(১) মিডিয়ার ভূমিকা
--------------------
আজকের খবরের কাগজে পড়লাম চারটি ভারতীয় হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র বাংলাদেশে মুক্তির জন্য চূড়ান্ত অনুমতি পেয়েছে। এগুলো হচ্ছেঃ তারে জামীন পার, ডন টু, থ্রি ইডিয়টস এবং ওয়ান্টেড। চারটিই নিঃসন্দেহে ভারতে জননন্দিত চলচ্চিত্র, এবং আমি নিশ্চিত যে যারা এই লেখাটা পড়ছেন তারাও এর মধ্যে অন্তত একটি বা দু'টি চলচ্চিত্র দেখেছেন। এ চলচ্চিত্র গুলোর সাথে আরো কয়েকটি ভারতীয় চলচ্চিত্র বছরখানেক আগে বাংলাদেশে মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, ব্যাপারটি তখন জনপ্রিয় গণমাধ্যমে এসেছিল। এ বিষয়টি আদালতে গিয়েছিল এবং তারই ফলশ্রুতিতে এই চারটি চলচ্চিত্র বাংলাদেশে পেক্ষাগৃহগুলোতে প্রদর্শনের অনুমতি পায়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বোদ্ধাগণ, প্রযোজকগণ, পরিচালকগণ, এবং শিল্পীগণ এই স্বিদ্ধান্তের বিপক্ষে। তাদের বক্তব্য পরিষ্কার – এখনো বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প এইসব উঁচু বাজেটের চলচ্চিত্রের সাথে দর্শকের ভাগ নিয়ে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত নয়, এতে করে দেশী শিল্প মার খাবে এবং ভিনদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসনে দর্শক প্রভাবিত হবে। সেই সাথে বাংলাদেশী কোন চলচ্চিত্র ভারতের সংশ্লিষ্ট মহল আমদানী করতে চায়নি, যার কারণ হিসেবে ভারতীয় বাংলাভাষা ভাষীদের বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের প্রতি অনিহাকে এবং বাজার না পেয়ে ব্যবসা অসফল হবার যুক্তিকে সামনে রেখে স্বিদ্ধান্তটি চাপিয়ে দেয়া হয়।
মজার বিষয় হচ্ছে আদালতের আজকের এই স্বিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনপ্রিয় গণমাধ্যমগুলোতে আসে নি। এর ফলে দেশী কলা-কুশলী গণের উদ্বেগ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছুয়নি। আমি নিজে প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার এবং বিডি নিউজ টুয়েন্টি ফোরে খুঁজেছি এবং আদালতের এই স্বিদ্ধান্তের লেশমাত্র কোথাও পাইনি। দু’একটা খবরের কাগজে হয়তো এসেছ – উল্লেখ্য আমি খবরটি জেনেছি “বাংলাদেশ প্রতিদিন” নামক একটি দৈনিক খবরের কাগজ থেকে।
অন্যদিকে “১৯ তম কোলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব”-নিয়ে আরেকটি খবর আজকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় এসেছে। এখানে মোটামোটি সব ধরণের খবর থাকলেও বাংলাদেশের এক অনন্য অর্জনকে ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সেটি হচ্ছে ‘এশিয়ান সেলেক্ট ক্যাটাগরি’-তে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরষ্কার পাওয়া মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর ‘টেলিভিশন’-এর নাম। পাছে পশ্চিমবঙ্গে ছবিটির কাটতি বেড়ে যায়, কিংবা পশ্চিমবঙ্গবাসীরা যদি বাংলাদেশী চলচ্চিত্র সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে ওঠে এজন্যই হয়তো উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবে কাজটি করা হয়েছে। এর পাশাপাশি মূখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা ব্যানার্জীর সাথে তোলা জনপ্রিয় পাঁচ ভারতীয় বাংলাভাষী অভিনেত্রী (রানী মূখার্জী, সুস্মিতা সেন, বিপাশা বসু, এবং আরো দু’জন) এবং বাংলাদেশি অভিনেত্রী তিশার ছবিটি তিশাকে বাদ দিয়ে পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। এখানেও উদ্দেশ্য পরিষ্কার। পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রের স্বার্থ রক্ষার্থে বিনোদন জগতের মুখপাত্র হিসেবে আনন্দবাজার পত্রিকা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে।
স্বাভাবিক বুদ্ধির বলে এটা পরিষ্কার হওয়া উচিৎ যে ভারত কখনো সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে বা বিপক্ষে এমন কোন রকমের কাজ করবে না যেটাতে তার নিজের কোন লাভ বা ক্ষতি নেই। ভারত (এবং সাধারণ ভাবে ভারতীয়রা) সবসময়ই নিজেদের স্বার্থরক্ষার্থে কাজ করে যাবে – যে কাজ কখনো কখনো বাংলাদেশের জন্য সুফল নিয়ে আসবে, কখনো বা কুফল।
সবচেয়ে বেশি শিক্ষনীয় যে বিষয়টি হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থে মিডিয়ার ভূমিকা। বাংলাদেশের কি এ থেকে কিছুই শেখার নেই? একই দেশে থেকে একে ওপরের পৃষ্ঠপোষকতা না করার ফল কখনো শুভ হতে পারে না। আজকের বাংলাদেশে ঈদের বাজারে যখন আমাদের মেয়েরা দেবদাস শাড়ি বা সানি লিওন লেহেঙ্গা খুঁজে বেড়ায় তখন ভারতকে কিংবা ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনকে গালমন্দ না করে আমরা কি ভাবতে পারি না যে সাধারণের মত গঠনে আমাদের মিডিয়া আসলে কী ভুমিকা পালন করছে? বিশেষ করে আজকের এই ঘটনাটিতে যেখানে পুরো মিডিয়াতে তোলপাড় হয়ে যাবার কথা, সেখানে মিডিয়াকর্মীদের নিরব দর্শকের ভূমিকা নেয়া আক্ষরিক অর্থেই হতাশাব্যঞ্জক।
(২) বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অবস্থান
--------------------------------------
দিন কতক আগে বর্তমানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের আকর্ষনের মধ্যমণি এম, এ, জলিল অনন্ত-এর একটি সাক্ষাৎকার টেলিভিশনে দেখছিলাম। তার দৈনন্দিন জীবন নিয়ে বানানো অনুষ্ঠানটির এক পর্যায়ে তিনি বললেন যে তার সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে তিনি বাংলাদেশের সাধারণ দর্শকদের, বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যমে কিংবা বেসরকারি বিশ্বব্দ্যালয়ে পড়াশোনা করা সুশীল চিন্তাধারার দর্শকদের মূল ধারার বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে ফিরিয়ে আনার। তার বক্তব্য থেকে হুবহু উদ্ধৃতি দিচ্ছি – “বাংলাদেশের সিনেমায় দর্শকদের ফিরিয়ে আনার কৃতিত্ব আমার একার না…” এখানে কয়েক মুহুর্তের নীরবতা, আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম স্বভাবসুলভ অহংকারী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বেরিয়ে এসে তিনি অবশেষে পুরো চলচ্চিত্র শিল্পকে কিঞ্চিৎ কৃতিত্ব দেবেন। কিন্তু তখনো তাঁর বাক্যটি শেষ হয়নি।
“… কৃতিত্বটা আমার এবং আমার ছবির।”
আমি তাঁর স্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এটা ঠিক যে আমি নিজেও সবান্ধব তাঁর কিছু মভি দেখেছি, বিশেষ কারণে বিনোদিতও হয়েছি এবং প্রয়োজন মোতাবেক হাসি ঠাট্টাও করেছি। আমার কাছে তিনি একজন উৎকৃষ্ট ‘এন্টারটেইনার’। তবে এর পাশাপাশি রেদওয়ান রনি, প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ, মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী এবং আরো অনেক নতুন সুস্থ ধারার নির্মাতার চলচ্চিত্র আমি দেখেছি এবং তাদের কাজের প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। উল্লেখ করার মত কয়েকটি চলচ্চিত্রের নামঃ ‘উধাও’, ‘চোরাবালি’, ‘টেলিভিশন’, ‘থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার’, ‘মনপুরা’, ‘জাগো’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’, ‘কমন জেন্ডার’ ইত্যাদি। অনন্তের অনেক গুণমুগ্ধ ভক্ত আছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সবাইকেই ‘থট প্রভোকিং’ এবং বিকল্পধারার ছবি করতে হবে তা নয়, কেউ কেউ অবশ্যই মূল ধারা কমার্শিয়াল ছবি তৈরি করবেন এবং তা বিনোদনের মাত্রা অনুযায়ী জননন্দিত বা জননিন্দিত হবে। অনন্তের শেষ ছবি ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’ পেক্ষাগৃহে টানা চলার রেকর্ড করেছে এবং অবশ্যই এর পেছনে ব্যবসাবুদ্ধি প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু তাই বলে চলচ্চিত্র জগতের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব নিজের (এবং নিজের সিনেমার) বলে দাবি করাটা যুক্তিতর্কের বাইরে চলে যায়। আমার দেখা অনন্তের চলচ্চিত্রগুলোতে দর্শকের আচরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যঙ্গাত্মক ও ঋণাত্মক ছিলো এবং এতে করে সাধারণের মনোভাব বেশ বোঝা গিয়েছে।
