১
গ্রুমিং শেষ পর্যায়ে। দু দিন পরই ষ্টেজ শো। নতুন জগতে পা ফেলবে তিনটি মেয়ে। সেই জগত সাধারণের কিছুটা দৃষ্টি সীমার মধ্যে হলেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এরই মধ্যে দশ জন তরুনীকে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মুখোমুখি হতে প্রস্তুত করে তুলেছেন আয়োজকরা।
পর পর আটটি পর্ব শেষে প্রতিযোগীতা এখন তুমুল প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ন।
আড় চোখে সহপ্রতিদ্বন্ধি তানজিনের দিকে তাকায় সোহাগী। তানজিনের প্রশংসায় প্রতিযোগীতার প্রতিটি পর্বে মুখর ছিলেন বিচারকরা। ঢাকার মেয়ে। এতো সুন্দরি সচরাচর চোখে পরে না।
চুড়ান্ত অনুষ্ঠানে তানজিন কি পোষাক পরবে প্রশিক্ষক তা ইতোমধ্যে ঠিক করে দিয়েছেন ! তা-ই পরে ও গ্রুমিংএ আছে । আয়োজকরা বোধ হয় ভেবেই রেখেছেন তানজিনই চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। বা আয়োজকরা চাইছেন তানজিন চ্যাম্পিয়ন হোক। তানজিন আগে থেকেই পোষাক পেল আর বাকিদের এই মাত্র জানানো হলো আজ ফাইনালের ড্রেস ও মেকাপ বুঝিয়ে দেয়া হবে ! এসব লক্ষ্য করে সোহাগীর মুখে কালো ছায়া নেমে আসতে চায়।
এ যাবৎ দর্শকদের ভোট সবচেয়ে বেশি পেয়েছে সোহাগী। এর কারণ তার নিজেরও অজানা । তবে বিচারকদের নম্ভর ছিল গড় পড়তা। দর্শকদের সমর্থন না পেলে সোহাগী দ্বিতীয় রাউন্ডেই বাদ পরে যেত। বাছাই পর্বে সে টিকেছিল অভিনয় দক্ষতা ও ভাল নাচ জানায়। বিচারকরা তখন উচ্ছসিত প্রসংশা করেছিলেন । কিন্তু অনুষ্ঠান চুড়ান্ত পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে যেন সোহাগী ফুরিয়ে আসছিল। প্রতি পর্বেই আগের পর্বের চেয়ে খারাপ হওয়ায় হতাশ ছিলেন প্রশিক্ষকরা। এমনকি বিচারকরাও কঠোর বাক্যে সমালোচনা করতে ছাড়েন নি। কিভাবে কিভাবে প্রতি পর্বে রক্ষাও পেয়ে গেছে।
শেষ পর্বটা হয়ে গেলে মুক্তির আনন্দ পাবে সোহাগী। এখন সময় যায় যন্ত্র চালিতের মতো। শিক্ষকদের এই করতে হবে,ওটা খেয়াল রাখতে হবে ... এসবই শুধু মাথায় ঘোরে । আর যখন যাই মনে পড়ে, তাৎক্ষণিক তা আয়ত্মে আছে বিশ্বাস না হওয়া পর্যন্ত চর্চা করে নিতে হয়।
২
আজ এই বেলা দেখভাল করছেন প্রশিক্ষক শোয়েব। শোয়েব তার স্বভাবসুলভ আত্মবিশ্বাসী ঢংয়ে সোহাগীকে ফাইনাল রাউন্ডের পোষাক ও ভূমিকা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। নড়াচড়াও যেন হাতে গোনা ও পুর্বপরিকল্পিত। তিনি প্রথম থেকে এই মহুর্ত পর্যন্ত যা বলেছেন , শিখিয়েছেন সব মুখস্ত বলে দিতে পারবে সোহাগী।
দ্রুত কথা বলতে বলতে বারবার তাকানো দেখে সোহাগী অনুমান করে তার চেহারার কোন রেখায় তানিজিনকে আগে ড্রেস বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে জানায় যে মন খারাপ হয়েছে তার ছাপ রয়ে গেছে। মনে কি ভাবছে তা কি এক আশ্চর্য ক্ষমতায় বুঝে ফেলতে পারেন প্রশিক্ষকরা। তাদের মধ্যে শোয়েব একটু বেশি বোঝেন হয়তো।
