প্রথম পর্বে ৮ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি পেলেন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা। তারা হলেন নেপালের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি রামবরণ যাদব। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গণহত্যা বন্ধে এবং বাংলাদেশের জনগণকে সহায়তার জন্য ভারতের সঙ্গে কাজ করেন। প্রয়াত ভুটানের তৃতীয় রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক। অর্থনৈতিকসহ সার্বিকভাবে সহায়তার জন্য তিনি এ সম্মাননা পান। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েত প্রেসিডিয়ামের চেয়ারম্যান প্রয়াত লিওনেদ ইলিচ ব্রেজনেভ, একই সংগঠনের চেয়ারম্যান নিকোলাই ভিক্টোরোভিচ পদগোর্নি এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মন্ত্রিপরিষদের চেয়ারম্যান আলেক্স নিকোলেভিচ কোসিগিন এ সম্মাননা পান। সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রয়াত মার্শাল জোসেফ ব্রজ টিটোও এ সম্মাননা পান। জোটনিরপেক্ষ নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন মুক্তি আন্দোলনের সমর্থক। যুক্তরাজ্যের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড রিচার্ড জর্জ হিথ সেই ব্যক্তি, যিনি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর লন্ডনে গেলে তাকে সম্মানের সঙ্গে বরণ করেন। আবার গণহত্যা বন্ধেও তিনি ইয়াহিয়া খানকে চিঠি পাঠান। তাকেও সম্মাননা জানায় বাংলাদেশ। এ পর্বে আরো সম্মাননা পান নেপালের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বিশ্বেশ্বর প্রসাদ কৈরালা।
গতকাল মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা দেওয়া হয় ৭৪টি। এর মধ্যে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন রয়েছে। এ সম্মাননা পায় ভারতীয় জনগণ এবং মিত্রবাহিনী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় জনগণ আন্তরিকতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দেশের জনগণকে খাদ্য, আশ্রয়, সেবা দিয়ে সাহায্য করেছিল। এরই স্বীকৃতিতে এ সম্মাননা গ্রহণ করেন বাংলাদেশে তাদের বর্তমান রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণ।
মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করায় স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাদের মিত্রবাহিনীকে। এটি গ্রহণ করেন তাদের প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী পল্লম রাজু। মৈত্রী সম্মাননা পান যুক্তরাজ্যের তৎকালীন এমপি মাইকেল বার্নস। তিনি পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের ব্রিটেন সফর বাতিলের দাবিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রস্তাব পেশ করেন। জার্মানিতে প্রবাস জীবনযাপনকালে বারবারা দাশগুপ্ত ও জার্মানির সুনীল দাশগুপ্ত দম্পতি মিলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে অনেক অর্থ সংগ্রহ করেন। পরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেন। ভারতের রথীন দত্ত পদ্মশ্রী আগরতলা সরকারি হাসপাতালে শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছিলেন। ভারতের রাজমাতা বিভু কুমারী দেবী রাজপ্রাসাদের দরজা শরণার্থীদের জন্য খুলে দিয়েছিলেন। যুক্তরাজ্যের সাংবাদিক সায়মন ড্রিং ২৫ মার্চের গণহত্যার কথা প্রথম বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। তার সাংবাদিকতায় ফুটিয়ে তোলেন এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের কথা, তাদের প্রতি বর্বর নির্যাতনের চিত্র। যুক্তরাজ্যের জুলিয়ান ফ্রান্সিস সীমান্তবর্তী এলাকায় শরণার্থীদের মধ্যে খাদ্য ও সেবা দেওয়ার কাজ করতেন। ভারতের অরুন্ধতী ঘোষ ভারত সরকারের লিয়াজোঁ অফিসের কর্মকর্তা হিসেবে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে প্রয়োজনীয় সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করেন। ভারতের আই পি গুপ্তা, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জ্যাক ফ্রেডেরিক রালফ জ্যাকব কমডেশন অব মেরিট, পিভিএসএম ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ হিসেবে মুক্তিবাহিনী গঠন, যুদ্ধ পরিকল্পনা এবং যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের দলিল প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের লিয়ার লেভিন প্রামাণ্য চিত্র ধারণ করে তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে রাখেন। যুক্তরাজ্যের বিমান মলি্লক মুজিব নগর সরকারের সময় দেশের প্রথম ৮টি ডাকটিকিটের নকশা তৈরি করেন কিন্তু এর কোনো পারিশ্রমিক নেননি। জাপানের তায়োশি নারা জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী সংগঠন তৈরি করেন। ভারতের ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার যুবক বয়সে স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে খাদ্য ও সেবা দিয়ে মানবিক সহায়তা করেন। আয়ারল্যান্ডের ব্যারিস্টার নোরা শরীফ আয়ারল্যান্ডে বাঙালি জনগণের কাছে