কিস্তি ১
গ্রেস (Nicole Kidman) যেন অন্য শহর থেকে পালিয়ে আসা এক দেবী। রূপবতী, রমণীয় ও বুদ্ধিমতী। যাবতীয় সুন্দর মানবীয় গুণাবলি দিয়ে গাঁথা তার মন। মাদক ব্যবসায়ী গ্যাংস্টার মাফিয়ারা তাকে খুঁজছে। বড় শহর থেকে পালিয়ে রাতের অন্ধকারে পথ হারিয়ে ডগভিলে এসে পড়ে গ্রেস। টম রক্ষা করে গ্রেসকে। লুকিয়ে রাখে শহরের কোণে পরিত্যক্ত রূপা খনিতে। গ্রেসকে খুঁজতে আসা মাফিয়াদের ভুল তথ্য দিয়ে অন্যদিকে পাঠিয়ে দেয় টম। ডগভিলবাসীদের সে বলে গ্রেসকে আশ্রয় দেবার কথা। কিন্তু ঘটনার পরম্পরায় বিমূঢ়, নিরদ্বিগ্ন জীবনযাপনকারী শহরবাসীরা বুঝতে পারে না, খুনি মাফিয়ারা যাকে খুঁজছে তাকে শহরে স্থান দেওয়া কতটা নিরাপদ ও যুক্তিসঙ্গত হবে। পরামর্শ আসে আইনি সহায়তা নেবার। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না তারা। একদিকে অমানবিক হবার লজ্জা, অপরদিকে মানবিক হবার যন্ত্রণা—এই দু’য়ের নিষ্পেষণে গ্রেসের পরিণতি অমীমাংসিতই থেকে যেত। ঠিক তখনি টম একটি পরীক্ষার আয়োজন করে। সে দু’সপ্তাহ সময় চেয়ে নেয় সকলের কাছ থেকে। এই দীর্ঘ দু’সপ্তাহ ডগভিলবাসীরা নিরীক্ষণ করবে গ্রেসের প্রতিটি কর্মকাণ্ড, এবং এই কর্মকাণ্ডের ওপরেই পরবর্তীতে নির্ভর করবে তার ভাগ্য। এই শর্ত ব্যবস্থা গ্রেসকে ঠেলে দেয় এক ধরনের অলিখিত নিয়ন্ত্রণের ভিতর। টম বলে, যে সুযোগ গ্রেস পেয়েছে তার সদ্ব্যবহার করা উচিত শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে—শহরবাসীদের সেবা করে। রাজি হয় গ্রেস। এভাবে শুরু হয় অভিবাসী হিসেবে তার কর্মযোগ।
চলচ্চিত্রটিতে দেখা যায়, শহরের প্রতিটি দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কাজ জোগাতে ব্যর্থ গ্রেস। ট্রাক চালক বেন, গ্লাস প্রস্তুতকারী হেনসন পরিবার, দোকানি জিনজার, কৃষক চাক্ এমনকি অন্ধ বুড়ো জ্যাক পর্যন্ত নিজেদের আশেপাশে বাড়তি কোন কাজ দেখতে পায় না। সবারই বদ্ধমূল ধারণা, ডগভিলে কোন বাড়তি কাজ নেই। শহরবাসীদের নৈমিত্তিক জীবনযাপনে গ্রেসের কোন বাড়তি সংযোজনের ক্ষমতাও নেই। আবারো টমের আগমন এবং তার হস্তক্ষেপেই প্রথম কাজ পায় গ্রেস। শহর থেকে একটু দূরে আঙুর ক্ষেত নিড়ানো—যখন গ্রেস প্রমাণ করতে পারে শারীরিক শ্রম দিতে সে সক্ষম তখন ডগভিলে যেন সবারই একজন সাহায্যকারীর দরকার হয়ে পড়ে। ট্রাকচালক বেনের খাওয়া এবং জিনিসপত্তর গুছিয়ে দেওয়া, হেনসন পরিবারের উৎপাদনে সাহায্য করা, দোকানি জিনজারের দোকান গুছিয়ে রাখা, চাক্কে আপেল পাড়তে সাহায্য করা, বিল