"এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।।
শোনায়ে লোভের বুলি
নেবে না কেউ কাঁধের ঝুলি
ইতর আতরাফ বলি
দূরে ঠেলে নাহি দেবে।।
আমির ফকির হয়ে এক ঠাঁই
সবার পাওনা পাবে সবাই
আশরাফ বলিয়া রেহাই
ভবে কেহ নাহি পাবে।।
ধর্ম কুল গোত্র জাতির
তুলবে না গো কেহ জিগির
কেঁদে বলে লালন ফকির
কেবা দেখায়ে দেবে।। "
১। প্রবেশ পথ...
"আপনারে আপনি চিনি নে।
দিন দোনের পর যার নাম অধর
তারে চিনবো কেমনে।।
আপনারে চিনতাম যদি
মিলতো অটল চরণ-নিধি
মানুষের করণ হত সিদ্ধি
শুনি আগম পুরাণে।।
কর্তারূপের নাই অম্বেষণ
আত্মার কি হয় নিরূপণ
আত্মাতত্ত্বে পায় সাধ্য ধন
সহজ সাধক জনে।।
দিব্যজ্ঞানী যে জন হলো
নিজতত্ত্বে নিরঞ্জন পেলো
সিরাজ সাঁই লালন রৈলো
জন্ম-অন্ধ মন-গুনে।।"
২। "তিন পাগলে হলো মেলা
ন’দে এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।।"......
"সদা মন থেকো রে হুঁস
ধর মানুষ রূপ-নিহারে।
আয়না আঁটা রূপের ছটা
চিলেকোঠায় ঝলক মারে।।
স্বরূপ রূপে রূপকে জানা,
তারই নাম উপাসনা,
গাঁজার দাম চড়িয়ে মনা,
বমকালী আর বলো না রে।।
বর্তমানে দেখো ধরি,
নরদেহ অটল বিহারী,
মরো কেন হরি বড়ি
কাঠের মালা টিপে-হারে।।
দেল ঢুঁড়ে দরবেশ যারা,
রূপ নেহারী সিদ্ধ তারা,
লালন কয়, আমার খেলা
‘ডাণ্ডাগুলি’ সার হলো রে।।"
৩। বিকেলের আলোয়....
"এমন মানব জনম আর কি হবে।
মন যা কর, ত্বরায় কর এই ভবে।।
অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই,
শুনি মানবের তুলনা কিছুই নাই ।
দেব-দানবগণ,
করে আরাধন
জনম নিতে মানবে।।
কত ভাগ্যের ফলে না জানি,
মন রে, পেয়েছ এই মানব-তরণী
বেয়ে যাও ত্বরায়
তরী সুধারায়,
যেন ভরা না ডোবে।।
এই মানুষে হবে মাধুর্য্য ভজন,
তাইতে মানুষ রূপ এই গঠিল নিরঞ্জন,
এবার ঠিকিলে আর
না দেখি কিনার,
লালন কয় কাতর ভাবে।।
৪। সামনে শিষ্যদের কবর....
"ভবে মানব-গুরু নিষ্ঠা যার
সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার।।
নদী কিংবা বিল বাঁওড় খাল
সর্ব স্তরে একই সে জল
একা মোর সাঁই
আছে সর্ব ঠাঁই
মানুষ মিশে সে হয় রূপান্তর।।
নিরাকারে জ্যোতির্ময় যে
আকারে সাকার হয় সে।
যে দিব্যজ্ঞানী হয়
সে জন জানতে পায়
কলিযুগে হয় মানব-অবতার।।
বহু তর্কে দিন বয়ে যায়
বিশ্বাসের ধন নিকটে রয়।
ডেকে সিরাজ সাঁই
লালনকে কয়
কুতর্কের দোকান খুলিস নে আর।।"
৫। খালি পায়ে প্রবেশ.....
"মিলন হবে কত দিনে
আমার মনের মানুষের সনে।।
চাতক প্রায় অহর্নিশি
চেয়ে আছি কালো শশী
হব বলে চরণ দাসী,
ও তা হয় না কপাল গুণে।।
মেঘের বিদ্যুৎ মেঘে যেমন
লুকালে না পায় অন্বেষণ,
কালারে হারায়ে তেমন
ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে।।
যখন ও-রূপ স্মরণ হয়,
থাকে না লোকলজ্জার ভয়
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
ও প্রেম যে করে সেই জানে।।"
৬। পাশাপাশি পালক মা মতিজান ফকিরানী ও ফকির লালন শাহ....
"আমি জন্ম-দুঃখী কপাল-পোড়া
গুরু আমি একজনা।
আমার বদ্ হাল তুমি দেখলে না।।
শিশুকালে মইর্যা গেছে মা
গর্ভ থুইয়া পিতা ম’ল
তারে দেখলাম না।
কে করবে সেই লালন পালন
কে করবে সান্ত্বনা।।
গিয়েছিলাম ভবের বাজারে
ছয় চোরা চুরি করে
গুরু বাঁধে আমারে।
তাই সিরাজ সাঁই খালাস পাইল
লালনেরে দিল জেলখানা।।"
৭। লালন....
“ মন আমার কি ছার গৌরব করছো ভবে!
দেখ না রে সব হাওয়ার খেলা,
হাওয়া বন্ধ হতে দেরী কি হবে?
থাকতে হাওয়ার হাওয়াখানা
মওলা বলে ডাক রসনা
মহাকাল বসেছে রানায়
কখন যেন কু ঘটাবে।
বন্ধ হলে এ হাওয়াটী,
মাটীর দেহ হবে মাটী
দেখে শুনে হওনা খাঁটী
মন! কে তোরে কত বুঝাবে।।
ভবে আসার আগে যখন,
বলেছিলে কর্ম সাধন
লালন বলে সে কথা মন,
ভুলেছো এই ভবের লোভে।।”
৮। কাঙ্গালিনী সুফিয়া.....
"দিল দরিয়ার মাঝে দেখলাম আজব কারখানা।।
দেহের মাঝে বাড়ি আছে
সেই বাড়িতে চোর ঢুকেছে
ছয় জনাতে সিঁদ কাটিছে,
চুরি করে একজনা।।
এই দেহের মাঝে নদী আছে
সেই নদীতে নৌকা চলছে
ছয় জনাতে গুণ টানিছে,
হাল ধরেছে একজনা।।
দেহের মধ্যে বাগান আছে
নানা জাতির ফুল ফুটেছে
ফুলের সৌরভে জগত্ মেতেছে
কেবল লালনের প্রাণ মাতলো না।।"
৯। মূরাল - লালন লোক সাহিত্য কেন্দ্র...
"পূর্ণচন্দ্র উদয় কখন কর মন বিবেচনা।
আগমে আছে প্রকাশি
ষোল কলাই পূর্ণশশী
পনেরই পূর্ণমাসী
শুনে মনের ঘোল গেলনা।
সাতাইশ নক্ষত্র সাঁইত্রিশ যোগেতে
কোন সময় চলে সাইত্রিশেতে
যোগের এমনি লক্ষণ
অমৃত ফলের স্থান
জানত যদি দরিদ্র মন
অশুসার কিছুই রইত না।।
পূর্ণিমার যোগাযোগ হলে
শুকনা নদী উজান চলে
ত্রিবেণীর পিছল ঘাটে
নিঃশব্দে বন্যা ছোটে
চাঁদ-চকোরে ভাটার চোটে
বাঁধ ভেঙ্গে যায় তত্ক্ষণা।।
নিচের চাঁদ রাহুতে ঘেরা
গগন চাঁদ কি পাব ধরা
দখল হয় রে অমাবস্যে
তখন চন্দ্র রয় কোন দেশে
লালন ফকির হারায় দিশে
চোখ থাকতে হয়ে কানা।।"
১০। যাদুঘরের ভেতরে.....
"খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।।
আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা
তার উপরে সদর কোঠা
আয়না-মহল তায়।।
কপালে মোর নইলে কি আর
পাখিটির এমন ব্যবহার
খাঁচা খুলে পাখী আমার
কোন বনে পালায়।।
মন, তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর তৈরী কাঁচা বাঁশে
কোনদিন খাঁচা পড়বে খসে
লালন কেঁদে কয়।।
লালন কয় খাঁচা খুলে
সে পাখী কোনখানে পালায়।।"
১১। লালনের মূরাল.....
"সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে।।
কেউ মালায় কেউ তসবি গলায়,
তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়।
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়,
জাতের চিহ্ন রয় কার রে।।
যদি ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান,
নারীর তবে কি হয় বিধান?
বামন চিনি পৈতা প্রমাণ,
বামনী চিনি কিসে রে।।
জগত্ বেড়ে জেতের কথা,
লোকে গৌরব করে যথা তথা।
লালন সে জেতের ফাতা
ঘুচিয়াছে সাধ বাজারে।।"
১২। লালনের ভাস্কর্য.....
"জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সব দেখি তা না না না।
যখন তুমি ভবে এলে
তখন তুমি কী জাত ছিলে
যাবার বেলায় কী জাত নিলে
এ-কথাটি বলো না।
ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল চামার-মুচি
একই জলে সব হয় শুচি
দেখে শুনে হয় না রুচি
যমে তো কাউকে ছাড়বে না।
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়
লালন বলে জাত কারে কয়
এই ভ্রমও তো গেল না।"
১৩। লালন মঞ্চ.....
"আঠারো মোকামে একটি রূপের বাতি জ্বলছে সদাই।
নাহি তেল তার নাহি তুলা আজগুবি হয়েছে উদয়।।
মোকামের মধ্যে মোকাম
শূন্য শিখর বলি যার নাম
বাতির লুন্ঠন সেথায় সুদন
ত্রিভুবনে কিরণ দেয়।।
দিবানিশি আট প্রহরে
এক রূপে চার রূপ ধরে
বর্ত থাকতে দেখলি নারে
ঘুরি মলি বেদের বিধায়।।
যে জানে সে বাতির খবর
ছুটেছে তার নয়নের ঘোর
সিরাজ সাঁই কয়, লালন রে তোর
দৃষ্ট হয় না মনের দ্বিধায়।।"
উইকিপিডিয়ায় - লালন
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১:৫৭