বৈশাখের তপ্ত দুপুরের রোদে ধুলো উড়িয়ে এক অশ্বারোহী শহরের দিকে আগত,কয়েকজন উত্সাহী কপালের উপর হাত রেখে আবছাভাবে অশ্বারোহীকে বিভিন্নভাবে মাপার চেষ্ঠায় রত। কিছুক্ষণের ভিতরেই অশ্বারোহী দৃষ্টিসীমার ভিতরে চলে আসল,না এ এক সম্পূর্ণ নতুন আগন্তুক। কয়েকদিনের রোদে পোড়া তামাটে চেহারার মাঝে রুক্ষতা,অভুক্ত হিংস্র বাঘ শিকারের নেশায় যখন উন্মত্ত অচেনা-অপরিচিত আগন্তুকের সর্বাঙ্গে তারই ছাপ। উত্সাহীরা সহসাই অনুধাবন করলো এ এক ভয়ঙ্কর সুনামির পুর্ভাবাস,ঝামেলা এড়াতে দ্রুত তারা পথের অন্য লোকদের ভিড়ে মিশে গেল। আগন্তুক এগিয়ে গেল শহরের একমাত্র স্যালুনের দিকে,ঘোড়া থেকে নেমে পোড়া ঠোট থেকে চুরুটটা ফেলে ভারী জুতার নিচে সেটাকে পিষলো কতক্ষণ। আশ্চর্যজনকভাবে ঘোড়া থেকে নামার পর এক মুহুর্তের জন্যও হৌলস্টার থেকে ডান হাত সরায়নি আগন্তুক যদিও দৃষ্টি সর্বদাই নিচের দিকে। এবার ধীরে ধীরে আগন্তুক তার মাথা উপরে তুলে তীক্ষ্ণ চোখে
চারপাশ ভালো করে দেখে নিল,তারপর হ্যাট খুলে পা বাড়ালো জব্বারের স্যালুনের দিকে। আগন্তুকের প্রতিটা পদক্ষেপ যেন আপাত কোয়ায়েট পরিবেশে এক একটা ঘন্টাধ্বনির সৃষ্টি করছে আর তা বারবার ইথারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। স্যালুনের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে আগন্তুক গম্ভীর অথচ ভীষণ ভরাট কন্ঠে বলল,ওই আক্কাইচ্চা কেডা বাপের বেডা অইলে সামনে আয়া খাড়া! স্যালুনের ভিতরে যারা ছিল সবার চোখে-মুখে হঠাত করে এক অজানা আতঙ্ক,আগন্তুক এক এক জনের দিকে তাকাচ্ছে আর তারা ভীতসন্তস্ত্র ভাবে মাথা নেড়ে না বোধক প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। সবশেষে আগন্তুকের চোখ গিয়ে ঠেকলো কাউন্টারে,স্যালুন মালিক জব্বার নিবিষ্ট মনে গ্লাস ক্লিনিংয়ে ব্যস্ত আর তার ঠিক সামনেই এক লোক দরজার দিকে পিছন ফিরে লাচ্ছি খাওয়াতে মত্ত। স্ট্রো দিয়ে বিকট শব্দ তুলে লোকটা লাচ্ছি গিলছে,পিছনে কি হলো না হলো সে দিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ব্যাপারটা আগন্তুকের কাছে ইনসাল্টিং মনে হলো,সে কিছু বলতে যাবে এমন সময় লোকটা ধীর অথচ আত্মবিশ্বাসের সাথে পিছন ফিরে আগন্তুকের দিকে তাকালো। স্বাগতম কুদ্দুইচ্চা.......ইয়ালি বুশুমা ......কাহিনী একই না হলেও এমনই একটা ডুয়লের গল্প জড়িয়ে আছে আমেরিকার ১০ ডলার নোটের সাথে।
প্রথমে ইউএস ১০ ডলারের নোটটা দেখা যাক,সেখানে যার পোট্রেট দেখা যাচ্ছে তার নাম আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন। হ্যামিল্টন তত্কালীন ইউএস ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যারন বারের সাথে একবার এক ডুয়লে জড়িয়ে পরেন এবং তাতে নিহত হন। হ্যামিল্টনের ছবি প্রথমবারের মত ইউএস ১০ ডলারের নোটে আসে ১৯২৯ সালে।