হেনসনকে পড়া বুঝিয়ে দেয়া, অন্ধ বুড়ো জ্যাক ম্যাকে’র মিথ্যা গল্পের শ্রোতা হওয়া, ভেরার বাচ্চাদের দেখাশোনার দায়িত্ব সব একে একে তার কাঁধে চাপতে থাকে। সমস্ত ডগভিলে যেখানে কোন বাড়তি কাজ ছিল না সেখানে তার ২২ অধিবাসীই কোন না কোন কাজে গ্রেসকে এবার সম্পৃক্ত করে। ফলে, এটা মোটেই আশ্চর্য নয় যে দু’সপ্তাহ পরে সবার মিলিত ‘হ্যাঁ’ ভোটে ডগভিলে তার থাকা নিশ্চিত হয়।
অভিবাসী গ্রেস এখন অধিবাসী হিসেবে দিনযাপন শুরু করে। অন্য ২২ ডগভিলবাসী তাকে নিজেদের একজন বলেই বরণ করে নেয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে তখনি, যখন বড় শহর থেকে পুলিশ এসে ডগভিলের দেয়ালে সেঁটে দেয় গ্রেসকে ধরিয়ে দেবার পুরস্কারসহ পোস্টার। শুধু এই শহর নয়, সমস্ত রাজ্যজুড়ে লাগানো পোস্টারগুলো গ্রেসের গতিবিধিকে—ডগভিলের শহুরে সীমার মধ্যে সংকীর্ণ করে তোলে। শুধু গ্রেসই নয় সকল ডগভিলবাসীর কাছেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে অনুচ্চারিত একটি শব্দ—‘বন্দিত্ব’। সহসা যেন দ্রুত পরিবর্তন ঘটে যায় শহরের প্রতিটি মানুষের আচরণে। যে গ্রেসকে নিজেদের ভিতর আপন করে নিয়েছিল সেই তাকেই হঠাৎ ‘দ্বিতীয়’ শ্রেণীভুক্ত করে ফেলে তারা। এবার একের পর এক চাপিয়ে দিতে থাকে অমানুষিক কাজের বোঝা। পারিশ্রমিকও তার অর্ধেক করে ফেলা হয়। আগে যেখানে কাজকর্মের ভুলগুলোকে উদাসী দৃষ্টিতে সবাই এড়িয়ে যেত, এখন ভাল কাজগুলোরও অপব্যাখ্যা দেওয়া হয়। ডগভিলের প্রতিটি মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে গ্রেসকে যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু করে।
দার্শনিক টম এতকিছু দেখেও ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মন্ত্র বারংবার পাঠ করে যায়। কাজের ভারে ন্যুব্জ ও মানুষের অমানবিকতায় বিপর্যস্ত গ্রেস ট্রাকচালক বেনকে বিশ্বাস করে ডগভিল থেকে পালাতে চায়। কিন্তু এখানেও বেন সুযোগ বুঝে বিশ্বাসঘাতকতা করে। পালানোর চেষ্টা যেন ভবিষ্যতে না করতে পারে সে জন্য গ্রেসের গলায় শিকল দিয়ে ভারি চাকা ও ঘণ্টা বাঁধা হয়। শুরু হয় নির্যাতনের সর্বোচ্চ পর্যায়। প্রায় প্রতিটি পুরুষ নির্দ্বিধায় ভোগ করতে থাকে তাকে, প্রতিটি শিশু উৎফুল্ল হয় তাকে আরও কষ্ট দিতে পারলে—প্রতিটি নারী শুরু করে আরো বিবিধ শারীরিক নির্যাতন। ধর্ষকামীতার উৎসবে মুখরিত ডগভিলে একমাত্র ব্যতিক্রম টম। নিজ শহর ও গ্রেসকে নিয়ে যার পরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:০৩