সৃষ্টিশীলতার প্রতি
শুধু তোমাকে সালাম-- আর কাউক্কে তোয়াক্কা করি না,
আর-সব-পায়ে-দলা মুথাঘাস-- শুধু তুমি ঘাসে রত্নফুল,
আর-সব নোংরা টাকা-পয়সার মতো : হাতে-হাতে ঘোরে-ফেরে--
শুধু তুমি অমল-ধবল তুমি,
তোমার আহারে শুধু ঘড়ি লাগে-- আর-কিছুই রোচে না তোমার,
নামো ঝরনা ফাটিয়ে পাথর-- সৃষ্টি তার মুখোশ ছিঁড়েছে,
বস্তুর বিরুদ্ধে শুধু অফুরান প্রজাপতি ওড়ে ॥
___________________________________________
আলোক সরকার আর অন্ধকার রায়
‘একি, আপনি বাজারে? কবিশাহেব, আপনিও কি বাজার করেন?’
--হ্যাঁ, আমাকেও বাজার করতে হয়,
আমাকেও তেল-নুন-মাংসের হিশেব কষতে হয়--
আমি নই বায়ুভুক রবীন্দ্রনাথ।
কবিতাকেও হতে হয় পৌরুষেয়--
শুধু নারীলাবণিগ্রস্ত নয়।
বসন্তের সংঘর্ষে জ্বলে উঠতে হয় আগুনের মতো।
জীবনানন্দকেও একদিন খালি গায়ে দুই হাতে দুই ভরা পানির বালতি
বয়ে নিয়ে যেতে দেখেছিলেন
অনুজ কবি আলোক সরকার আর অন্ধকার রায় ॥
__________________________________________
কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড
এখানে কবিতা বানানো হয়।
সব ধরনের কবিতা।
রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।
নাগরিক কবিতা, গ্রামীণ কবিতা।
প্রেমের কবিতা, শরীরের কবিতা।
স্বপ্নের কবিতা, বাস্তবের কবিতা।
চল্লিশের কবিতা, পঞ্চাশের কবিতা।
ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা।
আশির কবিতাও আমরা বাজারে ছাড়ছি শিগগিরই।
কবিতার হাত, পা, মাথা, ধড়,
শিশ্ন, যোনি, চুল, নখ,
চোখ, মুখ, নাক, কান,
হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল--
সব-কিছু মওজুদ আছে আমাদের এখানে।
স্বদেশি ও বিদেশি উপমা ও চিত্রকল্প,
শব্দ ও ছন্দ,
অন্ত্যমিল ও মধ্যমিল
লক্ষ লক্ষ জমা আছে আমাদের স্টকে।
ব্যাঙের ছাতার মতো আরো অনেক কবিতার কোম্পানি
গজিয়েছে বটে আজকাল। কিন্তু,
আপনি তো জানেনই,
আমাদের কোম্পানি ইতোমধ্যেই বেশ নাম করেছে।
আর ফাঁকি দিয়ে কি খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব,
বলুন?
হ্যাঁ, আপনার অর্ডার-দেওয়া কবিতাটি এই-তো তৈরি হয়ে এলো।
চমৎকার হয়েছে।
ফিনিশিং টাচ শুধু বাকি।
একটু বসুন স্যার, চা খান,
কবিতার কয়েকটা ইস্ক্রুপ কম পড়ে গেছে আমাদের,
পাশের কারখানা থেকে একছুটে নিয়ে আসবার জন্যে
এখখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি লতিফকে।
_____________________________________________
গ্রিনরোড
একদিন কুলিরোড ছিলে।
হাঁটু অব্দি ডোবানো ধুলোয় ছিলে এক নির্জন তাপস।
অড়হরখেতে একদিন দেখেছিলাম তরুণ খরগোশ
যেন কোন প্রাকৃতিক নিবিড় নিখিলে
বিদ্যুচ্চমক তুলে মিশে গিয়েছিলো মটরশুঁটির খেতে।
লাল-কালো কুঁচফল পেড়েছি একদিন সান্দ্র ঝোপ থেকে
দেখেছি ধানখেত, কামময়, গভীর খোড়ল, কৈশোরক নিরুদ্বেগে,
কৌতূহলে। তারপর সপ্তর্ষির নৈশ সংকেতে
আমগাছ জামগাছ কাঁঠালগাছের শ্যাম
ক্রমাগত মুছে মুছে উঠে আসছে তরুণ বিল্ডিং,
নিভে যাচ্ছে ঘাস, উবে যাচ্ছে নিবিড় বৃষ্টির দিন;
তবু তোমাকে কেন্দ্র রেখে একদিন ঝরেছে যে-পাতার শিকল
ধরিত্রীরই কোনোখানে যে-সব রয়েছে অবিকল--
অনশ্বর, অবিচ্যুত, স্বপ্নবিদ্ধ, নির্লিপ্ত, সকাম ॥
___________________________________________
পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ
পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ ঝর্না থেকে নেমে এসেছিলো।
এখন, রহস্যময় জলে, খেলা করে অবিরল।
পদ্মায় গিয়েছে একটি-- মেঘনায়-যমুনায়-সুরমায়--
আর-একটি গোপন ইচ্ছায়। পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ
ঝর্না থেকে নেমে এসে সাঁতরে চলে বিভিন্ন নদীতে।
পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ জলের রহস্য ভেদ করে
এখন একাকী এক শব্দহীন সমুদ্রে চলেছে॥
___________________________________________
সেরগেই এসেনিন বলছে
ইসাডোরা, বার্লিনে তোমার সঙ্গে আছি আমি।
আমার সঙ্গে আরেক কবি - গাধাও বলতে পারো -
গলায় ঝোলানো গিটার,
খামোখাই,
বাজাতে-টাজাতে পারে না।
কোত্থেকে এলেন আমাদের সেই মহাকথাশিল্পী,
ম্যাকসিম গোর্কি।
চেহারা ভাঙাচোরা হলে কী হবে,
চোখ দুটিতে তাঁর যেন ছুরির ঝলক,
সেই চোখ সব-কিছুর অন্তস্তলে ঢুকে যায়।
আমার দিকে তাকিয়ে গোর্কি,
চোখে স্নেহ ঝরে পড়ছে,
বললেন, ‘এসেনিন, কবিতা লিখছ তো?’
আমি পাশের গাধা-কবিটার সঙ্গে
তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলাম।
ছোট্ট একটা ঘরের মধ্যে তুমি নাচছ, ইসাডোরা।
মরচে-রঙা পোশাক তোমার।
তোমার আধ-খোলা স্তনজোড়ার বিভাজিকায়
একগুচ্ছ মলিন ফুলের স্তবক।
নাচছিলে তুমি -
কী-যে বিচ্ছিরি লাগছিল তোমাকে!
গেলাশে চুমুক দিয়ে
তাকাচ্ছিলাম চোখের কোনায়।
তারপর
ক্লান্ত হাঁটু মুড়ে
একটা মাদি-ঘোড়ার মতো
যেন ভেঙে পরলে আমার পায়ের কাছে।
ঠোঁটে অর্থহীন বাঁধানো হাসি নিয়ে
তাকালে আমার দিকে।
আমি তো তোমার ভাষা জানি না।
রিয়াজানের ছেলে আমি।
ইঙ্গিতে,
কনুইয়ের ঠেলায়,
হাঁটুর গুঁতোয়
আমার কথা ঠিকঠাকই জানিয়ে দিচ্ছিলাম তোমাকে।
এখানে যারা আছে তারা কিছু না-বুঝলেও,
গোর্কির তীক্ষ্ম চোখই বলে দিচ্ছিল :
আমি তোমার শরীরের
গোপনতম তিলটিরও খোঁজ রাখি।
আমাকে যখন কবিতা আবৃত্তি করতে বলা হলো,
উঠলাম।
আমার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে
ওঠানামা করছিল আমার হাত।
শ্রোতা-দর্শকদের চোখ-মুখ জানিয়ে দিচ্ছিল
তারা কিরকম উদ্দীপিত হয়ে উঠছে।
বিশ্ববিখ্যাত হতে পারো তুমি,
কিন্তু তোমার নৃত্যের ঘূর্ণি-যে অন্তত আজ,
এখানে,
এই আসরে,
কিছু নয় -
সেটাও আয়নার মতো পরিষ্কার ফুটে উঠছিল
ওদের চোখে।
আর তারপর তুমি
বেহায়ার মতো
সব রুশীদের চুমো খাচ্ছিলে।
মদ-জড়ানো গলায়
বলছিলে তোমার ভাঙা রুশ ভাষায়,
‘আহা, রাশিয়ানরা কত ভাল!
এরকম দেখিনি আর-কোথাও!’
সব বাহানা!
সবাইকেই তুমি বলো ওরকম!
এ তো আমার নিজের চোখে দেখা -
মার্কিনিদের সঙ্গে,
ব্রিটিশদের সঙ্গে,
ফরাশিদের সঙ্গে
একই তোষামুদে ভাষায় কথা বলেছ।
একেবারে একই ভাষায়।
ছিঃ!
রিয়াজানের গ্রামীণ যুবতীরাও তোমার চেয়ে সুন্দর!
*
আমি বেরিয়ে এলাম।
একা।
বার্লিনের পথ-ঘাট কিছু চিনি না।
ঘুরতে ঘুরতে নদীতীরে এলাম।
কে-একজন বলল, এর নাম বুড়িগঙ্গা নদী!
আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
এই নদী থেকে অন্য নদীতে পড়ব -
সেই নদী থেকে আরেক নদীতে -
এম্নি করে পৌঁছে যাব একদিন
ইছামতী নদীতে।
তারপর সাঁৎরে উঠব পাড়ে।
পৌঁছে যাব জালালপুর গ্রামে।
আম-জাম-কাঁঠালগাছে সবুজে-সবুজ
আমাদের সেই বাড়িতে গিয়ে উঠব।
সেখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে সবাই।
___________________________________________
একটি গ্রামের কথা
লোকে জিগেস করে—
তোমার কবিতায় এত বিষণ্ন রঙ কেন আজকাল?
কোনো জবাব দিই না।
বলব কি পিকাসোর উত্তরটি?
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে।
পিকাসো প্যারিসে তাঁর স্টুডিওয়।
স্পেনের একটি গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেল জর্মান বোমা বর্ষণে।
গের্নিকা।
পিকাসো সেই বিধ্বংস গ্রামের ছবি আঁকলেন ক্যানভাসে।
জর্মান সৈনিকরা প্যারিসে ঢুকে পড়ল একদিন।
স্টুডিওয় ঢুকে পিকাসোকে জিগেস করল—
এই ছবি কি তুমি এঁকেছ?
উত্তর দিলেন পিকাসো—
না। এসব এঁকেছ তোমরা।—
—মুশকিল হলো আমি মুখ ফুটে কথা বলতে পারি না।
না হলে বলতাম লোকজনকে—
যে-বিমর্ষতা দেখছ আমার কবিতায়,
তার কারণ এক ভয়ংকর বোমারু বিমান।
আমার শান্ত সবুজ নদী-বয়ে যাওয়া গ্রামটির ওপরে
অহৃদয় বোমার পর বোমা ফেলে
এ রকম তছনছ করে দিয়েছে যে—
তাকে আমি চিনি।
শুধু তার নাম আমি তোমাদের বলব না।
পিকাসোর মতো সাহস নেই আমার।
তখন শুধু সেই শ্যামল গ্রামটির স্মৃতি
আমাকে কষ্ট দিচ্ছে এত।
তাই আমার কবিতায় আজকাল দ্যাখো এত বিমর্ষতা।
আনন্দ কাকে বলে—আজ আর মনে নেই আমার।
আমার সেই গ্রামে তাবত্ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে
শুধু একটি গাছ
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
যার ডালে একটিও পাখি বসে না আজ আর।
যার কোনো ফুল ফোটে না।
কোনো ফলও না।
শুধু কী এক গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে।
আমি সেই গাছ।
সেই গাছ।
__________________________________________
সোনালি আর ডালিয়া
সোনালির সঙ্গে ডালিয়ার দেখা হয়ে গেল একদিন।
ডালিয়াকে জড়িয়ে ধরল সোনালি।
ডালিয়া বলল—আপনি কে?
সোনালি বলল—আমি সোনালি।
কত নাম শুনেছি তোমার।
তোমাকে তো দেখামাত্র চিনে ফেললাম।
ডালিয়া বলল—কার কাছে নাম শুনেছেন আপনি?
নাম বলল সোনালি।
ছায়া নামল ডালিয়ার দুধের মতো ফরসা মুখমণ্ডলে।
বলল শুধু—ও।
সোনালি বলে—মুখ কালো হয়ে গেল কেন তোমার?
উনি সারাক্ষণই তোমার কথা বলেন।
ম্লান মুখে ডালিয়া বলল—
সে-সব কথা ভুলে গেছি আমি।
আমার কথা বলে লাভ আছে আর?
সোনালির উত্তর—সে-কথা আমিও বলি।
কবিতা লিখে কী হবে?
জীবনে তো...
তারপরই সোনালি বলে—
ওনার আসল কে, চেনো না তুমি।
—কে?—
সোনালি হাসতে থাকে।
—তুমি আমি কেউ না। তার নাম কবিতা।
—কে মেয়েটা?
সোনালি বলে—চলো, কোথাও বসি।
কফি খেতে খেতে তোমাকে বলছি সব।
________________________________________
তেস্রা জুলাই
উত্তাল আবেগে অঝোরে কবিতা লিখে যাচ্ছিলাম।
আর ঐসব খসড়া কবিতাই পড়ে শোনাচ্ছিলাম তোমাকে।
অনেক কবিতাই শুনে স্তব্ধ হয়ে যেতে তুমি।
কথা বলতে পারতে না।
আমি জোর করে দু-একটা মন্তব্য শুনতাম তোমার কাছ থেকে।
আমাদের কথা চলছিল
সকালে দুপুরে বিকেলে রাতে_সব সময়।
মুখোমুখি আর টেলিফোনে আর সেলফোনে।
কোথায়-কোথায়-না আমরা মিলেছি পরস্পর।
একটিই লক্ষ্য ছিল : লোকচক্ষুর অগোচর হয় যাতে
আমাদের কথা কেউ শোনেনি।
দেখেছে-পড়েছে আমার কবিতা।
তুমি-আমিই জেনেছি
কথা আর কবিতা দুটি আলাদা জিনিস।
যে-সব কথা তুমি আমাকে বলেছ,
আমি বলেছি তোমাকে_
তা আমি কাউকে জানাতে পারি না।
লিখতেও পারি না।
চিরকালের মতো সে-সব কথা
তোমার-আমার ভেতরে বন্দি হয়ে থাকবে।
লোকে দেখবে-পড়বে শুধু আমার কবিতা।
কবিতা যে কথার ভেতরের কথা ধরতে পারে না,
সে শুধু জানি তুমি আর আমি।
তারপর এল তোমার-আমার মধ্যে সাগরপাড়ের ব্যাধি।
আমাদের কথা শেষ।
কবিতাও লিখি না আমি আর।
কথার সঙ্গে কবিতার কি তাহলে একটা সাঁকো আছে ভেতরে?
কী জানি।
তোমার সঙ্গে দেখাও হয় না আর।
কথাও হয় না।
আমার সব উত্তালতা এখন স্থির হয়ে গেছে।
যেন কোনো জাদুমন্ত্রবলে।
খাবার সময় খাই।
শোবার সময় শুয়ে পড়ি।
ডাক্তার সাহেব সব নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন।
বারান্দায় বসে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
গাছের কাছে গিয়ে বসে থাকি চুপচাপ।
আমার অতিপ্রিয় রঙ-চাও খাই না আর।
তারপর দেখা হলো তোমার সঙ্গে
তেস্রা জুলাইয়ে।
পরস্পরকে আমরা দেখলাম কি না জানি না।
আমরা বসে থাকলাম দুটি আলাদা সোফায়।
যে আমরা দেখা হলে হতাশ কলকণ্ঠ_
ফুটে উঠত তোমার মুখে জ্যোতি_
আমি যেন টগবগ করে ফুটতাম
কেশর-তোলা একটা ঘোড়ার মতো_
সেই আমাদের ভেতরে এখন স্তব্ধতা।
তোমাকে বলব বলে কত কিছু ভেবে এসেছিলাম_
কিছুই মনে পড়ছিল না।
কিছুই বলতে পারলাম না।
তুমিও না।
এক ঘণ্টা শুধু আমরা নিস্তব্ধ বসে থাকলাম মুখোমুখি।
আমার সামনে খাবার পড়ে থাকল।
রঙ-চা নিথর হয়ে গেল।
রাত্রি থেমে থাকল যেন বাইরে।
ঘণ্টা-মিনিটও নিশ্চল।
সময় হলে তুমি দরোজা খুলে দিলে।
আমি হাত তুললাম।
তুমি হাত তুললে।
আজ সকালবেলা একটা কথা জাগছে মনে।
একসময় আমরা শব্দ দিয়ে অনেক বাক্য তৈরি করেছি,
কবিতা লিখেছি আমি সেও শব্দ দিয়ে।
তেস্রা জুলাইয়ে নৈঃশব্দ্য কথা বলেছিল,
কবিতা লিখেছিল।
___________________________________________
মালার স্মৃতি
'মনে রাখার দিন গিয়েছে, এখন ভোলার পালা!'
_প্রশ্ন আমার : ভুলতে কি পেরেছিলেন কাজী কবি স্বয়ং?
বর্ণহীন জীবনে কেউ ভুলতে পারে ভালোবাসার রঙ?
মালার স্মৃতি থেকেই যায়, যতো শুকোক মালা!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ৯:২২