নজরুলের কাছে আমাদের ঋণ: আহমদ ছফা, কিস্তি ৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
নজরুল উর্দু ভাষায় গজল ও গান লিখেছেন। রাজ নওয়াব আলী রচিত সঙ্গীত বিষয়ক আকরগ্রন্থ ‘মারিফুন্নাগমাতে’র অংশবিশেষের স্বচ্ছন্দ বাংলা তর্জমা করেছিলেন। ভাষার উপর কি রকম দখল থাকলে এরকম একটি দুরূহ গ্রন্থের এমন সাবলীল অনুবাদ করা যায়, তা অনুমান করা অসম্ভব নয়। হাফিজ এবং ওমর খৈয়ামের গজল-রুবাই-এর মূল ফার্সী থেকে তিনি বাংলায় কাব্যিক রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন। সুতরাং ফার্সীর উপর নজরুলের পরিপূর্ণ দখল ছিল, এটা অনুমান এবং কল্পনার বিষয় নয়। হিন্দী ভাষায় রচিত নজরুলের ভজন নেহায়েত কম নয়। ভাষাটি না জানলে শুধুমাত্র স্মৃতি এবং শ্র“তির উপর ভরসা করে ভজন রচনা সম্ভব নয় বলেই ধারণা করি। নজরুল আরবী গানের সুরে গান লিখেছেন। আরবী ছন্দে বাংলা কবিতা লিখেছেন। ভাষাটি তিনি কতটা জানতেন, সে সংবাদ আমাদের জানা নেই। তবে ভাষার উপর বিশদ অধিকার না থাকলেও গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা নজরুলের ছিল, এটা মনে করা অসঙ্গত না। নজরুল ইসলাম বেশ কয়েকটি ভাষা জানতেন, এটা আমাদের কাছে একটা সংবাদ মাত্র। এই ভাষাজ্ঞান দিয়ে তিনি সাহিত্যের কায়া এবং প্রাণের মধ্যে একটা নতুন সংশ্লেষ ঘটিয়েছিলেন, সেই ব্যাপারটি কদাচিৎ আমরা চিন্তা করে দেখি। সে যা হোক, আমাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে—আরবী, ফার্সী, উর্দু ইত্যাদি ভাষায় নজরুলের সমধিক অধিকার ছিল এবং সেই কারণে পুঁথিসাহিত্যের ভাষায় নতুন মাত্রা এবং ব্যঞ্জনা সৃষ্টি তাঁর পক্ষে কোন অসম্ভব বা কঠিন কর্ম ছিল না।
সেই সময়টার কথাও মনে রাখতে হবে। ইতোমধ্যে সমাজ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভিতর দিয়ে অনেকদূর এগিয়ে এসেছে। হিন্দুসমাজের ভেতর উদারতা এবং মেনে নেয়ার শক্তি বেশ খানিকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর মুসলমান সমাজের ভিতরে একটা জঙ্গমতা সৃষ্টি হতে চলেছে। এই সময়ে নজরুলের আরবী-ফার্সী ভাষার শব্দমিশ্রিত কবিতা-গান যখন প্রকাশ পেতে শুরু হয়েছে, হিন্দুসমাজের ব্যক্তিবৃন্দ সাহিত্যে নতুন উপাদান সংযোজন করার জন্য নজরুলকে অভ্যর্থনা জানালেন। আর মুসলমান সমাজের চক্ষুষ্মান ব্যক্তিরা নজরুলের কবিতায় তাদের ব্যবহারিক জীবনের নিত্যব্যবহৃত শব্দসমূহের অকুণ্ঠিত, অসংকোচ প্রয়োগের সাক্ষাৎ পেয়ে তাঁকে আপন ঘরের মানুষ হিসাবে চিনে নিলেন।
নজরুলের কাছে বাঙালি মুসলমান সমাজের অন্যতম প্রধান প্রণিধানযোগ্য ঋণ এই যে, নজরুল তাদের ‘ভাষাহীন পরিচয় ঘুচিয়ে দিয়ে তাদের সামাজিক ভাষাকে সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা দান করলেন এবং স্বীকৃতি অর্জন করে দিলেন। আর নজরুলের কাছে সমগ্র বাঙালি সমাজের ঋণ এই যে, নজরুল বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে বাঙলার হিন্দু-মুসলিম উভয় স¤প্রদায়ের ভাষা হিসাবে চিহ্নিত করে নব বিকাশধারায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে অনেকদূর পর্যন্ত গাঁথুনি নির্মাণ করেছিলেন।
৪
