মুসলিম সমাজ যখন আধুনিক শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতে শুরু করেছে, তখন থেকেই তারা কলকাতা-কেন্দ্রিক ভাষাটিতে গ্রহণ করেছে। তার পরেও একটি কথা বলা যায়, কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ মুসলিম সমাজে আজকের দিনেও পুঁথিসাহিত্য আবেদন হারিয়ে ফেলেনি। সুতরাং জনগোষ্ঠীর ভিতর ফল্গুস্রোতের মত আরেকটি সমান্তরাল ভাষারীতি অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘চন্দ্রশেখর’ ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, সেই সময়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর সবচাইতে শক্তিমান মুসলমান লেখক মশাররফ হোসেন ‘শহীদে কারবালা’ পুঁথিটির একটি আধুনিক গদ্য-সংস্করণ রচনা করেছিলেন। লেখক নিজে সে গ্রন্থটির নামকরণ করেছিলেন ‘বিষাদ সিন্ধু’। মুসলমান সমাজে পুঁথির প্রভাব যে কতটা ছিল ‘বিষাদ সিন্ধু’র জনপ্রিয়তা থেকে তা অনুমান করা যায়।
মুসলমান সমাজের যে সকল লেখক বাংলা ভাষায় গদ্য-পদ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন তাঁরা প্রায় সকলেই কলকাতা-কেন্দ্রিক ভাষাটিকে প্রকাশমাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছেন। মীর মশাররফ হোসেন, কবি কায়কোবাদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক, মওলানা আকরম খাঁন প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকদের সকলকেই নগর-লালিত ভাষাটি ব্যবহার করতে দেখা যায়। এমনকি ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং মুসলমানদের পুনর্জাগরণ ঘটানোর মানসে যে সকল বই-পুস্তক রচনা করা হয়েছে, তার সবগুলোতেও ঐ ভাষারীতিরই অনুসরণ লক্ষ্য করা যায়।
পাছে প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের পাঠকেরা উপহাস করতে পারেন, এই হীনম্মন্যতা থেকেই কি মুসলমান লেখকেরা আপন সমাজে, পরিবারে; সংসারে সচরাচর ব্যবহৃত আরবী-ফার্সী শব্দসমূহ তাঁদের রচনায় যতটা সম্ভব পরিহার করতেন? বঙ্কিমচন্দ্র মীর মশাররফ হোসেনের রচনা পাঠ করে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এই লেখকের রচনায় পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ বেশি পাওয়া যায় না’। এটাকেই গ্রন্থ রচনার সবচাইতে বড় প্রশংসা বলে মুসলমান লেখকেরা কবুল করে নিয়েছিলেন।
মুসলিম লেখকেরা অবশ্য কলকাতা-কেন্দ্রিক ভাষারীতি গ্রহণ করে সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন। সব দেশেই ভাষার সর্বাধিক বিকশিত রূপটিকেই তাঁদের লেখার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করে থাকেন লেখকরা। মুসলমান সমাজের সাংস্কৃতিক নেতা বলে স্বীকৃত লেখক-কবিরাও তাই করেছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলামের বেলায় একটা ভিন্ন রকমের ব্যাপার ঘটে গেল। তাঁর রচনায় আরবী-ফার্সী এবং উর্দু শব্দাবলী প্রাণ-পাতালের উত্তাপে যেন ভাপিয়ে উঠতে থাকল। এটা কেন ঘটল, নজরুল ইসলাম এ সকল শব্দ কেন ব্যবহার করতে থাকলেন, জানা মতে কোন লিখিত কৈফিয়ত তিনি কোথাও দেননি। যদি তাঁকে কৈফিয়ত দিতে হত সম্ভবত আত্মপক্ষ সমর্থনে এ জাতীয় কথা তিনি বলতেন—মুসলমান সমাজে পেঁয়াজ-রসুনের চল্ আছে! তাই মুসলমানের রচনায় পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ থাকবেই। সেটা গোপন করা কোনো ভালো কাজ নয়। কারো নাসারন্ধ্রে সেজন্য যদি ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, করার কি আছে! এমনকি সে নাসারন্ধ্র স্বয়ং সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রেরও হতে পারে। তারপরেও তো একটি সমাজকে তার আত্মপরিচয় ফুটিয়ে তুলতে হবে। পুঁথিসাহিত্যের ভাষা নিয়ে কৃতবিদ্য পণ্ডিতেরা যতই নাসিকাকুঞ্চন করুন না কেন, এই ভাষাটি কদাপি উর্দু, আরবী এবং ফার্সী ভাষা নয়। এটা বাংলা ভাষারই একটা বিশেষ ফলিত রূপ। একটি সমাজের মধ্যে তার যথেষ্ট আদর রয়েছে এবং সেই বিশেষ সমাজের অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতাসমূহ এই ভাষার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। নজরুল ইসলাম সাহিত্যে নাসিকা-সমস্যা সমাধানের জন্য একটা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করলেন। অর্থাৎ তিনি অধিক হারে ঐ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করতে থাকলেন। তাঁর দক্ষতা সুফলপ্রসূ হয়েছিল। সর্বশ্রেণীর পাঠক ক্রমে ‘যাবনী মিশাল’ ভাষাভঙ্গীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন। হিন্দু সমাজের অগ্রণী সাহিত্যিকেরা এই অভিনব ক্ষমতা প্রকাশের জন্য নজরুলকে অভিনন্দিত করেছিলেন এবং তাঁরাই ছিলেন তাঁর সাহিত্যের প্রাথমিক সমঝদার। আর মুসলমান সমাজের চেনাজানা মানুষদের অনেকে, যাঁরা ঘরে-সংসারে উচ্চারিত শব্দসমূহ প্রকাশ্যে উচ্চারণের দুঃসাহস কখনো প্রদর্শন করেননি তাঁদেরই একাংশ, মহাসমারোহে নজরুলকে ‘কাফের’ ফতোয়া দিতে এগিয়ে এলেন। সেই মূঢ়তার আলোচনা অবশ্য বর্তমান প্রবন্ধের বিষয়বস্তু নয়।
