায়ই গণধোলাইয়ের ঘটনা শোনা যেত। ইদানিং রাজনৈতিক অস্থিরতার বদৌলতে মিডিয়াতে এই শব্দের প্রচলন কিছুটা কমতির দিকে। যদিও 'গণধোলাই' শব্দটির রাজনৈতিক ব্যবহার বেশ বেড়েছে। যেমন; হরতালকারীদের কেউ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ভাড়াটে পান্ডার আক্রমণের শিকার হলে, দলকানা কিছু গণমাধ্যম নিউজ করছে, "গণধোলাইয়ের শিকার হরতাল সমর্থক"।
সাম্প্রতিক সময়ে উগ্রপন্থীদের হাতে সাংবাদিক নির্যাতনের ব্যাপকতা চোখে পড়ছে। সাংবাদিকরা সন্ত্রাসী হামরার শিকার হয়, এতদিন এই ব্যাপারটি কমন ছিল। এখন এর সাথে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, সাংবাদিকদের উপর রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর আক্রমণের প্রবণতা বাড়তির দিকে। এজন্য আমরা আক্রমণকারীদের সমালোচনা করে মুখে ফেনা তুলতে পারি, তাদের উপর পাল্টা আক্রমণের হুমকি দিতে পারি ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক কিছু করতে পারি।
বিজ্ঞানের cause-effect বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সূত্র অনুসারে প্রতিটি ঘটনার পিছনে আরো কিছু ঘটনা কাজ করে। তার অর্থ দাঁড়ায়, পিছনের ঘটনাকে যদি আমরা ঠেকাতে পারি তাহলে effect বা প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয় না। সিরিয়াল কিলার এরশাদ সিকদার, রসু খাঁদের দেখে আমরা ঘৃণায় নাক শিটকাই, রাস্তাঘাটের পতিতাদের দেখে তাদের আমরা অচ্ছুত জ্ঞান করি, মাদকাসক্তদের আমরা কুলাঙ্গার গালি দেই, শিবির-হিজবুত তাহরীরদের আমরা জঙ্গি উপাধিতে ভূষিত করি। কিন্তু একটিবারের জন্যও আমরা ভাবি না, কেন এরা বিপথগামী হলো? এর পিছনে আমি, আমরা তথা আমাদের সমাজব্যবস্থা কি মোটেই দায়ী নয়? সমাজের সমস্ত বিপথগামীদের কেস স্টাডি করলে আমরা দেখতে পাব, এদের অধিকাংশ যে ধরণের পরিবেশ পেয়েছে, সেখান থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না। সময় হলে লেখা দুটো পড়ে দেখবেন, একজন সিরিয়াল কিলারের শৈশব ও কোথায় আমার দায়মুক্তি? । কি চমৎকার আমাদের আচরণ! যেই সমাজ তার কতিপয় সদস্যকে জীবনের মৌলিক অধিকার দিতে অহর্নিশ ব্যর্থ হয়, বিপথগামিতার পথে ঠেলে দেয়, সেই আবার তাদেরকে ধরে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানোর পাঁয়তারা করে!
আমাদের গণমাধ্যমকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এজন্য হামলাকারীদের প্রতি ঘৃণা বা নিন্দা জানানো অবশ্যই কর্তব্যভুক্ত। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? একটি কারণ, সাংবাদিকরা তাদের দায়িত্ব পালন করছে, সত্যকে উন্মোচিত করছে। আর তাই কর্তব্যনিষ্ঠ সাংবাদিকরা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। পাশাপাশি আরেকটি কারণের দিকে আমাদের খুব বেশি নজর নেই। মনে রাখা প্রয়োজন, এক হাতে তালি বাজে না। সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে পরিবেশিত অধিকাংশ নিউজ দেখলে মনে হয়, তারা সাংবাদিকতার নৈতিক জায়গার একটি বড় অংশ জুড়ে থাকা objectivity বা বস্তুনিষ্ঠতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে কোমড় বেঁধে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পক্ষে এবং বিপক্ষকে নির্মূল করার ব্রত নিয়ে মাঠে নেমেছে। অথচ মিডিয়ার কার্যক্রম দেখভালের জন্য নেই কোন কার্যকর মনিটরিং সেল বা মিডিয়াওয়াচ। আইনের অকার্যকারিতা ও এর প্রতি গণমানুষের অনাস্থার কারণে যেমন মানুষ 'গণধোলাই' এর আশ্রয় নেয়, তেমনি মিডিয়ার যথেচ্ছ আচরণের তদ্রুপ প্রতিদান অদূর ভবিষ্যতে মিডিয়াকর্মীদের কপালে জুটবে না, এমন নিশ্চয়তা বোধ করি দেয়া যায় না। এখন এই রোষ হয়ত ভুক্তভোগী গোষ্ঠীর মাঝে সীমাবদ্ধ আছে, ভবিষ্যতে এর ম্যাসিফিকেশন ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বলা হয়, 'মারের বদলা মার, খুনের বদলা খুন', এই কথার প্রতি আমাদের সমর্থন থাকলেও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলদের উচিত আইনের মাধ্যমে এর প্রতিফলন প্রত্যাশা করা। কিন্তু ক্রমাগত আইনের নিস্ক্রিয়তার কারণে এক সময় মানুষ ডেসপারেট হয়ে যায়। প্রচলিত আইনের প্রতি সে আর আস্থা রাখতে পারে না। ফলে গণবিস্ফোরণ বা গণজোয়ার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তাই এ ধরণের গণজোয়ার যেন মিডিয়ার বিরুদ্ধে না হয়, তার জন্য যেমন মিডিয়াকর্মীদের মগজে সাংবাদিকতার নীতিসমূহ জাগ্রত রাখা জরুরি, পাশাপাশি স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করতে একটি কার্যকর মিডিয়া মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১:৫৮