বাঙালি মুসলমান সমাজের ধর্মচিন্তা এবং সংস্কৃতি-চিন্তার মধ্যে একটা দুস্তর পার্থক্য বর্তমান। ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসার হওয়ার পূর্বে এখানকার যে স্থানীয় সংস্কৃতি বিদ্যমান ছিল, তার স্রোতধারার ভিতরে ধর্ম-ভাবনা পুরোপুরি অবগাহন করতে পারেনি। স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মচিন্তার একটা বিরোধ বরাবর থেকে গেছে। পৃথিবীর অন্যান্য মুসলমান সমাজে এ ধরনের ঘটনা খুবই কম ঘটেছে। যেমন ইরানে ইসলাম প্রসারের পরেও ইরানী জনগণ প্রাক-ইসলামী যুগের উৎসব-আচার, জাতীয় গর্ববোধ কোনকিছু পরিহার করেনি। ইন্দোনেশিয়াতে হিন্দু-ঐতিহ্যের সঙ্গে ইসলাম ধর্ম চমৎকার মিলেমিশে সহাবস্থান করছে অদ্যাবধি। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় নিশানবাহী বিমান সংস্থাটির নাম ‘গরুড়’। প্রতি বছর সে দেশে জাতীয়ভাবে রামায়ণ উৎসব পালন করা হয় এবং জনগণ হিন্দু-ঐতিহ্যের জন্য গর্ববোধ করেন। মুসলিম সন্তানের সংস্কৃতি নামকরণ করতে তাঁদের বাধে না। ইরানে দেখা গেছে ইসলাম পাকাপোক্তভাবে চালু হওয়ার পরেও ইরানী মহাকবিরা অগ্নি-উপাসক পারসিক নরপতিদের স্মৃতিকে সযতেœ লালন করে আরব আগ্রাসনের প্রতিবাদ করছেন।
বাংলা মুলুকেও ধর্ম-সংস্কৃতিতে এক ধরনের সংশ্লেষ যে ঘটেনি সে কথা সত্যি নয়। কিন্তু তার মাত্রা একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করতে পারেনি। খুব সম্ভবত মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যা হিন্দুদের অনুপাতে কম ছিল বলে এবং গোটা সমাজের অর্ধাংশেরও বেশি মানুষ অমুসলিম থেকে যাওয়ার কারণে ক্ষেত্রজ সংস্কৃতিটিকে সবসময় সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। ইসলাম ধর্মের অভিভাকেরা সকল সময়ে স্থানীয় সংস্কৃতির মধ্যে শেরক্ এবং মূর্তিপূজার গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন।
বাঙালি মুসলমান সমাজে মিলাদ মাহফিল, ওরস শরীফ, দুই ঈদের জামাত, নবীর দরূদ পাঠ, কোরআন খতমের আয়োজন করা—এ সকলই ছিল সংস্কৃতিচর্চার অন্তর্ভুক্ত শাস্ত্রসম্মত বিষয়। শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠানসমূহ আরবী ভাষার মাধ্যমে পালন করা হত, যার এক বর্ণও আম-জনগণ বুঝতে পারত না। এই ধরনের পরিবেশ-পরিস্থিতিতে জীবনের প্রতি অস্তিবাচক কোন সৃষ্টির প্রত্যাশা এক রকম অসম্ভব। সাধারণ বাঙালি মুসলমানদের আরবী-ফার্সীতে কোন অধিকার ছিল না। অভিজাত মুসলমানদের সমাজে হয়ত কিছুটা আরবী-ফার্সীর আংশিক অধিকার ছিল। কিন্তু সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগের পথ সুগম ছিল না। তাঁরা বাংলায় কথা বলতেন না। আর সাধারণ মুসলমানদের প্রায় শতকরা একশ ভাগই বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা বুঝতে পারত না।
পলাশীর যুদ্ধের পর মুসলমান অভিজাত শ্রেণী ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যায়। আপদকালে সামাজিক নেতৃত্ব নির্মাণ করার যে দায়িত্ব অভিজাত নেতৃশ্রেণীর থাকে, ভাষাগত কারণে মুসলমান অভিজাতরা তা করতে পুরোপুরি অসমর্থ ছিলেন। উত্তর ভারতের মুসলমান সমাজ যে রকম একজন স্যার সৈয়দ আহমদের মত সংস্কারক ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়েছিল, কিংবা বাঙালী হিন্দু সমাজ যেমন বিদ্যাসাগর-রামমোহনের আবির্ভাব সম্ভাবিত করেছিল, বাঙালি মুসলমান তেমন একজন ব্যক্তিত্বের উত্থান ছিল সামাজিক কারণেই এক রকম অসম্ভব। পরবর্তীকালে বাঙালি অভিজাত মুসলমান সমাজের পক্ষে একজন সৈয়দ আমির আলী জন্ম দেয়া সম্ভব হয়েছিল। সৈয়দ আমির আলী অভিজাত স¤প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। বাংলা ভাষায় তাঁর অধিকার ছিল না। তাঁর সমস্ত রচনা তিনি লিখেছিলেন ইংরেজিতে। তাঁর মধ্যে যে পরিমাণ যুক্তিবাদিতা এবং মনীষার প্রকাশ দেখা যায়, যদি তিনি বাংলা ভাষায় লিখতেন বৃক্ষ-সমাজের মত অনড়-স্থবির মুসলমান সমাজের মোহনিদ্রার অবসান আরো তাড়াতাড়ি ঘটত। কিন্তু তা ঘটতে পারেনি।
(চলবে)
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন