ধরুন আপনার পরিচিত একজন আছেন, কিঞ্চিত বিটকেল স্বভাবের। তিনি যাকে তাকে লাথি মেরে বেড়ান।
তার সাথে আপনি অনেক কিছুই করতে পারেন, কিন্তু স্বাভাবিক বুদ্ধির বলে কখনোই যে কাজটি আপনি করবেন না সেটা হলো তার দিকে পশ্চাৎদেশ বাড়িয়ে দেয়া। তাই নয় কি?
জাতিগতভাবে আমরা আপনার মতো বুদ্ধিমান নই। আমরা বারবার ওটা বাড়িয়ে দেই। অতঃপর যা ঘটার ঘটে। তারপর কান্নাকাটি করি “ভ্যাঁ ভ্যাঁ, ওর পা ভেঙে দাও, ভ্যাঁ ভ্যাঁ।”
ভূমিকা শেষ। এবার মূল আলোচনায় আসি।
আমার ব্যক্তিগত পর্যযবেক্ষণ হচ্ছে গত দশ বছরে বাংলাদেশে একটা অদ্ভুত রকমের অসৃজনশীল একটা ভোক্তা শ্রেণী তৈরী হয়েছে। এদের হাতে প্রচুর টাকা (ডিসপোজেবল ইনকাম)। এবং এদের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে যাদের এই সুবিধ নেই তাদের সাথে জীবনমানের একটা দৃষ্টিগ্রাহ্য পার্থক্য তৈরী করা।
এরা কেউ কেউ পৈতৃক কালো টাকার বলে বলীয়ান, কারো কারো আনাগোনা কর্পোরেট সিঁড়ির উপরের দিকের ধাপগুলোতে, কারো কারো পিতা হয়তো দেশের প্রশাসনের সামনে সাড়িতে। এদের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যটা সাধারণ সেটি হচ্ছে আক্ষরিক অর্থেই এদের টাকা খরচ করার মত জায়গা এ পোড়া দেশে নেই। আমার অনেক পরিচিত কিছু বন্ধুবান্ধব আছেন, যারা মাসিক আয় জমিয়ে বা খরচ করে শেষ করতে পারেন না। তারা ভবিষ্যতের আশায় কোথাও বিনিয়োগও করতে চান না, কারণ দূর দূর পর্যন্ত এর প্রয়োজন দেখেন না। তারা সর্বক্ষণ ব্যয় করার জন্য উশখুশ করেন। খুঁজতে থাকেন নতুন কোন খাবারের রেস্তোরাঁটা এলো? নতুন কোন আইসক্রীমের দোকানটা খুললো? কোথায় গেলে সবচেয়ে দামী কফিটা পাওয়া যাবে? ইত্যাদি। এদের কাছে জনপ্রতি দেড় থেকে দুই হাজার টাকা দিয়ে একবেলা খাওয়াটা অতিশয় গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। তিনশো টাকা দিয়ে এক-চামচ আইসক্রীম কিনতে তাদের কোন আপত্তি নেই।
আমি এদের সবাইকে দোষ দেই না। এদের অনেকেই ‘খেটে’ খায়। এদের জন্য এই শহরে আর কোন সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। খেলাধুলোর জায়গা নেই, নিরাপদ পার্ক নেই, ঘরের বাইরে পারিবারিক সময় কাটানোর মত পরিস্থিতি নেই, প্রেক্ষাগৃহে নিয়মিত ভালো ছবি নেই। বিনোদন বলতে শুধু ঐ রেস্তোরাঁতে সময়ক্ষেপন করা আর ভিন্ন ভিন্ন স্বাদে নিজের জিহবাকে রাঙানো। এছাড়া আর খরচ করার জায়গা কোথায়?
মজার বিষয় হচ্ছে, সম্প্রতি ঢাকা শহরে ধীরে ধীরে এদের এই সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া ‘ডিসপোজেবল ইনকাম’ –কে শুষে নেবার জন্য উপায় তৈরী হয়ে চলছে। এদেরকে একটা ইল্যুশন বা বিভ্রমে রাখার জন্য একই জিনিস ভিন্ন মোড়কে তিন-চারগুণ বেশি দামে উপস্থাপন করার প্রয়াস শুরু হয়েছে। সাধারণভাবে একটি রেস্তোরাঁতে খাদ্যমূল্যের ওপর শতকরা দুইশ বা তিনশ ভাগ প্রিমিয়ামের জায়গায় রাখা শুরু হলো শতকরা পাঁচশ বা হাজার ভাগ প্রিমিয়াম। আমার পরিচিত এমন বেসরকারী চিকিৎসালয় আছে যারা একেবারে একই সাস্থ্যসেবা দিয়ে কোন কারণ ছাড়াই চারগুণ পাঁচগুণ দাম হাঁকায়। একই কামিজে দু’শ টাকার বোতাম জুড়ে দশগুণ দামে বিক্রি করা হয় পিঙ্ক সিটি সহ গুলশান, বনানী-র অভিজাত মার্কেটে। নিম্নবিত্ত পরিবারের এক সপ্তাহের খাবার খরচ দিয়ে ডুবো তেলে ভাজা একখানা মুরগীর ঠ্যাঙ কেনা হয়, দু'কামড় খেয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়াও হয়।
এতে করে লাভের লাভ হচ্ছে এই ভোক্তা শ্রেনীটা এখন খুশি। আগে আট হাজার টাকা দিয়ে জিন্সের হাফপ্যান্ট কিনতে সিংগাপুর যাওয়া লাগতো, এখন দেশেই পাওয়া যায়। দু’জন মিলে হাজারখানেক টাকা খরচ করে একবেলা খাওয়ার কাজটা তো যে কেউ করতে পারে। কাজেই, ঐ একই খাবার তিনগুণ দামে কিনে খেতেই এই শ্রেণীর আনন্দ বেশি। এদের জীবন যাত্রার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এরা প্রয়োজন আর বিলাসীতার পার্থক্য বোঝেন না, বোঝার দরকারও বোধ করেন না।
উঁচু (!) মাপের দোকানগুলো এই শ্রেণীটাকে আকর্ষন করার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এরা ছাড়া বাকিরা তুচ্ছ, ফেলনা। এরা ‘ক্লাস’ কাস্টোমার, বাকিরা সবাই ‘রুট’-লেভেলের। পাঁচজন ‘রুট’ - লেভেলের কাস্টোমারকে বাদ দিয়ে যদি একজন ‘ক্লাস’ কাস্টোমার এরা ধরতে পারে ব্যবসা আরো বেশী লাভজনক হয়। কারণ এদের কাছে ২০০ টাকার মুরগী ১১,০০০ টাকায় বিক্রি করা যায়। এরা টু শব্দটিও করেন না। হয়তো ক্রেডিট কার্ডটা এগিয়ে দেয়ার আগে বিলের অংকটা দেখার প্রয়োজন-ও বোধ করেন না।
মুশকিল হচ্ছে বাকিরা, সমাজের সিংহভাগ যাদের ঐ শ্রেণীটাকে অন্ধের মতো, স্বপ্নের ঘোরে মরীচিকার পিছে ছোটার মতো, অনুসরণ করার চেষ্টা করে। রমজানের নামে পুরো ঢাকা শহর ব্যপী যে একমাসের খাদ্যোৎসব চলে তাতে একের সাথে অন্যের পাল্লা দেয়ার বিষয়টা আরো প্রকট হয়ে ওঠে। রেস্তোরাঁ গুলোও সুযোগ বুঝে দাম হাঁকায়। এরা আর ব্যবসা চায় না। ব্যবসা এমনিতেই ঢাকার মানুষ যথেষ্ট দেয়। এরা এখন ‘রুট’ লেভেলের কাস্টোমার তাড়াতে চায়। অল্প কিছু কাস্টোমার হলেই তাদের চলে। নিজেকে প্রশ্ন করে অবাক হই, এদের ব্যবসা কোন ‘লেভেল’-এ গিয়েছে, যে এরা এখন স্ব-উদ্যোগে গ্রাহকদের তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে!
আরেকটা মজার বিষয় হচ্ছে আমরা কিন্তু এখনো কেউ জানি না যে সত্যি সত্যি এই ‘রুট’ লেভেলের কাস্টোমারেরা যদি এইসব দাগাবাজ রেস্তোরাঁ গুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে এগুলো চলতে পারবে কিনা। একটা ব্যবসা চালানোর জন্য তাদের কিন্তু সব লেভেলের কাস্টোমারই প্রয়োজন। আমার এখনো বিশ্বাস, এদের অবস্থান যে আসলে খুব জরুরী কিছু নয়, এবং শহরের মানুষ চাইলেই যে বিলাসীতা থেকে মুখ ফিরিয়েও থাকতে পারে এটা এদেরকে জানানো গেলে পরিস্থিতি বদলাতে বাধ্য। এদের উঁচু হয়ে যাওয়া নাক ভুমির সমান্তরালে আসতে বাধ্য।
এবার উপসংহারে আসি। বাস্তবতা হচ্ছে, এটা হবে না। আমরা সবাই জীবনটাকে উপভোগ করতে চাই। দুইশ টাকার মুরগী এক হাজার টাকা দিয়ে কিনে সুন্দর একটা টেবিলে বসে খেতে আমাদের আপত্তি নেই। এ জন্যই নান্দো’স-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এহেন আচরণ করার দুঃসাহস পায়। কাজেই আমি নিশ্চিত এ বছর যারা কান্নাকাটি করছে তারা পরের বছর আবার পশ্চাৎদেশ তুলে করে লাথি খেতে যাবে। এদেরকে বয়কট করে পাল্টা লাথি কষানোর উদ্যোগ এরা কখনোই নিবে না। নাকি?
[পাদটীকাঃ এ বছর রমজানে নান্দো’স নামের রেস্তোরাঁটি প্ল্যাটার ৭ নামে একটা মেনুতে আরো কিছু পদ (আইসক্রিম ইত্যাদি) সহ একটি আস্ত মূরগীর দাম হেঁকেছে ১১,০০০ (এগারো হাজার) টাকা। এ নিয়ে তাদেরকে ফোন করে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো আগের ভালো ভালো আইটেম না রেখে এরকম দাম রাখা হয়েছে কেন। এর জবাবে নান্দো’স থেকে জানানো হয় তারা ‘রুট’ লেভেলের কাস্টোমারদেরকে আটকাতে চায়। তারা চায় ‘ক্লাসি’ কাস্টোমারদেরকে ধরার জন্য এহেন স্ট্রাটেজি নিয়েছে।]