আকাঙ্খিতভাবেই ছিড়ে গেল অতীত জীবনের শেষ বন্ধন।
দীর্ঘসময় ধরে খুঁজে খুঁজে নানা উপায়ে যাচাই শেষে, একটার পর একটা ভাবনা মিলিয়ে, প্রতিটি পরতে কারুকার্য এঁকে সাজিয়েছিলাম যেই জীবন। যাযাবর সব ফ্যান্টাসীতে ভরা ছিল, সেইসব ফ্যান্টাসীগুলোর সাথে তুলনা হতে পারে শুধুই কলম্বাসের যাত্রাপূর্ব ফ্যান্টাসী।
সকল সুহৃদের আহাজারি উপেক্ষা করেই নব জীবনের খোঁজে অভিযানে নেমেছিলাম। পথে প্রচন্ড নেতিবাচক সময়ের সাথে লড়াই করে তিলে তিলে সামলে উঠতেও শিখছিলাম। সেই সাথে ছোট ছোট ঝড়ে বিপন্নবোধ করাও চলছিল। একলা সেই অভিযান কখনো কখনো বড়ই রুক্ষ ঠেকেছিল। অতি কোমল স্বত্ত্বাটা ছিল প্রত্যক্ষ মায়াহীন। সেই আপাত যাযাবর আসলে ছিল অবাল্য চর্চা'র ফলে তৈরী এক নিখুত অভিমানী মানুষ, তাই পূবের মেঘ দেখে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিত সে। পরক্ষনেই মেঘটিকে ব্যাথা দেয়ার অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে, তার ভেঙে যাবার আগেই হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাতো।
এমনই একদিন, একখন্ড পূবালী মেঘের সাথে অভিমান করে, নীল সাগরের আভায় রাঙা মুখ ফিরিয়ে নিতেই মনে রহস্যময় ব্যথা মুচড়ে উঠলো। তাকিয়ে দেখলাম মুহুর্তেই মেঘটি ভেঙে গেছে,
যেন আজ সে অভিমান করলো।
সেই রহস্য ভেদ হলো এর কিছুদিন পর।
এক সন্ধ্যায় নিখুত অন্ধকার আকাশের পূব কোণে, এক বিশাল পূবালী মেঘখন্ড টুকরো টুকরো হয়ে যায় আমার দৃষ্টি'র বাইরেই। শুধুমাত্র বজ্রপাতটিই শুনেছিলাম। আতংকিত চোখে সকালের ছিন্নবিচ্ছিন্ন মেঘখন্ড দেখলেও তা অনুভব করতে পারি নাই। শুধু অনুভবেই ব্যার্থ হইনি বরং সেই তখন অনুভুতিই হারিয়ে ফেলেছিলাম। শুধু বুঝেছি রাতের আঁধারে বাংলার বর্ষা এল বলে।
এল সেই বর্ষা। রইলো বহুদিন, অবশেষে চলেও গেল।
কিন্তু হারিয়ে ফেললাম অন্যান্য সকল ঋতু!
শরৎ ও হেমন্ত সদ্য সমাপ্ত বর্ষার বিষাদময়তার কথা জানতো বলেই আমাকে নব্য উদ্যোমে মেতে উঠার জন্য তাড়া দেয়নি। শীতটা ছিল প্রচন্ড ঠান্ডা এ্যাসিডের মতই শীতল।
এরপর বসন্ত এলো। চারদিকে রঙ মাখিয়ে নবজাতক পত্র-পল্লবের মতই কোমল হয়ে, কিন্তু বর্ষার বিষাদ আমার গেল না!
বসন্ত এবার কলকাকলী মুখর হলো, বর্ষায় আক্রান্ত বিষন্ন আমার মোটেও ভাল লাগলো না সেই কোলাহল!
ব্যর্থতাজনিত একটু ব্যাথা পেলেও হাল না ছেড়ে বসন্ত এবার এলো তার রেনু উড়ানো যৌবনের মাদকতা সহ, আমি শুধু মাদকটুকুই গ্রহন করলাম, নতুন করে আসক্তিটুকু গ্রহন করলাম কিন্তু বর্ষার বিষাদটুকু তাড়ালাম না।
সময়ের নিয়মে এবং ঋতুগত "মানবিক" সীমাবদ্ধতায় বসন্তে ভাটা এলো, নিয়মিত অবহেলা ও অনাদরে, উপযুক্ত কদরের অভাবে এবং আমার অভিশপ্ত ছোঁয়ায়, আমাকে নবজীবন দিতে আসা বসন্ত নিজেই আক্রান্ত হলো প্রকৃতি'র অভিশপ্ত রোগে।
তবুও দুর্বার চেষ্টা করে গেল বসন্ত, বর্ষাক্রান্ত আমাকে সারিয়ে তুলতে নিজের সিনায় ঠাঁই দিল আমায়। কিন্তু ময়লা ও পুরনো যাযাবর বেশভুষা'র সাথে বর্ষার বিরামহীন বর্ষনে পুরোপুরি পঁচে যাওয়া আমি তার সিনা ক্ষয় করে ফেললাম!!!
এরপর একদিন নিজের শেষ বিন্দু পর্যন্ত উজার করে দিয়ে, ব্যর্থ হয়ে, আমাকে নবজীবন দিতে আসা সেই মহৎ ঋতুটি, সর্বোচ্চ আঘাত সয়ে, মহাকালের বেঁধে দেয়া নিয়মে, সময়ের সাথে সাথে বিদায় নিল!
প্রচন্ড অকৃতজ্ঞের মত বিদায় দিলাম বসন্ত'কে।
আর আমি প্রবেশ করলাম চৈত্রের প্রখর রূদ্র পরিবেশে।
বর্ষা'র প্রভাব কেটে গেছে অবশেষে। ভরদুপুরের প্রচন্ড তাপে, চারদিক যখন ফেটে চৌচির হয়ে গেল, তখন পরনের সেই পুরানো যাযাবরের পোষাক ছাড়তে বাধ্য হলাম। ধীরে ধীরে বুঝলাম কিভাবে পরপর ৩টি ঋতুকে অস্বীকার করেছি। হ্যা, উপলব্ধি করলাম কিভাবে বসন্তের মত একটি ঋতুকে চিরতরে কলুষিত করে দিয়েছি। এই আমি পর্যন্ত পৌছানোর সকল পথ রুদ্ধ করে দিয়েছি অন্য সব ঋতু'র জন্যও!
একটু আগে, শূন্য ভর দুপুরে, নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। যাযাবরের শখের পোষাক ছেড়ে, যাযাবরের আদিম চামড়া গায়ে, চৈত্র মাসের ব্ল্যাকহোলে, আমার নবজনম হয়ে গেছে।
চির আকাঙ্খিত নবজীবনটাই পেলাম, সর্বোচ্চ অনাকাঙ্খিত রূপে!