পুরো গ্রুমিংয়ে দেশ বিদেশের বিখ্যাত প্রশিক্ষকরা যা বেশি যতেœ বার বার বুঝিয়েছেন , তা হলো কোন অবস্থাতেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া যাবে না। অনুভুতির প্রকাশ হবে পরিমিত। যতটুকু দরকার। বাদ পড়ে গেলে কেউ যাতে কান্না-কাটি করে অনুষ্ঠান মাটি করে না দেয়। বাদ পড়ার ঘোষণা শোনার সাথে সাথে চিবুকটা একটু গলার দিকে নামিয়ে ফ্লোরে তাকাবে মূহুর্তের জন্য। তারপর দর্শকদের শেষ সাড়ির দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে একই সঙ্গে ডান দিকে সড়ে যেত হবে তিন ফুটের মত। প্রতিযোগীতায় টিকে থাকা একজন এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দেবে। এর মধ্যে উপস্থাপক নতুন করে অনুষ্ঠান এগিয়ে নেবে। নতুন প্রতিযোগীর নাম ঘোষনা করবে।
সব বিধি নিষেধ ভুলে শোয়েবকে দেখলেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘোরগ্রস্ত হয়ে যায় সোহাগী। প্রতি দিন , প্রতিবারই এমন হয়। আগে বিশেষত এই পর্বের প্রস্তুতির সময় শরীরের প্রায় প্রতি বাঁকে শিক্ষকদের আঙ্গুল ঘুরেছে । এই ছোঁয়ার মধ্যে বাড়তি কোন অর্থ নেই। অনুভুতি নেই। জড়তাও নেই কোন পক্ষের।
কিন্তু শোয়েবের সামনে আসলে সোহাগী ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে । তার আচড়নের মতোই কেমন বেপরোয়া , দ্বিধাহীন ও স্পষ্ট সব স্পর্শ শোয়েবের। সোহাগীর হাত ধরলে দ্বিতীয় দিন শিহরণ টের পেয়ে অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। তারপর লেকচার দিয়েছিলেন, অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণের ওপর। অন্য কোন প্রতিযোগীর সমস্যা না হলেও সোহাগী রক্ষা পায়না । তার নির্দেশনার মতো প্রতিটা স্পর্শও অনুভব করতে পারে সোহাগী। যেন ছাপ লেগে আছে। সে কাছাকাছি থাকলে মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। শোয়েবের প্রতি এই গোপন টান অনুভব করে নিজের উপর এক ধরনের বিরক্তিও অনুভব করে সোহাগী। তবে সব সাত - পাঁচ ভাবনা সে সামনে না থাকলেই। সামনে আসলে সব সময় একটা অপেক্ষা আর উৎকণ্ঠাও কাজ করে। মনে হয় এখনই কিছু একটা ঘটবে যেটা খুব আনন্দের ব্যাপার হবে। শোয়েব অন্য প্রতিযোগীদের কাছে গেলে নজর রাখে সে।
সব নিয়ম মনের পর্দায় ভেসে থাকে সোহাগীর। সৈনিক যেমন যুদ্ধ ক্ষেত্রে অস্ত্র আগলে রাখে, প্রতিযোগীদেরও তেমনি মেকাপের প্রতি যতœবান হতে হবে। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ি নিজের অর্ন্তগত সৌন্ধর্য ফুটিয়ে তুলে নিজের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ করে রাখতে হবে। ফুটে থাকতে হবে। সোহাগী প্রশিক্ষকের চোখকে ফাকি দিতে মুখের পেশিগুলো যথাসাধ্য ছেড়ে মনযোগ কেন্দ্রীভুত করার চেষ্টা করলো।
শোয়েব গভীর মনযোগ ও মেয়েদের মতো দক্ষতায় নিয়ে শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছেন সোহাগীকে। তার বাঁ হাতের কড়ে আঙ্গুল সোহাগীর নাভীর নিচে ভাঁজ কাপড়ের একটা থোকা চেপে রেখেছে। অন্য হাতে দুই ঠোঁটে ধরে রাখা সেফটিপিন থেকে একটি নিয়ে কাপড়ে গেঁথে একটা ফুলের থোকা তৈরী করে উঠে পাশের মেয়েটির পোষাক ঠিক করে দিতে সরে গেলেন।
৩