ব্যপারটা অনেকটা এরকম, ধরেন খুব মোটা একজন মানুষ শুধু একটা গামছা পড়ে স্টেডিয়ামের মাঝখানে উঁচু তালের মিউজিকের সাথে নৃত্য করছে। এই দৃশ্য দেখার জন্য হয়তো কিছু মানুষ হাসি তামাশা করার জন্য হলেও গাঁটের পয়সা খরচ করে টিকেট কেটে দেখতে যাবে। তাই বলে বাংলাদেশি নৃত্যকলার ধারক ও বাহক হিসেবে একে গন্য করাটা এক ধরনের ভুল হবে।
সাধারনভাবে বলতে গেলে বাংলাদেশ এখন ‘টেলিভিশন’ আর ‘ঘেটুপুত্র কমলা’-এর মত দুনিয়া কাঁপানো উন্নত মানের চলচ্চিত্র তৈরির ক্ষমতা রাখে। মিডিয়ার পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশের বাইরে বাংলাভাষীদের মাঝে এগুলো জনপ্রিয়তা পাবে না এটা আমাকে কোনভাবেই বিশ্বাস করানো যাবে না। “মানুষ যা খেতে চায়, তাই পরিবেশন করতে হবে”- এই ধরণের মনোবৃত্তি থেকে বের হয়ে এসে মিডিয়াকে জনমত তৈরিতে সচেষ্ট হতে হবে। এবং যতদিন তা না হচ্ছে সাধারণ জনগন হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে যতখানি সম্ভব দেশের চলচ্চিত্রের উর্ধ্বগতিতে সমর্থন দিয়ে যাওয়া।
(৩) তুলনামূলক চিত্র
----------------------
এখন বাংলাদেশের বেশ কিছু পেক্ষাগৃহে ইংরেজি ভাষায় তৈরি কিংবা ইংরেজিতে অনুদিত চলচ্চিত্র নিয়মিত প্রদর্শিত হচ্ছে। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে বিশ্বায়নের এই যুগে শুধুমাত্র একটি বিশেষ দেশের চলচ্চিত্রের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ কি যুক্তিযুক্ত? এখানে যে বিষয়টা আলোচনার যোগ্য সেটি হচ্ছে এই দুই ভিনদেশী ধারার চলচ্চিত্রের বাংলাদেশের বাজার কতখানি ব্যপ্ত। পশ্চিমা চলচ্চিত্রের সাথে ভারতীয় চলচ্চিত্রের তুলনা করা যাবে না কারণ ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে বাংলাদেশী সংস্কৃতি অনেক খানিই মেলে। আমি বিষয়টাকে এরকম ভাবে দেখি যে আমাদের উপমহাদেশীয় সংস্কৃতি এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির একটা কমপ্লেক্স প্রডাক্ট হচ্ছে মূল ধারার ভারতীয় চলচ্চিত্রের সংস্কৃতি। ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র শুধুমাত্র ভাষার ব্যবধানের কারণে হলেও এখনো বাংলাদেশের জনসাধারনের কাছে সমাদৃত নয়, অন্যদিকে ভাষার এবং বাচনভঙ্গির ব্যবধান খুব কম হওয়ায় ভারতীয় চলচ্চিত্র দেশের আনাচে কানাচে পৌঁছে গিয়েছে। এখন যদি আধুনিক যুগের চলচ্চিত্র নির্মানের কৌশলের দিক দিয়ে শিশুপ্রায় বাংলাদেশী চলচ্চিত্রকে বলা হয় বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী প্রায় কাছাকাছি রকমের গ্রহনযোগ্য ভাষার একটি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির মোকাবেলা করতে, তাহলে তা অসম যুদ্ধ হবে, এই যুদ্ধে বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের হার অনিবার্য এবং এর কুপ্রভাব যুগের পর যুগ বাংলাদেশীদের বহন করতে হবে প্রতি বছর আরো হাজারটা পণ্যের সাথে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানী করে। ঠিক এই কারণেই পেক্ষাগৃহে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন ছিল, আছে এবং থাকবে।
আমার লেখাটার শুরুতেই বলেছি ভারত আমাদের বন্ধু নাকি শত্রু তা আলোচনার বাইরে রেখেই নিজেদের স্বার্থে নিজেদের হেফাজত নিজেদেরকেই করতে হবে।
--------------
তথ্যসূত্রঃ
১। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনলাইন ভার্সন (দ্রষ্টব্যঃ পৃষ্ঠা ৮)
২। বাংলা নিউজ ২৪-এ আসা আনন্দবাজার পত্রিকার সমালোচনা
৩। এম, এ, জলিল অনন্তের সেই ইন্টারভিউয়ের ইউটিউব লিঙ্ক
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:৩৫