প্রচারপত্র বিলি ও আলোচনা করে তাদের সচেতন করার জন্য কাজ করেন। জাপানের তাকাওশি সুজুকি জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী সংস্থার সক্রিয় সদস্য হিসেবে শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনে যান ও তহবিল সংগ্রহ করে সহায়তা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফাদার রিচার্ড উইলিয়াম টিম গণহত্যা ও নির্যাতনের তথ্য গোপনে বিদেশে পাঠিয়ে জনমত তৈরি করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড রিচার্ড উইসব্রড ও উইলিয়াম গ্রিনফ, ডেনমার্কের কিস্টেন ওয়েস্টগার্ড মুক্তিযুদ্ধের সময় ডেনমার্কে গঠিত অ্যাকশন কমিটির সভাপতি ছিলেন। নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনের মাধ্যমে সেখানে গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। রাশিয়ার প্রয়াত রিয়ার অ্যাডমিরাল সার্জি প্যাভলোভিচ জুয়েনকো এবং তার দলের কর্মীরা বিধ্বস্ত চট্টগ্রাম বন্দর সচল করতে সক্ষম হন। এ সময় এক সোভিয়েত নাবিকের মৃত্যু হয়। আনাতোলি ভি সোকোলভ, কনস্টানটিন আই সুসলিকভ মৈত্রী সম্মাননা পান। ভারতের প্রয়াত দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আকাশবাণীর সংবাদ, সংবাদ পরিক্রমা ভরাট ও দরদি কণ্ঠে পাঠ করে বাঙালিদের উজ্জীবিত করার কাজ করতেন। ভারতের দশরথ দেব বর্মণ ত্রিপুরার আদিবাসী নেতা হিসেবে বহু শরণার্থীকে সহায়তা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের আর্চার কে বস্নাড একজন কূটনীতিক হয়েও নিজ দেশ পাকিস্তানের পক্ষে থাকলেও তিনি মুক্তিকামী বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ নিয়েছিলেন। ভারতের প্রয়াত দিলীপ চক্রবর্তী কলকাতা সহায়ক সমিতির সম্পাদক হিসেবে শরণার্থীদের সহায়তা জোগানো, ভারত সরকার ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে মূল্যবান ভূমিকা রাখেন। প্রয়াত ব্যারিস্টার সুব্রত রায় চৌধুরী দক্ষ আইনজীবী হিসেবে দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরিতে সহযোগিতা, কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী ফোরাম তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও সহযোগিতা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত সিনেটর ফ্রাঙ্ক ফোরেস্টার চার্চ মার্কিন কংগ্রেসে গণহত্যার কথা তুলে ধরে পাকিস্তানকে অর্থ সাহায্য বন্ধের অনুরোধ জানান। ভারতের ডি পি ধর সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তি প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, বোম্বেতে বিশেষ কনসার্ট করে অর্থ সংগ্রহ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত এডওয়ার্ড সি ডমিক জুনিয়র ওয়াশিংটনে ও বিভিন্ন ফোরামে এ দেশের যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের অনুরোধ করেন। রাশিয়ার প্রয়াত রাষ্ট্রদূত আনাতোলি ডবরিনিন, প্রয়াত নিকোলাই ফেরিবিন, প্রয়াত আন্দ্রেই আন্দ্রেভিচ গ্রমিকো, প্রয়াত প্রজ কিরিয়স্ট কোসেচই, প্রয়াত ইয়াকভ আলেকজান্দ্রোভিচ মালিক, যুক্তরাজ্যের প্রয়াত ব্রুস ডগলাস মান, ভারতের শহীদ ল্যান্সনায়েক আলবার্ট এক্কা, পরম ভীর চক্র, যুক্তরাষ্ট্রের শহীদ ফাদার উইলিয়াম পি ইভান্স ও রেভেরেন্ড ফাদার আগিন হোমরিচ সিএসসি, প্রয়াত জন কেনেথ গালব্রেইথ, কর্নলেস এডওয়ার্ড গালাঘার, প্রয়াত জোসেফ গার্স্ট, ভারতের পি এন হাসকর, জাপানের প্রয়াত তাকাশি হায়াকাওয়া, ভারতের প্রয়াত ভূপেন হাজারিকা, প্রয়াত ওস্তাদ আলী আকবর খান পদ্মবিভূষণ, আয়ারল্যান্ডের প্রয়াত সিন ম্যাকব্রিজ, ফ্রান্সের প্রয়াত আন্দ্রে মালরাক্স, ভারতের প্রয়াত ফিল্ড মার্শাল এস এ এম মানেকশ পদ্মভূষণ, মিলিটারি ক্রস, ভারতের প্রয়াত বিচারপতি সৈয়দ সাদাত আবুল মাসুদ পদ্মভূষণ, সুইডেনের প্রয়াত গানার মার্ডাল, ভারতের প্রয়াত সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, অন্নদা শঙ্কর রায়, প্রয়াত অংশুমান রায়, পূর্ণ আগতক সাংমা, প্রয়াত রওশন আরা বেগম সাংমা, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর উইলিয়াম বে সাক্সবে, ভারতের প-িত রবি শঙ্কর ভারত রত্ন, যুক্তরাজ্যের প্রয়াত লর্ড পিটার ডেভিড শোর, ভারতের ড. করণ সিং, শচীন্দ্র লাল সিং, প্রয়াত সরদার শরণ সিং, রাশিয়ার প্রয়াত ভালদিমির স্ট্যানিস, যুক্তরাষ্ট্রের রিচার্ড কে টেইলর, যুক্তরাষ্ট্রের আন্না ব্রাউন টেইলর, ভারতের মেজর জেনারেল এস এস উবান, জাপানের প্রয়াত নায়োকি উসাই, ইতালির শহীদ ফাদার মারিও ভেরোনিস। যেসব প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা জানানো হয় সেগুলো হলো : আকাশবাণী (অল ইন্ডিয়া রেডিও), ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি), ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেডক্রস (আইসিআরসি), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতি, অক্সফাম এবং জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড ন্যাশন্স হাইকমিশনার ফর রিফিউজি (ইউএনএইচসিআর)
চিনে নিন তাঁদের - শাহনেওয়াজ লতিফ