লাল-সাদা- কালোর মিশেল পোষাক পেয়েছে সোহাগী। একদম পছন্দ হয়নি ওর। শরীর থেকে একদম খাপছাড়া হয়ে আছে। কিন্তু অনুষ্ঠানের আগের দিন স্টেজে রিহার্সাল করতে গিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। মঞ্চে উঠলে আর বেখাপ্পা লাগবে না। সেটের কালার আর লাইটিংএর সঙ্গে মিলিয়েই পোষাক ভাবা হয়েছে। নিজেই টের পাচ্ছে এই আলোতে ওকে খুব সুন্দর লাগছে । প্রশিক্ষকদের জ্ঞানের বহরের আরেক দফা বিস্ময় মানে সোহাগী। কিছুই নজর এড়ায় না এদের। আর এতোই বেশি বোঝেন যে নিজ থেকে কিছু করার থাকে না। তাদের হাতের পুতুল বনে যেতে হয়। প্রথম প্রথম এক বাক্যে তাদের কথা মেনে নেয়াটা ভীষণ বিরক্তিকর ও এক ঘেয়ে মনে হয়েছিল। এখন একটা সম্পূর্ণতা এসেছে তাদের আগে পরে বলা অনেক কথা।
শোয়েবসহ অন্য সব প্রশিক্ষক আজ এক সাথে শেষ রিহার্সেলে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের আগে আগে বলেই হয়তো তাদের গাম্ভির্য আজ অনেক কম। প্রতিযোগীরা অনেক প্রশ্নের জবাব হাসিমুখেই পাচ্ছে। অন্য দিন হলো , এটা এখনো মাথায় ঢোকেনি ! কিচ্ছু হবে না ! অভিনয় রক্তে থাকতে হয় ! না হয় কোন না কোন কথা শুনতে হতো। তানজিনকে আজ সবচে বেশি সুন্দর লাগছে। হঠাৎ করে কেউ দেখলে ভাববে সদ্য অভিনয়ে আসা তরুনী গীতা বলী বসে আছে। কথা বলার সময় থুতনিটা একটু উপরে তুলে কথা বলে তানজিন। খুব সুন্দর দেখায়। সোহাগী এক রাতে আয়নার সামনে দাড়িয়ে চিবুক তুলে নিজের দিকে তাকিয়ে কথা বলে দেখেছে , ভাল লাগে না। গলার কণ্ঠাটা উঁচু হয়ে থাকে।
তানজিনের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে গিয়েছিল সোহাগী। রেডিসন ওয়াটার গার্ডেনের লহড়ী হলে হবে কালকের অনুষ্ঠান। বিকেল থেকে টানা রিহার্সেল শেষে দর্শকদের আসনের বসে বিশ্রাম করছিল সবাই বসে। তানজিনের কথা বলা দেখতে দেখতে আনমনা হয়ে যাওয়া গোহাগীর হঠাৎ করে নজর যায় স্টেজের দিকে। আজ পুরোটা সময়ে এই আলো একবারও ফেলা হয়নি। মুহুর্তের জন্য নেপথ্য শব্দও বেজে বন্ধ হয়ে গেল। উচ্চ শব্দে অন্যরাও মঞ্চের দিকে তাকায়। সোহাগী অস্থির হয়ে রুমে ফিরে যাওয়ার জন্য উঠে দাড়ায়। সে অনুভব করে কাল অনুষ্ঠানের গোপন একটা ব্যপার ধরা পরে গেছে ওর কাছে। প্রসঙ্গ চমক ও অভিব্যক্তি পরীক্ষায় গ্রাম্য বর্ষার দৃশ্যের সঙ্গে অভিনয় করতে দেয়া হবে !
৪
রাত ভর স্বপ্ন দেখে কাটলো সোহাগীর। রিহার্সেল থেকে ফেরার পর থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দুশ্চিন্তায় ভরে ছিল মন। চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে মিষ্টি স্বপ্নটি দখল করে নিল তার রাত।
ছোট নদী। সোহাগীদের দাদা বাড়ির পাশে। একটু বৃষ্টির চাদর থেমে থেমে দৌড়ে যাচ্ছে। দূর থেকে একটা গানের গলা শুনে এগিয়ে যায় সোহাগী। কাছে গেলে নদীর ধারে বসা নিঃসঙ্গ যুবকের গানের কথা স্পষ্ট হয়। ভীষন মিষ্টি গলা। আকাশ মেঘে ঢাকা ... শাওন ধারা ঝরে, / যেদিন পাশে ছিলে / সেদিন মনে পড়ে। মোহাবিষ্টের মতো সামনে এগিয়ে যায় সোগাহী। যুবকের সেদিকে খেয়াল নেই। একমনে গান গাইছে যুবক। ধীরে ধীরে তার কাছে যায় । অপরিচিত যুবক তখনো গেয়ে চলেছে, সেদিনও এই ক্ষণে ... সজলও ছিল হাওয়া ... কেয়ার বনে তারো ...
