বাংলা ভাষা : হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, কিস্তি ২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
সকলেই জানেন অতি অল্প দিন পূর্বে বাংলাভাষায় গদ্যগ্রন্থ ছিল না, কিন্তু পদ্য প্রচুর ছিল। ইংরেজি শিক্ষা আরম্ভ হইবার পূর্বে যে সকল পদ্য লিখিত হইয়াছিল, তাহা বিশুদ্ধ বাংলাভাষায় লিখিত। কৃত্তিবাস, কাশীদাস অনুবাদ করিয়াছেন, সেজন্য তাহাঁদের গ্রন্থে দু-পাচঁটি অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দ থাকিলেও উহা প্রধানত বিশুদ্ধ বাংলা। কবি-কঙ্কণ, ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ সেন প্রভৃতি কবিগণের লেখা বিশুদ্ধ বাংলা। গদ্য না থাকিলেও ভদ্র সমাজে যে ভাষা প্রচলিত থাকে তাহাকেই বিশুদ্ধ বাংলাভাষা কহে। আমাদের দেশে সেকালে ভদ্র সমাজে তিন প্রকার বাংলাভাষা চলিত ছিল। মুসলমান নবাব ও ওমরাহদিগের সহিত যে-সকল ভদ্রলোকের ব্যবহার করিতে হইত, তাহাঁদের বাংলায় অনেক উর্দু শব্দ মিশানো থাকিত। যাহাঁরা শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করিতেন, তাহাঁদের ভাষায় অনেক সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হইত। এই দুই ক্ষুদ্র স¤প্রদায় ভিন্ন বহু-সংখ্যক বিষয়ী লোক ছিলেন। তাহাঁদের বাংলায় উর্দু ও সংস্কৃত দুই মিশানো থাকিত। কবি ও পাঁচালীওয়ালারা এই ভাষায় গীত বাঁধিত। মোটামুটি ব্রাক্ষ্মন-পন্ডিত, বিষয়ী লোক ও আদালতের লোক এই তিন দল লোকের তিন রকম বাংলা ছিল। বিষয়ী লোকের যে বাংলা তাহাই পত্রাদিতে লিখিত হইত, এবং নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা ঐরূপ বাংলা শিখিলেই যথেষ্ট জ্ঞান করিত।
ইংরেজরা এ দেশ দখল করিয়া ভাষার কিছুমাত্র পরিবর্তন করিতে পারেন নাই। কিন্তু তাঁহারা বহু-সংখ্যক আদালত স্থাপন করায় এবং আদালতে উর্দুভাষা প্রচলিত রাখায় বাংলাময় পারসি শব্দের কিছু অধিক প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল মাত্র। সাহেবেরা পারসি শিখিতেন, বাংলা শিখিতেন। দেশিয়েরা দেশীয় ভাষায় তাহাঁদের সহিত কথা কহিতেন। সুতরাং ইংরেজী কথা বাংলার মধ্যে প্রবিষ্ট হইতে পারে নাই। যাহাঁরা ইংরেজি শিখিতেন বা ইংরেজের সহিত অধিক মিশিতেন দেশের মধ্যে প্রায়ই তাহাঁদের কিছুমাত্র প্রভুত্ব থাকিত না।
কথক মহাশয়েরা বহু-কালাবধি বাংলায় কথা কহিয়া আসিতেছেন। তাঁহারা সংস্কৃতব্যবসায়ী কিন্তু তাঁহারা যে ভাষায় কথা কহিতেন তাহা প্রায়ই বিশুদ্ধ বিষয়ী লোকের ভাষা। কেবল জমকালো বর্ণনাস্থলে ও সংস্কৃত শ্লোকের ব্যাখ্যাস্থলে ব্রাক্ষ্মণ পন্ডিতি ভাষার অনুসরণ করিতেন।