৩
নজরুল ইসলামের আরবী-ফার্সী শব্দের ব্যবহারের মধ্যে অতীতের পুঁথিসাহিত্যের নবজীবন দানের ইশারা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু নজরুল পুঁথি লেখেননি। আধুনিক যুগোপযোগী সাহিত্য সৃষ্টি করছিলেন। শুধুমাত্র ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতদের প্রয়াসের ফলে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া একটা ভাষারীতিকে বাংলা সাহিত্যের স্বাভাবিক প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়ে বাংলা ভাষাকে জনগোষ্ঠীর সত্যিকার প্রতিনিধিত্বশীল ভাষা হিসাবে গড়ে তোলাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। এতে তিনি যে সফলতা লাভ করেছিলেন, এক কথায় তাকে অতুলনীয় বললে অধিক বলা হবে না। নজরুল মুসলমানদের ঘরে-সংসারে ব্যবহৃত শব্দসমূহ ব্যবহার করে এমন একটা প্রক্রিয়া সূচনা করলেন, যার ফলে বাংলা ভাষার অভিধান-সংকলকদের প্রতি নতুন সংস্করণে নতুন-নতুন শব্দ সংযোজনের একটা বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়ে গেল। এটা নজরুল ইসলামের একটা বড় কৃতিত্ব।
সাহিত্যস্রষ্টা হিসাবে এই ভাষারীতি ব্যবহারে নজরুলের সাফল্যের পিছনে দুটি কারণ বর্তমান। প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সময়ে এসে বাংলা ভাষা যে গতিময়তা অর্জন করেছিল নজরুল ইসলাম এই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণরূপে আত্মস্থ করেছিলেন। বাংলা ভাষা সে সর্বাধিক শব্দসম্ভার সংস্কৃত থেকে ধার করেছে, সে দিকটিতে নজরুল সজাগ এবং ওয়াকেবহাল ছিলেন। তিনি তাঁর রচনায় আরবী-ফার্সী শব্দ ব্যবহার করেছেন বটে, এমনকি ইচ্ছা করলে অন্য কোন বিদেশী ভাষার একটি শব্দও ব্যবহার না করে বিশুদ্ধ সংস্কৃত-প্রধান বাংলা গান, কবিতা, গদ্য সৃষ্টি করতে পারতেন; নজরুলের সাহিত্য-সঙ্গীতে তার প্রচুর প্রমাণ রয়েছে। নজরুল যদি পুরোপুরি এই ভাষারীতি অবলম্বন করে সাহিত্য-সঙ্গীত সৃষ্টি করতেন, তাহলে আজকে তাঁর সাহিত্যের রস গ্রহণ করার জন্য ভিন্ন ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ এবং মানদণ্ড নিরূপণের প্রয়োজন হত।
দ্বিতীয়ত, কাজী নজরুল ইসলাম মুসলিম সমাজে আত্মগোপন করে থাকা পুঁথিসাহিত্যের ভাষারীতির সঙ্গে পুরোপুরি পরিচিত ছিলেন। তাঁর বাল্য এবং কৈশোরের একটা উল্লেখযোগ্য সময় তাঁকে এই পুঁথিসাহিত্যের পরিমণ্ডলে কাটাতে হয়েছে। এই সাহিত্যের শৈল্পিক উৎকর্ষ-অপকর্ষ সম্বন্ধে একটা বিশেষ ধারণা তাঁর গড়ে উঠেছিল। সমাজের যে অংশের মানুষের মধ্যে এই সাহিত্যের চল্ ছিল, সেই মানুষদের মানস-জগৎ এবং মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে তিনি জানতেন। সর্বোপরি বোধবুদ্ধিতে পরিপক্কতা অর্জনের পূর্বে এই ধরনের সাহিত্যের প্রতি একটা অনপনেয় শ্রদ্ধাবোধ জন্মানোই হল আসল কথা। নিজের সমাজের চর্চার জিনিস কিছুতেই ফেলনা হতে পারে না। বাকরুদ্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁকে এ বোধ আমরা লালন করতে দেখি।
নজরুল সাহিত্যে বাংলা কাব্যভাষার যেমন সৃষ্টিশীল প্রকাশ ঘটেছে, তেমনি এই পুঁথিসাহিত্যের ভাষাটিও সৃষ্টিশীল নির্বাচনের মাধ্যমে বিশিষ্টতা অর্জনের পর সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে। নজরুল পুঁথিসাহিত্যের প্রাণের আগুনটুকু গ্রহণ করেছেন, তার জীর্ণ কঙ্কাল বহন করেননি। তাই নজরুল সাহিত্যের পুঁথিসাহিত্যের জীবাশ্ম দৃষ্টিগোচর হলেও সেই ভাষা-কাঠামো খুঁজে পাওয়া যাবে না। পুঁথি-লেখকেরা বাঙালি মুসলমানের স্বাতন্ত্র্য-চেতনা উজ্জ্বল করে দেখার উদ্দেশ্যেই এই বিশেষ ভাষারীতি তৈরি করেছিলেন। নজরুল স্বাতন্ত্র্য-প্রয়াসী এই মুসলিম সমাজটিকে বাঙালি সমাজেরই একটি অংশ হিসাবে প্রমাণ করার জন্যই ঐ ভাষা ব্যবহার করেছিলেন।
(চলবে)