ছিল যে আশা যাওয়া ... যুথির সুরভিতে ... আঙ্গিনা ছিল ভরে।
বৃষ্টি ধরে আসলো একটু। ঘনিয়ে এসেছে অন্ধকারও। নদী থেকে উঠে আসা হাওয়া সোহাগীর লম্ব চুল উড়িয়ে তার শরীরে পেচিয়ে দিচ্ছে। ধীর পায়ে যুবকটির কাছা কাছি গিয়ে তার মুখ দেখার চেষ্টা করে। খুব পরিচিত আর কাছের মানুষ মনে হয় তাকে। যেন তার হারানো কোন বন্ধু। গানের কথাগুলো তার মনে হাহাকার আর অজানা কষ্ট জাগিয়ে তোলে। সে গাইছে , এখনো সেই স্মৃতি ... বুকেতে বয়ে চলি ... নিজেরো সাথে আমি ... নিজেই কথা বলি। হঠাৎ উত্তর পুব আকাশে এ প্রান্ত ও প্রান্ত করা একটা বিদ্যুৎ রেখার আলোয় যুবকের চোখ চিনে ফেলে সোহাগী। দেখে গান গাওয়া যুবকটি আর কেউ নয়। শোয়েব। শোয়েব তাকে দেখে উঠে দাঁড়ায় গান বন্ধ করে। সোহাগী হেসে বলে এই ছেলে , তুমি আবার গান গাইতেও জানো নাকি ! ধরো , বাকি টুকু গাও। শোয়েব চুপ করে আছে দেখে,সোহাগী নিজেই গুন গুন করে গাইতে থাকে। স্মৃতির মনিমালা ... সবার চেয়ে দামি ... আজও তা পড়ে আছি ... ভুলিনিতো কিছু আমি ... এখনো বসে আছি ... হারানো খেলা ঘরে। কিন্তু সোহাগীর গলায় এই গানে কোনবিরহ বেদনা নেই। বোঝা যায় সে বিরহের অবসান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। প্রেমিকের প্রতি এই নিশ্চয়তা ফুটে উঠছে তার কৌতুকপূর্ণ আর হাসি মেশানো কণ্ঠে। ততোক্ষণে যুবকের আড়ষ্ট ভাব কেটে যায়। সেও কণ্ঠ মেলায় , আকাশ মেঘে ঢাকা ... শাওন ধারা ঝরে ... যেদিন পাশে ছিলে ... সেদিন মনে পড়ে।
শোয়েব তার হাত ধরলে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে ওঠে। শোয়েবও চমকে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ততোক্ষনে আধার ঘনিয়ে আসে। অন্ধকারের চাদর তাদের ঢেকে ফেলে।
৫
অন্ধকার হল রুম করতালি মুখরিত হয়ে ওঠে। সম্বিৎ ফিরে আসে সোহাগীর। স্বপ্নে না বাস্তবে আছে বুঝে ওঠতে পারে না। আলো জ্বলে ওঠার পর খেয়াল করে স্টেজে শোয়েবকে জড়িয়ে ধরে আছে। এক নজরে সোহাগী দেখতে পায় দর্শকদের সঙ্গে সঙ্গে বিচারকরাও উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছেন।
৬
বিজয়ীর নাম ঘোষণার আগে আগে সাঁজ ঘরে একটু পাশে ডেকে শোয়েব অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গের অবতারণা করে।
- আমার মনে হয় তুমি অভিনয়ে থাকবে না।
- হ্যাঁ , ঠিক ধরেছো।
- কো আর্টিস্ট হিসেবে আমি না হলে কি হতো ?
- চ্যাম্পিয়ন হতাম না !
- আমাকেও থাকতে দিবে না শো বিজে ?
- নাহ !
শোয়েব ও সোহাগীর হাসির শব্দে চমকে তাকায় উৎকণ্ঠিত অন্য প্রতিযোগীরা।
রচনা : ২০/ ১ - ২৭/ ৮/ ২০১০ ইং