আমাদিগের দুভাগ্যক্রমে যে সময়ে ইংরেজ মহাপুরুষেরা বাঙালিদিগকে বাংলা শিখাইবার জন্য উদ্যোগী হইলেন, সেই সময়ে যে-সকল পন্ডিতের সহিত তাঁহাদের আলাপ ছিলো তাঁহারা সংস্কৃত কালেজের ছাত্র। তখন সংস্কৃত কালেজ বাংলায় একঘরে। ব্রাক্ষ্মণ-পন্ডিতেরা তাঁহাদিগকে যবনের দাস বলিয়া সঙ্গে মিশিতে দিতেন না। তাঁহারা যে সকল গ্রন্থ পড়িতেন তাহা এ দেশমধ্যে চলিত ছিল না। এমনকি দেশীয় ভদ্রসমাজে তাঁহাদের কিছুমাত্র আদর ছিল না। সুতরাং তাঁহারা দেশে কোন্ ভাষা চলিত কোন্ ভাষা অচলিত, তাহার কিছুই বুঝিতেন না। হঠাৎ তাঁহাদিগের উপর বাংলা পুস্তক প্রণয়নের ভার হইল। তাঁহারাও পন্ডিতস্বভাবসুলভ দাম্ভিকতাসহকারে বিষয়ের গুরুত্ব কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া লেখনী ধারণ করিলেন।
পন্ডিতদিগের উপর পুস্তক লিখিবার ভার হইলে তাঁহারা প্রায়ই অনুবাদ করেণ। সংস্কৃত কালেজের পন্ডিতেরাও তাহাই করিলেন। তাঁহারা যে-সকল অপ্রচলিত গ্রন্থ পাঠ করিয়াছিলেন তাহারই তর্জমা আরম্ভ করিলেন। রাশি রাশি সংস্কৃত শব্দ বিভক্তি পরিবর্জিত হইয়া বাংলা অক্ষরে উত্তম কাগজে উত্তমরুপে মুদ্রিত হইয়া পুস্তকমধ্যে বিরাজ করিতে লাগিল। যিনি ‘কাদম্বরী’ (১৮৫৪ খৃ.) তর্জমা করিয়াছিলেন (তারাশঙ্কর তর্করতœ, মৃ. ১৮৫৮ খৃ.), তিনি লিখিলেন, “একদা প্রভাতকালে চন্দ্রমা অস্তগত হইলে, পক্ষিগণের কলরবে অরণ্যানী কোলাহলময় হইলে, নবোদিত রবির আতপে গগনমন্ডল লোহিত বর্ণ হইলে, গগনাঙ্গন-বিক্ষিপ্ত অন্ধকাররূপ ভস্মরাশি দিনকরের কিরণরুপ সম্মার্জ্জনী দ্বারা দূরীকৃত হইলে, সপ্তর্ষিমন্ডল অবগাহনমানসে মানসসরোবরতীরে অবতীর্ণ হইলে, শাল্মলীবৃক্ষস্থিত পক্ষিগণ আহারের অন্বেষণে অভিমত প্রদেশে প্রস্থান করিল।” আমরা পূর্বে যে তিন ভাষার উল্লেখ করিয়াছি, ইহার সহিত তাহার একটিরও সম্পর্ক নাই।
এতো গেল সংস্কৃত হইতে অনুবাদ। ইংরেজি হইতে অনুবাদ একবার দেখুন, “পাঠশালার সকল বালকই, বিরামের অবসর পাইলে, খেলায় আসক্ত হইত; কিন্তু তিনি সেই সময় নিবিষ্টমনা হইয়া, ঘরট্ট প্রভৃতি যন্ত্রের প্রতিরূপ নির্ম্মাণ করিতেন। একদা, তিনি একটা পুরাণ বাক্স লইয়া জলের ঘড়ী নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। ঐ ঘড়ীর শঙ্কু বাক্সমধ্য হইতে অনবরতবিনির্গতজলবিন্দুপাতের দ্বারা নিমগ্নকাষ্ঠখন্ড প্রতিঘাতে পরিচালিত হইত; বেলাববোধনার্থ তাহাতে একটি প্রকৃত শঙ্কুপট্ট ব্যবস্থাপিত ছিল।” (বিদ্যাসাগর রচিত ‘জীবনচরিত’, ১৮৪৯ খৃ.)। ইংরেজি পড়িলে বরং ইহা অপেক্ষা সহজে বুঝা যাইতে পারে।
এই শ্রেণীর লেখকের হস্তে বাংলাভাষার উন্নতির ভার অর্পিত হইল। লিখিত ভাষা ক্রমেই সাধারণের দুর্বোধ্য ও দুষ্পাঠ্য হইয়া উঠিল। অথচ এুিকেশন ডেস্প্যাচের কল্যাণে সমস্ত বঙ্গবাসী বালক এই প্রকারের পুস্তক পড়িয়া বাংলাভাষা শিখিতে আরম্ভ করিল। বাংলাভাষার পরিপুষ্টির দফা একেবারে রফা হইয়া গেল।
৮টি মন্তব্য ৫টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন