লোকটা একটা ঝোপে লুকিয়ে আছে।
জংলা মতন জায়গাটা। চারিদিকে উঁচু উঁচুঁ বুনোঘাসের বন। দু'একটা কাঁটাগাছ, আর ঘাস।
বুকে ভর দিয়ে শুয়ে আছে। লোকটার দৃষ্টি সামনের দালানটার দিকে। 'এগুনোর আগে চারিদিকটা আরেকটু দেখে আসা দরকার।' - মনে মনে ভাবে সে। ডানদিকে তিরিশ গজ দূরে যে গাছটা, সে গাছের ওপরে তার একজন সাথী আছে। বাকিরা হয়তো চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার ইশারার জন্য অপেক্ষা করছে। সে এগুলেই বাকিরাও ঝাঁপিয়ে পড়বে। দালানটার ভেতর শত্রুর হেড কোয়ার্টার।
ঝুঁকিটা নিয়েই নিবে কিনা চিন্তা করছিল, এমন সময় দালানটা থেকে একজন প্রহরী বেড়িয়ে এল। সন্তর্পনে হাঁটছে। সতর্ক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হাতে একটা পি-৯০ সাবমেশিনগান। সম্পূর্ণ অটোমেটিক। ম্যাগাজিন খালি হবার আগে অন্তত তিন থেকে চারজনকে শেষ করে দিতে পারবে।
নাহ্। ঝুঁকি নেয়াটা ঠিক হবে না। এটাই শেষ মিশন। এর পরই জয়-পরাজয়ের ফলাফলটা নির্ধারিত হয়ে যাবে।
প্রহরীটা একপাশে সরে যেতেই লোকটা উঠে বসে। এক পা ডানদিকে সরে যায়। ওরা বোধহয় ভাবেনি যে তার দল সামনের দিক থেকে আক্রমণ করবে। দালানটার পেছনের দিকটাতে প্রহরা বেশী জোরদার। হাতের অ্যাজল্ট রাইফেলটা পিঠে ঝুলিয়ে আর,পি,ডি, লাইট মেশিনগানটা হাতে নেয়। এটার রেট অফ ফায়ারিং সাবমেশিনগানের মতো অতো ভাল না হলেও ড্যামেজ ভাল। কাছাকাছি বা মধ্যম দুরত্বে বেশ কার্যকরী।
তাকে উঠে বসতে দেখে বাকিরা সচেতন হয়। তার নেতৃত্বে অনেকগুলো লড়াই এরা জিতেছে। ভরসার কোন অভাব নেই।
প্রহরীটা এতক্ষণে দালানটার ডান কোণে পৌঁছে গেছে। আরেকটু হাঁটলেই চোখের আড়ালে চলে যাবে। লোকটা এগিয়ে যায়। তার সাথীরা তাকে অনুসরণ করে। দালানটার কাছাকাছি এসে দৌঁড় লাগায় লোকটা। দালানটার নকশাটা তার হাতের তালুর মতোই চেনা। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটা সিঁড়ি আছে। সেটা বেয়ে দোতলায় উঠে গেলেই কাভার পেয়ে যাবে। নিচের হলরুমটা থাকবে একেবারে হাতের নাগালে, নিশানার সীমানায়। অবশ্য এই সত্যটা তার শত্রুপক্ষও জানে। কাজেই তারা সিঁড়িতে একটা প্রহরী বসাবে। নিশ্চিত।
সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই ডানদিকে একটা গ্রেনেড চার্জ করে সে। ধোঁয়া সরে যেতেই সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করে। অনুমান সঠিক ছিল - সিঁড়ির মাঝামাঝি একটা দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে এতক্ষণে পুরো দালানে খবর পৌঁছে গেছে। শত্রু আসছে। এবার আর সে রেহাই দেবে না কাউকে।
দোতলার বারান্দায় নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। সেকেন্ডে দশ রাউন্ড। নিরবিচ্ছিন্ন। তার সঙ্গিসাথীরা এতক্ষণে যার যার অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে জগত কেঁপে ওঠে। নরক ভেঙে পরে। সবাই ভুলে যায় তার অতীত, তার ভবিষ্যৎ। শুরু হয় মুহুর্তটির জন্য বাঁচা। প্রতি মুহুর্তে হাজারো ক্যালকুলেশান আর বিদ্যুৎগতির প্রতিক্রিয়া। উত্তেজনায় ধনুকের ছিলার মতো টানটান একেজনের স্নায়ু।
.........
আতা চেয়ে চেয়ে দেখে কাণ্ডটা। কী ভয়ংকর যুদ্ধ। ওরে বাবা।
দশ মিনিট হইয়া গেলো, ফাহিম ভাইয়ের হুঁশ নাই। এরে মারতেসে তো তারে মারতেসে। কী মজা।
ডাক দেয়ার সাহস পায়না। কালকে একবার মার খেয়েছে সে। অহন আবার যদি দুই একটা লাগায়!
যুদ্ধ মনে হয় শ্যাষ। ফাহিম উন্মাদের মতো চিৎকার করে ওঠে। হেডফোনটাতে কার সাথে যেন কথা বলতে থাকে। ইংরেজিতে। কথা ঠিক বোঝা যায় না, কিন্তু আতা বুঝে ফেলে যে ফাহিম ভাই জিতসে। না জিতলে কথা বলার ধরণ আলাদা হতো। ইংরেজিতেই, কিন্তু রাগ রাগ।
আতা বুঝতে পারে। বোঝা যায়।
'কিরে, দাঁড়িয়ে আছিস ক্যান?'
'খালাম্মায় খাইতে ডাকে।'
ঘড়িতে বাজে রাত দশটা। ফাহিম চটজলদি উঠে পরে। এই সময় আম্মুকে রাগানো ঠিক হবে না। আতাকে আর খেয়াল না করে বেড়িয়ে যায়।
আচ্ছা কেমন লাগে কম্পিটারে খেলতে? আতার মনে অনেকদিনের লুকিয়ে থাকা কৌতুহল জেগে ওঠে। ফাহিম ভাই খালাম্মারে হেভি ডরায়। সুজা গিয়া খাওনের টেবিলে বয়া পরবো। একবার বইলে কমসে কম আধাঘন্টা। হাফিজের মা টেবিলের আসে পাশে থাকে এই সময়। কেউ তাকে খুঁজবে না। সময় বুঝে বের হয়ে যেতে পারলেই হলো।
আতা একটা ঝুঁকি নিয়েই নেয়। আগেও একদিন ফাহিম ভাইরে দেখসে। স্ক্রীনে একটা লিস্টি আছে। ঐ তার ওয়ালা জিনিসটা দিয়া একটা কাঁটা নাড়ানো যায়। তারপর লিস্টির এক জ্যগাত নিয়া টিপ দিলেই খেলা শুরু হয়। একবার খেলে দেখবে নাকি সে? হেডফোনটা কানে লাগিয়ে সে চেয়ারটায় বসে পরে।
তার ওয়ালা গোলগাল জিনিসটা বেশ গরম। হবেই তো। মেশিন কিনা। তার দাদাজান যখন গাড়িটা গ্যারেজে ঢোকায়, তখন ইঞ্জিলটা গরম থাকে। এটাও হয়তো সেকারণেই গরম। তবে জিনিসটা নিয়ন্ত্রণ করা বেশ মুশকিল। আস্তে টানলে যেতেই চায় না। আবার জোরে টান দিলে টিভিটার আরেক মাথা গিয়ে উপস্থিত হয়। কী ঝামেলা!
প্রচন্ড শব্দে বাড়িটা মাথার ওপর এসে লাগে। হেডফোন সহ চেয়ার থেকে মাটিতে পরে যায় আতা। ফাহিম ভাই এসে পরেছে। কান বন্ধ থাকায় সে টের পায়নি।
খেতে বসে কোন কারণে মনে পড়েছে যে ফোনটা ঘরে রেখে এসেছে। তাই নিতে এসেছে। এসে দেখে এই কাণ্ড। ফাহিমের রাগ উঠে যায়। সাহস কতো। বাবুর সখ হয়েছে, গেম খেলবে! শালা ছোটলোক কোথাকার! টেবিলের পাশে রাখা মশা মারার ব্যাটটা দিয়ে গায়ের সব শক্তি দিয়ে মেরেছে আতার মাথায়। ব্যাটটা মাঝখান দিয়ে ভেঙে গেছে। তবু ফাহিমের রাগ কমে না। আকার আয়তনে প্রায় অর্ধেক আতার দেহকে লাথি মারা শুরু করে - ' হারামজাদা! ইতর! ছোটলোক...'
............
'আহারে দাদা, বেশী লাগসে?'
'না। বেশী লাগে নাই।' মাথায় নেকড়ায় পট্টি পেঁচিয়ে আতা তাদের ছোট বিছানাটায় শুয়ে আছে। মিথ্যে কথা যদিও, তবু ব্যাথার কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
'দাদা আমারে একটা কম্পিটার কিইনা দিবা?'
রমজানের বুকটা শুকিয়ে আসে। যদিও মুখে কোন ভাব প্রকাশ করে না। 'ক্যান রে দাদা? কম্পিটার দিয়া কী করবি?'
'খেলুম। ফাহিম ভাইয়ের মতোন। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা।'
এইবারে ব্যাপারটা বোঝা গেল। তার পৌত্র তা'হলে এই অভিমানে আছে। রমজান মিয়া সন্তর্পনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। দশ বছর হলো সে এই বাড়িতে ড্রাইভারের চাকুরি করে।
ছেলেটা গতমাসে মারা যাবার পর আতাকে সাথে এনে রেখেছিল। ম্যাডাম ফুট ফরমাশ খাটার জন্য আতাকে জায়গা দিয়েছে। কোন মাসোহারার কথা এখনও হয়নি। পেটে ভাতে থাকা যাকে বলে আর কি।
রমজান মিয়ার একটা পা হাঁটু থেকে নেই। অটো গিয়ারে গাড়ি চালাতে একটার বেশী পা লাগে না। তা'নাহলে এই বাজারে এরকম বুড়ো একটা ড্রাইভারকে কে-ই বা চাকরি দিবে, তায় আবার এক পা ওয়ালা। পুরনো পরিচয়ে নাজিমুদ্দিন সা'ব তাকে একটা চাকরি দিয়েছে।
দাদাজানের চেহারা দেখে আতার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আহারে! দাদাজানকে কষ্ট দিতে একটূও মন চায় না। বড় ভালমানুষ। সে তো জানে নুন আনতে তাদের পান্তা ফুরায়। টাকার অভাবে স্কুল ছেড়ে এখন সে বড়লোকের বাড়ির চাকর। ক্লাস ফাইভে তার ওঠা হয়নি। তার কি এহেন স্বপ্ন দেখা মানায়?
রমজান মিয়া উঠে বিছানায় পরে। গ্যারেজের পাশে নাতিকে নিয়ে শুয়ে থাকার মতো একটা বিছানা আছে। চাপাচাপি করে দু'জনার হয়ে যায়।
'দাদাজান, একটা গল্প কইবা?'
'গল্প শুনবা দাদা? কী গল্প? রাক্ষস খোক্কস? নাকি বাম্য দইত্ত?'
'যুদ্ধের গল্প শুনবো। তুমি যে পা হারাইসিলা, ঐ গল্প।'- যুদ্ধের গল্প শুনতে আতার বড় ভাল লাগে। সে বড় হয়ে যুদ্ধ করবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই তাঁর।
ঠাকুরগাঁয়ে ছয় নম্বর সেক্টরে রমজান মিয়া যুদ্ধ করেছিল। ১৯৭১। বড় উত্তাল ছিল সময়টা। ধনী গরিব, সাহেব চাকর ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিয়েছিলে সেই অদ্ভুত সময়টা। নাজিমুদ্দিনের বাবা সুরুজউদ্দিন তার দলে ছিল। বিরাট বড়লোকের ছেলে। কী সুন্দর রাজপুত্রের মতো দেখতে।
সেই একটা লড়াইয়ে পায়ে গুলি খেয়েছিল রমজান মিয়া। ডিসেম্বরের দুই তারিখ ভোরে সে তার দল নিয়ে পাকবাহিনীর একটা বাংকার আক্রমণ করেছিল। যুদ্ধে তারা জেতে। তারা ছিল তেইশ জন। বাংকারটা দখল করে যখন বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে দেয়া হয় ততক্ষণে সাত জন সাথীকে তারা হারিয়েছে। আর রমজান মিয়া হারিয়েছে একটা পা।
দেশ স্বাধীন হবার পর সবাই মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার আলবদর সব এখন সার্টিফিকেট ওয়ালা মুক্তিযোদ্ধা। যখন অভিমানে সে সার্টিফিকেট আনতে যেতে চায়নি তখন সুরুজ তার হাতে পায়ে ধরতে বাকি রেখেছিল। 'রমজান ভাই এই বোকামিটা কইরো না। শত্রু শেষ। এহন আমাদের ভেতর শত্রু পয়দা হবে। লড়াই কিন্তু থামে নাই রমজান ভাই। তুমি থামলে চলবে না।'
সেদিন শোনেনি রমজান মিয়া। আজ হয়তো শুনতো।
'বুঝলা দাদা, সেই দিন ছিলো আমগো বিজয়ের দিন। মাঝরাতে গিয়া হ্যাগো দালান ঘিইরা রাখসি। ভোর ভোর অ্যাটাক দিমু। আমি গিয়া বইসি একখান জংলার মইদ্যে। আর আমগো নিজাম সা'বের বাপ সুরুজ ছিলো আমার লগে। ......'
আতা চোখ বড় বড় করে শুনতে থাকে। যুদ্ধের গল্প শুনতে তার বড় ভাল লাগে। এই ভালমানুষ দাদাজানটা কী ভয়ানক সাহস নিয়ে যুদ্ধ করসে। দেশ স্বাধীন করসে। ভাবতে ভাবতে গায়ের রোম খাড়া হয়ে যায় তার। গর্বে বুকটা ফুলে যায়। দাদাজানের সেই লড়াইটার গল্প অনেকবার শুনেছে সে। কিন্তু কিছু গল্প কখনও পুরনো হয় না।
এই যুদ্ধই ভাল। কম্পিটারের চেয়ে। তন্ময় হয়ে সে শুনতে থাকে। চোখের সামনে ভাসতে থাকে সেই সাদা দালান। দু'হাতে দৃঢ়মুষ্ঠিতে ধরা অস্ত্র, আর দু'চোখের তারায় প্রত্যয়ের ঝিলিক। আর বুকভরা সাহস। প্রচণ্ড সাহস। জন্মভূমির জন্য শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে উত্তেজনার বাষ্প ছড়িয়ে দেয়া উন্মাদ ভালবাসা। মুহুর্তের জন্য বাঁচার লড়াই।
এই নিয়েই থাকবে আতা। আর কিছু চাই না।