জন্মপরিচয়হীন আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন (১৭৫৫/১৭৫৭-১৮০৪) ছিলেন একজন রেভুল্যুশনারী ওয়ার হিরো যিনি ইউএসের ৭ জন "জনক" এর অন্যতম, ইউএসের প্রথম সংবিধান প্রণেতাদের একজন এবং ইউএস ট্রেজারীর প্রথম সেক্রেটারি। ওয়াসিংটনের ডান হাত হিসেবে পরিচিত হ্যামিল্টনের ট্রেজারীর সেক্রেটারি থাকাকালীন সময়ে নেয়া কিছু সময়োপযোগী ও দূরদর্শী পলিসি যুদ্ধপরবর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতিকে নিজের পায়ে দাড়াতে সক্ষম করার জন্য আজও প্রশংসিত। অন্যদিকে সম্ভ্রান্ত বংশের অ্যারন বারও (১৭৫৬-১৮৩৬) কন্টিনেন্টাল আর্মির কর্নেল হিসাবে হ্যামিল্টনের মত রেভুল্যুশনারী ওয়ারে অংশ নেন। পরবর্তিতে পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ হয়ে যাওয়া বার থমাস জেফার্সনের আন্ডারে ভাইস প্রেসিডেন্টের(১৮০১-১৮০৫) দায়িত্ব পালন করেন। এই দায়িত্ব পালন কালেই বার ১৮০৪ সালে হ্যামিল্টনের সাথে ডুয়লে অংশ নেন যেখানে তার গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হ্যামিল্টন পরবর্তিতে মারা যান,যার জন্য ওই ঘটনার পর থেকে বার আজও সমালোচিত।
হ্যামিল্টন আর বার ছিলেন একজন অপরজনের আর্চ রাইভল,ইলিজিটিমিট চাইল্ড হ্যামিল্টনের রাজনৈতিক উত্থান এবং বিত্তশালী হাই সোসাইটিতে তার বিয়ের ব্যাপার বার কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। অন্যদিকে হ্যামিল্টন বারকে চরম অপছন্দ করতেন তার তুলনামূলক প্রিভিলিজ্ড ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে। ১৮০০ সালের ইউএস প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে রিপাবলিকান থমাস জেফার্সন এবং ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকান অ্যারন বার উভয়েই ৭৩টা করে ভোট পাওয়াতে একটা ডেডলকের সৃষ্টি হলে সেটা মীমাংসার জন্য হাউজ অভ রিপ্রেজেনটিটিভে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে ফেডারালিস্টরা বারকে সমর্থন দিতে থাকলে ৩৫ ভোট পর্যন্ত ডেডলকের কোনো সুরাহা হয় না,তারপরই ফেডারালিস্ট হ্যামিল্টন ৩৬তম ব্যালটটা জেফার্সনকেও পছন্দ না করলেও তাকেই দেন কারণ তার মতে "এটলিস্ট জেফার্সন ওয়াজ অনেস্ট"। ফলশ্রুতিতে জেফার্সন হন প্রেসিডেন্ট আর বার হন ভাইস প্রেসিডেন্ট। ফেডারালিস্টদের সাথে বারের শক্ত লবিংয়ের কারণে ১৮০১ সালে হ্যামিল্টন পার্টি থেকে সরে দাড়াবেন বলে ঘোষণা দেন যদি ফেডারালিস্টরা বারকে প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যান্ডিডেড হিসেবে নমিনেইট করে। আর প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার সুযোগ নেই এটা বুঝতে পেরে বার ১৮০৪ সালে ফেডারালিস্টদের সমর্থনে নিউ ইয়র্কের গভর্নরের পদে প্রতিদ্বন্দিতা করেন কিন্তু এখানেও হ্যামিল্টন বাগড়া দিয়ে জেফার্সন সমর্থিত মর্গান লুইসের জয়ে সাহায্য করেন। একজনের প্রতি আরেকজনের কাদা ছুড়াছুড়ি অবশ্য কখনই থেমে থাকে নি,এরই ধারাবাহিকতায় ভাইস প্রেসিডেন্ট বার হ্যামিল্টনকে তাকে উদ্দেশ্য করে বলা বাজে কথার জন্য ক্ষমা চাইতে বলেন কিন্তু হ্যামিল্টন সেটা প্রত্যাখান করেন। ক্ষিপ্ত বার হ্যামিল্টনকে ডুয়ল চ্যালেঞ্জ করে বসেন আর প্রথানুযায়ী হ্যামিল্টনকেও তাতে সাড়া দিতে হয়।
জুলাই ১১,১৮০৪ সালে নিউ জার্সির উইহোকেনে ডুয়ল স্ক্যাজুয়ল করা হয়,তিন বছর আগে ঠিক একই দিনে হ্যামিল্টনের বড় ছেলে ফিলিপকে হত্যা করা হয়ছিল। দিনের শুরুতেই ডুয়লের জন্য দুজন মুখোমুখি হন,গুলি ছোড়ার পর পরই বারের গুলিতে উদরের নিম্নাংশে ডান হিপের উপরে আঘাত পেয়ে হ্যামিল্টন মাটিতে লুটিয়ে পরেন আর হ্যামিল্টনের গুলি বারের মাথার উপর দিয়ে গাছের ডালে আঘাত করে। কিন্তু হায় এটা যে হ্যামিল্টনের পূর্বপরিকল্পিত ছিল,আগের দিন রাতেই হ্যামিল্টন লিখে যান মর্মস্পর্শী এই কথাগুলো "আই হেভ রিজল্ভড,ইফ আওয়ার ইন্টারভ্যিউ(ডুয়ল) ইজ কন্ডাকটেড ইন দি ইউজ্যুয়ল ম্যানার এন্ড ইট প্লিজেজ গড টু গিভ মি দি অপরচুনিটি টু রিজার্ভ এন্ড থ্রৌ অ্যাওয়ে মাই ফার্স্ট ফায়ার এন্ড আই হেভ থটস ইভেন অভ রিজার্ভিং মাই সেকেন্ড ফায়ার"(আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি,যদি আমাদের সাক্ষাত(ডুয়ল) প্রচলিত প্রথানুসারেই হয় এবং আমার নিজেকে সংবরণ করা ও লক্ষ্যহীনভাবে প্রথম গুলি ছোড়া সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করে সেক্ষেত্রে এমনকি দ্বিতীয় গুলির ক্ষেত্রেও নিজেকে সংবরণ করার আমার চিন্তাভাবনা আছে)। প্রথম কে গুলি ছুড়েছিল সেটা অবশ্য মিমাংসা করা সম্ভব হয় নি,বারের গুলি হ্যামিলটনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় ফলস রিবস ভেদ করে ভিতরে ঢুকে পরে। সংকটাপন্ন হ্যামিল্টনকে নিউ ইয়র্কে তার এক বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে পরদিন জুলাই ১২ তারিখ দুপুর বেলা হ্যামিল্টন মারা যান। ম্যানহাটনের ট্রিনিটি চার্চইয়ার্ড সেমেটরিতে হ্যামিল্টনকে সমাহিত করা হয়।
অবশ্য কারো কারো মতে যদি কোনো ডুয়লিস্ট তার প্রতিপক্ষকে নিশানা না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে সেক্ষেত্রে সবাই জানে এমন একটা প্রসিজার আছে এবং অ্যাপার্যান্টলি হ্যামিল্টন তা ফলৌ করেননি। যদি হ্যামিল্টন সেটা করতেন সেক্ষেত্রে বারও হয়ত তাকে ফলৌ করতেন এবং হ্যামিল্টনের মৃত্যুও ঠেকানো যেত।
সবাই যখন এই শোকে কাতর,বার ফিরে আসেন তার দায়িত্বের অবশিষ্ট সময় শেষ করার জন্য। অবশ্য তখন তার বিরুদ্ধে মার্ডার চার্জের কথা উঠলেও যেহেতু ডুয়লের সব রুলস যথাযথভাবে মানা হয়েছিল তাই আর কোনো অভিযোগ গঠন করা হয় নি।
নোট:ভাষার মাসের প্রথম লেখা বলে ভিন্নভাবে উপস্থাপনা!